ডুমেলা বতসোয়ানা-৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ
আগের গুলো পড়তে চাইলে ক্লিক করুন-ডুমেলা বতসোয়ানা
সদ্য দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শামীমের সেই ভাঙ্গা গাড়িতে করেই এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হলাম। হাতে আমার ল্যাপটপের ব্যাগ। আমার সাথে ছোট্ট একটা লাগেজ ছিল। ঢাকা এয়ারপোর্টেই সেটা বুকিং করে দিয়েছিলাম বতসোয়ানা পর্যন্ত। বতসোয়ানা এয়ারপোর্টে এটা আগেই চলে এসেছিল। বতসোয়ানা এয়ারপোর্টে চেকিং পয়েন্টে এসে মনে হলো ঢাকার কোন বড়সড় বাস কোম্পানির কাউন্টার। ৫/৬টি ডেস্কে ব্ল্যাক অফিসাররা বসে আছেন। এর মধ্যে দু'জন ইন্ডয়ান মিক্সড তরুণী অফিসার। সাউথ আফ্রিকা থেকে যে ১৫/১৬ জন যাত্রী বতসোয়ানা এসেছি তারা একেজন একেক কাউন্টারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। আমি খালি পড়ে থাকা একটি ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলাম। একজন অফিসারকে বহির্গমন পথটা জিজ্ঞেস করতেই কাউন্টারের থেকে একটি ফরম ধরিয়ে দিল। আমি পূরণ করে অফিসারের হাতে ধরিয়ে দিতেই একগাল হেসে পরিস্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল- তুমি কি এখানে ব্যবসা স্থাপন করতে এসেছ? আমাদের দেশে বিনিয়োগ করবে? আমি বললাম না। আমি তোমাদের দেশে এসেছি তোমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখব বলে। তোমরা বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে ৮০ ভাগে উন্নীত হয়েছ কীভাবে তা দেখাই আমার উদ্দেশ্য। ফরমে আগমনের উদ্দেশ্য- এর জায়গায় পরিস্কার লিখেছি স্টাডি ফর এডাল্ট এডুকেশন ইন ইউনিভার্সিটি অব বতসোয়ানা। তারপরও আমাকে এই প্রশ্ন করার মানে কী!
শামীম ড্রাইভ করছে। আমি ফজলু এবং আলম তিনজনে পিছনে বসা। ফজলু আমার বাল্য বন্ধু। বাল্য বন্ধু মানে একেবারে হাফপ্যান্ট ফ্রেন্ড। সেই যখন হাফপ্যান্ট পড়ে প্রাইমারি স্কুলে যেতাম সেই সময়ের বন্ধু। ২০০৫ সালে সে বতসোয়ানা গিয়েছে। ওর ছোট ভাই মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে বতসোয়ানা প্রবাসী। দুই দুইটি মিনি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক হয়েছে এতদিনে। এগুলো পরিচালনার জন্য বিশ্বস্ত লোক দরকার। তাই বড় ভাইকে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বতসোয়ানার ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই এই বন্ধুই বতসোয়ানা থেকে ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিস করে আমার ঠিকানায় ভিসা পাঠিয়েছে। এজন্য বন্ধুকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমার ভিসা প্রাপ্তির ব্যাপারে শামীম বতসোয়ানা ইমিগ্রেশনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। এগুলো আমি বাংলাদেশ থাকতে ফজলুর সাথে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে জানতে পারি। বতসোয়ানা যাওয়ার আগে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের মোবাইল মেসেজ বিনিময় হতো। আর আলমও আমার পূর্বপরিচিত এবং আমাদের এলাকারই ছেলে। ও ওখানে চাকরির সন্ধানে গিয়েছে। আলম আমার প্রায় এক মাস আগে পৌঁছেছে। কথায় কথায় শামীমের সাথে পরিচিত হলাম। চব্বিশ পঁচিশ বছরের তরুণ। ঢাকায় বড় হয়েছে। যাত্রাবাড়িতে নিজেদের বাড়ি আছে। জীবিকার তাগিদে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বতসোয়ানা এসেছে আজ প্রায় ৩ বৎসর। কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ওর আন্তরিকতায় খুব মুগ্ধ হলাম। পরে বিস্তারিত আলাপ হবে ভেবে আর কথা বাড়াইনি। আমি ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে এপর্যন্ত আসতে কোন ঝামেলা হয়েছে কিনা তা জানতে চায় সবাই।
ঝামেলা হয়নি আবার! ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সেই যে ঝামেলার শুরু সেটা ৫ মাস পর বাংলাদেশে ফিরে আসা পর্যন্ত সাথে সাথে ছিল। তবে ঝামেলা হলেও আমি ছিলাম একেবারে নির্বিকার। যা হয় হোক একটা মনোভাব নিয়ে প্লেনে চড়ে বসেছিলাম। আমার ভাবনা ছিল আমি পথে নেমে পড়ি, পথ আমাকে যেখানে নিয়ে যায় যাক। যেখানেই ঝামেলা পাকিয়েছে আমি ভাবলেশহীনভাবে তার মুখোমুখি হয়েছি। ফেরার পথে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমিগ্রেশনের গাফিলতির কারণে ফ্লাইট পর্যন্ত মিস করতে হয়েছে। আসার পথে সিডিউলে কোন ট্রানজিট ছিল না। ফ্লাইট মিস করাতে প্রায় দেড় দিন এয়ারপোর্টেই কাটাতে হয়েছিল। সে আরেক মজার মজার সব অভিজ্ঞতার কাহিনী। এটি পরে বলব। তার আগে বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাওয়ার সময়ের ঝামেলার শুরুটা শেষ করে নেই।
ঝামেলার শুরুটা জিয়া বিমানবন্দর থেকে। বতসোয়ানা ভার্সিটিতে রিপোর্ট করার শেষ সময় ৫ আগষ্ট। সেই অনুযায়ী ২ আগষ্ট তারিখের টিকেট কনফার্ম করি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তখনও আমার ছুটি অনুমোদন করাতে পারিনি। সরকারি চাকরি। ছুটি অনুমোদন না করিয়ে গেলে পরে ঝামেলা হতে পারে। ২ আগষ্ট অফিসের শেষ সময়ে প্লেনের টিকেট দেখিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সবার সাথে সাক্ষাৎ করে ছুটি মঞ্জুর করালাম। অফিস আদেশের চিঠিটা হাতে নিয়েই বাসার উদ্দেশে দে ছুট। ওদিকে আমার লাগেজ প্রস্তুত থাকার কথা। আমি শুধু ল্যাপটপের ব্যাগটা হাতে নিয়েই রওনা দেবো। হাতে তিনঘন্টা সময় আছে। অফিসের গাড়ি আগেরদিন রিকুইজিশন দিয়ে রেখেছি। অফিসের গাড়ি নিয়েই এয়ারপোর্ট যাবো। প্রথমে যাবো বেইলি রোডে আমার বাসায়। ওখান থেকে এয়ারপোর্ট। আমার বন্ধু এবং সহকর্মী এনামুল হক বাড়ি থেকে খাবার বয়ে নিয়ে এসেছে। দু’মুঠো নাকে মুখে গুঁজে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে বেরুতে ১ ঘন্টা পার। আর হাতে আছে দুই ঘন্টা।
এখান থেকেই আমার দুর্ভোগের শুরু। ঢাকার যানজট ঠেলে আমি যখন এয়ারপোর্ট পৌঁছি হাতে মাত্র পঁচিশ মিনিট। লাগেজ ওজন করানো, বোর্ডিং পাস নেওয়া ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে ফাইনাল কল। আমি টেনশনে দরদর করে ঘামছি। গেটের প্রবেশ মুখে বাধা। দায়িত্বরত অফিসার বোর্ডিং পাস চাচ্ছে। আমি হাতে ধরা পাসপোর্ট এবং এর ভিতরে ভিসা, টিকেট, সরকারি অনুমতিপত্র সহ যাবতীয় কাগজ এগিয়ে দিলাম। দায়িত্বরত অফিসার বোর্ডিং পাস খুঁজছেন।
আরে! বোর্ডিং পাস নেই। বোর্ডিং পাস হচ্ছে প্লেনের আসন নিশ্চিত ব্যবস্থা। তাহলে কি প্রথম আমি যেখানে পাসপোর্ট, ভিসা জমা দিয়েছিলাম ঐ অফিসার বোর্ডিং পাস ফেরত দেন নি। এত তাড়াহুড়োর উত্তেজনায় ঠিকমত দেখিও নি। গেটে আটকা পড়ে অসহায় হয়ে গেলাম। বোর্ডিং পাস ছাড়া তো আমাকে কোনক্রমেই ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এখন উপায়! সময় বয়ে যাচ্ছে। আমার মাথা কাজ করছে না। পাশেই দেখছি শ্রম দিতে মধ্যপ্রাচ্য গমনকারী একদল কিশোর-যুবককে লাইন ধরিয়ে রাখা হয়েছে। ওদের পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে। অথবা কোন কারণে অযথা হয়রানি করছে। আমার মনে কোন অনুভূতি কাজ করছে না। ভাবলেশহীনভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। টার্মিনাল লাউঞ্জের প্রবেশমুখে যে কাউন্টারটি আছে সেখানেই পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। ওখানে বেশ ক’জন অফিসার ছিল। শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় সবাই নিজ নিজ কাজে এমন মগ্ন যে কে আমার পাসপোর্ট নিয়েছিল তাকে চিনতে পারছি না। তারপরও আমি কাউন্টারে যেয়ে সবার উদ্দেশে আমার বোর্ডিং পাস সমস্যার কথা বললাম।
এক অফিসার বোর্ডিং পাসটা এগিয়ে দিলেন। তারপর কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে টার্মিনাল লাউঞ্জে দাঁড়ানো ডিউটি অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমাকে কোন ঝামেলা ছাড়াই ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য। আমি অফিসারের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। এয়ারপোর্টের হয়রানি সম্পর্কে অনেক ভীতি ছিল মনে। কিন্তু আমার কাছে অন্যরকম মনে হলো। এমনও হতে পারে আমার যাত্রার সরকারি অনুমতি দেখে কেউ ঝামেলা পাকায়নি। আমি সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে প্লেনে উঠলাম।
অ্যামিরেটস্ এর সুবিশাল প্লেন। এয়ার হোস্টেজ এবং স্টুয়ার্টরা শুভ সন্ধ্যা জানিয়ে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা এত অনিশ্চয়তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত প্লেনে যখন উঠতে পেরেছি এটিই একসময় আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। আমার আসনটি পড়েছে একেবারে জানালার ধারে। আমার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। জীবনে প্রথম প্লেন ভ্রমণ। দিনের বেলায় হলে সবকিছু দেখতে দেখতে যাওয়া যেতো। আজকাল মহাকাশচারীরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিভ্রমণে বের হচ্ছেন আর আমি উপর থেকে আমাদের পৃথিবীটা কেমন দেখায় তা দেখতে পাবো না। জানালার পাশে আসন না পড়লে মনকে বুঝ দিতে পারতাম।
অ্যামিরেটস এর এই সুবিশাল প্লেনটি মধ্যপ্রাচ্যগামী বাঙালি যাত্রীতে ঠাসা। আমার আসনে বসার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে সবাইকে একনজর দেখে নিলাম। ইকোনমি এই ক্লাশটিতে মধ্যপ্রাচ্যগামী বাঙালি সহযাত্রীদের পেয়ে আমার মনে হলো আমি দেশের ভেতরেই কোথাও যাচ্ছি। প্লেনের ভিতর যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি আমার এই সহযাত্রীরা কোথায় যাচ্ছে। অধিকাংশকেই মনে হলো মধ্যপ্রাচ্যগামী। অন্য কোন দেশেও যেতে পারে। কারণ দুবাই এয়ারপোর্ট হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশের ট্রানজিট পয়েন্ট। তবে অধিকাংশই যে মধ্যপ্রাচ্যগামী তা তাদের কথায় এবং আচরণে বুঝা যাচ্ছে। কেউ কেউ স্বপরিবারে যাচ্ছে। আমার পাশের আসন দু'টোতে বসা দু'জনের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম দুইজনই দীর্ঘদিন ধরে আবুধাবি আছেন। প্রায় চার মাসের মত দেশে ছুটি কাটিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন। তারা পরষ্পরের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করায় বুঝলাম পূর্ব পরিচিত। আমার সাথে আর কথা বেশিদূর এগুলো না। আমি অন্যদিকে মনোনিবেশ করলাম।
সবাই যার যার আসনে স্থির হয়ে বসেছে। জানালার পাশে বসে মন খারাপ করে অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছি। একসময় ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন এবং কম্পন টের পেলাম। ইঞ্জিন চালু হয়ে রানওয়েতে ছুটতে শুরু করলো প্লেন। আগেই সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। স্পষ্ট টের পাচ্ছি আস্তে আস্তে গতি বাড়ছে। হালকা শীশের মতো শব্দ করে বাতাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে অ্যামিরেটস এর সুবিশাল এই প্লেনটি। হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেন আকাশে উড়াল দিল। আস্তে আস্তে উপরে উঠছে প্লেনটি। নিচে আলোকসজ্জিত এয়ারপোর্ট। একসময় পুরো ঢাকাকে মনে হলো আলোকসজ্জিত একটি জনপদ। রাতের অন্ধকারে নিচে আলোকসজ্জিত ঢাকা শহরটাকে খুব দ্রুত অতিক্রম করে প্লেন অন্ধকারে ছুটে চলেছে। কম্পিউটারের স্ক্রীনে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি এখন কত ফিট উঁচুতে আছি। বিমানবালারা নাস্তার ট্রলি ঠেলে ঠেলে যাত্রীদের আসনে আসনে যাচ্ছে এবং চাহিদামাফিক নাস্তা সরবরাহ করছে। আমার প্রচন্ড পানির পিপাসা ধরেছে। ঠান্ডা সফট ড্রিংক নিলাম। বিয়ার নিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পাশে বসা মধ্যপ্রাচ্যগামী মুরুব্বীর কাছে বেয়াদবি মনে হয় কিনা ভেবে নেইনি।
একঘেঁয়ে জার্নি। দিন হলে চারিদিক দেখে শুনে সময় কাটানো যেতো। রাতের বেলা কিছু দেখা যাচ্ছে না। এত ক্লান্তিতে ঘুমও আসছে না। আমার আসনের সাথে লাগানো কম্পিউটারে গান শুনে, গেমস খেলে সময় কাটাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে অন্ধকারের বুক চিরে কোন দেশের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি বোঝার চেষ্টা করি। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে ওঠা লেখাগুলো পড়ি। একঘন্টা দুইঘন্টা করে সময় পার হচ্ছে। মাঝখানে একবার এয়ার হোস্টেজ এসে ডিনার সার্ভ করল। প্লেনের ভিতরের লাইট যখন সব নিভিয়ে দেওয়া হলো আমি চোখ বন্ধ করে বাইরের দৃশ্য অনুভব করার চেষ্টা করছি। এখন কোথায় আছি তা ভাবার চেষ্টা করছি। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে কত ফুট উচ্চতায় এবং কোন স্থানে আছি। মনের চোখ দিয়ে তা দেখার চেষ্টা করছি। অবশ্য ঢাকা থেকে দুবাই যাওয়ার পথে উপর থেকে পৃথিবীর দৃশ্য দেখতে না পেলেও এই দুঃখ আমার মিটেছিল দুবাই থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা গমনের সময় দীর্ঘ আট ঘন্টা যাত্রা পথে। দীর্ঘ ৫ মাস শেষে ঢাকা আসা পর্যন্ত সবখানেই আমার আসন পড়েছিল একেবারে জানালার পাশে। এমনকি সবক'টি ভ্রমণ ছিল দিনের বেলায়। সে এক বিচিত্র অনুভূতি। আমার প্রথম দীর্ঘ বিমানভ্রমণ বলেই হয়তো আমার এমন অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব বিধাতার সৃষ্টির অপূর্ব কারুকাজ যতই উপরে যাওয়া যাবে ততই অনুধাবন করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস জন্মেছে।
স্থানীয় সময় রাত দু'টোয় গিয়ে প্লেন দুবাই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল। দুবাইয়ে প্রায় ৭ ঘন্টার ট্রানজিট। এই সময়টা কাটানোর জন্য টিকেট এজেন্সী কর্তৃক দুবাইয়ে মিলেনিয়াম নামে একটি হোটেল বুক করা আছে। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্টের বাইরে বের হলেই নির্দিষ্ট গাড়িতে করে নিয়ে যাবে। সুতরাং নো টেনশন। প্লেন থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই চমৎকার চমৎকার বাস এসে আমাদের একে একে মূল টার্মিনালে নিয়ে গেল। কি করতে হবে আমি ভাবছি না। জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে দুবাই এয়ারপোর্টের ভিতরে প্রবেশ করলাম।
ওরে বাব্বা! হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেকগুলো প্লেন এসাথে মনে হয় ল্যান্ড করেছে। দুবাই এয়ারপোর্ট বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। সুতরাং এত মানুষ তো হবেই। বিচিত্র ধরনের মানুষগুলো। কারও গায়ের রং ধবধবে সাদা। কারও গায়ের রং তামাটে। কেউ আবার কুচকুচে কালো। আমি বতসোয়ানা কালোদের দেশে যাচ্ছি। সুতরাং কালোদের প্রতি আমার একটা বিশেষ নজর পড়তে লাগলো। আমি একেজন কালোকে দেখে ভাবি আচ্ছা সে আফ্রিকা মহাদেশের ঠিক কোন দেশের নাগরিক? কোন দেশ থেকে এসেছে? কোন দেশেই বা যাবে? এটি আমার ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই কৌতুহল মিটাতে এই ব্যস্ত সময়ে কারও সাথে কথা বলার মানে হয় না।
সারা বিশ্ব থেকে সবাই এসে এখানে জড়ো হয়েছে। এখান থেকে আবার সারা বিশ্বে যে যার কাজে ছড়িয়ে পড়বে। বিচিত্র পোষাকধারী বিভিন্ন রঙের মানুষ দেখতে দেখতে আমি এগুতে থাকি। আমাদের প্লেনে আসা বাঙালিরা যে কোন জনস্রোতে হারিয়ে গেছে কে জানে। এতক্ষণে আমার মনে হলো আমার আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে। অর্থাৎ এখানে সবাই আন্তর্জাতিকভাবে বিদেশী নাগরিক। কোন সমস্যায় পড়লে কেউ সাহায্য করার নেই। যা করার আমাকেই করতে হবে। জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে বিশাল বিশাল কয়েকটি লাউঞ্জ পার হয়ে একসময় আমি দেখি অনেক লোক এক জায়গায় কিউ ধরছে। আমি কোন নির্দেশনামা আছে কিনা দেখছি। বুঝলাম মূল টার্মিনালে প্রবেশের আগে এখানে চেকিং হবে। সুতরাং আমিও কিউ ধরলাম। আমার হাতে ল্যাপটপ। আমার সামনে যারা আছে তাদের অনেককে বেল্ট জুতো পর্যন্ত খুলতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেককে সিকিউরিটি রূমের একপাশে নিয়ে পুরো শরীর হাতিয়ে দেখছে। আমি মোবাইল, জুতো, বেল্ট, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ সবকিছু সিকিউরিটি ট্রেতে রেখে গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম।
চলবে...
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?
দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্তান.....
শেখস্তান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন