সাইনসের ল্যাব পার্টনাররা ছেলে হলে বেশ সুবিধা হয়। একটু স্টেরিওটাইপ করা হয়ে গেলেও, সাধারন সত্য হিসেবে যা দেখেছি তাই বলছি--ছেলেরা যান্ত্রিক নৈপূণতার সাথে কাজ করতে পারে মেয়েদের চেয়ে ভাল। বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে মাইক্রোএরের ছোট ছোট ঘরগুলোতে কেসিন সল্যুশন ভরাট করতে গিয়ে নতুন করে টের পেলাম। আমার করা ঘরগুলো ভুলে ভরা। ভুল করে কম দিয়ে ফেলেছি, ভিতরে বাতাস ছিল খেয়াল করি নি। কিংবা একই ঘরে দুইবার বিশুদ্ধ পানি ঢেলেছি। ডেভিডের ঘরগুলো অদ্ভূত নিপূণ।
আমার বায়োকেমিস্ট্রির ল্যাব পার্টনার ডেভিড। বেছে নেয়ার স্বাধীনতা ছিল না, যার সাথে যাকে দেয়া হয়েছে। বেশ ভদ্র এবং চমৎকার ছেলে। পুরো সেমিস্টারে সপ্তাহে টানা তিন ঘন্টা এক সাথে কাজ করতে হবে, স্বস্তি পেলাম। সেটা শেষ মেষ। ওর সাথে পরিচয়ের শুরুতে হল অস্বস্তিকর কান্ডটা। 'আমি ডেভিড' বলে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি অনাত্মীয় পুরুষদের সাথে হ্যান্ডশেইক করি না। এখানে গোঁড়া বলা হোক আর যাই বলা হোক, এটা আমার স্বনির্ধারিত সীমারেখা, যাকে আমি ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসেবে দেখি। সমস্যা হলো, আমি খুব ভাল করেই জানি এই হ্যান্ডশেইকে কোন পাপচিন্তা নেই। নেহায়েত ভদ্রতা। আমি খুবই বিনয়ের সাথে 'না' করার চেষ্টা করি এবং পরে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করি মনে যেন একটুও খারাপ লাগা না থাকে। কিন্তু, যেভাবেই 'না' করি না কেন, যাকে 'না' করা হবে, তাকে অপমানিত বোধ না করার জন্য খুবই ভাল হতে হবে, খুবই 'বুঝদার' হতে হয়। প্রতিবার 'না' বলি আর মনে মনে প্রার্থনা করি, আল্লাহ, ব্যাটা যেন আর যাই হোক, অপমানিত যেন না হয়, প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ। ঔচিত্য অনৈচিত্যবোধ আর ভালো লাগা খারাপ লাগার প্রাত্যহিক গোলযোগের একটা সামান্য উদাহরণ মাত্র।
মনে পড়ে গেল হাইস্কুলের টিচার মিস্টার এন্ডিকটের কথা। আমার ম্যাথস স্যার ছিলেন। ম্যাথসে ফার্স্ট হওয়ায় আমার চেয়ে বেশি খুশি হলেন স্যার। ইয়া লম্বা লাল মুখো স্যার খুশিতে আরও লাল হয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, 'কনগ্র্যাচুলেশনস ইয়াং লেডি'। 'না' করতে কষ্ট হল সত্যিই। কিন্তু করলাম। আমাকে খুবই স্বস্তি দিয়ে স্যার পুরা ব্যাপারটা মজা হিসেবে নিলেন। এরপরে, হাইস্কুলের পুরা দুই বছর আমাকে জ্বালিয়ে মারলেন। করিডোরে বা যেখানেই হোক, দেখা হলেই 'গুড মর্নিং' বলে হাত বাড়িয়ে দিতেন। তারপরে বিমর্ষ হওয়ার ভাব করে বলতেন, 'ওহ তুমি তো এখন আমাকে রিজেক্ট করবে।' বলেই আকাশ ফাটানো সে কি হাসি!
দিনগুলো এখন বেশ যাচ্ছে। আজ বাসা থেকে বের হলাম সেই সকাল আটটায়। বাসায় ফিরলাম রাত নয়টায়। সারাদিনে মাঝে এক ঘন্টার ব্রেইক ছিল কেবল। বাকি সময় ক্লাস আর ক্লাস। আমার একটা মজার ব্যাপার হলো, আমি খুব 'শান্তি' এবং 'স্বস্তিতে' থাকি, যদি ফাঁকিবাজি কম করি! যা 'করার কথা' তা ঠিক ঠাক মত মন লাগিয়ে করি। এখন সকাল ছয়টায় দিন শুরু হচ্ছে আর রাত বারোটায় রাত। অনেক দেঁৗড়, অনেক হাঁটা, কিছু বিশ্রাম, একটা এসএমএসের বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া, গভীর রাতে 'শ্রাবন মেঘের দিনে' পড়ে হাপুশ নয়নে কাঁদা... সব মিলিয়ে সত্যিই বেশ যাচ্ছে দিনগুলো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০