বতসোয়ানা এয়ারপোর্ট
আগেরগুলো পড়তে চাইলে-ডুমেলা বতসোয়ানা
চার আগষ্ট ২০০৬ তারিখে আমি বতসোয়ানার মাটিতে পা দিয়েছি। সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইনসের ছোট্ট এই প্লেনটি নামার আগে আকাশে যখন চক্কর দিচ্ছে মনে হচ্ছিল এই বুঝি মাটিতে আছড়ে পড়বে। বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এরকম হয়। ল্যান্ড করতে গিয়ে মুখ থুবরে পড়ে। মাঝে মাঝে প্লেন রানওয়ে থেকে ছিটকে পাশের খাদে গিয়ে পড়ে। প্লেনটি বৃত্তাকারে ঘুরে বতসোয়ানা এয়ারপোর্টে নামার আগে পুরো বতসোয়ানা দেশটাকে একঝলক দেখে নেই। আমাদের দেশের মতো সবুজের সমারোহ নেই দেশটিতে। উপর থেকে দেশটিকে দেখে কেমন যেনো ন্যাড়া মনে হলো। স্থানে স্থানে বাবলা জাতীয় গাছের ঝোপ। কালাহারি মরুভূমি এই দেশে অবস্থিত। প্লেন থেকে কালাহারি মরুভূমি দেখতে পেলাম। একটি সরু নদী চোখে পড়েছে। আক্ষরিক অর্থেই সরু। এই নদীটিই মনে হয় বতসোয়ানার সবেধন নীলমণি ওকাভাঙ্গো নদী।
বতসোয়ানা পৌঁছে প্রথমেই যেটি করলাম তা হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্ত দুঃশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা। আমি যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন সাইক্লোনের পূর্বাভাস। দেশের সভ্য অস্তিত্ব সংকটের মুখে। নতুন একটি দেশে এসেছি, এখানকার পরিবেশকে মানিয়ে নিতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা শামীমের বাসায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হয়ে পড়লাম বাঙালি কমিউনিটির খোঁজে। গ্যাবরনে হাতে গোনা অল্প ক'জন বাঙালি থাকে। বন্ধু ফজলুর কাছে আগেই তাদের নাম জেনেছি। বাংলাদেশে থাকতে সবচেয়ে বেশি যার নাম শুনেছি তিনি হলেন মোল্লা ভাই। একসময় বতসোয়ানার প্রভাবশালী বাঙালি ব্যবসায়ী ছিলেন। এদেশে এসেছেন পনের বিশ বছর হতে চলল। দু'হাতে প্রচুর কামিয়েছেন। আবার উদার হৃদয়ের কারণে দু'হাতে খরচও করেছেন। তিন চারটি মিনি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, টেক অ্যাওয়ে ছিল। এখন অনেকটা নিঃস্ব। সম্ভবত জুয়া খেলে সব খুইয়েছেন।
গ্যাবরনে মোল্লা ভাইয়ের টেক অ্যাওয়ের পেছন দিকে ফাঁকা মত একটা জায়গা। আমরা এখানে সমবেত হই। বতসোয়ানায় একজন বিশিষ্ট ফার্মাসিস্ট সুশীলদা, ডা. আরুস্তু আসেন। কিছু সময়ের জন্য এখানে একটা বাঙালি আড্ডা জমে ওঠে। সন্ধ্যার দিকে আবার শামীমের বাসা। ওখানে আরও কিছু বাঙালি এসে উপস্থিত হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ সদ্য বতসোয়ানা এসেছে। শামীম ব্যাচেলর ছেলে। তাই ওর ওখানে আড্ডাটা জমে ভালো। শামীমের ওখান থেকে পরদিন বন্ধুর সাথে চলে যাই মোলেপোলেলে নামক ভিলেজে। গ্যাবরন থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। বন্ধু ফজলুর রহমানের ভাই মুজিবুর রহমান একজন সফল ব্যবসায়ী। অনেক কষ্টে বতসোয়ানা এসে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এই ভিলেজে আরও বেশ কিছু বাঙালি আছে। এরাও সবাই ব্যবসায়ী। কেউ কেউ দেশ থেকে আত্মীয় পরিজন এনে ব্যবসাকে আরও বড় পরিসরে সাজিয়েছে। মোলেপোলেলে অবস্থানের এই ক'দিনে ঘুরে ঘুরে সব বাঙালির ব্যবসাস্থলে গিয়েছি। এরা মোটামুটি সবাই ভালো আছে।
মোলেপোলেলেতে মোটর পার্টস ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের সাথে পরিচয় হয়। ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একসময় রাজনৈতিক না কি কারণে যেন দেশান্তরী হয়। ভাগ্যান্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে বতসোয়ানা। বাঙালি বলে চিনতে কষ্ট হয় জাহাঙ্গীরকে। একসময় কালাহারি মরুভূমিতে চাকুরি করতে হয়েছিল। বছরের পর বছর মরুভূমিতে পরে থেকে ওর গায়ের রংটাও কালো হয়ে গিয়েছে। বতসোয়ানার ভাষা এবং কালচার ও এমনভাবে রপ্ত করে নিয়েছে যে এখানকার নেটিভরা তাকে বতসোয়ানার সিটিজেন ভাবে। এই দুই তিনদিনে একটা নীরস জীবনযাত্রা মনে হলো মোলেপোলেলে প্রবাসী বাঙালিদের জীবনযাপনকে। বন্ধু ফজলু সকালবেলা 'পিটসানা' নামের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসতো। আমি ওর সঙ্গী হতাম। সময় কাটানোর জন্য এদিক সেদিক ঘুরে এখানকার জীবযাত্রা দেখতাম।
এই দুই তিনদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছি। সময়গুলো কাটতে চাচ্ছে না। বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তিবোধ করছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন ফি টা বন্ধুর কাছে গচ্ছিত আছে। ব্যাংক থেকে তুলতে হবে। আরও একদিন অপেক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় একবার পৌঁছুতে পারলে আমার মতো করে সময় কাটানোর উপায় করে নিতে পারবো। এই ক'দিনে বতসোয়ানাকে যতটুকু দেখেছি দেশটিকে আমাদের চেয়েও গরীব মনে হলো। পিটসানা রেস্টুরেন্টে বসে থেকে বতসোয়ানা অধিবাসীদের জীবনযাত্রা বুঝতে চেষ্টা করেছি। একটি মজার তথ্য পেয়েছি বন্ধুর কাছ থেকে। এরা কাজ করে যে বেতন পায় তা খেয়ে দেয়ে ভোগবিলাসে পনের দিনেই শেষ করে ফেলে। তার পর বাকি মাস ধার কর্জ করে চালায়।
বন্ধুর কথার এই সত্যতা উপলব্ধি করেছি আফিসপাড়ায় মানি ল্যান্ডিং প্রতিষ্ঠানের আধিক্য দেখে। কে কত সহজে ধার দেবে তার বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখানকার অধিবাসীদের ঋণভারে জর্জরিত করে ফেলছে। আমার মনে পড়ে বাংলাদেশের কথা। মাইক্রো-ক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণের নামে আমরাও দেশের জনগণকে ধীরে ধীরে ঋণভারে জর্জরিত করে ফেলছি। গরীবরা আজ এক এনজিও থেকে ঋণ নেয়। সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় এলে আরেক এনজিওর দ্বারস্থ হয়। এভাবে সে একসময় ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। যৌতুক, আত্মহত্যার মতো অপরাধগুলো এভাবেই সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
গ্রামে গঞ্জে শহরে সর্বত্রই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কো-অপারেটিভ নামে আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এরা দৈনিক ভিত্তিতে গরীবদের কাছে থেকে জমা গ্রহণ করে। সেই টাকা আবার উচ্চ সুদে তাদেরকে ধার দেয়। কখনো কখনো এই সুদের হার ৬০%-৭০% ও ছাড়িয়ে যায়। মাঝখানে যে মুনাফা হয় তা দিয়ে পরিচালক ক' জনের পকেট ভারি হয়। মাঝে মাঝে জনগণের কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরে কেউ আবার রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। এটা দেখার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ আমাদের দেশে আছে কিনা কে জানে! বতসোয়ানায় নেই। ইন্ডিয়ানরা এই ব্যবসার সাথে জড়িত। সাথে নেটিভ কোন পার্টনার থাকে। নেটিভ পার্টনার থাকলে এই দেশে যে কোন ব্যবসা সহজে স্থাপন করা যায়।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৬