মেডিকেলে ক্লাস শুরুর পরপরই একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলাম। পত্রিকা বলা ভুল হবে। এ-ফোর সাইজের পাতার এপিঠ-ওপিঠ, তিন ভাজ করা। ১৯৮৮ সালের কথা। তখন কম্পিউটার এতো চালু হয়নি। আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। মেডিকেলের পড়াশোনা ভালো লাগতো না, তাই নিয়ে। কবিতাটা পরে শিবিরের একটা সাহিত্য সভায় পড়েছিলাম। সে সময়কার একজন তরুণ কবি খুব নির্দয়ভাবে তার সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, আবেগ তাকলেই কবিতা হয় না। শিখাও একটা লিখেছিল। নাম দিয়েছিল, 'আমি মুসলিমা গেরিলা'। এটা নিয়ে তাকে নাকি অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। আমাদের ইয়ারের কয়েকজনও কবিতা দিয়েছিল।
কবিতাপত্রটির খসড়া হাতে লিখে তৈরী করার পর সেলিম রেজা ভাইকে দেখালে তিনি খুব উৎসাহ দিলেন এবং বললেন টাইপ করতে হবে না, হাতের লেখাই সুন্দর দেখাচ্ছে। ফটোকপি করে প্রকাশ করেছিলাম। ভালোই সাড়া পড়েছিল। আমাদের ব্যাচে একটা মেয়ে ছিল, স্কার্ফ পরতো মাথায়। সে প্রায়ই আমার হাতের লেখার প্রশংসা করতো। তখন বুঝিনি যে এই প্রশংসার অন্য অর্থ থাকতে পারে।
ব্যাচের আরেকটা মেয়ে একদিন আমাকে একটা ব্যতিক্রমী উপহার দেয়। সেটি ছিল নিক্যাপ বা প্যাটেলা। হাটুর জয়েন্টের সামনের দিককার তিনকোনা ছোট হাড়টা। পড়ার সুবিধার জন্য সে হাড়টির বিভিন্ন অংশ রঙ্গির কালি দিয়ে একে দিয়েছিল। কয়েকদিন পর সে জানালো যে, ফজলে রাব্বী হলে আমার রুমে গিয়েছিল, কিন্তু আমাকে পায় নি। তখন রেটিনা কোচিং সেন্টার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতাম। দিনের বেলা খুব কমই হলে থাকতাম। কিছুদিন পরে সে খুব রাগ করে তার দেয়া উপহার ফেরত চাইলো। আমি অবাক হয়েছিলাম, উপহার সে দিলই বা কেন, আর রাগ করে ফেরত চাইলোই বা কেন? তার এই উপহার দেয়া, আমার রুমে আমাকে খুঁজতে যাওয়া, রাগ করা - এসবের যে অন্য মানে থাকতে পারে তা বুঝিনি।
আরেকজনের ব্যাপারও বুঝতে পারিনি। আমাদের ব্যাচের আরেকটা মেয়ে। ববছাট চুল। সে প্রায়ই গল্প লিখে আমাকে দিতো মন্তব্য করার জন্য। আমি ভাবতাম যেহেতু একটা সাহিত্য পাতা প্রকাশ করেছি, তাই সে আমাকে সাহিত্যের ভালো সমঝদার ভাবে। সেবার ঈদে মিলাদুন্নবীতে আমরা ট্রাফিক সিগন্যালে দাড়িয়ে গাড়ীতে কলেমার স্টিকার লাগিয়েছিলাম শিবিরের পক্ষ থেকে। সে আমার কাছ থেকে অনেকগুলো স্টিকার চেয়ে নেয় এবং জানায় যে তার এবং পরিচিত অনেকের বাসায় সে স্টিকারটি লাগিয়েছে। এসবের যে অন্য মানে থাকতে পারে, তা তখন বুঝিনি। সে এখন চোখের ডাক্তার হয়েছে। আমি চশমা নিয়েছি প্রায় দশ বছর হলো। মাঝে মাঝে মনে হয় তার কাছে চোখ দেখাতে যাই। কিন্তু, যাওয়া হয় নি।