দেখতে দেখতে কিভাবে যে তিন তিনটি বছর চলে গেলো, আর মাত্র তিন মাস! নাহ্, আর সময় নেই, এখন একটু সিরিয়াস হতেই হবে! ব্রাউন ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগার উপর আরেকটু ঠেলে দিয়ে ব্যস্ত হাতে কিবোর্ড চাপে মেহেরিন। ল্যাপটপে ডাটা এনালাইসিসের সফ্টওয়ার চালিয়ে দিয়ে পিসিতে পেপার খুঁজে বেড়ায়। এক ইন্ট্রোডাকশন লিখতেই নাকি ছয়মাস লাগে, ও যে কিভাবে তিন মাসে পুরো থিসিস লিখবে এক খোদা তায়ালাই জানেন! কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু পর পর মোবাইল চেক করছে। দেশ থেকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ফোন আসবে, মনটা ভেতরে ভেতরে পড়ে আছে সেদিকেই।
আজকে বাবার এন্জিওগ্রামের রিপোর্ট দেয়ার কথা! দেশ টার যে কি হলো, একটু বুকে ব্যথা করলেই এন্জিওগ্রাম! যত্তোসব! এই তো তিন মাস আগেই মেহেরিন দেশে গিয়েছিলো, তখন কত বললো, বাবা চেক আপটা করাও এবার, অনেকদিনতো কোনো চেক আপ করাও না! আমি চলে গেলে সেহেরিন তো একা সব পেরে ওঠে না! নাহ , তখন সে গেলো না ডক্টরের কাছে ! এখন ভীতুর ডিম, কিভাবে তুমি আমাকে ছাড়া এন্জিওগ্রাম করাচ্ছো? আমি তো আর তিন মাস পরে চলেই আসবো, তখন করালেই হতো! অভিমানে বুকে চাপ চাপ ব্যাথা করে মেহেরিনের! নাহ , ওর বাবার রিপোর্ট কখনই খারাপ আসবে না, মেহেরিন সিউর, কিছু হয়নি ওর বাবার! ভয় শুধু এন্জিওগ্রামের কোনো সাইড ইফেক্ট না হলেই হলো! যেদিন সেহেরিন ফোনে জানালো যে বাবার এন্জিওগ্রাম করতে হবে , সেদিনই মেহেরিন গুগলে পড়েছে এন্জিওগ্রাম সম্পর্কে! মেহেরিনের ভীতু বাবাটা কিভাবে যে এত ধকল সহ্য করবে!
এলোমেলো ভাবনার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে কর্কষভাবে বেজে ওঠা মোবাইলের রিংটোনে বুকের ধুকপুকানিটা বেড়ে যায় হঠাৎ! হুমম, দেশের নাম্বার।
-হ্যালো
-হ্যালো আপু.........
কি ব্যাপার, সেহেরিন ফোন না করে ওর বন্ধু মনসুর কেনো ফোন করলো? তবে কি খারাপ কিছু?
নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিগ্গেস করে,
-হ্যা, বলো মনসুর, কি খবর ভাইয়া ?
যথাসম্ভব হালকা গলায় মনসুরের উত্তর,
-আপু, আংকেলের তো বাইপাস সার্জারী করাতে হবে...............
মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে মেহেরিনের,শেষ রক্তবিন্দু হারানোর মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে সারা শরীর! কি বলে এসব!
- বাইপাস? কি বলছো তুমি? সেহেরিন কোথায়? ওকে দাও।
- এখানেই আছে আপু , কথা বলেন।
এক সাথে অনেক গুলি চিন্তা এসে ভর করে মাথাটা কেমন অনুভুতি শুন্য ফাঁকা ফাঁকা করে দেয়!
-হ্যালো
-হ্যালো
-বাইপাস করাতে হবে নাকি?
-হুম, তিনটা ব্লক পাওয়া গেছে, তুমি আসতে পারবা?
-কবে করতে হবে? আমি তিন মাস পরে আসলে তখন করানো যাবে না?
-নাহ, দেরী করা যাবে না, তুমি এখনি আসতে পারবা না?
- আমাকে সাতটা দিন সময় দাও তাহলে, আমার এক্সপেরিমেন্টগুলো একটু গুছিয়ে নেই
-তুমি বুঝতে পারছো না! ডক্টর বলেছে একেবারে অপারেশন করে বাসায় নিতে, দু একদিনের মধ্যেই করাতে হবে। আমি কোনো রিস্ক নিবো না। তুমি না আসতে পারলে আমি একাই করিয়ে ফেলবো!
শিরদারা বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে যায় মেহেরিনের।বলে কি? বাবার বাইপাস সার্জারী করাতে হবে, আর ও এখানে বসে থাকবে? ওর সারা পৃথিবী একদিকে আর বাবা একদিকে! ওর কোনো ডিগ্রীর দরকার নেই, কোনো কিছুর দরকার নেই ,শুধু দরকার বাবাকে ! বাবার জন্যই ওর এত পড়ালেখা , এতদূরে আসা! বাবার চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট এসব কি করে হয়? ও অবাক হয়ে অনুভব করে, ওর তিন বছরের অবর্তমানে , অসুস্থ মা বাবা এর দেখাশোনা আর সংসারের হাজারটা ঝামেলা সামলাতে সামলাতে ওর সেই ছোট্ট বোনটা আজ কতটা দায়িত্বশীল আর সাহসী হয়ে গিয়েছে! বুকে কতটা সাহস ধারন করলে এত বড় একটা দায়িত্ব সে একার কাঁধে নিয়ে নেয়!
দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় মেহেরিন! ওকে যেতে হবে।এই মুহুর্তে ওর পরিবারের ওকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।
-ঠিক আছে , আমি আসছি, তুমি আমাকে দুটা দিন সময় দাও।
- হুম, তাড়াতারি আসো তুমি। আর শোনো, বাসায় কিন্তু মামনি বাবা জানেনা কিছু, তুমি কিন্তু কিছু বোলো না এখনই।
এডভাইজারের রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেহেরিন।
-I m feeling so helpless!
মমতায় আর্দ্র হয়ে ওঠে সুদানী বংশোদ্ভূত এডভাইজরের কন্ঠ,
-U know, Allah is the best helper! U should be grateful that it has been detected and it can be cured! Some people don’t even get that chance! Many in my family have also gone through this Bypass surgery and they are totally fit now! Do you want to go home? Go home; you should be with your family as you are the elder one! Don’t Worry! Be patience and pray to the Almighty, He is the best rescuer! Before leaving must make some arrangements that who will handle your experiments।
শুধুমাত্র মুখে সান্ত্বনা দেয়াই নয়, নিজে রুম থেকে বের হয়ে এসে সেক্রেটারিকে নির্দেশনা দেন মেহেরিনের এয়ারপোর্ট পিক আপের ব্যবস্থা করতে।
ঝটপট কিছু কাজ করে মেহেরিন। বরের কাছে ফোন করে টিকিটের ব্যবস্থা করতে বলেই টেকনিশিয়ানদের ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় সব কাজের। সময় নেই, একদম সময় নেই হাতে! হে আল্লাহ, আমার এমন একটা বাবাকে এত কঠিন পরীক্ষায় কেন ফেল্লে তুমি?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:১৫