somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্র্যাপড ইন দ্যা ইস্টার্ন ফ্রন্ট (Trapped in the Eastern Front)

১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে লেখা এরিক মারিয়া রেমার্কের (Erich Maria Remarque) অসাধারণ সব উপন্যাসের কথা স্মরণ করি। শুধু ফ্রন্টের যুদ্ধের বীভৎসতাই নয়, এই লেখক তার অসামান্য উপন্যাস গুলোয় বর্ণনা করেছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জার্মানি, সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধ-ফেরত জার্মান যোদ্ধাদের করুণ আর্থসামাজিক, মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কথা। অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (All quiet on the western front) এবং দ্যা রোড ব্যাক (The Road Back)- তার এই উপন্যাস দুটিতে যথাক্রমে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং যুদ্ধ থেকে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ফেরা যোদ্ধাদের যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন।

অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের একটি অংশে গল্পের নায়ক 'পল' এক সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালীন দল থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি গর্তে পড়ে যায়। দৈবক্রমে শত্রুপক্ষের এক সৈন্যও তখন লুকিয়ে ছিল গর্তটির ভেতর। তাকে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড চমকে যাওয়া, ভীত পল নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোমরে গোজা ছুড়ি বের করে সৈন্যটিকে উপর্যুপরি আঘাত করে। তারপর পালিয়ে বাঁচতে সাঙ্ঘাতিক আহত প্রতিপক্ষের সাথে গর্তের ভেতরই সে পড়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। কিন্তু সেখানে লুকিয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে পলের বোধোদয় হয়, আহত, কাদা-পানিতে শুয়ে গোঙাতে থাকা শত্রুপক্ষের এই সৈন্য তার মতই একজন মানুষ। এমন অনুভূত হতে, গর্তের ভেতরই সে প্রায়-অচেতন সৈন্যটির পরিচর্যা করে, তার আহত স্থানে টার্নিকেট বেঁধে দেয়, পানি খাওয়ায়, কানের কাছে ফিসফিস করে বিদেশী শত্রুকে অভয় দেয়, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এক পর্যায়ে মারাত্মক আহত সৈন্যটি মারা যায়। তার বুক পকেটে ছিল একটি চিঠি এবং তার পরিবারের ছবি। পল সেটি সংগ্রহ করে এবং মনে মনে ঠিক করে- যদি বেঁচে ফিরতে পারে, তবে চিঠিটি সে পৌঁছে দেবে সৈন্যটির পরিবারের কাছে।

যুদ্ধ হয়ত কখনো জরুরী কিন্তু সব সময়ই তা অনাকাঙ্ক্ষিত। কখনো প্রাণ বাঁচাতে, শাসকের পক্ষ নিয়ে, শাসকের নিপীড়ন অস্বীকার করে স্বাধীনতা চেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনো বাধ্য হয়ে- মানুষকে, সৈনিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন মন থেকে যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি মুছে ফেলাই হয়ে উঠে সবচেয়ে জরুরী কাজ। এবং তারপর মানুষকে, জীবনকে ভালবেসে বেঁচে থাকা, জীবন প্রবাহে ভেসে পড়া। কিন্তু বাংলাদেশে, আমাদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা শিং-মাগুর-কৈ মাছের মত যুদ্ধকে চেতনার দ্রবণে জিইয়ে রাখতে চাই। এবং অকারণে নিজেদের অনবরত উসকে, উষ্ণ রাখি প্রতিশোধের আগুনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে মিশে থাকে নিপীড়িতের প্রতি সুবিচার করার প্রচেষ্টা, ন্যায়ের বিনির্মাণ; কিন্তু নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারতে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আশ্রয় নেয়া হয়, তখনই দাঁত মেলে দেখা দেয় যুদ্ধের অন্ধকার।

বাংলাদেশে বিহারীদের কোনো মানব-অধিকার নাই। মানুষ হিসেবে যে অধিকার তাদের প্রাপ্য ছিল, জাতিতে বিহারী বলে বাংলাদেশে তারা তাদের সেই অধিকার দাবি করতে পারে না। তাদের অধিকাংশ, ক্যাম্পের ঘিঞ্জির ভেতর শিক্ষাহীন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধাহীন বঞ্চিত-আনাহুত-মানবেতর জীবন যাপন করে। একই সাথে অশিক্ষিত ও অস্তিত্বে সঙ্কটাপন্ন মানুষ যেমন হয়ে থাকে- বিহারীরাও উদ্ধত, অপরাধ প্রবণ ও বিপদজনক। যারা নাগরিক নয়, যারা দেশের সরকারের কাছে নিজেদের জানের নিরাপত্তা দাবি করতে পারে না, তারা কিসের তোয়াক্কা করে?

ভারত থেকে তৎকালীন পাকিস্তানে অভিবাসিত, সংখ্যায় লঘু, ধর্মে মুসলমান এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী একাত্তরের সময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে নিয়েছিল। পাক-হানাদার বাহিনী, তাদের নিযুক্ত প্যারা-মিলিটারি রাজাকার-আলবদর-আলশামসের বিশ্বাসঘাতক বাঙালি কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিহারীরাও তখন অবতীর্ণ হয়েছিল নিরীহ বাঙালি নিধনে, সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে। তার ফল স্বরূপ যুদ্ধের পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে নারী-শিশু সহ তারা কচুকাটাও হয়েছে নির্বিচারে। বাংলাদেশে পড়ে থাকা তাদের অবশিষ্টাংশ আজও পাকিস্তানকেই মনে-প্রাণে কামনা করে। তারা উর্দুভাষী এবং বাংলাদেশের স্বাধীন বাতাসে নিঃসঙ্কোচে পাকিস্তানের সবুজ-চানতারার পতাকা ওড়ায়। ক্রিকেটে পাকিস্তানের খেলার দিন, তা প্রতিপক্ষ হোক বাংলাদেশ বা অন্য কেউ, তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে দেদার পটকা ফোটায়।

কিন্তু এ স্বত্বেও যুদ্ধের (এতদিন) পর, স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও তারা অত্যাচারিত থাকতে পারে না, নির্বিচারে খুন হয়ে যেতে পারে না। তারা রক্তমাংসের মানুষ। তারা আটকা পড়েছে। পাকিস্তান তাদের নিয়ে যেতে চায় না জেনেও তারা নিজেদের বলে 'নিরুপায় পাকিস্তানি'। এর চেয়ে করুণ আর কি হতে পারে? আমরা আজ স্বাধীন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে কখনো ব্যবহৃত হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শুরু হয়েছে, চলছে, আশা করি শেষও হবে। তাই, আজকের সময় ছিল সব ভুলে গিয়ে মানবিক আচরণ করার; মানুষকে, মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেবার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ নিরপরাধ বিহারী শিশুর, নারী-পুরুষের মৃতদেহকে তুচ্ছ করে আমাদের নির্বিকার করে রাখতে প্ররোচিত করে এবং তার সুযোগে খুনিরা নিশ্চিন্তে পার পেয়ে যায়, তবে এই ভয়ানক, মারাত্মক, সাংঘাতিক চেতনাটি নিয়ে আমাদের শঙ্কিত, ত্রস্ত, লজ্জিত হয়ে ওঠা প্রয়োজন। শবেবরাতের পরের দিন সকালে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে; নিহত শিশুদের, মানুষের জন্য সুবিচার চেয়ে তারা আজ আন্দোলন করছে রাস্তায়। কিন্তু কারা তা চেয়ে দেখে? খবরের কাগজে এর স্থান হয় ভেতরের বা শেষের পাতায়! প্রতিক্রিয়াশীল (সাধারণত) সমাজ, লেখক, কবি, শিল্পীরা নিশ্চুপ। শুধু বিরক্তিকর, নৈরাশ্যবাদী, ছিদ্র অন্বেষণকারী, সব কাজে বাম হাত সেঁধান কিছু বামপন্থী সক্রিয় কর্মী বেঘোরে চিৎকার করে মুখে-মাথায় ফেনা তুলছে; যা তারা সব সময়ই করে থাকে, যখনই মানবতা বিপন্ন হয়, মানবের অধিকার খর্ব হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামে আজ যাকে আমরা জানি, তা যে আদতে চেতনা-নাশক-- বিহারী হিসেবে পরিচিত, নিরুপায় পাকিস্তানী হিসেবে পরিচয় দানকারী মানুষ হত্যার এই কাণ্ড, এবং সবার নির্লিপ্ততা সেটিই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:১৬
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×