আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে জৈব জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে খাদ্য সঙ্কট দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর এর ভয়াবহতা আমাদের জন্য এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার বিশেষ করে কৃষির আধুনিকায়ন এবং সময় ও সম্ভাবনাকে ধারণ করে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব।
মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ক্ষুদ্র দেশটিতে প্রায় ১৬ কোটি লোকের বসবাস। যা কি না সমগ্র বিশ্বে বিরল। অধিকন্তু আমরা আমাদের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও উর্বর ভূমিটুকুর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। বলতে গেলে আমাদের কৃষিতে এখনো সেকেলে চাষ পদ্ধতিই রয়ে গেছে। কৃষিতে আধুনিকায়ন করা গেলে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো যেত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারলে দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেও রফতানি করা সম্ভব।
দেশের মোট জনশক্তির ৬২ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত।
২০০৬-০৭ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১.৩৭ শতাংশ। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ২৮৯.৪২ লাখ মেট্রিক টন। আর সরকারি ও বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় ২৪.২০ লাখ মেট্রিক টন।
২০০৭-০৮ অর্থবছরের খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩৬.৩২ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২.২৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে।
[সূত্র : অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৮]
এ ছাড়া সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল সিন্ডিকেট। সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক ফসল। অথচ দেশে উৎপাদিত আলু, কলা, আনারস, পেঁপে প্রভৃতি অসংখ্য পণ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে নতুন নতুন উপাদেয় তৈরি করে নিজেদের পুষ্টির সরবরাহের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যেত।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শুধু পশুসম্পদ খাতে যে পরিমাণ উৎপাদন সম্ভব বর্তমানে তার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ অনুrপাদিত থেকে যাচ্ছে।
জার্মানির একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেশটি এত বেশি উর্বর যে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে লাঙ্গল লাগে না, আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে কদুর (লাউয়ের) বীজ বপন করলে দুই দিন পর লতা, কয়েক দিন পরে পাতা এর পর কদু (লাউ) জন্মায়। অথচ দেশটির লোকেরা অশিক্ষিত ও অলস। তারা চিংড়ি মাছ দিয়ে মজা করে লাউ খায় আর গান ধরে 'স্বাদের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।
একজন জাপানি বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ছিল বাংলাদেশটাকে আমাদের হাতে দেয়া হলে আমরা বিশ্বকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দ্বিতীয় জাপান উপহার দিতাম।
যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ভারত, চীন, জাপান, ডব্লিউবি, আইএমএফ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার আমাদের এই দেশটির দিকে নজর দেয়ার কারণ হিসেবে অনেকে শুধু দেশটির তেল-গ্যাস-বন্দর প্রভৃতি সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের কথা বলে থাকলেও এর সাথে জড়িত রয়েছে অনেক বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ। কারণ দেশটি আয়তনে বিশ্বের ৩ হাজার ভাগের মাত্র ১ ভাগ হলেও এর লোকসংখ্যা ৪০ ভাগের ১ ভাগ। যা কি না বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ২০-৪০ গুণ বড়, অনেক দেশেই তা অনুপস্থিত। আর এই বিশাল ভোক্তার জনসংখ্যার কারণে এই দেশটি একটি বিশাল বাজার। এই ১৮ কোটি লোকের বাজার দখল বিশ্বমোড়লদের অতিরিক্ত নজরের একটি অন্যতম কারণ। কেননা অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিজেদের অর্থনীতিকে উৎপাদনমুখীর পরিবর্তে ভোগমুখী করে তোলা হয়েছে দৃশ্যমান এসব দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পরামর্শে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, তৃতীয় বিশ্বের এই জনবহুল উন্নয়নশীল দেশটির রাজধানী শহরকে এখন বিশ্বের সিটি অব শপিংমল বললে অত্যুক্তি হবে না।
দেশের অর্থনীতির দিকে তাকান, দেখতে পাবেন আমাদের ভোগকৃত অধিকাংশ পণ্যসামগ্রীই শুধু নয়, চিন্তা-চেতনা তথা সংস্কৃতিও হয় ওই সব মোড়ল দেশের বহুজাতিক কোম্পানি বা চ্যানেল থেকে আমদানি করা। যেখানে আমাদের নিজস্ব যোগান নামমাত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আরো ৮০ শতাংশ খাঁটি দুধ উৎপাদন সম্ভব অথচ শিশুখাদ্যের জন্য বিদেশীদের ভেজাল দুধেই আমরা অধিক সন্তষ্ট। এখন প্রশ্ন আসতে পারে দেশের বাজেটে ও বাঘা বাঘা অর্থনীতবিদ ও সংস্থাগুলোর গবেষণায় আমাদের প্রবৃদ্ধি তো বাড়ছেই। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে আমার কাছে যেটা মনে হয়, দেশের অর্থনীতি কর্মকাণ্ড যেখানে বাস্তবতার আলোকে অনেক বেশি উৎপাদনমুখী হওয়ার কথা ছিল সেখানে তা কেবলই ফটকা কারবারি ও প্রতারণার ফাঁদে বন্দী। এখানে যেটা হচ্ছে তা হলো ১০ টাকাকে ২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি সত্যিকার অর্থে খুবই নগণ্য।
বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্যের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধিকে আপাত আমাদের মতো কৃষিনির্ভর জনবহুল দেশের জন্য অধিক বিপদসংকুল মনে হলেও এটাকে আমরা বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারি। কারণ বাংলাদেশের কৃষিতে যে অযুত সম্ভাবনা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেও বিশ্ববাজারে রফতানি করা সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, আমরা কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনার খুব কমই বর্তমানে উৎপাদন করছি। এর মূল কারণ কৃষিকে আমরা এখনো আধুনিক করতে পারিনি। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও হীনমন্যতার কারণে কৃষিতে এখন প্রায় শতভাগ কৃষক ও খামারীই অশিক্ষিত।
শিক্ষা ব্যতিরেকে কৃষির আধুনিকায়ন বলতে গেলে অসম্ভব। আমাদের বিপুল জনশক্তির একটি বিশাল অংশকে যেমন যোগ্য ও দক্ষ করে বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি দেশের হাজারো শিক্ষিত যুবকদের যদি কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা যায় তাহলে একদিকে যেমন অপরাধ কর্মকাণ্ড হ্রাস পাবে অন্য দিকে দেশের কৃষিতে একটি বিপ্লব সাধিত হবে।
যদিও সরকারের যুব উন্নয়ন, কৃষি, মৎস্য বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা সদরে সহযোগিতার ব্যবস্থা রেখেছেন এবং দেশী-বিদেশী সব ব্যাংকের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কৃষি ঋণ দেয়া বাধ্যতামূলক করেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কাক্সিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর অনেক নেতিবাচক বিষয়গুলোর প্রচার-প্রসার আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটুকু যতটা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায় তাদের ভালো দিকগুলোর ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রে বা জাপানে একজন কৃষক বা খামারীও অশিক্ষিত চোখে পড়বে না অথচ আমাদের দেশের একজন উচ্চশিক্ষিত তো দূরের কথা সামান্য শিক্ষিত লোকের কাছেও কৃষক পরিচয় দেয়াটা জাতকুল চলে যাওয়ার মতো বিষয়। উচ্চশিক্ষিতদের (তাদের) চোখে কোনো মোবাইল কোম্পানির অফিসে করণিক বা রিসিপশনিস্টের কাজটাকে অধিক আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।