দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে লেখা এরিক মারিয়া রেমার্কের (Erich Maria Remarque) অসাধারণ সব উপন্যাসের কথা স্মরণ করি। শুধু ফ্রন্টের যুদ্ধের বীভৎসতাই নয়, এই লেখক তার অসামান্য উপন্যাস গুলোয় বর্ণনা করেছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জার্মানি, সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধ-ফেরত জার্মান যোদ্ধাদের করুণ আর্থসামাজিক, মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কথা। অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (All quiet on the western front) এবং দ্যা রোড ব্যাক (The Road Back)- তার এই উপন্যাস দুটিতে যথাক্রমে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং যুদ্ধ থেকে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ফেরা যোদ্ধাদের যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন।
অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের একটি অংশে গল্পের নায়ক 'পল' এক সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালীন দল থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি গর্তে পড়ে যায়। দৈবক্রমে শত্রুপক্ষের এক সৈন্যও তখন লুকিয়ে ছিল গর্তটির ভেতর। তাকে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড চমকে যাওয়া, ভীত পল নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোমরে গোজা ছুড়ি বের করে সৈন্যটিকে উপর্যুপরি আঘাত করে। তারপর পালিয়ে বাঁচতে সাঙ্ঘাতিক আহত প্রতিপক্ষের সাথে গর্তের ভেতরই সে পড়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। কিন্তু সেখানে লুকিয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে পলের বোধোদয় হয়, আহত, কাদা-পানিতে শুয়ে গোঙাতে থাকা শত্রুপক্ষের এই সৈন্য তার মতই একজন মানুষ। এমন অনুভূত হতে, গর্তের ভেতরই সে প্রায়-অচেতন সৈন্যটির পরিচর্যা করে, তার আহত স্থানে টার্নিকেট বেঁধে দেয়, পানি খাওয়ায়, কানের কাছে ফিসফিস করে বিদেশী শত্রুকে অভয় দেয়, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এক পর্যায়ে মারাত্মক আহত সৈন্যটি মারা যায়। তার বুক পকেটে ছিল একটি চিঠি এবং তার পরিবারের ছবি। পল সেটি সংগ্রহ করে এবং মনে মনে ঠিক করে- যদি বেঁচে ফিরতে পারে, তবে চিঠিটি সে পৌঁছে দেবে সৈন্যটির পরিবারের কাছে।
যুদ্ধ হয়ত কখনো জরুরী কিন্তু সব সময়ই তা অনাকাঙ্ক্ষিত। কখনো প্রাণ বাঁচাতে, শাসকের পক্ষ নিয়ে, শাসকের নিপীড়ন অস্বীকার করে স্বাধীনতা চেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনো বাধ্য হয়ে- মানুষকে, সৈনিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন মন থেকে যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি মুছে ফেলাই হয়ে উঠে সবচেয়ে জরুরী কাজ। এবং তারপর মানুষকে, জীবনকে ভালবেসে বেঁচে থাকা, জীবন প্রবাহে ভেসে পড়া। কিন্তু বাংলাদেশে, আমাদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা শিং-মাগুর-কৈ মাছের মত যুদ্ধকে চেতনার দ্রবণে জিইয়ে রাখতে চাই। এবং অকারণে নিজেদের অনবরত উসকে, উষ্ণ রাখি প্রতিশোধের আগুনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে মিশে থাকে নিপীড়িতের প্রতি সুবিচার করার প্রচেষ্টা, ন্যায়ের বিনির্মাণ; কিন্তু নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারতে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আশ্রয় নেয়া হয়, তখনই দাঁত মেলে দেখা দেয় যুদ্ধের অন্ধকার।
বাংলাদেশে বিহারীদের কোনো মানব-অধিকার নাই। মানুষ হিসেবে যে অধিকার তাদের প্রাপ্য ছিল, জাতিতে বিহারী বলে বাংলাদেশে তারা তাদের সেই অধিকার দাবি করতে পারে না। তাদের অধিকাংশ, ক্যাম্পের ঘিঞ্জির ভেতর শিক্ষাহীন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধাহীন বঞ্চিত-আনাহুত-মানবেতর জীবন যাপন করে। একই সাথে অশিক্ষিত ও অস্তিত্বে সঙ্কটাপন্ন মানুষ যেমন হয়ে থাকে- বিহারীরাও উদ্ধত, অপরাধ প্রবণ ও বিপদজনক। যারা নাগরিক নয়, যারা দেশের সরকারের কাছে নিজেদের জানের নিরাপত্তা দাবি করতে পারে না, তারা কিসের তোয়াক্কা করে?
ভারত থেকে তৎকালীন পাকিস্তানে অভিবাসিত, সংখ্যায় লঘু, ধর্মে মুসলমান এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী একাত্তরের সময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে নিয়েছিল। পাক-হানাদার বাহিনী, তাদের নিযুক্ত প্যারা-মিলিটারি রাজাকার-আলবদর-আলশামসের বিশ্বাসঘাতক বাঙালি কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিহারীরাও তখন অবতীর্ণ হয়েছিল নিরীহ বাঙালি নিধনে, সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে। তার ফল স্বরূপ যুদ্ধের পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে নারী-শিশু সহ তারা কচুকাটাও হয়েছে নির্বিচারে। বাংলাদেশে পড়ে থাকা তাদের অবশিষ্টাংশ আজও পাকিস্তানকেই মনে-প্রাণে কামনা করে। তারা উর্দুভাষী এবং বাংলাদেশের স্বাধীন বাতাসে নিঃসঙ্কোচে পাকিস্তানের সবুজ-চানতারার পতাকা ওড়ায়। ক্রিকেটে পাকিস্তানের খেলার দিন, তা প্রতিপক্ষ হোক বাংলাদেশ বা অন্য কেউ, তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে দেদার পটকা ফোটায়।
কিন্তু এ স্বত্বেও যুদ্ধের (এতদিন) পর, স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও তারা অত্যাচারিত থাকতে পারে না, নির্বিচারে খুন হয়ে যেতে পারে না। তারা রক্তমাংসের মানুষ। তারা আটকা পড়েছে। পাকিস্তান তাদের নিয়ে যেতে চায় না জেনেও তারা নিজেদের বলে 'নিরুপায় পাকিস্তানি'। এর চেয়ে করুণ আর কি হতে পারে? আমরা আজ স্বাধীন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে কখনো ব্যবহৃত হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শুরু হয়েছে, চলছে, আশা করি শেষও হবে। তাই, আজকের সময় ছিল সব ভুলে গিয়ে মানবিক আচরণ করার; মানুষকে, মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেবার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ নিরপরাধ বিহারী শিশুর, নারী-পুরুষের মৃতদেহকে তুচ্ছ করে আমাদের নির্বিকার করে রাখতে প্ররোচিত করে এবং তার সুযোগে খুনিরা নিশ্চিন্তে পার পেয়ে যায়, তবে এই ভয়ানক, মারাত্মক, সাংঘাতিক চেতনাটি নিয়ে আমাদের শঙ্কিত, ত্রস্ত, লজ্জিত হয়ে ওঠা প্রয়োজন। শবেবরাতের পরের দিন সকালে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে; নিহত শিশুদের, মানুষের জন্য সুবিচার চেয়ে তারা আজ আন্দোলন করছে রাস্তায়। কিন্তু কারা তা চেয়ে দেখে? খবরের কাগজে এর স্থান হয় ভেতরের বা শেষের পাতায়! প্রতিক্রিয়াশীল (সাধারণত) সমাজ, লেখক, কবি, শিল্পীরা নিশ্চুপ। শুধু বিরক্তিকর, নৈরাশ্যবাদী, ছিদ্র অন্বেষণকারী, সব কাজে বাম হাত সেঁধান কিছু বামপন্থী সক্রিয় কর্মী বেঘোরে চিৎকার করে মুখে-মাথায় ফেনা তুলছে; যা তারা সব সময়ই করে থাকে, যখনই মানবতা বিপন্ন হয়, মানবের অধিকার খর্ব হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামে আজ যাকে আমরা জানি, তা যে আদতে চেতনা-নাশক-- বিহারী হিসেবে পরিচিত, নিরুপায় পাকিস্তানী হিসেবে পরিচয় দানকারী মানুষ হত্যার এই কাণ্ড, এবং সবার নির্লিপ্ততা সেটিই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।