প্রথম দিনটা আমার ফ্রি ডে ছিলো। কদিন থেকেই পায়ের ব্যাথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। ল্যাবএ লম্বা সময় ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাজ করার জন্যই কিনা কে জানে! ইন্ডিয়ার চিকিৎসা সেবার এতো নাম শুনি! সুযোগটা নেবার জন্য তাই মিটিং শুরু হবার একদিন আগেই চলে গিয়েছিলাম।
আগের রাতে অনেক দেরীতে ঘুমালেও সকাল সকাল উঠতে হলো! কারন ব্রেক ফাস্টের টাইমলাইন ৯ টা পর্যন্ত। সারাদিনের জন্য মনে মনে একটা প্ল্যান ছিলো। তাই সকাল বেলাতেই গোসল দিয়ে জার্নির ক্লান্তি আর ঘুমের অবসাদ ঝরিয়ে নিলাম। প্রথম দিনের পোষাক হিসেবে বেছে নিলাম আমার হলুদ রঙের একটি লাকি ড্রেস! (হা হা খুব সিলেক্টেড কিছু ড্রেস আছে, আমার লাকি ড্রেস! যা শুধুমাত্র কোনো বিশেষ দিনে নিজেকে সাহস দেবার জন্যই আমি ব্যবহার করি। এই দিনটি বিশেষ ছিলো, কারণ একটা অচেনা নতুন শহরে আমার প্রথম দিন। )
এই হোটেলে অনেকগুলি রেস্টুরেন্ট! আমাদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেকেন্ড ফ্লোরে একটা রেস্টুরেন্টে। একে তাকে জিগ্গেস করতে করতে খুজে পেলাম তাকে! গিয়ে দেখি বেশি কেউ নাই। আসলে আমিই দেরীতে গিয়েছিলাম! তো নাস্তার আয়োজনতো সেইরকম! আলু পরোটা, ছোলা ভাটোরা, ইডলি, দোসা সব হাজির! এছাড়া পাউরুটি, জ্যাম জেলী, কেক পেস্ট্রি , নানা রকমের ফল এসবতো আছেই! ও রাইসেরও কয়েকটা আইটেম ছিলো, নাম ভুলে গেছি! এই সকাল বেলাতেও টক দই আছে! সব দেখে শুনে মনে হলো দোসা খাই। কারন এটা একদম গরম গরম বানিয়ে দিচ্ছে! একটা মসলা দোসা আর একটা মসলা অমলেট দিতে বলে আমি এক গ্লাস জুস নিয়ে কোনার একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম।(ওরা হাসছিলো, আমার সবকিছুতেই মসলা চাই দেখে! ওরা কিভাবে বুজবে যে আমি গিয়েছি মসলা বর্জিত এক দেশ ফিলিপাইন থেকে! ) আহ! কি দোসা! অমলেটটা ভাল লাগে নাই। দোসার সাথে কি কি যেনো দিয়েছিলো, দারুন টেস্ট! এতো ভালো লেগেছিলো যে আরেকটা নিয়েছিলাম। আর মিল্ক কফি ! দারুন জমজমাট ব্রেকফাস্ট !
ব্রেকফাস্ট শেষ করে গেলাম রিসিপশনে। জিগ্গেস করলাম এপোলো হসপিটালে কিভাবে যাওয়া যায়? ওরা জানালো, হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে পারি অথবা বাইরে থেকে অটো নিয়ে। এক্ষেত্রে হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে গেলে লাগবে ৯০০ রুপি আর বাইরে থেকে অটো নিয়ে গেলে লাগবে ২৫০ রুপি। কিন্তু যেহেতু আমি বিদেশী, আমার নিরাপত্তার জন্য হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। আমি ভেবে দেখলাম, আমার পোশাক আসাক, চেহারা ছবি কোনোকিছুতেই আমাকে বিদেশী বলে চেনার কিছু নেই। আমাকে দেখতে আর দশটা সাধারন ভারতীয়র মতই। তাই নিরাপত্তা ইস্যুতে কান না দিয়ে বাইরে থেকে অটো নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও কথা আছে, অটো যদি হোটেলের ভিতর ডাকিয়ে এনে নেই তাহলে ২৫০ রুপি, আর যদি হোটেলের গেট থেকে বের হয়ে মেইন রাস্তা থেকে নেই তাহলে ২০০ বা ১৫০ রুপি। মানে হলো হোটেলের ইমেজ = ৫০ রুপি! এখন চিনি না জানি না, বাইরে গিয়ে কোথায় অটো খুজবো? হোটেলওয়ালাদেরকেই বললাম অটো এনে দিতে।
বেশ সুন্দর একটা সকাল । বাংলাদেশে শীত আসার আগে যেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকে, সেরকম একটা আবোহাওয়া । এক জায়গায় দেখলাম বিশাল একটা মানব বন্ধন হচ্ছে। কি যেন একটা পলিটিক্যাল অস্থিরতা চলছিলো।
একটা ব্যাপার দেখে খুবই অবাক হলাম। মহিলারা শাড়ি পরে , এমনকি বোরখা পরেও মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। কেউ কোন মন্তব্য করা তো দূরে থাক, ফিরেও তাকাচ্ছে না। খুব ভালো লাগলো ওনাদের এই সাবলম্বীতা ।
২৫মিনিটে পৌছে গেলাম গন্তব্যে।এপোলোর গেটএ আমাকে নামিয়ে দিয়ে অটোয়ালা বললো, " ম্যাডাম আপনার এখানে কতোক্ষন লাগবে? আপনি আর যেখানে যেখানে যেতে চান , আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।" (আসার সময় একে জিগেস করেছিলাম, এখানে কি কি দেখার মতো আছে, মার্কেট কোথায়, বিরিয়ানীর রেস্টুরেন্ট কতদুর.... .... ইত্যাদি।) আমি প্রথমে মানা করলাম," আরে না না , আমার কতোক্ষন লাগে কোনো ঠিক আছে নাকি?" (মনে মনে টেনশন, আবার ওয়েটিং চার্জ না দিতে হয়! ) কিন্তু সে নাছোড়বান্দা! " আপনার ২ ঘন্টা লাগলেও অসুবিধা নাই, আপনি কাজ শেষ করে বের হয়ে একটা মিসকল দিলেই আমি গেটে চলে আসবো।" (অটোয়ালার এই অপেক্ষা করতে চাইবার কারণ আমি পরে ধরতে পেরেছি। প্রথমত, সে আমাকে হোটেলের ভিতর থেকে তুলেছে। কাজেই সে প্রথমেই বুজতে পেরেছিলো, আমি এখানে নতুন। তাই ইচ্ছামত আমার কাছ থেকে ১৫০ রুপির জায়গায় ২৫০ রুপি করে ভাড়া নিতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত , হায়দ্রাবাদ হলো মোটরসাইকেলের শহর । এখানে কোনো পরিবারে যদি ৪ জন সদস্য থাকে, তাহলে ঐ ৪ জনের জন্য ৪ টা মোটরসাইকেলও থাকবে! প্রত্যেকের নিজস্ব যানবাহন আছে। যেকারনে অটোয়ালারা পর্যাপ্ত প্যাসেন্জার পায় না। এজন্যই আমার মত বকরা পেলে হাত ছাড়া করে না।) আমি ভেবে দেখলাম, লোকটা যথেস্ট ভদ্র আছে, আবার একটা অচেনা অটোতে ওঠার চেয়ে, একে নিয়ে যাওয়াই ভালো। তার মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিলাম।
হায়রে! এ কোথায় আসলাম! কোথায় আমাদের দেশের এপোলো, আর কোথায় এই দেশের এপোলো। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষজন। পরিচ্ছন্নতার অভাব দেখে অবাক হলাম! ঢাকার যেকোনো বড় প্রাইভেট হসপিটাল এর চেয়ে বেশী পরিচ্ছন্ন।মনে হচ্ছিলো আমি কোনো প্রাইভেট নয়, পাবলিক হসপিটালে চলে আসছি। নেটে আগেই দেখে গিয়েছিলাম যে দুইজন রিউমাটোলজিস্ট আছেন এই হসপিটালে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দুজনই রোগী দেখবেন দুপুরের পর। এরমধ্যে একজনের ম্যানেজারের ব্যবাহার খুব খারাপ লাগলো। ও বললো যে, ওর ডাক্তার নাই, আমি যেনো অন্য আরেকজন ডাক্তার আছে , তার কাছে যাই। আমি যতোই ওকে জিগেস করি," তোমার ডাক্তার কখন আসবে? আমি কখন আসলে তোমার ডাক্তারের সাথে দেখা করতে পারবো? " সে তো কিছুই আমাকে ঠিক করে বললো না, উল্টা প্রশ্ন করলো , "এপোলোতে নতুন?" এমনিতেই আমি খেপাটে মানুষ। অল্পতে রেগে যাই। এই প্রশ্নে আমার ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠলো। আমি বললাম যে," হ্যা, আমি অন্য একটা দেশ থেকে চিকিতসা নিতে আসছি।" তখন সে আমি কাটায় কাটায় ৪টার সময় উপস্থিত থাকবো, এই শর্তে আমাকে তার ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে দিলো। এরপর আরেকজন ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টও নিলাম। ভাবলাম আসছি যখন, দুজনকেই দেখায় যাই, দেখি দুজেনর ডায়াগনসিস এক হয় কিনা!
মিসকল দিয়ে গেটে আসতেই দেখলাম আমার অটোওয়ালা হাজির। বললাম শাড়ির মার্কেটে নিয়ে যেতে। সে আমাকে এবিড নামে এক জায়গায় নিয়ে গেলো। প্রথম দোকান থেকেই ফটাফট দুইটা কটন শাড়ি কিনে ফেললাম। যা দেখি সবই ভালো লাগে! ঐ দোকান থেকে আরও শাড়ি কেনার ইচ্ছা থাকলেও , ভাবলাম এক দোকান থেকেই সব কিনে ফেলব? আগে একটু ঘুরে দেখে নেই! ঘুরতে ঘুরতে আরো একটা শাড়ি কিনে ফেললাম আর সেলোওয়ার কামিজ কিনলাম আমার ছোটো বোনের জন্য।ওকে বাংলাদেশে ফোন করে রঙ জিগগেস করে ওর ড্রেসটা কিনেছিলাম! কিন্তু ও আজ পর্যন্ত ড্রেসটা পড়লো না! আমার মা আর বোনের জন্য কেনাকাটা করার সময় আমি খুবই আতংকগ্রস্ত থাকি! ওরা এতো চুজি কেনো? এতো শাড়ি! অথচ আমার মায়ের জন্য একটা শাড়িও আমি পছন্দ করতে পারলাম না!
হায়দ্রাবাদ সিল্ক শাড়ির জন্য বিখ্যাত। হায়দ্রাবাদী ট্রেডমার্ক হলো পচাম্পালী সিল্ক। পচাম্পালী সিল্ক দামে আকাশছোঁয়া, ডিজাইনও স্বতন্ত্র। কিন্তু পিউর সিল্কই বেশী পছন্দ হলো। আমার মায়ের জন্য একটা পিউর সিল্ক পছন্দ হলো। দামটা চড়া হওয়ায় ভাবলাম আরোতো সাত দিন আছি, দেখি যদি অন্য কোথাও এর চেয়ে একটু কমে পাই!
এদিকে মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ২ টা বেজে গেছে! মাঝখানে একবার অটোওয়ালাকে টাকা দিয়ে আসছি কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। আমার আবার ৩ টা থেকে এপয়েন্টমেন্ট।কাজেই দুপুরে আর খাওয়া হলো না। ফিরে গেলাম হসপিটালে। প্রথম যে ডাক্তারের কাছে গেলাম, উনি অল্পব্য়ষ্ক।কোনো টেস্ট করতে বললেন না । শুধুমাত্র Physical apparent এবং family historyর উপর বিচার করে উনি আমাকে ওষুধ দিয়ে দিলেন।উনি আমার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন।আমাকে বললেন যে, "আপনি তো আর চেকআপএর জন্য আসতে পারবেন না, আপনার কোনো দরকার হলে এই প্রেসক্রিপশনটা স্ক্যান করে ইমেইল করবেন, আমি আপনাকে পরামর্শ পাঠিয়ে দিবো।" উনি আমাকে যে ওষুধ গুলি দিয়েছিলেন, আমার কাছে খুবই ভালো ওষুধ মনে হয়েছিলো এবং আমি সবগুলি ওষুধ কিনে এনেছিলাম। যদিও এখনও পর্যন্ত একটাও খাইনি! এরপর গেলাম আরেকজনের কাছে। অনেকক্ষন অপেক্ষার পর আমার ডাক পড়লো। এই ডাক্তার আগেরজনের তুলনায় বেশ বয়স্ক। উনিও খুব ভাল ব্যবহার করেছিলেন, অনেক গল্প করলেন আমার সাথে। কিন্তু টেস্ট না করে ওষুধ দিলেন না।ব্লাড দিয়ে বের হতে হতে বিকাল প্রায় শেষ।
হোটেলে ফেরার আগে অটোওয়ালাকে অনুরোধ করলাম, হোটেলের কাছাকাছি কোনো শাড়ির শোরুমে নিয়ে যেতে (আমার মায়ের শাড়ি কেনার জন্য)।অটোওয়ালার এর মধ্য অভিগ্গতা হয়ে গেছে শাড়ির দোকানে ঢুকলে আমি সহজে বের হইনা। কাজেই সে বিনীত অনুরোধ করলো, আমি যেনো একটু তারাতারি ফিরে আসি। যাই হোক এক ঘন্টা ধরে তন্ন তন্ন করে খুজেও আমার চাহিদা মত শাড়ি না পেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম।
মিটিং এর ফাঁকে হায়দ্রাবাদে: পর্ব ১
মিটিং এর ফাঁকে হায়দ্রাবাদে