ছবি ঋণ: গুগল......
১) কাগজের নৌকা কেউ বানিয়েছে তা
চুপচাপ ভাসিয়েছে জলে,
রেলগাড়ি ঝমাঝম কেউ বেশি কেউ কম
নিজস্ব কথাটুকু বলে!
জলের গানের "কাগজের নৌকা" গানটা আমার খুব ভালো লাগে। গানটি শুনতে শুনতে মনে হয় কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দেয়া শৈশবের কথা। কখনো মনে হয় সন্ধ্যা মুখপাধ্যায় এর সেই বিখ্যাত গান "কাগজের এই নৌকা আমার যদি ময়ূরপঙ্খী হয়ে যেত...!" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "নৌকা ডুবি" কিনবা "কাগজের নৌকা"কবিতাও মন ছুঁয়ে যাবার মতো সাহিত্য কর্ম। ভিক্টর ব্যানার্জীর "কাগজের নৌকা বাংলা ছায়াছবি" না দেখে থাকলে দেখে আসতে পারেন এই ফাঁকে। আর হ্যাঁ, কাগজের নৌকা ভাসিয়ে করতোয়া নদী রক্ষার জন্য অভিনব প্রতিবাদও আমার কাছে একেবারেই ব্যতিক্রম মনে হলো।
২) দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না
ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনা.....!
মক্কায় নবী এলো মা আমিনার ঘরে
হাসিলে হাজার মানিক কাদিলে মুক্তা ঝরে!
দয়াল তুমি যার সখা তার কিসের ভাবনা...
ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনা.....!
গানটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। মিউজিক ছাড়া "দে দে পাল তুলে দে..." গানটা শুনে দেখুন আপনার মন ভরে যাবে।
৩) "তোমায় নিয়ে নাও ভাসিয়ে যাব তেপান্তর....." লাইনটা যেন কোন গানের? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে! "আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে"। গানটা যে কি ভালো লাগে.......!
৪) আমাদের এই দাদা তার প্রিয়তমাকে কি এই গান শুনাচ্ছেন.......!
সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা
তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা
সখি গো.... ও আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি
তোমার কাছে পয়সা নেব না......
৫) এই খালা কি গান গাচ্ছেন আপনারা কি বলতে পারবেন?
তিনি গাচ্ছেন এই গান: ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা.........!
৬) "ভাঙা তরি ছেড়া পাল" গানটিই কি গাচ্ছে ছেলেটি?
৭) আমার জীবন নায়ে বন্ধু তুমি প্রাণের মাঝি
যেই নদীতে লইয়া যাইবা যাইতে আমি রাজি
ইহকালের নদী বাইয়া পরকালের নদী......
সত্যি বন্ধু যাব আমি, লইয়া যাও গো যদি.....!
৮) মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না
৯) কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া
আমার ভাইজানরে কইয়ো নাইওর নিতো বইলা!
১০) রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতার আবৃতি. .....
১১) ও মাঝি নাও ছাইরা দে
ও মাঝি পাল ওরাইয়া দে
গা রে মাঝি গা কোন গান......
১২) কোন মিস্ত্রি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়....
১৩) মন মাঝি খবরদার আমার তরী যেন ডুবে না
১৪) আমারে কান্দাইয়ারে বন্ধু কি সুখে ঘুমাও
কলঙ্কি বানাইলিরে বন্ধু ঘাটে বাইন্দা নাও......
নৌকার সাতকাহন: বাংলাদেশের নৌকার যতো মজার নাম
আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলেই বাংলাদেশের খাল বিল,নদী-নালাগুলো পানিতে ভরে যায়,বেড়ে যায় বৃষ্টির পরিমাণ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা তাই একটি প্রাচীন ও জরুরী বাহন।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে নৌকা এখনও স্থানীয় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পণ্য পরিবহনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বর্ষাকালে নৌকা প্রচুর ব্যবহার হয়।
গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে। এসব নৌকার রয়েছে মজার মজার নাম।
ডিঙ্গি: ডিঙ্গি নৌকা আকারে ছোট। এটি বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকা। নদী তীর বা হাওর-বাওরে যারা বাস করেন তারা সবাই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন। এটি নদী পারাপার বা অল্প পরিমাণ পণ্য পরিবহনে কাজে লাগে। আকারে ছোট বলে এ নৌকা চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।
ডোঙা: তালগাছের কাণ্ড কুঁদে এ নৌকা বানানো হয়। ডোঙ্গা বেশ টেকসই,তবে এতে খুব বেশি মানুষ বা মালামাল নেওয়া যায় না। পার্শ্বদেশ বা বিস্তার এতই কম যে,এতে পাশাপাশি দু’জন বসা যায় না। একটু বেসামাল হলে,ডোঙ্গা উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। ডোঙার উপর দাঁড়লে যাতে তলা ফেঁসে না যায়,সে জন্য এর তলদেশ বেশ মোটা রাখা হয়। তাল গাছের কাণ্ড সহজে পচে না বলে ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।
কোষা: বর্ষাকালে চরাঞ্চলে বা বিলে ডোঙা দেখা যায়। অন্যান্য নৌকার মতো এর গলুইয়ের কাঠ বড় থাকে না। অঞ্চল বিশেষে এর আকার কমবেশি দেখা যায়। কোষা মূলত পারিবারিক নৌকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাটবাজার,স্বল্প দূরত্বে চলাচলের কাজে লাগে। একটি আদর্শ কোষা নৌকাতে আটজনের মতো যাত্রী বহন করা যায়। সাধারণত কোষাগুলোতে ছই থাকে না। কোষা বৈঠা দিয়ে চালানো হয়। তবে অগভীর জলে লগি ব্যবহার করে চালানো যায়। একটি ভারি এবং বেশি ওজন বহন করার উপযোগী কোষাকে বলা হয় ‘ঘাসী নৌকা’।
সাম্পান: বাংলাদেশের লোকগীতি ও সাহিত্যে সাম্পানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান। চট্টগ্রাম,কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। এ নৌকাগুলির সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো,পেছনটা থাকে সোজা। প্রয়োজনে এর সঙ্গে পাল থাকে আবার কখনও থাকে না।
একজন মাঝিচালিত এই নৌকাটি মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এক সময় বড় আকারের সাম্পানও দেখা যেত কুতুবদিয়া অঞ্চলে,তবে এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাতজন মাঝি থাকতো আর থাকতো তিনকোণা আকারের তিনটি করে পাল।
গয়না: এ নৌকা আকৃতিতে মাঝারি। এটি কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। মূলত যাত্রী পারাপারের কাজেই এদের ব্যবহার করা হতো। একসঙ্গে প্রায় ২৫-৩০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকার। আবার রাজশাহী অঞ্চলে এর থেকেও বড় আকারের গয়না নৌকা পাওয়া যেত। এরা আকারে যেমন বড় তেমনি এই নৌকায় বেশি সংখ্যক যাত্রীও উঠতে পারতো। বর্তমানে এই নৌকাও বিলুপ্তির পথে।
বজরা: আগের দিনে ধনী লোকেরা শখ করে নৌকা ভ্রমণে যেতেন। তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ‘বজরা’ নৌকা। বজরাতে তারা এক রকম ঘরবাড়ি বানিয়ে নিতেন। ফলে এতে খাবার-দাবারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই থাকতো। কোনটিতে আবার পালও থাকতো। এতে থাকতো চারজন করে মাঝি। বজরা মূলত সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে দেখা যেত।
বাইচের নৌকা: নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ যে এ নৌকাকে ঘিরে হতো অনেক মজার মজার খেলা। ‘নৌকা বাইচ’ এখনও একটি জনপ্রিয় খেলা। বাইচের নৌকা লম্বায় দেড়শ থেকে দুইশ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রতিযোগিতার সময় এতে পঁচিশ থেকে একশ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতে পারে। আগে নবাব-বাদশাহরা বাইচের আয়োজন করতেন। এইসব বাইচের নৌকার আবার সুন্দর সুন্দর নাম দেওয়া হতো, যেমন- পঙ্খীরাজ,ঝড়ের পাখি,দ্বীপরাজ,সোনার তরী ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জ,পাবনা,ময়মনসিংহ,ফরিদপুর,নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে এসব নৌকা ছিল।
বাতনাই: এর অপর নাম ‘পদি’। এটি মালবাহী বজরার একটি সংস্করণ। খুলনা অঞ্চলে মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই বজরাগুলো অনেক বড় হয়। বর্তমানে এই বজরা আর দেখা যায় না। যান্ত্রিক নৌকার ব্যবহারের কম খরচ ও কম সময় লাগে বলে এ নৌকার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এ নৌকার বড় খরচ ছিল এর লোকবল। এটা এতটাই ভারি হতো যে এটি চালাতে ১৭-১৮ জন মাঝি লাগতো।
ময়ূরপঙ্খী: রাজা বাদশাহদের শৌখিন নৌকার নাম হলো ‘ময়ূরপঙ্খী’। এর সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ময়ূরপঙ্খী’। এই নৌকা চালাতে প্রয়োজন হয় চারজন মাঝির। নৌকায় থাকতো দুটো করে পাল।
বালার: কুষ্টিয়া অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও নৌকা ব্যবহার হয়ে আসছে। সেখানে বিখ্যাত নৌকার নাম হলো ‘বালার’। এ নৌকাগুলি আকারে অনেক বড় হয় এবং প্রায় ১২-৫৬ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। আর বৈঠা বায় ১০-১২ জন মাঝি। এ ধরনের নৌকায় পাল থাকে দুটো করে।
পানসী: নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি। এই পানসীতে চড়ে মাঝি মাল্লার ভাটিয়ালি, মুর্শিদী আর মারফতি গান গেয়ে মন কেড়ে নিতো যাত্রীদের। বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে এটি প্রচুর দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে পানসি নৌকা হারিয়ে গেলেও
ছুঁইওয়ালা বা একমালাই: পালতোলা পানসির মতো ছুঁইওয়ালা একমালাই ছিলো দূরপাল্লার নৌকা। আজও এর দেখা মেলে। বরিশালের দুশুমি গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাসহ উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারের সদস্যরা ছুঁইওয়ালা নৌকার মাঝি হিসেবে বাপ-দাদার এ পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
পাতাম: এক ধরনের যুগল নৌকা। দুটি নৌকাকে পাশাপাশি রেখে ‘পাতাম’ নামক লোহার কাঠাটা দিয়ে যুক্ত করে এ যুগল নৌকা তৈরি করা হয়। একে অনেক সময় ‘জোড়া নাও’ বলা হয়। এ নৌকা মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে মাঝি ছাড়া চারজন দাঁড় টানা লোক থাকে। এতে একটি পাল খাটানোর ব্যবস্থা থাকে। এক সময় এই নৌকা সিলেট ও কিশোরগঞ্জে অঞ্চলে দেখা যেতো। এখন বিলুপ্তপ্রায়।
তথ্যসূত্র:
১. উইকিপিডিয়া
২. বাংলাপিডিয়া
৩. বাংলাদেশের নৌকা, এম এ তাহের
৪. বার্জ ফর বাংলাদেশ, ইভ মার
৫. বিডিনিউজ২৪
সব শেষে একটি নীতি কথা:
সব ছবি ঋণ: গুগল......
সবাই ভালো থাকবেন। শুভ ব্লগিং.....
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৩৫