'মানিক, এ্যাই মানিক, তারাতারি কর বাবা দেরী হয়ে যাচ্ছে' ডাক দিলেন আব্দুল হক সাহেব। তার অনেক আদরের ছেলে মোজাফফর হোসেন মানিক। ছোটবেলায় অনেক শখ করে নাম রেখেছিলেন 'মানিক'। অনেক স্বপ্ন দেখেছেন তাকে নিয়ে। ছেলে অনেক বড় হবে, দেশজ়োড়া খ্যাতি হবে। দেশের সবচেয়ে ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়বে। জ়ীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে সফল হবে। সমাজের দশজন তাকে দেখে বলবে ‘ওই দ্যাখ মানিকের বাবা যাচ্ছে।‘
ছেলের কোন ইচ্ছা বা শখ অপুর্ন রাখেননি তিনি, ছেলেও তাকে নিরাশ করেনি। ভাল স্কুলে ভর্তি করেছেন, ছেলে ভাল রেজাল্ট করে দেখিয়েছে। এস.এস.সি, এইচ.এস.সি তে ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করেছে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে হয়েও কখনো খারাপ কোন কিছুর সাথে জড়ায়নি। নম্র, ভদ্র সর্বোপরি ভাল ছেলে হিসেবে সবাই তার সুনাম করে। তার বুকটা গর্বে ফুলে যায়। তবে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন ছিল যখন মানিক দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। ছেলেকে প্রান ভরে দোয়া করলেন। ছেলেও সুখের সাগরে গা ভাসিয়ে নাদিয়ে দিনরাত মেহেনত করল, ভারসিটিতে ক্লাশ করা, বাসায় পড়াশোনা করা, পাশাপাশি তার বাবার সাথে তাদের পারবারিক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে বসা শুরু করল। মানিক অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করল। মাষ্টার্সেও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ন হলো। বাবার স্বপ্ন পুরন করল। এখন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকুরী করছে।
আবদুল হক সাহেব নামাজ পড়ার সময় আল্লাহ’র কাছে দুহাত তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তাকে এত ভাল একটি সন্তান দান করার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে সব দিয়েছেন। যেখানে যান সবাই মানিকের প্রশংসায় পঞ্ছমুখ। এখন একটি ভাল মেয়ে দেখে যত তারাতারি সম্ভব ছেলের বিয়ে দিতে চান আবদুল হক সাহেব। এসব চিন্তা করতে করতে চোখ ভিজে যায় আবদুল হক সাহেবের। এমন সময় মানিক এসে দাঁড়ায় তার পাশে, তাড়া দেয় ‘চলেন বাবা, আপনাকে ধান্মন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাব’। একটি মাত্র গাড়ি তাদের। প্রতিদিন ছেলে তাকে তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে যায় তারপর নিজের অফিসে যায়, আবার রাতে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। আজকাল এরকম দায়িত্ববান সন্তান পাওয়া দুষ্কর।
প্রতিদিনের মত মিরপুর থেকে ধানমন্ডি রওনা হলেন। খুব পরিচ্ছন্ন গাড়ি চালায় তার ছেলে। কখনোই তাড়াহুরা করেনা, সবসময় ট্রাফিক আইন মেনে চলে। তার অফিস ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডে, তো গণসাস্থ্য হাসপাতালের পাশে ধানমন্ডি থানাসংলগ্ন ৬ নম্বর সড়কের সিগন্যালে যে ক্রসিং আছে সেখান দিয়ে তাকে ডানে মোড় নিতে হয়। মানিক ডানে মোড় নেয়ার জন্য সিগন্যালে অপেক্ষা করছিল। মানিক হঠাৎ খেয়াল করল যে ডানদিক দিয়ে চৈতালি নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি দোতলা বাস এসে বায়ে মোড় নেয়ার জন্য থামল। এই গাড়িতে করেই মানিক ৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছে। এই বাসগুলি কখনোই সিগন্যাল বা ট্রাফিক আইন মেনে চলেনা। জ্যাম থাকলে সবসময় রং সাইড দিয়ে চলে যায়। কিন্ত মানিক যেহেতু আগে এসেছে তাই ওর গাড়ি নাগেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস দুটি বায়ে মোড় নিতে পারবেনা। দোতলা বাস থেকে কয়েকটি ছেলে ওর গাড়ির সামনে এসে গাড়ি সরানোর জন্য চীৎকার করতে লাগল। কিন্ত সামনে সিগন্যাল আর পেছনে গাড়ি থাকায় মানিক গাড়ি সরাতে পারছিলনা। কিন্ত ছেলেগুলোর সেদিকে নজর নেই তাদের চীৎকার তখন অশ্রাব্য গালাগালিতে রুপান্তরিত হয়েছে।
‘ওই শালা ড্রাইভারের বাচ্চা, গাড়ি সরা নাইলে পিটাইয়া তোর গাড়ি ভাইঙ্গা দিমু’।
‘খাড়াইয়া আছস কেন, ওর কানের নিচে দুইটা বয়রা দে নাইলে কাজ হইবনা’।
আরও কিছু ষ্টুডেন্ট নেমে এসে ওর গাড়ি ঘিরে ফেলে।যুগপৎ গালাগালির পাশাপাশি গাড়ির গায়ে আর কাচে কিল ঘুষি মারতে থাকে। পেছনে বসা মানিকের বাবা আব্দুল হক সাহেব অবাক হয়ে তাকিয় থাকেন। মানিক ততক্ষনে গাড়ির কাচ নামিয়ে বলে ‘তোমরা এমন করছ কেন, সিগন্যাল না ছাড়লে গাড়ি কিভাবে সরাবো? আর আমিও ঢাকা ইউনিভার্সিটির ষ্টুডেণ্ট ছিলাম, এই বাসে করে টানা ৮ বছর যাতায়াত করেছি। এরকম খারাপ আচরন কেন করছ? কোন ডিপার্টমেন্টে পড় তোমরা?’
‘কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ি সেটা তোরে কইতে হইব, (গালি)’
মানিক অবাক হয়ে যায়, ওরই সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন ষ্টুডেণ্ট যে বিনা কারনে ওর সাথে এত খারাপ ব্যাবহার করতে পারে সেটা ও কখনো কল্পনাও করেনি। এটা ভাবতে ভাবতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে ওর কপালে খুব জোরে ঘুষি মারল, আরেকটি ঘুষি এসে পড়ল বামচোখের নিচে। সব অন্ধকার দেখতে লাগল মানিক। দরজা খুলে বের হয়ে বোঝাতে চাইল ওদের, কিন্ত কে শোনে কার কথা, বৃষ্টির মত কিল, ঘুষি আর লাথি মারতে লাগল ছেলেগুলো। মানিকের মনে হলো ও একদল ক্ষুধার্ত হায়েনার মাঝখানে পড়ে গেছে। আবদুল হক সাহেব গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন, ‘থামো তোমরা, কেন মারছ আমার ছেলেকে! কি অন্যায় করেছে আমার ছেলে? ও তো তোমাদেরই মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে, তবে কেন মারছ ওকে?’ অনেক চেষ্টা করেও আবদুল হক সাহেব ওদের থামাতে পারলেননা। ওনার সামনেই গনহারে সবাই মারতে লাগল মানিককে, তার মানিককে। যে ছেলেকে নিয়ে এত গর্ব তার, যার গায়ে কখনো একটা ফুলের টোকা পরতে দেননি, তাকে তারই চোখের সামনে মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে দিল।
মার খেতে খেতে মানিক ভাবল এখান থেকে ছুটতে না পারলে আজকে ও মরেই যাবে, কোনমতে হাত ঝাড়া দিয়ে দৌড়ে রাস্তার ওইপাশে চলে গেল। কিন্ত ওর বাবা এখনো অই নরপশুদের মাঝখানে রয়ে গেছেন। সামনেই ধানমন্ডি থানা, দৌড়ে থানায় ঢুকল মানিক। কর্তব্যরত অফিসারকে দ্রুত খুলে বলে তার সাহায্য চাইল। তার সাথে কয়েকজন পুলিশ সেপাই পাঠাল। মানিকের শরীরে একফোটা শক্তি নেই, শুধু তার বাবা এখনো ওইখানে আছে এই দুশ্চিন্তায় সে পুলিশ সাথে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে আসল। ছেলেগুলো তখনো দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে একদল দৌড়ে এসে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। মানিক পেছন ফিরে দেখে একজন পুলিশও নেই, পালিয়েছে। এবার ছেলেগুলো ওকে আবার পেটাতে লাগল, শুধু পার্থক্য এই যে এবার ওরা সংখ্যায় প্রায় দ্বিগুন। মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে পারাতে লাগল, আবদুল হক সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। ওদের থামাতে না পারলে তার ছেলেকে আজ ওরা মেরেই ফেলবে। তিনি দৌড়ে এসে মানিকের উপর শুয়ে পরলেন আর ছেলের প্রান ভিক্ষা চাইলেন। ওদের মনে একটুও দয় হলোনা, তাকে উপেক্ষা করেই অরা মারতে লাগল, মনে হলো তাদের অনেকদিনের পুরোন ক্ষোভ মিটিয়ে নিচ্ছে। একটা ছেলে হঠাৎ এগিয়ে এসে আবদুল হক সাহেবের মাথায় ঘুষি মারল। তার হাতে বোধহয় ধারালো কোন আংটি পরা ছিল সাথে সাথে মাথে কেটে রক্ত পরতে লাগল। তবুও তিনি ছেলেগুলোকে মারা থামনোর জন্য আবারো অনুনয়-বিনুনয় করতে লাগলেন। আরো প্রায় ৫ মিনিট মারার পর ছেলেগুলো থামল, প্রায় ২৫-৩০ জন ছেলে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন এদের মধ্যে দেখতে অভদ্র একজনও নেই। সবার চেহারায় ভদ্রভাব রয়েছে। সব ভদ্র ঘরের সন্তান। এদের দেখে কেউ বলতে পারবেনা এরা খুনীর মত আচরন করতে পারে। কি অবলীলায় তারা বিনাদোষে তার ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
মানিকের দিকে তাকিয়ে দেখেন মানিক নিথর হয়ে পরে আছে। প্রায় বেহুশ হয়ে গেছে। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মাথায় বোধহয় ধারালো কোন কিছু দিয়ে আঘাত করেছে , চার-পাচ জায়গা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে । একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বিনাকারন এরকম ভাবে মারতে পারে এটা উনি কখনো ভাবতে পারেননি। আশেপাশে কত কত লোক দাঁড়ানো ছিল, একজন মানুষ এগিয়ে আসেনি তাকে সাহায্য করার জন্য। মানুষের দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই এসময় কেউই এগিয়ে আসেনা। পুলিশ পালিয়ে গেল! পুলিশ ই বা কে পালাবেনা, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ষ্টূডেণ্ট, এদের গায়ে হাত তুললেই মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করে মেধাবী ছাত্রকে পুলিশ বিনাকারনে মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে। এদের সাথে ঝামেলায় গেলে এরা শাহবাগে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে দিবে। তারপর আস্তে আস্তে পুরো দেশে সে আগুন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মত ছড়িয়ে যাবে। জীবনে প্রথমবারের মত আবদুল হক সাহেবের প্রচন্ড লজ্জা লাগল যে তার ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছে। যে ইউনিভার্সিটির ষ্টূডেন্টরা বিনা কারনে তাদের সিনিয়র ভাইকে এভাবে মারতে পারে, তাদের বাবার বয়সী একজন লোককেও যারা একটূও ছাড় দেয়নি। তারা আর যাই হোক মানুষ না। কারন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে মনুষ্যত্ব প্রয়োজন নেই, নির্দিষ্ট পরিমান নাম্বার পেলেই চলে।
কোনমতে ছেলেকে নিয়ে গণসাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে ধুকলেন আবদুল হক সাহেব। কর্তব্যরত ডাক্তার মানিককে দেখে শিউরে উথলেন। সারা শরীরের রক্ত মুছে দেয়ার পর দেখেন মানিকের সারা শরীরে চাকা চাকা দাগ হয়ে গেছে। প্রচন্ড রাগে মনে হলো সব কিছু ধংস করে দেন। তার আদরের ধন তার সামনে পরে আছে। চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় কান্না বেড়িয়ে আসল। কি দোষ তার? কি অন্যায় তার? কেন তার সাথে এ পাশবিক আচরন? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মানুষ তাদের ছেলেদের কে পাঠিয়ে কি ভুল করছে? এরা কি মানুষ নাকি মানুষ নামের ঘৃন্য নরকের কীট?
বিঃ দ্রঃ এটী কোন গল্প বা উপন্যাস নয়। খবরটি খুব ছোট করে ০২ অক্টোবরের প্রথম আলো তে এসেছিল। এই তার লিঙ্ক Click This Link । মোজাফফর হোসেন মানিক আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। ভাল এবং ভদ্র হিসেবে আমাদের বন্ধুমহলে তার সুনাম অনেকদিনের। তার উপর তারই ইউনিভার্সিটির ছেলেদের এরকম নির্মম আচরনে আমরা হতভম্ব এবং লজ্জিত। যাদের বাসাইয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে, ভাই, বন্ধু, বা আত্মিয় আছে দয়া করে তাদের জিজ্ঞেস করুন তারা চৈতালী নামক বাসে যাতায়াত করে কিনা। যদি করে তবে ভালকরে তাদের হাত ধুয়ে দিবেন, কারন তাদের হাতে লেগে আছে আমার বন্ধু মানিকের রক্ত।
দয়া করে এই পোষ্টটিতে হিট দিন আর শেয়ার করুন সব জায়গায়। নইলে পরবর্তিতে যেকেউ তাদের এই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন
ঢাকা ইউনিভার্সিটির ষ্টুডেন্ট বাস 'চৈতালী' অথবা একদল অমানুষের গল্প (শুধু মাত্র অবিশ্বাসিদের জন্য)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯