somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরাণের কাহিনীতে নারীর অবস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পর্ব - ০১

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পুরাণের কল্পকাহিনীতে ধর্ম ও শাস্ত্রীয় বিধান সম্পর্কে নানামুখী সচেতনতা থাকলেও যৌনতার ব্যাপারে তেমন রক্ষনশীলতা বা স্পর্শকাতরতা দেখা যায় না। নিয়োগ পদ্ধতির বৈধতা এবং বংশ অথবা সিংহাসনের জন্যে বংশের নিকট আত্মীয় অথবা দেবতাসম উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত কোন ব্যক্তির দ্বারা নিয়োগপদ্ধতির প্রয়োগ যথেষ্ট চালু ছিল।


নিকট আত্মীয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক এবং বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কেরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে অগণিত। সেসব সম্পর্ক তেমন সমাজ বহির্ভূত বা নিন্দনীয় ছিল বলেও মনে হয় না। তবু এর-ই মাঝে অবিবাহিত অবস্থায় মাতৃত্ব অর্জন বা বিয়ের আগে কৌমার্য হারানো সমাজে মোটেও গ্রহনীয় ছিল না। যার জন্যে বিয়ের আগে সন্তানের জন্ম হয়েছে বলে ব্যাস যেমন সত্যবতীর মতো মার দ্বারা জন্মের পরেই পরিত্যক্ত হন, তেমনি কর্ণ-ও কুন্তিকে দিয়ে পরিত্যক্ত হন এক-ই কারণে। শকুন্তলাকে এক-ই কারণে ফেলে চলে যান মেনকা। বিষয়গুলোর সাথে ধর্ম ও শাস্ত্রীয় বিধান যুক্ত হওয়াতে অনেক সহজ হয়ে গেছে এগুলো, মানুষ মেনেও নিয়েছে সরল বিশ্বাসে।


সেই পঞ্চপাণ্ডব
কিন্তু অনুসন্ধানী পাঠক মাত্রই জানেন অর্জুন, ভীম সহ পঞ্চ পাণ্ডবের সকলেই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্মালেও সেটি নিন্দনীয় হয়নি। এখানে বলা হয় যেহেতু কুন্তী তখন বিবাহিতা ছিলেন এবং পাণ্ডুর পত্নী কুন্তী পান্ডুর অনুমতিতেই বিভিন্ন দেবতার ঔরষে তিনটি সন্তান ধারন করেন দুর্বাসা মুনির কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্র উচ্চারণ করেন। কুন্তীর কাছ থেকে শিখে এক-ই মন্ত্র পাঠ করে মাদ্রীও ক্ষেত্রজ পদ্ধতিতে দুটি সন্তানের জননী হন অশ্বিনী কুমারদ্বয় তথা আশ্বিণীভ্রাতাদের দ্বারা। ভিন্ন ভিন্ন পিতার ঔরষে পাঁচটি সন্তানের জন্ম পুরোপুরি বৈধ ছিল যেহেতু পাণ্ডুর পুত্র উৎপাদনের ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছিল । শিকার করতে গিয়ে এক অনভিপ্রেত দুর্ঘটনার কবলে পরে পান্ডুর ওপর বর্ষিত হয়েছিল এই ভয়ঙ্কর অভিশাপ।


নিন্দনীয় হলেও সমাজে ব্যাভিচার (এমন কে নারীদের মধ্যেও) ও গুরুপত্নীর সঙ্গে গুরুগৃহে বসবাসরত তরুণ শিক্ষার্থী বা শিষ্যের জৈবিক ও মানসিক সম্পর্ক হয়তো খুব বিরল ছিল না। যার জন্যে মনুসিংহিতায় এইসব ব্যাপারে বিস্তারীত ও সুস্পষ্ট বিধান দেয়া হয়েছে। গুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে শিশ্য চন্দ্র বা সোম অফরণ-ই শুধু করেননি, তারার গর্ভে সোমের ঔরষে এক পুত্রের-ও জন্ম হয়। এর পরেও বৃহস্পতি তারাকে নিয়ে ঘরসংসার করেন, কেবল পুত্রটি জন্মানো পর্যন্ত তারাকে অপেক্ষা করতে হয়। সোম বা চন্দ্র-ও মহা আনন্দে পুত্র বুধকে গ্রহণ করেন। এরকম আকাইম্যা ও অদ্ভুতুড়ে উদাহরণ আজকের সানি লিওনি ইভা-অ্যাঞ্জেলিনার দুনিয়ায়-ও শোনা যায় না।


তখনকার দিনে আরো একটি ব্যাপার ছিল যা সমাজে অগ্রহণীয় বলে বিবেচিত হতো। আর সেটা হলো, ভিন্ন শ্রেণি বা বংশের নরনারীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। অম্বিকা ও অম্বালিকার দাসীর সঙ্গে ব্যাসের সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন বিদূর যার জন্যে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও পঙ্গু অথবা ভগ্নস্বাস্থের ধৃতরাষ্ট্র বা পাণ্ডুর মতো কখনো হস্তিনাপুর রাজত্বের রাজা হবার জন্যে বিবেচিত হন নি। এক-ই রকমভাবে, কর্ণ যদিও সূর্য্যদেবের সঙ্গে অবিবাহিতা কুন্তির সম্পর্কের ফল, বিবাহের পূর্বে জন্মগ্রহণ করার লজ্জায় পিতামাতা দুজনেই তাকে পরিত্যাগ করেছিল জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।


এক রথচালক (অধিরথ) ও তার স্ত্রীর (রাধা-২) মতো নীচু জাতের মাবাবার দ্বারা লালিতপালিত হওয়ায়, দ্রৌপদী কর্নকে তার স্বয়ংম্বর সভায় সম্ভাব্য পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি। দ্রৌপদীর সুহৃদ ও সকল বিপদের সহায় কৃষ্ণের, যার প্রবল আধিপত্য ছিল দ্রৌপদীর জীবনে, কথামতো দ্রৌপদী কর্ণকে “কর্ণ সূতপুত্র “ বলে স্বয়ংবর সভায় অপমান করেছিল। যদিও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা ছিলেন না।


এক-ই কারনে কর্ণ হস্তিনাপুরের সিংহাসনের জন্যেও স্বাভাবিক অবস্থায় বিবেচিত হননি। এমন কি অর্জুনের চাইতেও অস্ত্র-চালনায় কর্ণ বেশি পারদর্শী হওয়া সত্বেও এই বংশের আভিজাত্যের ঘাটতির জন্যে অর্জুনের সঙ্গে লড়ে নিজেকে শ্রেষ্টতর প্রমাণ করতে পারেননি কর্ন।


এক-ইরকম্ভাবে, দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রশিক্ষক গুরুর শিষ্য হতে পারেন নি, কেবল নীচু জাতের সন্তানে ই পরিচয়ের জন্যে। উচ্চ বর্ণের কোন পুরুষ অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের নারীকে বিয়ে করলে সমাজ সেটা খুব দোষনীয় মনে না করলেও কোন উচ্চ বর্ণের নারী টার চেয়ে নিম্ন বর্ণের পুরুষকে বিয়ে করলে টাকে সমাজচ্যুত হতে হতো।


পরিহাষের বিষয় হলেও নারী হরণের বাপারটিও শাস্ত্রসম্মত ছিল। এক পুর্যুষ নারী হরণে যাবে বলে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করছে, রাত্রি যেন অন্ধকার হয়। মেয়েটির আত্মীয়স্বজন জেগে না ওঠে, কুকুরগুলো ডেকে না ওঠে।“ পরে অবশ্য নারী হরন আট রকম বৈধ বিয়ের একটি বলে স্ব্বকৃত হয়।


অপ্সরাসহ ঋষি

আফসুস....
সুন্দরী যুবতী নারীকে দেখা মাত্র-ই দেবতা ও ঋষীদের মধ্যে অতি সহজেই কামচেতনার সৃষ্টি হতো তখণ এবং বিনা সংকোচে তারা নারীদের কাছে তাদের সঙ্গম-সম্ভোগের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। আর প্রথমেই রাজী না হলেও (কখনো কখনো আবার শুরুতেই রাজি, যেমন ইন্দ্রের আহবানে বিবাহিতা অহল্যার সম্মতি) প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরে নারীরা রাজি হতো। এই রাজী হও্য়া স্বেচ্ছায় না অভিশাপের ভয়ে ঘটতো, নাকি ঘটতো দেবতা বা মুনীঋষিদের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে বিগলিত চিত্তে নিজেকে সঁপে দিতে কিংবা বলি দিতে, ধন্য হতে, অর্থাৎ উত্তম-অধমের মনস্তাত্তিক সংকটের কারণে-ই সেটা ঘটতো কিনা বলা শক্ত।


হালের উৎসব উদযাপনে হিন্দু নারী

এতো শত বিবাহবহির্ভূত যৌনমিলনের কথা মহাভারতে থাকলেও রাবন কতৃক তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রের সঙ্গে মিলিত হতে উদ্যত অপ্সরী রম্ভাকে (সেই রাতে তখনকার দিনে গ্রহনীয় এবং প্রচলিত নিয়মমতো তো এক রাতের জন্যে রাবনের ভ্রাতুস্পুত্রের সঙ্গে রম্ভার বিয়ের কথা ছিল) ধর্ষণ ছাড়া জোর করে সঙ্গমের বড় বেশি উল্লেখ নেই কোথাও। রাবণের এই কর্মের শাস্তিস্বরূপ তার ভ্রাতুস্পুত্রের দেওয়া অভিশাপে রাবন আর কখনো কাউকে ধর্ষন করতে সমর্থ হননি। এই অভিশাপের ফলেই কিনা কে জানে, অশোকবনে এতো দীর্ঘকাল বন্দী থাকা সত্বেও সীতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে অসমর্থ হন রাবণ।

চলবে ..................
এর বেশিরভাগ তথ্য পূরবী বসূর প্রাচ্যে পুরাতন নারী গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৪২
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতায় যাবার আগেই নারী বিদ্বেষ শুরু

লিখেছেন অপলক , ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১০:১১

সংবাদ সম্মেলন থেকে বের করে দেওয়া হলো নারী সাংবাদিককে, যা বললেন মুফতি ফয়জুল করিম

বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের এক নারী সাংবাদিক মনিকা চৌধুরীকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী দলগুলো নারী বিদ্বেষী - এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:২৯

আরবের দেশগুলোকে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা দেখতে পারেন না হিজাব ইস্যুর কারণে। অথচ, আরব দেশ কাতার বি,এন,পি'র চেয়ারপারসনকে চার্টারড প্ল্যানে করে দেশে পাঠাচ্ছে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। আওয়ামী লীগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ সকাল ৮:৫৩

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা



ইদানিং নারীনীতি নিয়ে দেশে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। আলেম-ওলামা এবং ইসলামপন্থীরা যখন পাশ্চাত্যঘেঁষা নারীনীতির সুপারিশকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনই মূলত এই আলোচনার বিস্তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×