প্রথম পর্ব
চেক আউট করে কাঁচের পার্টিশনের ওপারে প্রতীক্ষারত ছোট বোনের উপর ঝাপিয়ে পরে মেহেরীন, দুইবোন দুজনকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না!
'আরে আরে কান্নার কি হলো, আপনারা বাসায় চলেন তো!' দুইবোনের কান্নায় ঈষৎ বিব্রত মনসুর চেস্টা চালায় পরিস্থিতি হালকা করার।
এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাবার পথে গাড়ীতেই পরিকল্পনা শুরু হয় পরবর্তী পদক্ষেপের। মনসুর জানায়, ঢাকা শহরের কোন হসপিটালের কোন ডক্টর বাইপাস সার্জারীর জন্য প্রসিদ্ধ, তা ইতোমধ্যেই ওর খবর নেয়া শেষ, এর মধ্যে নামকরা একটি প্রাইভেট হসপিটালের ড. রহমানকেই ওর সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে।ঠিক হয় পরদিন সকালেই মেহেরীন দেখা করবে ঐ ডক্টরের সাথে।
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মধ্যরাত, বাসায় ফিরেই ফোন নিয়ে বসে মেহেরীন, সব আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে পরামর্শ চায় পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে । এদিকে বাপের চেহারার দিকে তাকাতে পারে না মেহেরীন! কি বলবে ওর ভলুকে? যেই বাবা এতদিন ভালুকের মত বিশাল বুক দিয়ে আগলে রেখেছে ওদেরকে, তাকে যে ওর বাঁচাতেই হবে, তাকে ছাড়া যে একমূহুর্ত বাঁচতে পারবে না মেহেরীন! বাবা যে ওর কলিজার টুকরা, ওর জানবাবা! মনের ভিতর উথাল পাতাল দুশ্চিন্তার ঝড়টাকে অতিকস্টে চাপা দিয়ে রেখে হাসিহাসি মুখ করে বাবাকে বোঝায় মেহেরীন, " আরে এটা তো কোনো ব্যাপারই নাহ! আজকাল কত মানুষ করছে এই অপারেশন, দেখবা তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবা।"
পরদিন মনসুর আর সেহেরীনকে সাথে নিয়ে মেহেরীন যায় ড. রহমানের সাথে দেখা করতে। হসপিটালে পৌঁছে ডক্টরকে ফোন দেয় মেহেরীন, "আমি মেহেরীন, ফিলিপাইন থেকে এসেছি, আমার বাবার আপনার কাছে সার্জারী করানোর কথা।" 'ওহ, হ্যা, হ্যা, আপনি এসেছেন? আমি গাড়ীতে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।" বেলা তখন বারোটা, ড. রহমান নাকি দিনে তিনটা থেকে চারটা অপারেশন করেন, এতো দেরী করে হসপিটালে এসে কিভাবে ম্যানেজ করে কে জানে! অপেক্ষার প্রহর আর গুনতে পারে না মেহেরীন, ডক্টরকে কল দিয়ে বসে আরেকবার, এবার অবশ্য ডক্টরের উত্তরে কিছুটা হতচকিৎ হতে হয় মেহেরীনকে, " আরে কোথায় আপনি ? ডাক্তার এসে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আর আপনার খবর নাই !" আজব মানুষ তো এই ডাক্তার! মনসুর কে সাথে নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে যায় মেহেরীন, সেহেরীন বাইরে থাকতে চাইলে ওকে আর জোর করে না। মধ্যবয়সী অত্যন্ত সুপুরুষ ডক্টর, মাথা ভর্তি বড় বড় চুল, মুখে প্রানখোলা হাসি আর চোখে কৌতুক ! মেহেরীনকেও পা থেকে মাথা পর্যন্ত ডক্টরের মনিটর করাটা চোখ এড়ায়নি মেহেরীনের। হাস্যোজ্জ্বল ডক্টরের ব্যবহারও খুব আন্তরিক, বসতে বলেই প্রথমে এন্জিওগ্রামের সিডি চালিয়ে দিলেন, ব্যাখ্যা করলেন যে, ব্লক আর্টারির এমন এক জায়গায় রয়েছে যেখানে রিং পরানো সম্ভব নয়, বাইপাসই একমাত্র সমাধান। উনি এতো কনফিডেন্সের সাথে এবং এতো হালকাভাবে ব্যাপারটা ডীল করলেন যে, মেহেরীনের মনে হলো ও ঠিক জায়গাতেই এসেছে, এনার উপর ভরসা করা যায়! এরপর ডক্টর প্রশ্ন করে মেহেরীনের প্রবাস জীবন নিয়ে, ফিলিপাইন দেশটা কেমন, ও কি নিয়ে পড়াশোনা করছে! আরও জানায়, মনসুরের কাছে শুনে সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলো মেহেরীনের সাথে পরিচিত হবার জন্য। মেহেরীন বলে যে, সী লাভারদের জন্য ফিলিপাইন হলো স্বর্গপুরী! জবাবে ডক্টর জানায়, সে ভীষণভাবে সী লাভার , আর তার ছেলে তো সী গেমস এর চরম ভক্ত! পরে একদিন মেহেরীনের সাথে বসে সে একটা বেড়ানোর ছক করে ফেলবে। ঠিক হলো বাড়ী গিয়ে অপারেশনের ডেট ঠিক করে জানাবে মেহেরীন, অপারেশনের একদিন আগে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।
এরপর সমস্যা হলো অপারেশনের ডেট নিয়ে, শুক্রবার ডক্টর অপারেশন করেন না, শনিবার মেহেরীনের পরিবার রাজী না আর রবিবার হলো সেহেরীনের জন্মদিন, ঐদিন অপারেশন করাতে মেহেরীন রাজী না। অবশেষে সোমবার অপারেশনের ডেট ঠিক হলো, রবিবার সকালে বাবাকে সিসিইউ তে ভর্তি করালো সেহেরীন আর মনসুর। ঢাকা শহর ভর্তি আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে শুধুমাত্র বড় মামা আর ছোট মামা আসলো হসপিটালে। আর দল বেঁধে আসলো মনসুরের বন্ধুরা রক্ত দিতে। অপারেশনের ফর্মালিটির জন্য একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হয়, যেখানে লেখা থাকে অপারেশনের দায়ভার হসপিটাল কর্তৃপক্ষের নয়, সেই ফর্মে সাইন দেয়ার সময় মেহেরীনের বুকে কত টন পাথর চাপা দিতে হয়েছিলো, সেটা নাহয় নাই বা বল্লাম! সিসিইউতে বাবা একা একা থাকতে চাচ্ছিলো না, মেহেরীনরা বার বার আসা যাওয়া করছিলো, একপর্যায়ে নার্স এবং গার্ডের সাথে একটু বাকবিতন্ডাও হয়েছিলো এ নিয়ে। ছোটমামা মনসুরের বন্ধুদের খাওয়াতে চাইলেন, কিন্তু ওরা কেউ খেতে রাজি হলো না। মেহেরীন গেলো ডক্টরের কাছে , 'আপনি একটু চলুন আমার বাবার কাছে, বাবা ভয় পাচ্ছে, আপনি গিয়ে তাকে সাহস দিবেন।' ডক্টর সাথে সাথে সিসিইউতে আসলেন , বাবার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন, রিপোর্ট দেখলেন। যাবার সময় চুলে একটা ঝাঁকি দিয়ে সীস্টার কে একটা ঠেলা দিয়ে হাসিমুখে জিগ্গেস করলেন, " এই সিস্টার, আজরাইল না আসলে কি রোগী মরে? " কি আজব, নিয়ে আসলাম বাবাকে সাহস দেয়ার জন্য, এখন রোগীর সামনে কিসব কথাবার্তা! তাও আবার হাসিমুখে! ডক্টরকে কিছুটা ক্রেজি মনে হয় মেহেরীনের।
নিয়ম হলো অপারেশনের আগের দিন সারাদিন সিসিইউতে রেখে সন্ধ্যায় কেবিনে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কেবিন খালি নাই, মনসুর অনেক চেস্টা করেও কোনো কেবিন জোগাড় করতে পারে নাই। তখন মেহেরীন জানতে পারলো যে, ড. রহমানের আরেক পেশেন্ট কেবিন না পেয়ে ভিআইপি কেবিনে ছিলো, সন্ধ্যায় অন্য কেবিন খালি পেয়ে ওরা সিফট হয়ে যাবে, তখন মেহেরীন গিয়ে আবার ধরলো ড. রহমানকে, ' আমাদেরকে তাহলে আপাতত ভিআইপি কেবিনে দিয়ে দিন। ' ডক্টর রাজী হলেন এবং ব্যবস্থা করে দিলেন।
সন্ধ্যায় মেহেরীন লিফ্টে করে সিসিইউ তে গিয়েছে, বাবাকে এখন কেবিনে আনা হবে। হঠাৎ দেখে যে, সিসিউর বাইরে অনেক ভীড়। সব সিস্টাররা গোল হয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। লিফ্টের সামনে বোরখা পড়া এক মহিলা বুক চাপড়ে কাঁদছে! একটা অল্পবয়স্ক ছেলেও চিৎকার করে কাঁদছে, চারপাশে তাদের আত্মীয়স্বজনরাও কাঁদছে, পুরা থমথমে একটা পরিবেশ! লিফ্টে করে বাবাকে নিয়ে নিচে নামার সময় এক ডক্টর ওয়ার্ড বয়কে জিগ্গেস করলো ," এও কি রহমান স্যার এর পেশেন্ট?" মেহেরীন মনে মনে শঙ্কিত হয়, মানে কি? উপরে যে রোগীর জন্য কান্নাকাটি চলছে, সেও কি তবে ড. রহমানের পেশেন্ট? আবার বাবার সামনে কাউকে জিগ্গেসও করা যায় না ! প্রচন্ড কৌতুহল আর শঙ্কায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মেহেরীন! কিভাবে জানা যায়, উপরে কি ঘটেছে! বাবাকে কেবিনে রেখে যাওয়ার সময় ওয়ার্ড বয়কে অনুরোধ করে যে উপরে কি ঘটেছে তা জেনে এসে জেনো মেহেরীনকে জানায়, কিন্তু সেই ওয়ার্ড বয় আর আসে না। তখন মনসুরকে জোর করে পাঠায় খবর আনতে। এদিকে বাবার ওষুধপত্র চেক করতে গিয়ে মেহেরীন দেখে যে, বাবাকে যে ইনসুলিন দেয়া হয়েছে সেটা বাবা সবসময় যে ইনসুলিন ব্যবহার করে তার থেকে ভিন্ন। ডিউটি ডক্টরকে এই ব্যাপারে জিগ্গেস করা হলে সে খুব অদ্ভুৎ আচরণ করে, সার্জারী ডিপার্টমেন্ট আলাদা, তাই সে এ ব্যাপারে কিছু বলবে না! এক পর্যায়ে সে বলে যে, 'ইনসুলিন সম্পর্কে আমি কিছু জানি না!' মেহেরীন তখন রেগে গিয়ে বলে যে, "ইনসুলিন সম্পর্কে জানেন না , আপনাকে ডাক্তার বানইছে কে!" একেতো মনের অবস্থা খারাপ, তার উপর ডিউটি ডাক্তারের এই ব্যবহার মনের ভেতর জমে থাকা বাস্পের পরিমান শুধু বাড়িয়ে দেয় ! থাকতে না পেরে নার্সদের কেই জিগ্গেস করে বসে, " আচ্ছা উপরে কি ড. রহমানের পেশেন্ট মারা গেছে? সিসিউর বাইরে এতো কান্নাকাটি কেন?" নার্সরা জানায় যে, নাহ ড. রহমানের পেশেন্ট মারা যায় নি, তবে ৬০৩ এর পেশেন্টকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আর পারে না মেহেরীন, দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পরে, "বাবা তো এই অপারেশন করাতে চায়নাই, আমি রাজি করিয়েছি তাকে, তার উপর হসপিটালের সেই ফর্মও আমি ফিলাপ করেছি, আল্লাহ না করুক খারাপ কিছু হলে আমি নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবো না!" মেহেরীনের এই কান্না দেখে সিস্টাররা এগিয়ে আসে, "আরে আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন? অপারেশনের পর তো সব পেশেন্টকেই লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখতে হয়!" এর মধ্যে মনসুরও চলে আসে, " আল্লাহ আপু আপনাকে আমি কত শক্ত ভাবতাম , আপনি এভাবে কাঁদছেন?" মনসুরকে দেখে কান্নার বেগটা যেনো আরও ঠেলে বের হয়ে আসে। মনসুর জানায় যে, সিসিউর বাইরে যে পেশেন্টকে নিয়ে মেহেরীন উদ্বেলিত, সে হার্ট পেশেন্ট না, তার কিডনি ফেউলর করেছে। এরপর ৬০৩ এর পেশেন্টের আত্মীয়রয় এসে মেহেরীনকে সান্ত্বনা দিতে থাকে , মেহেরীন তো আর বলতে পারেনা যে ওদের পেশেন্টকে লাইফ সাপোর্টে রেখেছে, সেই ভয়েই সে কাঁদছে! কিছক্ষন পর খবর আসলো যে, ৬০৩ এর পেশেন্টের সেন্স ফিরেছে, মেহেরীনও চোখ মুছে কেবিনে ফিরলো। কিন্তু বাবার সমানে সযত্নে লুকিয়ে রাখলো বুকের ভিতর হতে থাকা অবিরাম ঝর তুফান! মেহেরীনের কান্না দেখে ৬০৩ এর পেশেন্টের এক রিলেটিভ আসলো ওর বাবার সাথে দেখা করতে, ছেলেটি এসে ওর বাবার হাত ধরে এতো সুন্দর করে কথা বললো, সাহস দিলো, যে কৃতজ্ঞতায় মেহেরীনের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেলো! এছাড়া মনসুরের বন্ধুরাও আসলো বাবার সাথে দেখা করতে।
অপরদিকে, মেহেরীনের বাবার অপারেশনের চিন্তায় ওর মায়েরও শরীর অনেক খারাপ হয়ে যায়, যেকারনে সিদ্ধান্ত হয় যে রাতে এক বোন মায়ের কাছে থাকবে , আরেক বোন বাবার কাছে। রাতে সেহেরীনকে বাবার দায়িত্ব দিয়ে বাসায় ফেরার পথে ভীষণ একা লাগে মেহেরীনের! শীতের রাত হওয়া সত্বেও ড্রাইভারকে বলে কাঁচ তুলে দিয়ে এসি ছেড়ে দিতে, যাতে ওর কান্নার আওয়াজ গাড়ীর কাঁচের বাইরে যেতে না পারে! একটু মন খুলে কাঁদা যে ওর বড় প্রয়োজন! এই প্রথম প্রান খুলে কাঁদে মেহেরীন, যে কান্না ও লুকিয়ে রেখেছিলো ওর বাবা মা আর বোনের সামনে, পরিবারের বড় মেয়েরা কাঁদলে অন্যদের সামলাবে কে? কিন্তু মেহেরীনকে সামলানোর জন্যও তো কাউকে প্রয়োজন ! সেহেরীনের পাশে তো মনসুর আছে, মনসুরের সব বন্ধুরা আছে, এত বড় বিপদের দিনে মেহেরীনের পাশে যাদের থাকার কথা, ওর স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর লোকজন, তারা কেউ নেই কেনো? এত দুর্ভাগ্য কেনো ওর?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২৪