সম্মানিত অতিথি আসবেন আমাদের ইস্কুলে। খুশির সীমা নেই। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নানান আয়োজনে। অতিথি কেমন অনুষ্ঠান পছন্দ করেন আর কী কী খেতে পছন্দ করেন ইত্যাদি বিবেচনা করে আমরা কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছি ক’দিন ধরে। নিরলস ভাবে রিহার্সেল করে যাচ্ছি পুরোদমে। আমরা সবাই ব্যস্ত আর ব্যস্ত।
ইস্কুল ধোয়া-মোছার কাজ চলছে সমানে। মাঠের সবুজ ঘাসগুলো মেসিন দিয়ে ছাঁট দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। বাগানের ফুল, অর্কিড ও পাতাবাহার গাছগুলো চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে। ভবনের যেখানে রং পলিশ করা দরকার সেখানে তা করা হয়েছে। তারপর আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছি কোথাও কোনো ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা বা ময়লা পড়ে আছে কিনা। পেলেই তা তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে দ্রুত ফেলে দিচ্ছি। হেডস্যার থেকে শুরু করে দপ্তরি পর্যন্ত কারো নিস্তার নেই। সবাই আছে ছোটাছুটির মধ্যে।
দুই.
আমরা ইস্ত্রি করা ইউনিফরম পরে খুব পরিচ্ছন্ন ভাবে ইস্কুলে এসেছি। সকলের মুখে হাসি। বেলা সাড়ে দশটায় অতিথি আসবেন। আমরা সাড়ে ন’টা থেকে রাস্তার দুই ধারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ইস্কুল গেট থেকে মেইন রোডমুখী রাস্তার দিকে চলে গেছে আমাদের লাইনটি। সবাইকে সিজিল করে রাখার জন্যে সবচেয়ে রাগী দুই স্যারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের হাতের বেতের মাথা ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে থাকে।
ফুলের মালা, তোড়া আর পাঁপড়ি ভর্তি ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
বারোটা বাজে অতিথি আসার কোনো খবর নেই। আমাদের আনন্দ ফিকে আসতে শুরু করেছে।
স্যার, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, পা ব্যথা করছে।
তোমরা প্রস্তুত হয়ে থাকো। যে-কোনো সময় এসে পড়বেন অতিথি। এই ছেলে তুমি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেনো? এসব বলতে বলতে স্যার ব্যস্ত হয়ে সামনের দিকে চলে গেলেন।
একটু পর পর হঠাৎ স্যারেরা এমন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন যে এই বুঝি অতিথি এসে পড়ছেন। আমরা তখন উঁকি-ঝুকি মেরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরে আবার একটু ঢিলেডালা ভাব। আবার বেত নিয়ে স্যার আর মেডামদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। রোদের প্রচণ্ড তাপ। ঘামছি। মেয়েরা কপালে ওড়না টেনে ধরেছে। আমাদের ঢিলেমি ভাব দেখলেই স্যারেরা হুট-হাট ধমক মেরে সোজা করে ফেলেন।
স্যার কখন আসবে অতিথি?
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। একদিন একটু কষ্ট করলে কী হয়? হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে বললেন, টাইম হয়ে গেছে, অতিথি এসে পড়ল বলে।
একটু পরে এক কোণায় একটু হই চই পড়ে গেল। একজন ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে বলল, স্যার আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আমার চারপাশের সব ঘুরতেছে। স্যার কোনো কথা না বলে তাকে টেনে তুলে সোজা করে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। এখন অতিথি আসবে, মাথা ঘুরানির আর সময় পেল না। ফাজিল।
মাননীয় অতিথি চলে এসেছেন। আমরা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কেউ কেউ উঁকি মারছে অতিথিকে দেখার জন্য। পরিবেশটা গরম হয়ে উঠল।
দেখতে দেখতে অতিথি চলে এসেছেন আমাদের কাছে। অতিথির সাথে আমাদের হেডস্যার ও দুই মেডাম আছেন। হেডস্যার সামনের দিকে ঝুকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে অতিথিকে পথ দেখিয়ে হাঁটছেন। স্যার ও মেডামদের চোখে মুখে বিনয়ের হাসি।
অতিথি হাত ও মাথা নেড়ে হাসিমুখে আমাদের শুভেচ্ছা-অভিভাদন এবং ফুলের তোড়া, মালা গ্রহণ করছেন। হেডস্যার ইঙ্গিত করতেই বৃষ্টির মতো ফুলের পাঁপড়ি পড়তে লাগল অতিথির ওপর। কিছু গিয়ে পড়ছে হেডস্যার ও মেডামদের গায়েও। মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আটকে আছে ফুলের কিছু পাঁপড়ি। আকাশের তারার মতো জ্বল জ্বল করছিল পাঁপড়িগুলো।
ডালা থেকে পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিতে দিতে আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে।
অতিথির পেছনে সবাই ছুটে চলেছে। আমার সামনে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন দুইজন স্যার। তাঁরা বললেন, দেখছেন ছেলের কারবার! মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
দুই স্যার অতপর দুইজন সুঠাম ছাত্রকে ডেকে আনলেন। তারা আমাকে পাঁজাকোলা করে সোজা কলপাড়ে নিয়ে মাথায় পানি দিল। কিছু পানি কানে আর নাকে ঢুকল। হাঁচি আর কাশিতে সোজা হয়ে গেলাম আমি।
তিন.
প্রধান অতিথির বিলম্বে আগমনের কারণে আমাদের অনুষ্ঠানসূচি সব এলোমোলো হয়ে গেল। বেশি সময়ের অনুষ্ঠান কম সময়ে শেষ করতে হবে। আমাদের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে হলো। অনুষ্ঠানের কোনটা লেজ আর কোনটা মুড়ো বোঝার উপায় নেই।
ইস্কুলের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মাননীয় অতিথিকে কিছু বলার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বললাম, মাননীয় অতিথি যদি দয়া করে সময় মতো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন, তাহলে আমাদের এত বড় আনন্দ-আয়োজন এভাবে করতে হতো না। আমরা একটি সুন্দর ও আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ার জন্য বেশ কদিন ধরে পরিশ্রম করে আসছি। শুধুমাত্র সময়ের অভাবে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আমাদের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান দেখে যদি মাননীয় অতিথির মনে আনন্দ না জাগে তবে তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করে দেন।
মাননীয় অতিথি বিষয়টি খুব অনুভব করতে পেরেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে বললেন, দেরি করে আসা মোটেও ঠিক হয় নি, বিষয়টা আমার মনে থাকবে। আমি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে আর এমনটি হবে না। সবাই দিল হাততালি।
এর কদিন বাদেই জানতে পেলাম, এখন কোনো অতিথির আগমনে ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আর দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না।
কষ্টের বিনিময়ে পরিবর্তন এলে আর কোনো কষ্ট অবশিষ্ট থাকে না। আমাদের তাই হলো। কী মজা!
ছবি: নেট থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৩০