পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ হয়ে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা বিলাসিতা? তাহলে তো, যেই নারীরা আসলে অধিকার পায়, তাদেরও নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা বিলাসিতা। তাই মানে মানে চুপ করে ছিলাম।
আমার জীবনে দেখা প্রথম নারী, আমার মা। আমি বরাবর মুগ্ধ হই মাকে দেখে। আরও হব।
মেয়েটার শৈশব কেটেছে গাছে গাছে। হাডুডু খেলে। নদীতে সাঁতার কেটে। 'গাইছ্যা বান্দর' উপাধি পেয়ে। এসএসসিতে পুরো জেলা হাইস্কুলের ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। অনার্সে উঠতেই বাবার সাথে বিয়ে। মায়ের মোটেও ইচ্ছা ছিল না বিয়ে করার, কিন্তু ফ্যামিলির সবার কথা ছিল, মেয়েরা অনার্স পাশ করে ফেললে লোকে ভাবে বেশি বয়স হয়ে গিয়েছে, তাই আর কেউ বিয়ে করতে চায় না! বেছে নেয়ার স্বাধীনতা ছিল না বলেই উনিশে বিয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেশির ভাগ মেয়ে কম বয়সে বিয়ের পরে বলে অতো কম বয়সে বিয়ে করা উচিত হয় নি। আমার মা বলে, উনিশে বিয়ে করেছি বলেই জীবনটাকে এত উপভোগ করতে পেরেছি, সবার উচিত উনিশে বিয়ে করা!
অথচ, প্রথম জীবন কষ্টে কেটেছে। মায়েদের বাড়িতে বড়লোকী না থাকলেও অন্তত: খাবার খাওয়া যেত পেট ভরে। ঢাকা ইউনির লেকচারার বাবার পকেটে তখন খুবই সীমিত আয়। দিনের পর দিন কেটে যায় এক রুমের ঘরে, শুধু ভাত আর আলু ভর্তা খেয়ে। মাসের শেষে তবু লোনের বোঝা। অসুস্থ দাদু গ্রাম থেকে এসে থাকে নব বিবাহিত বাবা মায়ের ওই এক রুমের ঘরে। ওই সময়টার কথা বলতে গিয়ে বাবার চোখে এখনও পানি টলটল করে। উনিশ বছরের কিশোরী মা প্রচন্ড ভালবাসায়, প্রচন্ড বুঝদার হয়ে সংসারের হাল না ধরলে আজ এখানে থাকতাম না হয়তো। সেদিন নানু শুনছিল সব, বাইশ বছর আগের কষ্টের কথাগুলো এত দিন কিচ্ছু জানত না, যা এখন অনেক দূরের অতীত। বিয়ের এক বছরের মাথায় ভাইয়া, আড়াই বছরের মাথায় আমি!
'নারী অধিকারের' ধূয়া তখন। মা 'না' হওয়ার অধিকার মায়েদের হাতে। কিন্তু এটাই যে অনেকের জন্য কাল হয়! হ্যা, অর্থনৈতিক ভাবে হয়তো ঠিক বুদ্ধিমতীর কাজ ছিল না, কিন্তু একটা বিশ বছরের মেয়ে মা হওয়ার পরে আত্মীয় স্বজন সবাই যেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করছিল, 'এত তাড়াহুড়ার কি ছিল' বলে , মেয়েটার আনন্দে আনন্দিত না হয়ে, সাহস যা দরকার তার একটুও না দিয়ে, মমতার হাত না বাড়িয়ে, ব্যাপারটার কষ্টবোধ মাকে ছেড়ে এখনও যায় নি। তবু আমার সাহসী মা সেই সময়টাকে উপভোগ করেছে বুঝা যায়। ইংল্যান্ডে, স্বজনদের থেকে অনেক দূরে মা তখনও কাজ করে দু'টো বাড়তি পয়সার জন্য। কাঁধে আমাকে ঝুলিয়ে, প্র্যামে ভাইয়াকে ঠেলে। তবু, এখন অ্যালবাম ভর্তি সেই সময়ের ছবি। মা নাকি তখন পুতুল খেলার মজা পেত আমাদের পালতে। আমাদের প্রতিটা মুখভঙ্গি নাকি ভাল লাগত, ক্যামেরায় ধরে রাখতে ইচ্ছা করত। এখন যখন মা শুনে কেউ সন্তান নিতে দেরি করছে, তখন কষে ঝাড়ি লাগায়। 'এই সুন্দর সময়টা কি বসে থাকবে?'
তো, উনিশে বিয়ে, বাইশে দুই সন্তানের মায়ের ভাগ্যে আর কি থাকতে পারত? সারাজীবন রান্নাঘরে হাঁড়ি ঠেলা, স্বামীর পদসেবা, সন্তান প্রতিপালন আর বিনোদন হিসেবে পরচর্চা করা ছাড়া?
মা তিন সন্তানের মা হয়েও থেমে থাকে নি। মনে আছে, মীরা যখন একদম পিচ্চি, তখন মা ইকোনমিক্সে অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে। আমরা আরেকটু বড় হওয়ার পরে, একটা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ফুল টাইম চাকরীর পাশাপাশি আমাদের সামনেই মা একে একে বিএড, এমএড করলো। অথচ অবহেলিত হই নি একদম। আমাদের জীবনে বাবার চেয়েও বেশি করে পেয়েছি মাকে। সেই সময়টায়, যদি বাবাকে পাশে না পেত, তাহলে মায়ের পক্ষে কখনই পড়াশোনা করা সম্ভব হতো না। চাকরীর চাপে পড়াশোনা ঠিক মত করতে না পেরে পরীক্ষার আগের দিন যখন মা খুব নার্ভাস, তখন বাবা পাশে বসে সাহস দিত। পড়া বুঝিয়ে দিত। রাগ জাগত মায়ের সাথে। কাজের মেয়ের লবন বেশি দেয়া পুঁড়ে ফেলা ভর্তা ভাজি খেয়ে ফেলত সোনা মুখ করে। সবাইকে অবাক করে আমার সুপার উইমেন মা বিএড এমএড দুইটাতেই ফার্স্ট ক্লাস পেল! অস্ট্রেলিয়ায় এসেও অবলীলায় পড়াশোনা করে স্কুল টিচার হয়ে গেল। সেই কঠিন সময়ও বাবা থেকেছে একদম পাশে।
বাবার দিকের সংসারের অনেকটুকু অর্থনৈতিক দায়িত্ব বাবার। সীমিত আয়ে বরাবর টানাটানিতে বড় হয়েছি। ছোট বেলা বুঝতাম না, এখন বুঝি: প্রতি মাসের শেষেই ঋন বোঝা হয়ে থাকত। ক্লাসের সবাই দেখতাম পকেট মানি পায়, পাঁচ টাকা দশ টাকা যাই হোক। আমি লাঞ্চে আটা রুটিও নিয়ে গিয়েছি অনেক, তবু কখনও পকেট মানি পাই নি! তখন বুঝি নি, এখন বুঝি, কি শক্তভাবে সংসারের হাল ধরে ছিল মা বরাবর, এখনও আছে।
শুনেছি যেই নারীরা ক্যারিয়ার সচেতন হয়, তারা রাঁধতে জানে না, সন্তানদের সময় দিতে জানে না, ভালবাসতে জানে না, 'নারী' হতে জানে না। ক্যামনে বিশ্বাস করি বলুন, মাকে দেখেছি যে! এই বিদেশ বিভঁূইয়ের যান্ত্রিক জীবনেও প্রান আছে মায়ের জন্যই... মায়ের বদৌলতে এখনও প্রতিদিন শাক খাই, শিম-লাউ-বেগুন খাই। মায়ের হাতের রান্না যে একবার খেয়েছে, সে বার বার খেতে চাইবে!
সকাল আটটায় বের হয়ে গিয়ে, সারাদিন বাচ্চাদের আর স্কুলের কলিগদের সাথে চিল্লাচিলি্লর পরেও কি করে মা বাসায় এসে রান্না করে আমার জানা নেই। বাবা একেবারেই রাঁধতে জানে না, কিন্তু সাহায্য করে পুরাদমে। মাছ কুটে দেয়া, বা পেঁয়াজ কেটে দেয়া। দুই বুড়াবুড়ি টুকটুক গল্প করতে করতে রান্না ঘরে কাজ করে, ভালোই লাগে দেখতে! বা সব শেষে হাড়িকুড়ি মেজে ফেলে বাবা! অনেক বাবাদের দেখেছি আলাদা বাটিতে আলাদা তরকারি পেলে বর্তে যাই। বাবাকে রাগ করতে দেখেছি 'আলাদা' কিছু দিলে!
আমাদের পরিবারের কাছাকাছি এসেই মানুষ হিংসায় জ্বলে পুড়ে। কারণ এখনও আমরা সবাই বাসায় একসাথে থাকলে খাবার টেবিলে বসে একসাথে খাই। একদম ছোটবেলা থেকে এই নিয়মের ব্যাতিক্রম দেখি নি। খেতে খেতে হাত শুকিয়ে গেলে তবে উঠি। যখনই সময় পেতাম, ঢাকায় আমরা সন্ধ্যার পরে বের হতাম ফুলার রোডে ফুচকা খেতে। এখানে উইকেন্ডগুলো প্রায়শ:ই বাইরে যাই এক সাথে। পুরো ব্যাপারটার অরগেনাইজিং কমিটির চেয়ারম্যান মা।
প্রতিদিন সকালে সবার লাঞ্চ রেডি করা থেকে ঝাড়ি দিয়ে নাস্তা করানো, বাইরে বের হওয়ার সময় তালা দিয়ে যাওয়ার কথা দশবার মনে করিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে খাটের মাথায় কাপড়ের স্তুপ ঠিক করে রাখার জন্য ঝাড়া ঝাড়ি... সব ওই মহিলার কাজ।
প্রচন্ড 'সামাজিক' মহিলা। দেশ থেকে আসার সময়ও দেখেছি কত মানুষ মায়ের হাত ধরে কাঁদছে। আত্মীয়তার কিচ্ছু নেই অমন মানুষগুলো। ঢাকায় ফিরে গিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো মা। বহু আগের কোন এক ছাত্রের মা যখন শুনে মা দেশে ফিরেছে, তখন ছুটে এসে দেখা করে। এখানেও কি করে সবাইকে হিপনোটাইজড করে ফেলেছে, 'ভাবী' বলতে অজ্ঞান। যেখানে যে অসুস্থ আছে বা বাসা বদলাচ্ছে, তার জন্যই মা হাজির টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি ভাত তরকারি নিয়ে। দাদুবাড়ি নানুবাড়ি দুই গ্রামেরই সব সমস্যাগ্রস্ত মানুষেরা মাকে চিনে। এখনও চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেয় সিডনীর নাম করে, কারণ জানে, এই এক মহিলা কখনও ফিরিয়ে দিবে না।
মিনা কার্টুনের রেলেভেনস বুঝতাম না ছোট বেলায়, কারণ, আলহামদুলিল্লাহ, আমার মা বাবার মধ্যে একজনের জন্য আরেকজনের শ্রদ্ধাবোধের কমতি দেখি নি কখনও। ভাইয়া আর আমার পড়াশোনার মধ্যে যে কোন তফাৎ আছে, তাও মনে হয় নি কখনও।
বাবা বলে, বাবার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার মা।
সব পুরুষেরা আমার বাবার মত না, আমি জানি। সব নারীরা আমার মায়ের মত না, আমি জানি। বড় ভাগ্যবতী আমি, আমার বাবার মত পুরুষের ঔরসে হয়ে, মায়ের মত নারীর গর্ভে জন্মে। ওঁদের মহত্বের একটু খানি পেলেই আমি বর্তে যাই। নারী দিবসে একজন প্রকৃত পুরুষ--আমার বাবার প্রতি সালাম। একজন প্রকৃত নারী--আমার মায়ের প্রতি সালাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৭ ভোর ৫:০০