অনেক দিন ধরে ব্লগ করা হচ্ছে না। ব্লগের প্রথম পাতা খুলেই কিছু লেখার সবটুকু ইচ্ছা দুম করে উধাও হয়ে যায়। মনে হয়, ইন্টার্যাক্টিভ ব্লগের সবগুলো ভাল দিক ভুল প্রমানিত করার জন্য আমরা সম্মিলিত ভাবে উঠে পড়ে লেগেছি। আগে যেটা কখনও ভাবি নি, এখন একটা লেখা দেয়ার আগে তাই ভাবি-- প্রতিক্রিয়া কি হবে! ভালো 'শিক্ষা' পেয়েছি মনে হয়। সে যাই হোক, আজ কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে, তাই ভাবলাম নির্দোষ রোজনামচা মার্কা লেখা নামাই।
সকালটা শুরু হয়েছে বিচ্ছিরি ভাবে। মেজাজ খারাপ হলে আমি চিল্লাচিলি্ল করি না। হয়, যার উপর মেজাজ খারাপ তাকে কঠিন কঠিন কথা বার্তা এক নি:শ্বাসে শুনিয়ে রাগ ঝেড়ে ফেলি। পরে যদি মনে হয় খুব অনুচিত কিছু বলেছি, তাইলে স্যরি হওয়া যায়, কিন্তু সেটা তো পরের ব্যাপার। আর না হয় একদম চুপ মেরে যাই। নিজের ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি। ট্রেনে উঠে শেষ স্টেশন পর্যন্ত বসে থাকি চুপচাপ। মানুষ দেখি, ফুল দেখি, পাখি দেখি, মনে মনে গুণ গুণ গান গাই। আমার জীবন থেকে হুট করে বের হয়ে যাই স্কেজু্যল টেজু্যল সব পানিতে ফেলে। যত গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস, কাজই থাকুক না কেন, ক্ষনস্থায়ী উলটা দৌড় দেই। অনেক ঝামেলায় পড়েছি এর জন্য কিন্তু চরম মন খারাপের সময় আমার আসলেই মাথা ঠিক থাকে না।
আজ মনে হল সারাদিন ঘরে বসে গান শুনি। তারপরেই মনে হলো, ধুর, আমাকে সারা জীবনই একা থাকতে হবে। কেউ বুঝবে না। এক্সপেক্টশন কমাতে হবে, নিজেতে, নিজের প্রিয় মানুষদের উপর বিশ্বাস, নির্ভরতা কমাতে হবে, কমাতে হবে। স্কেজু্যল ঠিক রাখতে হবে... সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
সিদ্ধান্ত নেয়ার ছয় মিনিটের মাথায় রেডি হয়ে আমি রাস্তায়। ঘন্টা দু'য়েক পরে ইউনি পেঁৗছে লজে। জাকারিয়া ম্যাথুজ, আমার প্রিয় মুখটা তখন কথা শুরু করে দিয়েছে। আমার আট মিনিট দেরি হয়েছে।
আমি জাকারিয়া ম্যাথুজের চরম ভক্ত। সাউথ আফ্রিকান পাবলিক। দেখতে সাদা, চুল বাদামী। কিন্তু সাউথ আফ্রিকায় নাকি এই মানুষগুলোকেও 'কালারড' বলা হতো, গায়ে ইন্দোনেশিয়ান রক্ত আছে বলে। 'কালারড' বলে ইউনিতে ঢুকতে সংগ্রাম করতে হয়েছে, প্রচন্ড ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র থাকা সত্ত্বেও। সমাজের প্রকাশ্য রেসিজমের মুখে সংগ্রাম করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন একে একে। ফার্মেসী পড়ে আমেরিকায় স্কলারশিপ নিয়ে গিয়ে পিএইচডি করলেন। ফায়জা ম্যাথুজ, জাকারিয়া ম্যাথুজের স্ত্রীকেও প্রচন্ড শ্রদ্ধা করি আমি। তাঁর জীবনের ঘটনাগুলোও একই ধরণের। ইউনিভার্সিটির মেডেল জেতা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী।
জাকারিয়া ম্যাথুজ এসেছেন এবারের মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের ইউনি শুরু করার সাথে সাথে কিছু কথা বলতে। নিজে অবাঞ্চিত থেকে, সবগুলো স্পটলাইট গায়ে নিয়ে উঠে এসেছেন, তাই জানেন আমাদের সময়টা কত কঠিন।
মুগ্ধ হয়ে শুনলাম এক ঘন্টার সাউথ আফ্রিকান মিষ্টি একসেন্টের সুন্দর কথাগুলো। চরম ভালো লাগা কথাগুলো সবই আমার নিজের কথাগুলো গুছিয়ে বলা। এই বিনয়ী মানুষটার মুখ থেকে শুনতে যত ভালো লাগছিল, আমি নিশ্চিত আমার মুখ থেকে শুনতে তত ভালো লাগবে না। পড়াশোনা ঠিক রাখার জন্য অরগ্যানাইজড থাকা, রুটিন মত চলা, শারিরীক পরিশ্রম করা, ইত্যাদি ইত্যাদি বলার পাশাপাশি বলে দিলেন নিজেদের সাথে কিছু মৌলিক বোঝাপড়া করার কথা, কারণ সত্যিই হাই স্কুল থেকে অনেক ভিন্ন তো ইউনি লাইফ এভাবেই--সিদ্ধান্তগুলো নিজের নিতে হয়। নিজেকে চিনা তাই খুবই জরুরি।
নিজের পরিচয়ের সবটুকুই আমরা বংশ সূত্রে নিয়ে আসি না। মুসলিম হওয়া তার একটা। জাকারিয়া ম্যাথুজের বলেন, তুমি যদি মুসলিম পরিবারের জন্মে থাকো, কখনও ভেবে না থাকো, তুমি কেন মুসলিম, তাহলে ভাবো। নিজের সাথে একান্তে বসে ভাবো। নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, তুমি নিজেকে কেন মুসলিম ডাকো? পৃথিবীতে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, এই মুসলিমদের ঘিরেই... এত ঝামেলার মুখে পড়েও তুমি নিজেকে কেন মুসলিম ডাকো? তুমি নিশ্চিত তুমি মুসলিম থাকতে চাও? তুমি যা চাও ইসলাম তোমাকে তা দিবে? হ্যা বা না খুঁজে বের করো, শক্ত সিদ্ধান্ত নাও, ব্যাস। Find out you identity. Figure out what you want to be and be comfortable with it. Because you are going to be exposed and challenged.
ঠিক এই প্রশ্নগুলো নিজেকে করেছি আগে। অনেকবার। নিজের পরিচয় নিয়ে আমি স্বস্তি পাই, আমি জানি আমি কি হতে চাই। ভালো লাগল, কারণ এই কথাগুলো এতটা শক্ত করে আমাকে কেউ বলে নি। মুসলিম হওয়া যে আসলে নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপার, আমাদের মুসলিম সমাজে বড় হয়ে ঠিক এই ভাবে ভাবা যায় না। সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগটা কেউ দেয় না।
আর একটা কথা বলেছিলেন, যেটা আমার একদম দিলকে বাত! অমুসলিমদের সাথে কথা বলার সময়, কখনই, কখনই ওদের ধর্মের যেই দিকগুলো আমাদের খারাপ লাগে, সেগুলো নিয়ে কথা না বলা। আমার ধর্ম যদি শ্রেষ্ঠ ধর্ম হয়, তাহলে এমন অনেক সুন্দর জিনিস থাকার কথা, যেগুলো নিয়ে কথা বলে কূল পাওয়া যাবে না। অন্যের ধর্ম নিয়ে টানাটানির সময় পাওয়া যাবে কই? বাইবেলের কতটুকু অংশ বানানো, অসম্ভব অর্থহীন আলোচনার একটা, যেটা প্রচুর মুসলিমকে আমিও করতে দেখি। দু:খজনক, ব্লগেও দেখি, কিছু মানুষ পড়েই থাকে অন্য মতালম্বীর খারাপ জিনিসগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো প্রচারের জন্য। করুণা হয়, বলার মত নিজের কিছু নাই?
এত ভাল ছাত্র ছিলেন জাকারিয়া ম্যাথুজ, শরমই লাগে। লোভ হয় গোপনে, এত বিনয়ী হওয়ার লোভ। গুছানো ভাবনার লোভ।
ভারি কথাগুলোর পরে পিজ্জা ভক্ষন। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি। ওজু করতে গিয়ে মিভেতের সোনালী চুল দেখে আমি মুগ্ধ। ওর সবুজ চোখ আর সোনালী চুলের প্রশংসা করতেই ও ঠোঁট উলটে বলে, দেখো না, কালারড পিগমেন্টের অভাবে আমার চোখ আর চুলের রং ওমন। আমাকে তো আল্লাহ কম কম দিছে, তোমাকে তো মেলোনিন সহ সব বেশি বেশি দিছে, বেশি পেয়ে আবার এত দু:খ করার কি আছে? কথা ঠিক!
মাসাল্লায় ফিরে দেখি দোহার চারপাশে আসর বসেছে। এই মেয়েটা একটা ওয়ান পিস আইটেম। লেবানিজ। সারাক্ষণ ছুটাছুটি লাফালাফি করছে আর অনবরত মুখ ছুটছে। ওর কান্ড কারখানা কথা বার্তা হা করে দেখার মত। কাজ করে ধুপ ধাপ দ্রুততার সাথে। ইউনিতে আসার এক বছরের মাথায় ইউনিরই একটা লেবানিজ ছেলেকে বিয়ে করেছে। তিন বছরের মাথায় এক সন্তানের জননী! ও যখন সাত আট মাসের প্রেগন্যান্ট, তখনও দেখি ওর লাফালাফি একটুও কমে নি, মুখও বন্ধ হয় না একটুও। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম--এই বুঝি কিছু হয়ে যায়! ও মুখ বিমর্ষ করে বলে, মুহাম্মদ (ওর বর) খালি মোটা হচ্ছে। পরক্ষণই মুখে হাসি... এতে অবশ্য ওকে টেডি বিয়ার টেডি বিয়ার লাগে! আসর জমিয়ে বলছে ওর বরের সাথে প্রথম পরিচয়ের ঘটনা। মুহাম্মদ কাঁপতে কাঁপতে যেভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে সেই ঘটনা শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ।
রিমা লেবানন থেকে এসেছে মাত্র। ফ্যাটমির ভ্রু নাচানো প্রশ্ন: কি বিয়ে করোনি যে? (লেবানীজ মেয়েগুলো বিবাহযোগ্য বয়সে দেশে গেলেই বিয়ে করে আসে।) রিমার গোমরা মুখো উত্তর--আরে নাহ। ওখানে ছেলেরা সব মেয়েদের জুতা পড়ে আর ইয়া বড় গোঁফ রাখে। আর.. সবার আগে জিজ্ঞাসা করে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক কি না!
আনিসাকে কিছুক্ষণ খোঁচানো হলো কারণ ও সোমালিয়া থেকে, অথচ সোমালিয়ান ভাষায় 'ম' নেই। রংপুরের লোকজন যেমন অংপুর বলে, সোমালিয়ানরা নিজেদের তেমন সোয়ালিয়ান ডাকে। ও কিন্তু আমার চেয়ে ভালো হিন্দী জানে!!!
ঘন্টা দু'য়েক আড্ডা শেষে যখন ইউনিভার্সিটি ওয়াক দিয়ে হেঁটে লাইব্রেরিতে যাচ্ছি, তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা নেই। মাথা উঁচু করে বৃষ্টিতে সমর্পন... নো পলায়ন মনোবৃত্তি। মন বেশ ভালো।
দিনটা শেষ হলো বায়োকেমিস্ট্রি লেকচার দিয়ে। সেমিস্টার শুরুর প্রথম দিন একটা সার্ভেতে অংশগ্রহন করতে হয়েছে। প্রশ্নগুলো এমন-- বায়োকেমিস্ট্রির পাশাপাশি কি কি সাবজেক্ট করা হচ্ছে, বায়োকেমিস্ট্রি বলতে কি বুঝায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কি ধরণের ছাত্র ছাত্রী আছে তার ব্যাপারে হালকা ধারণা নেয়ার জন্য। একটা প্রশ্ন ছিল, বায়োকেমিস্ট্রি কোর্স থেকে কি পেতে চাও? আমার সোজা সাপ্টা সৎ উত্তর ছিল: 'ডিস্টিংশন'। অতি বোদ্ধারা আতেলীয় উত্তর দিয়েছে-- 'বায়োকেমিস্ট্রির জ্ঞান'।
ড: ব্রাউন একটা উত্তরই ঘটা করে পড়ে শুনালেন--'চিকস। মাইয়্যা মানুষ।'
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০