ডুমেলা বতসোয়ানা-৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আগেরগুলো পড়তে চাইলে ডুমেলা বতসোয়ানা
(এই পর্বটি একটু দীর্ঘই লিখতে হলো। কারণ বতসোয়ানা যাওয়ার আগে এই ঘটনাগুলো না বললে ভ্রমণকাহিনীটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আমি ভেবেছিলাম প্রতিদিন একটি করে পর্ব দেবো। কিন্তু নানা কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। তাই সপ্তাহে কমপক্ষে ২টি পর্ব দেবো। ডুমেলা বতসোয়ানার পাঠক ব্লগার বন্ধুদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি আপনারা আপনাদের মূল্যবান মতামত রাখবেন ধারাবাহিকটি পড়ে। ধন্যবাদ সবাইকে।)
দুবাই এয়ারপোর্টে আরব্য কেতাদূরস্ত পোশাকে আবৃত যে অফিসারটি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার কাছে গিয়ে আমি বললাম- এক্সকিউজ মি, আই এম টু লেট ফর ইমিগ্রেশন চেকিং। হিয়ার ইজ মাই পাসপোর্ট। এই বলে পাসপোর্ট এগিয়ে দেই। অফিসার হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে কাউন্টারের পেছনে নিজ আসনে গিয়ে পাসপোর্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এক মিনিট, দুই মিনিট, দশ মিনিট যাচ্ছে সে বারবার পাসপোর্টের পাতা উল্টিয়েই যাচ্ছে। আর দুর্বোধ্য ভাষায় আমাকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছে। সম্ভবত আরবিতে কিছু একটা বলছে। এই ব্যাটা কি ইংরেজি একেবারেই জানে না! আমার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে পাসপোর্ট নিয়ে সে আরেক কাউন্টারের দিকে ছুটল। সেখানে আরেকজন অফিসার বসা। ইমিগ্রেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেই মনে হলো। তারা নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করছে। দুর্বোধ্য সেই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারছি না। সামনে কোন সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি কিনা তাও বুঝতে পারছি না।
কি সমস্যা হয়েছে তা জানার জন্য আমি এগিয়ে যাই। আমাকে হাত ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে ওরা আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতেই থাকে। একসময় দেখি আমার পাসপোর্ট নিয়ে দুজনেই ভিতরের কোন কক্ষে চলে গেল। হায় হায় কি করি এখন। প্রায় পনের বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষায় আছি। কারও টিকিটির দেখা পাচ্ছি না। কি সমস্যা তাও বুঝতে পারছি না। আমার তো গলাকাটা পাসপোর্ট না যে সমস্যায় পড়তে হবে। একেবারে বাংলাদেশ সরকারের সীল ছাপ্পর মারা সরকারি পাসপোর্ট। আমি ভাবলেশহীন মুখে কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যা হয় হোক-এমন মনোভাব। প্রায় আধঘন্টা পর দু’জনে আবার দেখা দিল। সাথে তরুণ বয়সের একজন অফিসার। সে ইংরেজিতে আমাকে বলল যে তোমার পাসপোর্টে একটি বড় ত্রুটি আছে। তুমি সর্বশেষ যে গন্তব্যে যাবে সেই দেশের ভিসা পাসপোর্টে লাগানো নেই।
ভিসা! ভিসা! বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় ভিসার বিষয়টি কাজ করে। ব্যাটারা আগে বলবি তো যে ভিসার সমস্যা। আরে! বতসোয়ানা সরকার তো আমাকে কাগুজে ভিসা দিয়েছে। সেটি পাসপোর্টে কিভাবে লাগানো থাকবে! আমি ব্যাগ হাতড়ে এ ফোর সাইজের কাগজে বতসোয়ানা সরকারের দেওয়া ভিসা বের করে অফিসারের হাতে ধরিয়ে দেই। আসলে আমি ভেবেছিলাম বতসোয়ানা সরকারের দেওয়া ভিসা বোধহয় বতসোয়ানা ঢুকতে লাগবে। তাই যত্ন করে এটি আলাদা করে হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়েছি। পাসপোর্ট কিংবা টিকেটের সাথে রাখিনি। আর তাতেই যত বিপত্তি। ইমিগ্রেশন অফিসার ভিসা হাতে পেয়ে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে তারপর পাসপোর্টে সিল মেরে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বহির্গমন টার্মিনাল ধরে এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়ে আসলাম। একঝলক গরম লু হাওয়া এসে আমার শরীরে ঝাপটা মারতেই বুঝলাম আমি এখন মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই শহরে প্রবেশ করেছি। রাত প্রায় ৩ টার মতো বাজে। দুবাই শহরটিকে ঘুরে দেখতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু এটাতো সম্ভব না। আমাকে এখন মিলেনিয়াম হোটেলে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবো। কাল ১০ টায় টানা আট-দশ ঘন্টার প্লেন ভ্রমণ করতে হবে। এর জন্য শরীরটাকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন।
পরদিন সকাল ৮টার মধ্যেই ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে প্রাণ ভরে গোসল সেরে নিলাম। সবকিছু গুছিয়ে হোটেল রিসিপশনে চাবি জমা দিয়ে লবিতে রাখা সোফায় বসেছি। ইতিমধ্যেই অনেকে এসে জড়ো হয়েছে। অনেকে বুফে সিস্টেমে ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছে। সবজি, সালাদ, ফলমূলের আধিক্য। ব্রেকফাস্টের ফাঁকে ফাঁকে আমি সবার উপর নজর বুলাচ্ছি। এটা আমার একটা অভ্যাস। অনেকের দিকেই তাকাই, তবে সবাইকে নজরে রাখি না। হঠাৎ করে বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী কেউ চোখে পড়লে তার বিষয়টাই মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। চোখে পড়ার মতো কাউকে দেখছি না। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে এখান থেকে সাউথ আফ্রিকা যাবে। সিংহভাগই সাদা। কালোদের দেশে সাদাদের আধিক্য যে চোখে পড়ার মতো তা দুবাই এয়াপোর্টেই বুঝলাম। বেশ কিছু তরুণ-তরুণীও আছে। আমি এই ভিড়ের মধ্যে বাচ্চাসহ সেই জুটিটাকে খুঁজছি। নাহ্ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি তাদের গন্তব্য সাউথ আফ্রিকা নয়, অন্য কোন দেশে? ব্রেকফাস্ট সেরে অপেক্ষমান বাসে চড়ে বসেছি। বাস পূর্ণ হতেই আমাদের নিয়ে আবার এয়ারপোর্টে রওনা হয়। অ্যামিরেটস এর সুনির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে পাসপোর্ট ভিসা জমা দেই বোর্ডিং পাসের জন্য। বোর্ডিং পাস হাতে আসে। কি যেন সমস্যা হয়েছে। প্লেন এক ঘন্টা লেট করবে। প্লেন লেটের বিষয়টি অ্যানাউন্স হচ্ছে। সবার যা হাল আমারও তাই। এটা নিয়ে ভাবছি না। আমি খুঁজছি বাঙালি কোন মুখ। আমার মতো ভ্রমণে কিংবা কাজে সাউথ আফ্রিকা যাচ্ছে এরকম একটা মুখও খুঁজে পেলাম না।
ঠিক পৌনে এগারটায় আবার এনাউন্সমেন্ট। এবার প্লেনে উঠতে হবে। সবার সাথে কিউ ধরে হাঁটতে থাকি। অ্যামিরেটস এর এই ফ্লাইটে পুতুলের মতো সব এয়ার হোস্টেস। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে আমাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে গুডমর্নিং জানাচ্ছে। এই প্লেনটি প্রথমটির চেয়ে আরও বড়। ভিতরের পরিবেশটা আরও সুন্দর। নির্দিষ্ট আসনে বসে আমি পুলকিত হলাম। একেবারে জানালার পাশে আসন। দিনের আলোয় আকাশপথে ভ্রমণ উপভোগ করতে করতে যাওয়া যাবে। একসময় প্লেনটি নড়েচড়ে উঠে শ’ পাঁচেক যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়াল দেয়। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। প্লেন ক্রমাগত উঁচুতে উঠছে। দুবাই এয়ারপোর্টটা একসময় বৃত্ত থেকে বিন্দুর মতো হয়ে আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়। আমার বাম পাশের আসনে একটি অল্প বয়স্ক বালক। সিটের সাথে লাগানো কম্পিউটারে গেমস নিয়ে মেতে আছে। পাশের সিটে ভদ্রলোক সম্ভবত ওর বাবা। এয়ার হোস্টেজ ট্রলি ঠেলে নাস্তা-পানীয় নিয়ে আসতেই ভদ্রলোক দেখলাম রেড ওয়াইন চাইল।
প্লেন ছুটে চলেছে সাউথ আফ্রিকার উদ্দেশ্যে। আমার ভ্রমণপিপাসু মনটা ছুটে চলেছে সাথে সাথে। মেঘের উপর দিয়ে যখন আমরা উড়ছি উপরে নিঃসীম নীলাকাশ। কী অদ্ভূত নীল! আমরা পৃথিবী থেকে আকাশকে যে নীল দেখি তারচেয়েও শতগুণ নীল সেই মেঘের ওপাড়ের আকাশ। নিচে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু মেঘের পাহাড়। মনে হয় আমাকে কেউ এখান থেকে ছেড়ে দিলে টুপ করে মেঘের কোলে গিয়ে শুয়ে পড়বো। মেঘের উপরের আকাশটা সবসময়ই রৌদ্রোজ্জল। মাঝে মাঝে মেঘের বুক চিরেই প্লেন চলছে। জানালার শার্শিতে মেঘের কণার আস্তর পরে আমার দৃষ্টিকে ঘোলাটে করে দিচ্ছে। একটানা আট ঘন্টার জার্নি। কিছুটা একঘেয়েমীতে পেয়ে বসে। একসময় মনে হলো প্লেন কোন এক মহাসাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে দৃশ্য আরও অদ্ভূত। নিচেও নীল, উপরেও নীল। ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু নীলের রাজ্যে বিচরণ।
একসময় আট ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষ হয়। জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে বের হতেই তীব্র এক শীতের স্রোত শরীরের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। সাউদার্ন আফ্রিকা অঞ্চলে এই সময়টাতে শীত সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। বন্ধু ফজলু আমাকে মেসেজে জানিয়েছে। বতসোয়ানা যাওয়ার আগে প্রায় প্রতিদিনই ওর সাথে মোবাইলে মেসেজ বিনিময় হতো। বতসোয়ানাতে এই আগষ্ট মাসে শীতের তীব্রতায় হাত বের করে মোবাইলের বাটন টিপে মেসেজও নাকি ঠিকমতো লিখা যেতো না। এটি বন্ধুর কাছ থেকে শুনে সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছি। তারপরও এই কনকনে শীত আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিল বতসোয়ানায় কিরকম শীত পড়তে পারে।
জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যে দুঃসংবাদের মুখে পড়লাম তা হলো সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইনস যাত্রী স্বল্পতার কারণে আজ বতসোয়ানার ফ্লাইট বাতিল করে আগামীকাল সকাল সাতটায় পুনঃনির্ধারণ করেছে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। দুবাই এয়ারপোর্টে এক ঘন্টা লেট হওয়ায় এখন ফ্লাইট বাতিল। মহা ঝামেলায় পড়লাম। বিনা ব্যবস্থাপনায় বার ঘন্টা সময় আমাকে এই এয়ারপোর্টে থাকতে হবে। অ্যামিরেটস এর কাউন্টারে বসা সুবেশী তরুণীটিকে বললাম এই ট্রানজিট পিরিয়ড আমি কি করবো। সে বলল এখান থেকে বতসোয়ানা পর্যন্ত তোমার টিকেট তো সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইন্সের। সুতরাং ওরাই ভালো বলতে পারবে। আমাদের বতসোয়ানা পর্যন্ত কোন ফ্লাইট নেই। ওদের অফিসে গিয়ে খোঁজ নাও।
পাশাপাশি অনেক দেশের এয়ারলাইনস অফিস। আমি সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইনস খুঁজে এগিয়ে গেলাম। কাউন্টারে বসা এক ব্ল্যাক তরুণ। ওকে সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললাম। সব বুঝে নিয়ে সে আমাকে জানাল তার কিছুই করার নেই। আমি যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইলাম যে এটাতো আমার কোন দোষ নয়। অ্যামিরেটস এর ফ্লাইট দেরি করেছে আর তোমরাই ফ্লাইট বাতিল করেছো। সুতরাং ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। আর আশ্চর্য এই বতসোয়ানা যাওয়ার মতো এই ফ্লাইটে কোন প্যাসেঞ্জার নেই। অন্য কোন এয়ারলাইন্সের আরও একটি ফ্লাইট নাকি আসবে। সেটিতে বতসোয়ানা যাওয়ার প্যাসেঞ্জার থাকবে। এখন থাকলে দল বেঁধে এয়ারলাইনসকে ট্রানজিট হোটেলের ব্যবস্থা করার জন্য বাধ্য করা যেতো। আমার যুক্তি তর্কের কাছে হেরে গিয়ে তরুণটি 'দেখি কি করা যায়' বলে আমাকে অপেক্ষায় রেখে কোথায় যেনো চলে গেলো। অনেকক্ষণ দেখা নেই। আমি টেলিফোন বুথ থেকে নাম্বার নিয়ে মূল অফিসে কথা বলি। এই কাউন্টারে যে বসা ছিল সে কোথায় গিয়েছে জানতে চাই। অপর প্রান্ত থেকে সঠিক জবাব পাই না। প্রায় ঘন্টাখানেক দৌড়াদৌড়ি করেও কোন কূল কিনারা করতে না পেরে শেষমেষ ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আবারও জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে আরেক রাত কাটাবার মনস্থির করে ফেললাম।
প্রথমেই খুঁজে পেতে ট্রানজিট হোটেল বের করি। কাউন্টারম্যান জানায় একটা মাত্র রূম আছে। চারশ’ ডলার ভাড়া। এতগুলো টাকা নষ্ট না করে বিকল্প কোন উপায় আছে কিনা তা ভেবে দেখি। একটি দেশের এয়ারপোর্ট পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বলে আমার ধারণা। জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টটিকে ঘুরে ফিরে দেখবো বলে মনস্থির করি। প্রথমেই ঢুকি একটি ডিউটি ফ্রি শপে। কিছু কেনা কাটার নাই। এমনিতেই প্রবেশ করেছি। চোখে কোন কিছু পড়লে তখন না হয় কেনা যাবে। দুবাই এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপে ঢুঁ মেরেছিলাম। দুবাইয়ের তুলনায় জোহানেসবার্গের ডিউটি ফ্রি শপ অনেক অনুজ্জ্বল। দুবাই এয়ারপোর্টে এমন কিছু নেই যে তা দেখিনি। কসমেটিক, জুয়েলারি, প্রসাধনী, কাপড়চোপড়, খেলনা মোট কথা হেন কোন জিনিস নেই যে তা শপে নেই। আর আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো। ওখান থেকে আমি বন্ধুর জন্য দুই কার্টুন বেনসন সিগারেট কিনেছিলাম কোন প্রশ্ন ছাড়াই। কিন্তু জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে আরও দুই কার্টুন কিনতে চাইলে বলল ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের কাছে কোন কিছু বিক্রয় করা নিষেধ। অর্থাৎ সাউথ আফ্রিকাতে যারা প্রবেশ করবে শুধু তাদের জন্যই এই ডিউটি ফ্রি শপ। এখান থেকে যারা অন্য দেশে যাবে তারা এই শপ থেকে কেনাকাটা করতে পারবে না।
আচ্ছা না পারলে নাই। অযথা পয়সা খরচ করার কোন মানে হয় না। ওখান থেকে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটা পানশালা খুঁজে পেলাম। এরা বলে লিকুয়ারাম। পানশালায় কারা পান করতে প্রবেশ করে তা দেখাই উদ্দেশ্য। সেই সাথে কিছুটা সময় কাটানোও যাবে। কাচের ডোর ধাক্কা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি। প্রথমেই সিগারেটের ধূঁয়া নাকে এসে ধাক্কা মারে। কক্ষটা ধূঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হালকা রঙিন আলো কক্ষের পরিবেশটিকে রহস্যময় লাগছে। কেউ শুধু ধূমপান করতেই প্রবেশ করছে। কেউ আবার কফি খেতে কিংবা হুইস্কি, বিয়ার খেতে ঢুকছে। এখানেও বিভিন্ন বয়সের এবং চেহারার নারী পুরুষের ছড়াছড়ি। আমি বেছে বেছে এমন জায়গাটিতে বসেছি যেখান থেকে সবার উপর চোখ রাখা যায়। কিছু একটা খেতে হয় ভেবে গোটা দুই প্যাকেট চিপস এবং একটি বিয়ার নিয়ে আসলাম কাউন্টার থেকে। তারপর মৃদু চুমুক আর চিপস চিবানো। কতজন দোর ঠেলে ধূমপান করতে আসছে আবার চলে যাচ্ছে। আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত দুইটি ইরানি মেয়ে ত্রস্তপায়ে ভেতরে ঢুকে দুজনেই সিগারেট ধরাল। নাকেমুখে সিগারেট টানার ধরন দেখে মনে হলো খুব তাড়া আছে বোধহয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ধেক সিগারেট শেষ করে ছাইদানীতে ফেলে আবার ঝটিকা বের হয়ে গেল। আমিও কতোক্ষণ বসে থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম। এক জায়গায় এতক্ষণ বসে থাকা ভাল দেখায় না। সময় কাটানো এখন আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা।
বাংলাদেশ থেকে প্লেনে চড়ার পরে হিসাব অনুযায়ী ৩ আগষ্ট রাত আটটায় অর্থাৎ এখন আমার বতসোয়ানা পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু আমি জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে। খবরটি বন্ধুকে জানানো দরকার। নতুবা সে এয়ারপোর্টে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। বিশ র্যান্ড (দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা) দিয়ে একটি কার্ড কিনে বুথ থেকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। কাল সকালে এয়ারপোর্টে আসলেই চলবে জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরেফিরে কাটালাম। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। দোতালায় অবস্থিত লিকুয়ারাম বারের সোফাগুলো আরামদায়ক। ওখানে বসে সারারাত কাটিয়ে দেওয়া যায় কিনা পরিকল্পনা করে আবারও পানশালায় প্রবেশ করি। সাড়ে এগারটার দিকে দেখি বারটেন্ডাররা বিনয়ের সাথে সবাইকে উঠে যেতে বলছে। এখন বন্ধ করে দেবে। বাস্তুহারার মতো উঠে পড়তে হয়। এবার পুরো বিমানবন্দরটা চক্কর দেওয়া যাক। আমার ধারণা আমার মতো কেউ না কেউ এরকম সমস্যায় পড়েছে এবং রাত কাটাবার সুযোগ খুঁজছে। আমি চোখ-কান খোলা রেখে অলস পায়ে হাঁটতে থাকি। ধীরে ধীরে এয়ারপোর্টের ব্যস্ততা কমে আসছে। ডিউটি ফ্রি শপগুলো বন্ধের প্রস্তুতি চলছে।
দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামি। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে আমি একটি বিশাল মূর্তির সামনে পড়ি। মূর্তিটিকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু স্মরণ করতে পারছি না। বিদেশী রূপকথার কোন মূর্তি হবে। ছোটবেলায় বিদেশী রূপকথার বইয়ে অবিকল এরকম মূর্তির ছবি দেখেছি। রূপকথার গল্পটি সম্ভবত শিশুতোষ গল্প। অর্থাৎ মূর্তির এই চরিত্রটির সাথে শিশুদের খুব সখ্য। শ্বেতপাথরে নির্মিত মূর্তিটির একহাতে একটি লন্ঠন ধরা। সাদা শুভ্র দাঁড়িতে আবৃত একজন মহা মনীষী মনে হয়। মূর্তি না বলে এটিকে ভাস্কর্য বললেই মানাবে ভাল। আমি এই ভাস্কর্যটিকেই সেন্টার পয়েন্ট ধরি। অর্থাৎ এয়ারপোর্টের যেখানেই যাই না কেন এই ভাস্কর্যের সামনেই ঘুরেফিরে আসবো। কারণ এখানে বেশ ক’টি বেঞ্চ বসানো। অনেকেই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখানে বসে এয়ারপোর্টের রাতের ব্যস্ততা দেখে কিছুটা সময় কাটানো যাবে। রাত কাটাতে হলে এখানেই কাটাতে হবে।
রাত মোটে সাড়ে বারো। এয়ারপোর্টের ভিতরে তেমন একটা শীত অনুভূত হচ্ছে না। গায়ে শার্টের উপরে ব্লেজার চাপানো। হাতে ল্যাপটপের ব্যাগটাকে একটা বোঝা মনে হচ্ছে। এটা হাতে ধরে বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরেফিরে আবার ভাস্কর্যটির সামনে এসে বসেছি। দু’চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। নিষ্প্রাণ এয়ারপোর্টটি কিছুসময়ের জন্য আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ল বলে মনে হলো। সিকিউরিটি, ইমিগ্রেশন মিলে একটা ব্যস্ততা ভাব। কোন একটা প্লেন ল্যান্ড করেছে বলে মনে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মূল প্রবেশ পথ দিয়ে একদল প্যাসেঞ্জার হুড়মুড় করে প্রবেশ করল। ইমিগ্রেশনের লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। ভাস্কর্যটি লাগোয়া ডিউটি ফ্রি শপগুলো আবার কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ বিশ্রাম নিতে বেঞ্চে বসে পড়েছে। একটি তরুণী প্যারাম্বুলেটর ঠেলে ঠেলে এদিকে এগিয়ে আসছে। পেছনে দুইটি মাঝারি সাইজের চাকা লাগানো ট্রাভেল ব্যাগ ঠেলে এক তরুণ পেছন পেছন আসছে। প্যারাম্বুলেটরে বসানো বাচ্চাটিকে দেখে আমি চমকে উঠি। আরে! সেই জুটি যাদেরকে আমি দুবাই এয়ারপোর্টে দেখেছিলাম। আচ্ছা এরা কি বতসোয়ানা যাবে নাকি অন্য কোন আফ্রিকান দেশে যাবে। বতসোয়ানা গেলে আমার মতোই সারারাত বসে বসে কাটিয়ে দিতে হবে। আর যদি ট্রানজিট হোটেল বুকিং দেওয়া থাকে তাহলে হোটেলে রাত কাটাবে। অন্য কোন দেশের ফ্লাইট আছে কিনা তা দেখার জন্য আমি ফ্লাইট সিডিউল স্ক্রিনে তাকাই। জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে রাতে আর কোন ফ্লাইট নেই। একেবারে সকাল সাতটায় প্রথম ফ্লাইটটি আমাদের বতসোয়ানা নিয়ে যাবে। তারপর আরও অনেক ফ্লাইট আছে। এই জুটিটি কোন দেশে যাবে কে জানে!
দীর্ঘ ট্রাভেল শেষে জুটিটিকে কিছুটা বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। এরা এখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে মনে হয়। সাউথ আফ্রিকায় প্রবেশ করলে এতক্ষণে ইমিগ্রেশনের দিকে রওনা দিত। সাউথ আফ্রিকায় গমনকারী যারা এই ফ্লাইটে এসেছে সবাই ইমিগ্রেশন চেকিং শেষে বেরিয়ে গেছে। এয়ারপোর্টের ভিতরের এই অংশটি আবারও কিছুটা নির্জন হয়ে পড়েছে। প্যারাম্বুলেটরে বসানো বাচ্চাটি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি অলস চোখে চারিদিকে ইতিউতি তাকাচ্ছি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। এই জুটিটির উপর চোখ রাখছি। চমৎকার মানিয়েছে দু’জনকে। হলিউডের টিনেজ নায়ক নায়িকার পার্ট দিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসে দু’জনকে। আরেব্বাহ! সত্যিই কি এরা নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছে নাকি! সাউথ আফ্রিকা অঞ্চল একসময় ফরাসীদের কলোনি ছিল। এই জুটিটি ফ্রান্সের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিদেশি কালচার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। এরা রাস্তাঘাটে, অফিসে পার্কে সর্বত্র নির্লজ্জভাবে চুমু খেতে পারে। এখানে এই এয়ারপোর্টেও যে এদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বজায় রাখবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে। বিশ্রামরত আমাদের সবাইকে অবজ্ঞা করে হলিউডি নায়ক-নায়িকার ঠোঁট জোড়া পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে গেল। একেই কি ফ্রেঞ্চ কিস বলে? চোখ বন্ধ করে তারা ঠোঁটে ঠোঁটে কি সুধা পান করছে কে জানে! তবে আমার মনে হলো একটি হলিউডি সিনেমার নায়ক নায়িকার লাইভ লাভ পার্ট দেখছি।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?
দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্তান.....
শেখস্তান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন