রিতিমতো একটি পিলে চমকানোর মতো ঘটনা বটে! সিম ক্লোন করে একই নাম্বার অন্য কেও ব্যবহার করতে পারে। পেয়ে যেতে পারে ওই মোবাইল ফোনে সংরক্ষিত সব তথ্য, নাম্বার ও এসএমএস। তাই অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা মিসড কল ব্যাক না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এতদিন মেষ সাবক বা গরুর ক্লোন হওয়ার কথা আমরা শুনেছি কিন্তু এবার শোনা যাচ্ছে, সিম ক্লোন করে একই নাম্বার অন্য কেও ব্যবহার করতে পারে। পেয়ে যেতে পারে ওই মোবাইল ফোনে সংরক্ষিত সব তথ্য, নাম্বার ও এসএমএস। তাই অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা মিসড কল ব্যাক না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান একটি জনপ্রিয় মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য ড়্গেত্রে টুকটাক সমস্যা বোধ করলেও মোবাইল ফোন থেকে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয় কখনই খেয়াল করেননি। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাৎ তার ফোন থেকে ৪২ টাকার ব্যালেন্স ফুরিয়ে যায়। আগে দু-একবার এমন হলেও তিনি বিষয়টি পাত্তা দেননি। ফোন অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করা হলে মাসুদ সাহেবকে জানানো হয়, তার ফোন থেকে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মাসুদ সাহেব জানান, তিনি কথা বলেননি। তার ডায়াল নাম্বারেও কারো নাম্বার নেই। পুরো ঘটনাটির কোনো কূলকিনারা বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। পরে এক আইসিটি ও টেলিকম বিশেষজ্ঞ বন্ধুর কাছ থেকে বুঝতে পারেন পুরো বিষয়টি। এই খবরটি প্রকাশিত হয় দৈনিক ভোরের কাগজে।
সাম্প্রতিক ওয়েবসাইট হ্যাক করার ঘটনা প্রচুর ঘটলেও মোবাইল ফোনের সিম হ্যাক করার ঘটনা একেবারেই নতুন। মূলত এক শ্রেণীর অপরাধী এ ঘটনা ঘটাচ্ছে। অনেকে আবার মজার ছলেও এ ঘটনা ঘটাচ্ছে। মোবাইল ফোনের একই নাম্বার ও তথ্যাদি ব্যবহার করে নকল কোনো ইউজার ওই সিমটির সুবিধা নিলে বিষয়টিকে বলা হচ্ছে ক্লোনিং। উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ক্লোন’ হলো কোনো জীব বা কোষ বা বৃহৎ জৈব অণুর হুবহু নকল। ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডের গবেষক ড. আয়ান উইলমুট প্রথমে একটি ভেড়ার ক্লোনিং করেন।
কিন্তু মোবাইল ফোনের সিম ক্লোনিং করার ঘটনা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন একটি বিষয়। বাংলাদেশের আইটি, টেলিকম ও আইসিটি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি মোটামুটি জানলেও মোবাইল সিম ক্লোনিং ঘটনা খুব একটা বেশি নয় বলে মনে করেন। মোবাইল ফোন অপারেটররাও জানিয়েছেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে সত্যি সত্যিই মোবাইল ফোন সিম ক্লোনিংয়ের মতো ঘটনা যদি বেশি মাত্রায় ঘটে- সেক্ষেত্রে ভয়াবহ ধরনের ভার্চ্যুয়াল অপরাধ ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
মোবাইল ফোন হ্যাকিং বা ক্লোনিংয়ের বিষয়ে গত শনিবার ৮ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা ডয়চেভেলে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সিম ক্লোন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, জঙ্গিসহ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ক্লোন করা সিম ব্যবহার করতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসিডিবি) মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, তারা এই ক্লোন সিম সম্পর্কে সচেতন আছেন। ক্লোন সিম ব্যবহার করে নানা অপরাধমূলক কাজ করা সম্ভব। তাই এ ব্যাপারে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে বিটিআরসি এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান ডিসিডিবি মনিরুল।
তবে মোবাইল ফোন অপারেটররা দাবি করছেন, তারা এখনো এরকম কোনো অভিযোগ পাননি। বাংলাদেশে ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটরের এখন গ্রাহক সংখ্যা ৯ কোটি ৩০ লাখ। মোবাইল ফোনের গ্রাহক দিন দিন বাড়ার পাশাপাশি সচেতনতার অভাবে ঝুঁকিও বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন ডয়চেভেলেকে বলেন, পরিমাণে কম হলেও বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সিম ক্লোন করা হচ্ছে। সচেতন না হলে তা আরো বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রচারণার অভাবে গ্রাহকরা ক্লোন করা সিম সম্পর্কে তেমন সচেতন নন। মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া অথবা একই ফোন নম্বর দুজন ব্যবহার করলে বুঝতে হবে সিম ক্লোন হয়েছে। আর এখন মূল সিম ছাড়াই কম্পিউটারের মাধ্যমে মিসড কল দিয়ে সিম ক্লোন করা সম্ভব। কোনো গ্রাহক যদি অপরিচিত ফোন থেকে পাওয়া মিসড কলে কল ব্যাক করেন তাহলে তার সিম ক্লোন হয়ে যেতে পারে বলে জানান জাকারিয়া স্বপন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোনের সিমের সঙ্গে ফোন সেটটিও ক্লোন হতে পারে। আর সেট ক্লোন হলে মেমোরিতে থাকা সব তথ্য চলে যেতে পারে অন্যের হাতে। তাই অপরিচিত মোবাইল ফোন থেকে আসা মিসড কলের জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য মোবাইল ফোন গ্রাহকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ইন্টারনেটে পরিচয় বগুড়ার ওয়েবসাইট এক প্রোগ্রামারের। ‘ম’ আদ্যক্ষরের ওই গ্রোগ্রামার মূলত হ্যাকার হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি বিশেষ কৌশলে তার ইন্টারনেট চালান পুরোপুরি ফ্রি। যে মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করেন সেটি থেকেও তিনি কথা বলেন অফুরন্ত। বিনিময়ে তাকে দিতে হয় না কোনো বিল! এ বিষয়ে ওই হ্যাকার বলেন, এটি হয়তো অসততা। কিন্তু ফ্রি কোনো কিছু করার সুযোগ থাকলে আমি কেন টাকা ব্যয় করবো। এটি কিভাবে করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব বলা যাবে না। তবে আমাদের দেশের আইসিটি ও টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয় না। এছাড়া তারাও অনেক ক্ষেত্রে ‘দু-নম্বরি’ করে। আমি তারই সুযোগ নিচ্ছি মাত্র।
কিভাবে সিম ক্লোন হয়
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে সিম ক্লোনিংয়ের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো মাস দুয়েক আগে এ বিষয়ে জানায়, দেশটিতে এক লাখেরও বেশি মোবাইল ফোন গ্রাহক সিম ক্লোনিংয়ের শিকার হয়েছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, খুব সহজ উপায়ে ক্লোনিং হয় বলেই এর শিকারে পরিণত হয়েছেন তারা। যে নম্বরগুলো থেকে ফোন আসে, সেগুলোর শুরুতে +৯২, #৯০ অথবা #০৯ এই তিন ধরনের কোড থাকে। মোবাইলের গ্রাহক যদি ফোন ধরে ফেলেন, তাহলে অপর প্রান্ত থেকে কল সেন্টারের কর্মী সেজে কথা বলে জালিয়াতরা। সংযোগ নির্বিঘ্ন আছে কিনা, তা পরীক্ষা করতে গ্রাহককে তার মোবাইলে #০৯ বা #৯০ চাপতে বলা হয়। এই নম্বরগুলো চাপার পর যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, সেই নম্বরে উল্টো কল যায় এবং সিম ক্লোন হয়ে যায়। কল ধরতে না পেরে গ্রাহক যদি পরে মিসড কলের ওই নম্বরে কলব্যাক করেন, তাহলেও একই পদ্ধতিতে সিম ক্লোন হয়।
সিম ক্লোন হওয়ার কারণে গ্রাহক বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে পারেন। জালিয়াতরা মূল ব্যবহারকারীর সিম, মেমোরি কার্ড বা ডেটা কার্ডে সংরক্ষিত তথ্যগুলো হাতিয়ে নেয়। সিমের নম্বর ব্যবহার করে তারা অন্য যে কোনো নম্বরে ফোন করতে পারে। যে কোনো ব্যক্তিকে হুমকি বা সন্ত্রাসমূলক ফোনের কাজে নম্বরটি ব্যবহার করতে পারে। আর্থিক বিপর্যয়, সামাজিক সম্মানহানি বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে পারেন তারা। ভারতে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি বিএসএনএলসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি ভুয়া এসব কলের ব্যাপারে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়েছে। ফোনে এটিএম বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড বা অন্য যে কোনো ধরনের পাসওয়ার্ড সেভ না করার পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
আপনার করণীয় বিষয়গুলো..
ক্লোনিংয়ের বিষয়ে পরামর্শ হিসেবে জনপ্রিয় ব্লগ ‘আমার ব্লগে’ অরীত্র আহমেদ নামে একজন ব্লগার এ বিষয়ে বলেন, আপনার ব্যালেন্স নিয়মিত চেক করুন। অহেতুক কোনো কারণে ব্যালেন্স কমে গেলে কাস্টমার কেয়ারে খোঁজ নিন। তারা যদি বলে আপনি কোনো কল বা এসএমএস করেছেন, তাহলে ধরে নিন আপনার সিম ক্লোন করা হয়েছে। যদি কোনো নম্বর থেকে মিসড কল আসে, অপরিচিত নম্বর, তাহলে ব্যাক করবেন না। কারো যদি কথা বলার দরকার থাকে, নিজেই ফোন দেবে। কথা বলার সময় খেয়াল করুন কোনো ধরনের ডিজিটাল টোন পাচ্ছেন কিনা। যদি ওগঝও শর বা ডাটা (এনক্রিপশন কি) ব্যবহার করে আপনার সিম ক্লোন করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক ধরনের টোন পাওয়া যায়। অনেক সময় মাইকের সাউন্ড সেটিংসে সমস্যা হলে একটা চিঁ চিঁ শব্দ হয়। অনেকটা সে রকম। তিনি বলেন, সিম অফ করে কল দিন সিমে। যদি বন্ধ আসে, তার মানে ক্লোনিং হচ্ছে না। তবে তার মানে এই নয় যে ক্লোন হয়নি। ক্লোন যারা করেছে, তারা যে ধরনের সিস্টেম ব্যবহার করে, তাতে চাইলে কোনো সিম ইচ্ছে করলে অফ করেই রাখতে পারে। তাই মাঝে সাঝেই এই কাজটা করে দেখুন। সতর্ক হলে আপনি ক্লোনের বিষয়টি ধরেও ফেলতে পারেন। আর একবার ধরতে পারলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সিম কোম্পানিকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।