somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রূপান্তর

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ ভোর ৬:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

No plea of Gregor's helped, no plea was even understood.
- Franz Kafka, The Metamorphosis

দুঃস্বপ্নের ঘুম ভেঙ্গে উঠে অরুণিমা আবিস্কার করল যে সে মিসেস চক্রবর্তীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
তার সমগ্র শরীর গোখরো সাপের মতন করে পেচিয়ে রেখেছে লাল বেনারসি, লোহার হাতকড়ার মতন তার কব্জি চেপে ধরেছে একজোড়া শাখা আর গলায় ফাঁসির দড়ির মতন ঝুলছে মঙ্গলসূত্র। মাথার নিচের শিমুল তুলোর বালিশ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। রক্ত তার কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছে- সারামুখ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। শাড়ির বাধনে নড়তে অক্ষম অরুণিমা অসহায়ের মতন তার সারা শরীরের কিলবিলে গয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আমার কি হয়েছে?’
বেকায়দায় শুয়ে শুয়েই ভাবলো অরু। এটা তো স্বপ্ন হতে পারেনা। চিরপরিচিত চারদেয়ালের ঘরের মাঝেই শুয়ে রয়েছে সে। একদেয়ালে তাকভরা বই, টেবিলের ওপর ছড়ানো খাতাপত্র আর দেয়ালে ফেমিনিজমের একটা হলদে পোস্টার। পোস্টারটা অরুণিমা নিজে প্রিন্ট করিয়েছে। রোসি দ্য রিভেটার পেশি ফুলিয়ে ঔদ্ধত্যময় দৃষ্টিতে পৃথিবীকে বলছে-আমরাও পারি।
জানলা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। গুমোট অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। দারুণ মেঘ করেছে আজ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময়ের জন্মই হয়েছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর জন্যে।
উপুড় হতে চারহাত পা ছড়িয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস অরুণিমার। মা বলেছে ওভাবে শুতে নেই। লোকে বলবে অলক্ষী! এখন অপরের বাড়ি গিয়ে শুতে হবে। তাদের মন যোগাতে হবে। তারা কি ভাববে না ভাববে তাও ভেবে নিতে হবে অরুণিমার।
স্বশুরবাড়ি,বাপেরবাড়ির লোকজনের মন যোগাতে যোগাতে নিজের বাড়ি হারিয়ে ফেলেছে অরুণিমা। সারাদিন লাগাতার এইবাড়ি ওইবাড়ি দৌড়ানোর ঝক্কি। আজ মেসোশ্বসুর-কাল ভাশুরের শালা তো পরশু মেজোবৌদির ননদের বাড়ি। আবার একেকবাড়ির একেক রকম রীতিনীতি-সংস্কার। যে বাড়িই হোক না কেন-খুঁত বের করার ব্যাপারে তাদের কারো কোন জুড়ি নেই।
ধুশশালা, মরুকগে সব! আপাতত পাছা চুলকাচ্ছে অরুণিমার। কোনমতে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে শরীরটা একটু বাঁকালো, অতঃপর অতি সন্তপর্ণে তিন চারপ্রস্থ কাপড়ের ভেতর হাত গলিয়ে চুলকানো। আহ!কি শান্তি!
প্রতিদিন কাক ডাকার আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকতে হলে বুদ্ধি কাকদের থেকেও কম হয়ে যায়। আরেবাবা!ঘুমেরও তো দরকার আছে,নাকি? রাতের বেলা স্বামীর যন্ত্রনা সহ্য করে জেগে থাকো,ভোরের আলো ফোটবার আগে স্বশুরের জন্য রান্না করো। শাশুড়ি তো বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। এরপর খাবার টেবিলে তিন রাজা-রানী বসে ঝিমাবে আর অরু একটু ঢুলে পড়লেই দোষ!
‘বাবা-মা কিছু শেখায়নি!’
এই বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়েই এতোদিন পর্যন্ত মুখ বুজে আছে অরুণিমা। নাহলে কবেই শাশুড়ির মুখে ঝামটা মেরে বাড়ি চলে যেত। চিরপরিচিত জীবনাচরণে ফিরে যাবার জন্য অন্তরটা হাঁসফাঁস করছিলো অরুণিমার!তার জন্যে প্রয়োজনে এক আধটা মানুষ মারা পড়লেও খুব একটা সমস্যা নেই তার। তবু পরোক্ষ হত্যা বাদেও জীবন ফেরত পাবার আরেকটা উপায় ছিলো। পতিপরমেশ্বর বিলেত থেকে ফিরেছিল বিয়ে করবার জন্যে-কিছুদিনের মাঝে আবার ফিরতে হবে তার। একবার পতিপমেশ্বর বিলেত ফিরে গেলেই অরুণিমা বাপের বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করবে-এই ছিলো তার পরিকল্পনা।
তবে পরিকল্পনা কাজে দেয়নি। পতিদেব বিলেত ফিরে গেছেন,অরুও বাপের বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু পড়াশুনা আর করা হচ্ছেনা। অরুর আত্মাটা কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন শুধু ঘুম পায় ওর। বাবা-মাও কেমন সারাদিন বিয়ের পর কিভাবে চলনবলন করতে হয়, তা-ই শিখাতে ব্যস্ত। স্বশুর শাশুড়ির মন যোগানো যাবতীয় কৌশল তাকে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
যে কয়টি শিক্ষা তাকে দেয়া হচ্ছে তার সবগুলোর মূল সূর একই-নিজেকে বদলাতে হবে অরুর। যে অনন্ত স্পর্ধা নিয়ে ক্যাম্পাসে স্লোগান দেয়া দগদগে নারীমূর্তি সে গড়ে তুলেছে-সেটা পেছনে ফেলে আসতে শিখতে হবে। এমনকি ওর নামটাও বদলে দিতে চাইছে ওরা। শ্বশুর শাশুড়ির ইচ্ছে-যাতে অরুণিমা নিজের নাম এফিডেবিট করে অরুণিমা রায়ের থেকে মিসেস অরুণিমা চক্রবর্তী করে ফেলে। বাবার বড়ো শখ করে দেয়া নাম-তবু চুপ করে আছে। বিয়ে-থা হয়ে গেছে, এখন সবকিছুতে নিজেদের মতামত জাহির করতে চাইবার আর উপায় নেই।
বিবাহ সম্প্রদান কারক।
আজই সেই নাম এফিডেবিট করতে যাবার কথা। সকাল সাতটা বাজে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হবেন স্বশুর মহাশয়। বাপেরবাড়ি থেকে স্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি থেকে উকিলের চেম্বার।
উঠতে হবে।
ঘুম থেকে উঠে স্নান করে,খাওয়াদাওয়া করে, শাড়ি পরে সুশীলা বাঙ্গালী বউ হয়ে উঠতে হবে। ডানপিটে অরুদিকে লুকাতে হবে চারপ্রস্থ কাপড়ের তলে। তবেই স্বশুরের মন শান্ত হবে-অতীত পেছনে পড়েছে! শ্বশুর শান্ত তো বাবা-মাও শান্ত। বাবা-মা শান্ত হলেই মিসেস অরুণিমা চক্রবর্তী শান্ত।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ একটানা একঘেয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে বজ্জাত এলার্ম ঘড়িটা!
হয়েছেটা কি?
হায় খোদা! সাড়ে সাতটা বাজে।
অরুণিমার চোখ অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম ! সাড়ে সাতটারও বেশি-প্রায় পৌনে আটটা। কি হলোটা কি? এলার্ম কি বাজেনি? অবশ্য গাঢ় ঘুমের মাঝে এলার্মের শব্দ শুনতে না পাবার সম্ভাবনা আছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে হয়তো সেই ভোর থেকেই বেজে চলেছে।
ঘুমটা বেশ একটা আরামের হয়নি অরুর-একের পর এক দুঃস্বপ্ন। কে জানে!হয়তো সেইজন্যেই বেশি গভীর হয়েছে। তাছাড়া কতদিন একটু আরাম করে ঘুম হয়না। একবার সুযোগ পেয়ে দেহমন একেবারে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বসেছে। এখন স্বশুরমশাই এসে উপস্থিত হলেই হয়েছে।
একটুও রেডি হয়নি অরুণিমা। মুখও ধোয়নি। সারা শরীর আলুথালু, সিঁদুর লেপ্টে আছে সারামুখে। শ্বশুর নিশ্চয়ই দেখেই মাকে বলবে, ‘আপনাদের মেয়ে কি এরকম দিনের বেলা পড়ে পড়ে ঘুমোয়? সারারাত জেগে করে টা কি?’ খবর চাউর হতেও সময় লাগবে না। শ্বশুরকে বসিয়ে রেখে বউ ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে!- টিপ্পনি কাটার সুযোগ ছাড়বেননা শাশুড়ি!
না! সামান্য একটা খারাপ রাত্রির জন্যে এতোকিছু হয়ে যেতে দেয়া যায়না। অরুণিমা আলোর বেগে মাথার মধ্যে সব গুছিয়ে নিতে থাকে।
এমন সময়ে খুব সন্তপর্ণে কেউ দরজায় টোকা দিলো, ‘মাগো!সাড়ে সাতটা বেজে পার হয়ে গেলো।তোমার শ্বশুরমশায় রওনা দিয়ে দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠবি না মা?’
তড়িঘড়ি করে উত্তর দিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেললো অরুণিমা।
মুখ থেকে শব্দ বের হতে চায় না।
মাথার মাঝে চিন্তাও গুলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন আবছা আবছা লাগছে। চোখ জলে ভরে গেলে যেমন হয়, তেমনি। তবু কোনমতে অরুণিমা বললো ‘উঠছি,মা!’
নিজের গলা শুনে নিজেই চমকে উঠলো অরু! অরুর গলার আওয়াজ ক্যাম্পাসের মাঝে বিখ্যাত। সেই অরুর গলা থেকে এমন ইঁদুরের মতন মিনমিনে আওয়াজ বেরুচ্ছে কেনো?
দরজার ওপাশ থেকে অবশ্য স্বরের তারতম্য বোঝা গেলো না খুব একটা--অথবা মা খেয়াল করলেন না।তিনি এখন দশপদ রান্না করতে ব্যস্ত। হাজার বলেকয়েও অরুকে রান্না শেখাতে পারেননি কোনকালে। এখন তারই মাশুল গুনতে হচ্ছে।
মা চলে গেলেন। বাবা এলেন প্রায় সাথেসাথেই। সেই ছোট্টবেলায় অরুকে স্কুলে পাঠানোর সময় যেভাবে ডাকতেন,সেভাবে ডাকতে শুরু করলেন। ‘অরু,এই অরু-অরু রে!মা ওঠ ওঠ ওঠ! বেলা হয়ে গেলো যে।তোর শ্বশুরুমশায় চলে আসছেন তো!ওঠো মা,ওঠো।’
গলার সমস্ত শক্তি একত্র করে অরু জবাব দিলো, ‘উঠি।’
জীবনে কখনও অরু এক শব্দে কোন কথার জবাব দেয়নি। তবে বাবা খেয়াল করলেন না। তিনিও অরুর শ্বশুরমশায়ের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। শ্বশুর খুব ধার্মিক শোনা যায়-গীতা উপনিষদের জ্ঞানটা একটু আওড়ে নেয়া দরকার।
কিন্তু অরুর ছোটবোন নিরুপমা টের পেলো যে দিদির কিছু একটা হয়েছে। জন্মের পর থেকে দিদিই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সে যদি টের না পায় তাহলে কে আর টের পাবে! সে ফিসফিস করে পেছনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘দিদি, কিসু হইসে? দরজাটা খোল প্লিজ।’
অরুর অবশ্য দরজা খোলার সামান্যতম ইচ্ছা নেই। বরং তার কিছুটা শান্তিই লাগছে! কতোদিন নিজের সাথে একটু সময় কাটানোর সময় পায়না সে। ভাগ্যিস দুটো দরজাতেই ছিটকিনি লাগিয়েছিলো। পতিপরমেশ্বরের সাথে রাত কাটানোর একটা সুবিধা অন্তত পাওয়া গেলো!
তবে সারাদিন এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে না। শ্বশুরের সামনে বাবাকে ছোট হতে দেয়া যায়না। ধাপে ধাপে চিন্তা করতে হবে অরুর। কিছুই কেনো যেন মনে পড়তে চাইছে না। মাথার মাঝে ছোট ছোট কাজের একটা ছক বানিয়ে নিলো অরু। এখন সর্বপ্রথম করণীয় হলো, শান্তিমতো উঠে দাঁড়ানো, তারপর মুখ ধোয়া, শাড়ি বদলানো আর নাস্তা করা।
তবে গোখরো সাপের প্যাঁচের থেকে নিজেকে ছুটিয়ে উঠে দাঁড়ানো কিকরে সম্ভব হবে,সেটা এখনও অরু হিসেব করে বের করতে পারেনি। বিশেষত হাতের মাঝে এই জবরজং হাতকড়া পরা অবস্থায়।
দুবার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেললো অরু। ছোট ছোট ধাপ--বেবি স্টেপস।
প্রথমেই হাতজোড়া মুক্ত করতে হবে। কিন্তু তার দুইহাত পিছমোড়া করে বাধা। একহাত দিয়ে আরেকহাত খোলা যাচ্ছেনা।কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকলো অরু। বন্দিনীর মতন আবছা গুঙিয়ে হাতের বাঁধন ঢিলা করবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাতীর দাঁত দিয়ে বানানো হাতকড়ার বাঁধন ঢিলা করা যাচ্ছে না। শক্ত হয়ে এঁটে আছে হাতের ওপর। কোনদিন এভাবে অবশ হয়ে আসেনি অরুর শরীর। নিজের নতুন সাজপোশাকে নড়ে বেড়াতে ভালোই শিখেছিলো সে। আজকে কোনভাবেই আর কিছু মনে পড়ছে না। রোসি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তার হলদে পোস্টারের থেকে। তার ঠোটে আবছা বিদ্রূপের হাসি।
ওর দিকে তাকিয়ে অরুর মেজাজ খারাপ হয়। ওকে জিতে যেতে দেয়া যায়না। একটা নির্জীব পোস্টারের চাইতে একটা আস্ত মানুষের শক্তি বেশি। অনেক বুদ্ধি অরুর মাথায়-কিছু একটা খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে সে। এই সিঁথিকাটা সিঁদুরের তলে থকথকে মগজ।
ভাবো অরু-ভাবো। কিছু একটা উপায় বের করো। তোমার অস্তিত্বে তোমাকে বেচে থাকতে শিখতে হবে।
বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর অরুর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। একটু বিপজ্জনক,কিন্তু বিকল্প ভাবার সময় নেই।
কোনমতে খাটের মাথার শক্ত কাষ্ঠল জায়গাটার কাছে সে হাতজোড়া নিয়ে গেলো অরু। এরপর জোরে জোরে শাখাজোড়াকে ঠুকতে লাগলো। ঘরের সবাই শ্বশুরের মনোরঞ্জের জন্য ঘর গোছাতে ব্যস্ত--আর বাইরেও কনস্ট্রাকশনের বড্ড খুটখাট।নইলে এই শব্দ শুনে নির্ঘাত তাদের মনে হতো অরু একলা দেয়ালে মাথা ঠুকছে।
শাখাজোড়া ভেঙ্গে গেলো।অরুর হাত এবারে মুক্ত। অনেকক্ষণ পরে অরুর নিজেকে একটু মানুষ মানুষ লাগতে লাগলো।
হাত মুক্ত হবার সাথেসাথেই গলার ফাঁস খুলে ছুঁড়ে ফেললো অরু।কিন্তু পা-জোড়া তখনও বাঁধা। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করেও অরু খুব একটা জুত করতে পারলো না।
উলটো বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়লো অরু। হাজার বছরের সনাতন ক্লান্তি তার উপর ভর করে পড়লো যেন।
ক্লান্তির ঠেলায় একটু বিশ্রাম নিতে নিতেই অরুর মাথায় ফের একটা বিপজ্জনক বুদ্ধি খেলে গেলো। একটি একটি করে হাত পা মুক্ত না করে সে একবারে পুরো শরীর দোলাতে শুরু করলে একবারে পুরো দেহ নিয়ে খাট থেকে নিচে পড়তে পারে সে। যেভাবে তার সমগ্র শরীর পেঁচিয়ে রয়েছে-কোনদিন সব ছাড়িয়ে উঠতে পারবে বলে মনেও হয়না। তাই মুক্তি পেতে গেলে সমগ্র শরীরকেই বিসর্জন দিতে হবে একত্রে।
কিন্তু সমস্যা হলো,সবার আগে যদি মাথাটা পড়ে মাটিতে ঠুকে যায় তাহলে মারাত্মক ব্যাথা পাবে,জ্ঞানও চলে যেতে পারে। এই মূহুর্তে আর যা-ই হোক,অজ্ঞান হওয়া চলবে না।
বেল বাজলো। ঘরের ভেতর একটা শোরগোল পড়ে গেলো। শ্বশুরমশায় এসেছেন। মা দৌড়ে দরজা খুললেন,বাবা বললেন, আসুন বেয়াই আসুন। অনেকদিন পরে এলেন।আছেন কেমন?শরীরস্বাস্থ্য ভালো?
শ্বশুর পরমেশ্বর বড় কৃপা করে বললেন, হুম।
প্রায় কাঁধে করে তাকে নিয়ে বসার ঘরে বসালেন বাবা। মা টেবিলে সাজালেন দশব্যঞ্জন।
শ্বশুর বললেন, ‘এতসব খাবোনা।বৌমা কোথায়?তাকে ডাকুন। লোকলস্কর সব বসে আছে তার জন্য।’
‘অরু!বেয়াইসাহেব এসেছেন।এদিকে আয় মা!’
‘সন্তানকে তুই করে ডাকবেন না। সম্মান না পেলে সম্মান দিতে শেখেনা শিশুরা।’
শ্বশুরের উপদেশ শিশুর মতন গিলে নেন বাবা। বিগলিত কন্ঠে বলেন, ‘তা তো বটেই!’
তারপর মিহিগলায় নিজের মেয়েটিকে ডেকে নেন- “মা অরু-এসো মা,তোমার শ্বশুরমশায় অপেক্ষা করছেন’
অরুর আর কোন উপায় নেই। যা হবার হোক,তাকে এখন বিছানা থেকে নামতেই হবে। শরীরটা দুলিয়ে দুলিয়ে সে অভিকর্ষের মায়ায় বিছানা থেকে গড়িয়ে দিলো। ধুপ করে একটা শব্দ এলো অরুর ঘর থেকে।
‘কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ হলো বোধহয়!ওটা অরুর ঘর না?’ শ্বশুর বললেন।
‘মা,অরু।তুই ঠিক আছিস?’ মায়ের কন্ঠে উৎকন্ঠার ছোঁয়া।
প্রবল ব্যাথায় অরুর সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। কোমরের কোন একটা হাড্ডি ভেঙ্গে গেলো নাকি?
‘অরু, কি হলো তোমার? তোমার শ্বশুরমশাই অপেক্ষা করছেন।দরজা খোল এক্ষনি।’ শব্দটা বুঝি শুনতেও পাননি বাবা।
অরু কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না। তার বাবা অথবা শ্বশুরমশাই কি কখনো বুঝবেন অরুর কি হয়েছে? অরুর যা হয়েছে তা কি বাবা অথবা শ্বশুরমশায়ের সাথে কখনও হওয়া সম্ভব? হয়তো সম্ভব! হয়তো তিনি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তারা রায়বাবু আর ‘চক্কোত্তি মশাই’ থেকে হঠাৎ করে বুড়ো দাদুভাই হয়ে গেছেন! তাদের আবাসস্থল বৃদ্ধাশ্রম।
কোলাপুরি চপ্পলের আওয়াজ শোনা গেলো। শ্বশুরমশাই ঘরে ঢুকেও চপ্পল খোলেননি। চপ্পলের শব্দ আগাতে আগাতে অরুর ঘরের সামনে এসে থামলো।
ওপাশের দরজা থেকে নিরু ফিসফিস করে বললো, ‘দিদি,তালৈমশায় আসতেসে তোর ঘরের দিকে।’
‘আমি জানি’
আর কেউ শুনে ফেলার ভয়ে চাপা স্বরে নিজেকেই বলে অরু।
‘অরু!’ বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
‘তোমার শ্বশুরমশায় জিজ্ঞেস করছেন তুমি কেন সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হওনি । তুমি বরং নিজেই একবার ওনার সাথে কথা বলে ওনাকে বুঝিয়ে বলো।তাড়াতাড়ি দরজাটা খোল মা। ঘরদোর একটু নোংরা থাকলেও সমস্যা নেই’-দরজা খোলার আগে ঘরটা একটু গুছিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে দিলো বাবা।
‘ওর শরীরটা ভালো নেই’ মা শ্বশুরমশাইকে বুঝ দেবার চেষ্টা করছে।
‘বিশ্বাস করুন,ওর শরীরটা বড্ড খারাপ। নইলে আমার অরু প্রতিদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের সব্বাইকে ডেকে তোলে। তারপর আমাদের নাস্তা বানিয়ে খাওয়ায়।ওর রান্নার হাত কিন্তু চমৎকার,আপনারা অবশ্য খেয়েই দেখেছেন।ও কিন্তু সব নিজেই শিখেছে,আমি কিছুই শেখাইনি’
মিথ্যের পাহাড় বানাচ্ছে মা।
‘ও প্রতি সন্ধ্যায় নিজের থেকে ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রদীপ জ্বালায়।আজকালকার সব ছেলেমেয়েদের ঠাকুরদেবতার থেকে ভক্তিশ্রদ্ধা উঠেগেছে।আজ নিশ্চয়ই প্রচন্ড শরীর খারাপ।নয়তো ও সূর্যপ্রণাম করতে ভুল করে না। শাস্ত্রে অসুস্থ শরীরে সূর্যপ্রণাম না করার বিধান রয়েছে। আপনি নিজেই এখন ওর ধর্মানুরাগের লক্ষণ দেখবেন।রাতের বেলাতেও শাঁখা খুলে শোবেনা। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সিঁদুরের দাগ একটুকুও ফিকে হতে দেয়নি।এখন দরজা খুললে আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।’
‘তাই হবে হয়তো। শরীর খারাপ ছাড়া এই ব্যবহারের আর কোন ব্যখ্যা থাকতে পারে না। আশা করি বড় কিছু নয়। তবে বাড়ির বৌদের সামান্য শরীর খারাপটারাপ থাকলেও একটু আপোষ করেই নিতে হয়। নইলে বাকি সবার কাজের কেমন ব্যাঘাত ঘটে দেখতে পাচ্ছেন তো?’
‘শ্বশুরমশায়কে ভেতরে আসতে বলবো?’ বাবার গলার স্বরে অস্থিরতা
‘না!’
অরুর দরজার সামনে একটা অস্বস্তিকর নিরবতা।ওপাশের দরজার সামনে নিরুর ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়। নিরু বাকিদের সাথে নেই কেন? ও বোধহয় মাত্র ঘুম থেকে উঠলো। কিন্তু ও কাঁদছে কেনো? হয়তো ওর মনে হচ্ছে অরুর বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে এখুনি।
মা আবার সারারাত ধরে কাঁদবে।
বাপির হ্যান্ডব্যাগে খুঁজে পাওয়া যাবে সিগারেটের প্যাকেট।
দিদির ব্যাগে মদের বোতল।
মহিমা পিসি দিদির পূর্বতন প্রেমিকদের কথা তুলে তুলে খোঁটা দিতে দিতে বলবে, ‘ওই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?’
মাহিন ভাইয়া আবার বাসার সামনের রাস্তার উপর সারাদিন বসে থাকবে।
না,এখনো সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।এখনো অরুর নিয়ন্ত্রনের মাঝে আছে সবকিছু। এখনও সবকিছু প্ল্যানমাফিক আগাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কেউ কিচ্ছু জানেনা।
এই মুহুর্তে অরু শুয়ে আছে ঠান্ডা মোজাইকের মেঝের ওপর। এখনো পর্যন্ত সবাই আশা করছে এক্ষুনি সে উঠে দাঁড়িয়ে শ্বশুরমশায়ের জন্য দোর খুলে দেবে। এখনো পর্যন্ত সামান্য বেয়াদবি ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি। এইটুকুর জন্য কোন না কোন অজুহাত একটু পরেই দিয়ে দেয়া যাবে। এইটুকুর জন্যে কারো বিয়ে ভাঙ্গে না।এইটুকুর জন্যে বউরা কেবল একটু নাক সিটকানি খায়।
বাংলাদেশের মেয়ে অরু। নাক সিটকানি খাবার অভ্যাস আছে তার।
শ্বশুরমশায়ের গলার স্বর এবার উঁচুতে উঠলো, ‘বৌমা, কি হলো! তুমি আমাকে আর তোমার বাবা মাকে দরজার সামনে দাড় করিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে হ্যাঁ-হু করছো কেন? তুমি কিন্তু আমাকে প্রচন্ড বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছো। আমি কস্মিনকালেও কোন ভদ্রঘরের বৌকে এমন কান্ড করতে দেখিনি। আমার ধারণা ছিলো তুমি একজন বুদ্ধিমতি ও ভদ্র মেয়ে। অথচ আজ মনে হচ্ছে তুমি একেবারে কঠিন বেয়াদব। বাবা মা তোমাকে কিচ্ছু শেখাননাই নাকি?’
‘বাবা!’
মেঝেতে পড়ে থেকেই উত্তেজনার ঠেলায় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে অরু চিৎকার করে বলতে লাগলো
‘আমি এখনই দরজা খুলছি,আমি একটু অসুস্থ। একটু মাথা ধরেছিলো,এতক্ষণ বিছানাতেই ছিলাম। এখন একটু ভালো লাগছে,আমি বিছানা ছাড়ছি। একটু দাঁড়ান। হঠাৎ করে কি যে হলো বুঝতে পারছি না। কাল রাতেও আমি একেবারে ঠিকঠাক ছিলাম,বাবা মা কে জিজ্ঞেস করে দেখুন। রাতেই সামান্য মাথা ধরেছিলো,পাত্তা দেইনি।আপনাকে তখনই জানানো উচিত ছিলো। ভাবলাম রাতে ঘুমালেই সেরে যাবে। কিন্তু...আমার অসুখের জন্য আমার বাবা মা কে কষ্ট দেবেননা প্লিজ। আপনি বাসায় চলে যান,আমি একটু পরেই আসছি। দয়া করে একটু মা-কে বলবেন যাতে আমাকে ভুল না বোঝেন।’
কথাগুলো মুখ থেকে বের করতে করতে অরু কোনমতে আলমারির কাছে এগুতে থাকে। সে এবার আসলেই দরজাটা খুলতে চাচ্ছে। শ্বশুরমশাইকে তার পূত্রবধূর চন্দ্রবদনখানা দেখাতে চাচ্ছে। সবাই কৌতূহলে এতো ফেটে পড়ছে যে অরুর এখন সত্যি দেখতে ইচ্ছে করছে যে তাকে দেখার পরে সবাই মিলে কি এমন করে উলটে ফেলবে! সেগুন কাঠের মসৃণ আলমারি বেয়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও অরু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।কোমরে আর কব্জিতে মারাত্মক ব্যাথা-তবু সেদিকে মনোযোগ দেবার মতন অবস্থা এখন অরুর নেই। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই বাইরে শ্বশুরমশায়ের কথা শুনতে পায়।
‘আপনারা কি ওর কথার একটা লাইনও বুঝেছেন? ও কি আমাদের সাথে মস্করা করার চেষ্টা করছে? এভাবে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে পাগলের প্রলাপ শোনানোর মানে কি?’
‘হে ঠাকুর’
মায়ের গলার স্বর শুনেই বোঝা গেলো যে মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
‘মেয়েটার হয়তো খুব অসুখ করেছে আর আমরা ওকে অকারণে কষ্ট দিচ্ছি।নিরু!এই নিরু!’
‘আজ্ঞে মা!’
দরজার ওপার থেকে ডাক শুনলো নিরু। অরুর ঘরকে মাঝখানে রেখেই তারা দুইজন কথা বলছে।
‘দৌড়ে ডাক্তার আংকেলকে ডেকে নিয়ে আয়!অরু খুব অসুস্থ!দৌড়ে যা!শুনছিসনা অরু কেমন জ্বরের ঘোরে উল্টোপাল্টা বকছে!’
‘জ্বরের ঘোরে কেউ এতো জোরে চিৎকার করে না! শুধু পাগল ছাগলই এমন চিৎকার করে উল্টোপাল্টা বকতে পারে। মেয়ের নির্ঘাত মাথায় সমস্যা আছে!’ মার কন্ঠে যতটা উত্তাপ শ্বশুরের কন্ঠ ততটাই নিরুত্তাপ।তিনি পাগল মেয়ে গছিয়ে দেয়ার অপরাধে বেয়াই বেয়ানকে অভিযুক্ত করতে ব্যস্ত।
‘শিউলি!এই শিউলি!’-কাজের মেয়েকে ডাকছে বাবা। ‘একজন তাল-চাবিওলা নিয়ে আয় এক্ষুণি-দৌড় দে!’
মুহুর্তে দুইজন বালিকা সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
হাট করে দরজা খুলে যাবার শব্দ পাওয়া গেলো!
দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা গেলোনা। দরজা তাহলে ওরা খুলে রেখেই চলে গেছে। দরজা খুলে রাখা বড় অমঙ্গলের কাজ!কেউ মারা গেলে-মরাবাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকে।
বাইরের ধুদ্ধুমারের তুলনায় অরু বরঞ্চ এই সময়ের মাঝে আরও শান্ত হয়েছে। ওদের কাছে অরুর কথাকে প্রলাপ মনে হচ্ছে। যদিও নিজের কাছে তার কথাগুলো পানির মতন পরিস্কার! হয়তো বুকের কথা মুখ দিয়ে বের হতে গিয়ে মগজের হস্তক্ষেপে এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাচ্ছে। তবে কমপক্ষে সবাই এতোটুকু তো বুঝতে পারলো যে ওর কিছু একটা হয়েছে আর ওর সাহায্য দরকার। যাক তবু তো ভালো। বাবা-মা ভালোই জানেন যে ক্লাস টেনে থাকতেই ওর ম্যানিক ডিপ্রেশন ধরা পড়েছিলো। হয়তো সেটার কথা এতোক্ষণে মনে পড়েছে মায়ের। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে নববধূর বদলে মানুষ মনে হচ্ছে অরুর। তার জন্য ডাক্তার ডাকা হচ্ছে-তালা চাবিওলা খোজা হচ্ছে। মিসেসদের জন্যে এতোকিছু করা হয়না কখনো।
ততক্ষণে পাশের ঘরে একটি অপার্থিব নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। গুরুজনেরা সবাই সম্ভবত দরজায় কান লাগিয়ে অরুর পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে আছে।
‘শুনুন’ বাবার গলায় আনন্দ স্পষ্ট। ‘দরজার নব ঘোরানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।‘
‘সাবাশ অরু!’ মায়ের কন্ঠে অবিশ্বাসের আতিশয্য! যেন দরজা খোলার চেয়ে বড় কোন কাজ অরু কখনো করেনি!
‘পারবি মা!তুই পারবি,একটু কষ্ট কর,আরেকটু সহ্য কর।’
অবশেষে দরজাটা খুলতে লাগলো। দরজাটা আর ভাঙ্গা লাগলো না।
তালাচাবিওলারও দরকার পড়লো না।
দরজাটা ভেতরের দিকে খোলে।তাই পুরোপুরি দোর খোলার আগে অরুকে দেখা গেলো না। যখন দেখা গেলো তখন শ্বশুরমশায়ের মুখ থেকে সজোরে ‘হে ঠাকুর!’ ধ্বন্যাত্মক একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে এলো। এবারে অরুও শ্বশুরমশায়কে দেখতে পেলো।তার দুহাত মুখের ওপর। অতি বিস্ময়ে গাল ঝুলে পড়েছে। অরুর মা হতভম্ভ ও হতবুদ্ধি হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। তার দৃষ্টিতে আতঙ্ক আর লজ্জার এক অপূর্ব সংমিলন ঘটেছে।
তবে বাবা মুখভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন। অর্ধনগ্না রক্তমাখা কন্যাকে দেখে তার বরঞ্চ মুঠো শক্ত হয়ে এসেছে। তিনি কন্যাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে তাকে এহেন বেয়াদবির জন্য একচোট শিক্ষা দেবার কথা ভাবছেন। তবে ইস্পাতকঠিন সেই দৃষ্টির মাঝে চোখের মনিটি একটু ভয়ে কেঁপে গেছে।মানবতার সবচেয়ে আদিম অকৃত্রিম আবেগ-ভয়! এই ঘরটিকে এখন সেই আদিম অকৃত্রিম আবেগ জাপটে ধরেছে।
তবে অরুর খুব একটা ভাবান্তর হলোনা। অর্ধনগ্নিকা সদ্যবিবাহিতা উন্মাদিনী ঘরে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো না। সে বরং দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তার দুচোখে হাজার শতাব্দির সনাতন ক্লান্তি ভর করেছে।
ইতোমধ্যে বেলা গড়িয়েছে। গাড়ির হর্ন আচ্ছাদিত করেছে পাখির কলরবকে। সোনালী আলো সাদা হয়েছে। করিডোরের সরু জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়না। একটা ইংরীজি মিডিয়াম স্কুল দেখা যায়। স্কুলের বাচ্চারা পড়ে ব্রিটিশ কারিকুলাম। বাঙ্গালিত্বের ছোঁয়া বিবর্জিত। এরা পরিচয়হীন-বাবা বলেন। নিজের সংস্কৃতি-তা যেমনই হোক-নিজের পরিচয়। নিজেরটাই শ্রেষ্ট। তাই নাস্তার টেবিলে বাবা সবসময় বাজাবেন রবীন্দ্রসংগীত-মায়াবন বিহারীণী হরিণী। হরিণীকে জয় করবে শিকারী। তাকে ধরবার পণ করবে। নারী ছলনাময়ী-ছলাকলা করবে সে। সিংহী হয়ে শিকারীকে শিকার করা তার পক্ষে দোষনীয়।
এখনও বৃষ্টি পড়ছে। রোদ আর বৃষ্টি একসাথে। ভালুকের জ্বর। ছোটবেলায় অরু খুব চমৎকার ছড়াগান করতো। একবার ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছিলো। সেইটা বাধাই করা ছবি ঝুলছে বসার ঘরে। ঠোঁটে তার আত্মদাম্ভিক হাসি। যেন চাইলেই সে জয় করতে পারে বিশ্বকে।
দরজাটা এখনো হাট করে খোলা। সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। সিড়ির মুখে অরুর বিয়ে উপলক্ষ্যে নিরুর আঁকা আল্পনাটাও দেখতে পাচ্ছে অরু।
‘আচ্ছা’- অরু জানে যে এই মুহুর্তে এই ঘরে শুধুমাত্র সে-ই সচেতন অবস্থায় আছে।
‘আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি,একটু ব্যাগটা গুছিয়ে নেবো আর এরপরই রওনা দেবো। আমাকে একটু পাঁচটা মিনিট সময় দিন শ্বশুরমশাই! আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি যে আমি মোটেই আলসে বা পাগল কোন মেয়ে নই। আপনাদের ঘরে বৌয়ের জীবন হয়তো একটু কঠিনই হয়ে যাচ্ছে আমার জন্যে কিন্তু এছাড়া আমি বাবা মার মুখে হাসি ফুটাতে পারবো না। আপনি তাহলে শাশুড়ি মা-কে দয়া করে সবটা বুঝিয়ে বলবেন।নাহলে তিনি আবার এই ঘটনার ভুল ব্যখ্যা দাঁড় করাবেন। হঠাৎ করে যে কেউই একটু অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারে। ওনাকে একটু মনে করতে বলবেন কিভাবে একয়টাদিন আমি একনিষ্ঠভাবে আমার সব দায়িত্ব পালন করেছি আর একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি আবার ওগুলো করতে শুরু করবো। আমি একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আটকে গেছি ঠিকই কিন্তু আমি ঠিক এর থেকে বেরিয়ে আসবো। আপনি ভালোমতোই জানেন যে আমার বাবা মায়ের সুখের জন্যে আমি ওনার ওপর কতটা নির্ভরশীল। ওনার একদিনের একটা কটুকথা আমার বাবা মা কে এক মাস পর্যন্ত ঘুমাতে দেয়না। প্লিজ আমার জীবনটাকে আরো কঠিন করে দেবেন না। প্লিজ! বাবা! আমার কথার মাঝে চলে যাবেন না। এতো পরিশ্রমের পর এই সামান্য ঘটনার জন্য সবকিছুকে নষ্ট করে দেবেননা প্লিজ!’
কিন্তু অরু কথা বলা শুরু করবার সাথে সাথেই শ্বশুরমশায় উল্টোফিরে পালানোর পথ খুজতে শুরু করেছিলেন। আর যেতে যেতে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত কপাল মুছতে মুছতে পিছন ফিরে উন্মাদ পূত্রবধূর ভীষণ রূপ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তিনি খুব আস্তে হাটছিলেন-যেন কোন শক্তি তাকে ঘর থেকে বের হতে বাধা দিচ্ছে। তবে দোর দিয়ে বের হতেই হঠাৎ তার শরীরে দুনিয়ার শক্তি ভর করলো। সিড়ি দিয়ে সন্ত্রস্তপদে দুদ্দাড় করে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।
অরু বুঝতে পারছিলো যে এরকম অবস্থায় শ্বশুরমশায়কে চলে যেতে দেবার প্রশ্নই আসেনা। এইটুকু ঘটনার প্রভাব হয়তো অরুর বাবা মা ঠিকমতো বুঝতেই পারছে না!তাদের ধারণা তাদের কন্যা শ্বশুরালয়ে মহাসুখে আছে।অরুর কাছে তারা তেমনই শুনেছে। তাছাড়া বাবা মার টেনশন করার আরো বহু বিষয় আছে। তারা বর্তমান নিয়েই এতো দুশ্চিন্তিত যে ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় তাদের নেই।
তবে সবাইকে খুশি রাখতে গেলে অরুকে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে। শ্বশুরমশায়কে এখন আটকাতে হবে,ঠান্ডা করতে হবে,বুঝাতে হবে আর অতঃপর তার মন জয় করতে হবে। অরুর যাবতীয় আত্মত্যাগের ভবিষ্যত এটার উপর নির্ভর করে।
অরু চেষ্টা করলো তার শ্বশুরমশায়ের পেছন পেছন দৌড়ে যেতে।কিন্তু চেষ্টা করতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো সে। মাটিতে মাথা ঠুকে গিয়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেলো।এমন হচ্ছে কেন? নিজের শরীরকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অরু।
‘হে ঠাকুর! এই অরুর বাবা-অরুকে একটু ধরো। মেয়েটা ব্যাথা পাচ্ছে তো-কষ্ট পাচ্ছে তো’-মায়ের কন্ঠে হাহাকার।
মা আজন্ম ভীতু মানুষ। আজকের এই ভয়াবহ ঘটনায় সে বরং আরো বেশি ভয় পেয়ে গেছে। দরজা খুলে অরুকে দেখতেই সে ভয়ে লাফিয়ে সরে আসতে গিয়ে মাংসের বাটি উলটে দিয়েছে। মাংসের ঝোল গড়িয়ে পড়ছে বহুমূল্য কার্পেটে। অন্যদিন নিরু কার্পেটে একদানা ভাত ফেললেও ঘরে লংকাকান্ড ঘটে যায়-তবে আজ তার কার্পেটের দিকে খেয়ালই নেই।
‘মা,ও মা! মাগো!’ প্রথম বুলির মতন পরম মমতা আর স্নেহে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো অরু।
অরুর কান্নাভেজা আর্তনাদ শুনে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। অরু জীবনে কখনো মাকে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে দেখেনি-এই প্রথম।
তবে এখন তার বাবা মায়ের রোমান্স দেখার সময় নেই। তার শ্বশুরমশায়কে আটকাতে হবে। ভদ্রলোক এতোক্ষণে সিড়ির গোঁড়া পৌঁছে গেছেন। তার দুদ্দাড় করে নামার শব্দ গোটা সিড়িঘরে অনুরণিত হচ্ছে।
অরু দৌড়ে পিছনে যাবার চেষ্টা করলো-কিন্তু ততক্ষণে আর কোন লাভ নেই।
শ্বশুর আসলেই চলে গেছে-এটা বুঝতে পেরে বরং অরুর বাবা ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেলেন। শ্বশুরের পিছনে পিছনে গিয়ে তাকে আটকানো এমনকি অরুকে সাহায্য করার বদলে টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে গোল করে পাকিয়ে অরুর দিকে তেড়ে এলেন। তার ভাবসাব দেখে মনে হলো ছোটবেলার মতন করে তিনি অরুকে পিটিয়ে তক্তা করে দেবেন।
অরু যতই করুণ স্বরে কেদে কেদে বাবার ক্ষমা ভিক্ষা করে-বাবা ততই বেগে তেড়ে আসে। শ্বশুর তাড়ানো মেয়ে অরু-তার কোন দয়ামায়া প্রাপ্য নেই।
বাবা এগিয়ে আসতে লাগলেন। আজ অরুকে তিনি পিটিয়েই সোজা করে দেবেন। অরু ভয়ে উলটো ঘুরে ঘরে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো। সেই ছোটবেলা থেকেই অরু বাবার মারকে অনেক ভয় পায়। বাবা খুব রেগে গেলে ফোস ফোস করে ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়। ফোস ফোস শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরুর বড় ভয় হয়।
অরু ভয়ে চিৎকার করে কেদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে সে হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। সাথেসাথে অরুর বাবা ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। অরু বাবার ভয়ে গুটিশুটি মেরে খাটের নিচে লুকিয়ে মুখ চেপে ধরে আতঙ্কে কাঁদতে থাকে। সেই কান্নার শব্দ বাইরে শোনা যায়না।
অনেকক্ষণ পর রায়বাড়ির সরগরম বন্ধ হয়ে চারিদিক কেমন একটা ভোঁতা নিরবতা নেমে এলো।

ওর কি হলো হঠাৎ করে বলো তো! ছোটোবেলায় তো ওর এরকম কিছু মানসিক সমস্যা ছিল-সেইসবই কি আবার ফিরে আসলো না কি? আমার তো লক্ষণ বড় সুবিধার মনে হচ্ছেনা।
ফিরে আসবে না তো কি? অসুস্থ একটা ঘর বানায়ে রাখসো তুমি। ঘরভর্তি পর্দা-সারাঘর অন্ধকার করে দিয়ে রাখা। এই ঘরে থাকলি তো মানুষ এমনিতেই অসুস্থ হয়ে যাবে। তোমার মাথায় হাজারটা সমস্যা আর সেইসব তুমি ঢুকাইসো তোমার মেয়ের মাথায়।
তোমার মেয়ে! অরু যখন গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হতো তখন সে ছিলো আমার মেয়ে আর আজকে একটু পাগলামি করলো আর সাথে সাথে আমার মেয়ে?
মায়ের মাথায় উত্তরটা এসে ঘুরপাক খেতে থাকে। মাথার থেকে ঠোটের ডগা পর্যন্ত চলে আসে, কিন্তু জিহবা সামলে নেয় মা। এমনিতেই ঘরে এক অশান্তি চলছে। আরেক অশান্তি শুরু করার কোন মানে হয়না এখন আর। অশান্তি ভালো লাগেনা একদম।
বিয়ের পরের থেকেই কেমন যেনো পাগল পাগল ভাব করতেসে আমার মেয়েটা। বিয়েটা কি ওর ভালো দিতে পারলাম না, সন্ধ্যা? ওই তো কতোবার বললো যে ওর ছেলে পছন্দ।
তা অবশ্য ঠিক। অনেক পরিশ্রমের পরে এই ছেলেটাকে পছন্দ করেছে অরু। কতো ছেলেই তো দেখানো হলো ওকে। রায়বাড়ীর বড়ো মেয়ে-রায়বাড়ির সুন্দরী মেয়ে। কলেজে ওঠার পরের থেকেই তো একের পরে এক প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। ইউনিভার্সিটিতে ওঠার আগে তো একজনকেও দেখানওনি মা। নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন জমিয়ে। আর একেকজনের বিয়ে হয়েছে আর তার ছবি ফেলে দিয়েছেন। একটা ছেলে ছিলো বুয়েটের প্রফেসর-ইশরে। মেয়েটা আরেকটু বড় হলেই সাজিয়ে গুজিয়ে ছেলের সাথে আড়ং এর শো-রুমে পাঠিয়ে দেয়া যেত।
তবে মেয়েকে মুক্তির রাস্তা যে দেননি ওরা তা কিন্তু নয়। যদি মেয়েটা ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং গোছের কিছু পড়তো, তাহলে কিন্তু বিয়ে দেয়ার জন্যে এতো পাগলামি করতো না কেউ। কিন্তু মেয়ে পড়বে সোশিওলজি-পাশ করে খাবে কি? এই মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারলে বাবা-মায়ের বদনাম।
কাজেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই প্রতি মাসে নিয়ম করে তিনজন করে পাত্র বাতিল করতে হতো অরুর। এ বেশি ফর্সা, এ বেশি কালো, এ বেশি মোটা আর এ বেশি চিকন। কোন না কোনভাবে একটা না একটা খুত বের করেই ফেলতো। আসলে নিজেকে খুব বেশি সুন্দরী মনে করতো বোধহয়-মা ভাবেন। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ওরকম একটু মনেই হয় সবার। মা যখন সন্ধ্যামালতী ছিলেন তখন তার পেছনেও কতো ছেলে ঘুরঘুর করতো-কতোজনে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে চাইতো। কিন্তু তাদের কথায় ভুলে গেলে তো আজকের এই জীবন পেতেন না মা। মিসেস রায় হতে পারতেননা কোনদিন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের লেডিস ক্লাবে গিয়ে র‍্যাফেল ড্র তে আয়রন জিততে পারতেন না।
অরুরও একই সমস্যা ছিলো। সব ছেলেপুলে ঘুরঘুর করতো ওর চারপাশে। আর তাদেরকে খুব পাত্তাও দিতো সে। অথচ একটাও জাতের না। একজন গাঁজাটি তো আরেকজন বেকার তো আরেকজন চোল্লিশোর্ধ প্রাইভেট টিচার-আর প্রত্যেকেই কবি। এদের সাথে তো আর সত্যিকারের বিবাহিত জীবন কল্পনা করা যায়না।
অরুও জানতো সেটা। সেজন্যেই এদের এতো পছন্দ করতো সে। এমন সব ছেলেপুলে যারা নিজেরাও হয় কোনদিন বিয়ের কথা নিজেরাও চিন্তা করেনা-অথবা চিন্তা করলেও অরুণিমাকে সেটা নিয়ে জ্বালানোর সাহস পাবেনা। অরু চেয়েছিলো এদের একেকটাকে পুষে রাখতে যাতে করে অন্যান্যদের থেকে বেঁচে ফেরা যায়। বাইশ বছর বয়েসী যুবতী অবিবাহিত সোশ্যাল সায়েন্টিস্টকে কেউ কাজল-টিপ-শাড়ি আর কবিমার্কা প্রেমিক ছাড়া কেউ এখনো কল্পনা করতে শেখেনাই। কাজেই রোজ রোজ নতুন অপ্রত্যাশিত কবিতা শোনার চেয়ে প্রত্যাশিত আধাবুড়ো ছড়া আওড়ানোই অরুর জন্যে সহজতর ছিলো।
অরুর আসল ভালোবাসা ছিলো সোশ্যাল সায়েন্স।বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে একটা বই লেখার ইচ্ছে ছিলো ওর। প্রথম চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়েছিলো-একটা পেপারও ছাপা হয়েছিলো কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়া জার্নালে।
কিন্তু ততদিনে অরু বড়ো হয়েছে। আরো প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। আড়ং এর শোরুমে যেতে হয় তার প্রায়ই। গিয়ে গল্প করার ছলে অদ্ভুত কিছু প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হয়। আজীবন গৎবাধা কনভেয়ার বেল্টে বেঁচে আসা ছেলেগুলো সারাদিন চেষ্টা করতে থাকে কেমন করে নিজেদের খুব রহস্যময় আর আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে। গান পারে-গিটার বাজায়-কবিতা লেখে-সিনেমাখোর ইত্যাদি বহু জাতের ছেলেপুলেই দেখা হলো-কাউকেই এতোটুকু জাতের মনে হলো না। জাতের হলে কি আর পাতানো বিয়ে করতে আসে?
মুরোদ থাকলেই তো নিজেই প্রেম করতে পারে।
আরে না দোস্ত! তুই এরেঞ্জ ম্যারেজকে এরকম ছোট করিসনা। অরুর বান্ধবী নুজহাত বলতো।
দেখ, আমিও আগে এমনই মনে করতাম। কিন্তু দেখ দোস্ত, অনেকেই কিন্তু তাদের পড়াশুনা নিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। প্রেম করার সময় পায়না। তার মানে তো এই না যে চাইলে প্রেম করতে পারতো না। আমার জামাই কিন্তু খুব রসিক মানুষ-অথচ জীবনে একটাও প্রেম করেনাই।
এখনও বিয়ে হয়নি নুজহাতের। বিয়ের কথাবার্তা চলছে কেবল। ছেলের সাথে স্কাইপে কথা হয়েছে একদুইবার। তাতেই জামাই জামাই করে আহ্লাদে গদগদ হচ্ছে সে।
তোর ভাইয়ার যে কি রসিক মানুষ অরু, কি বলবো তোকে! আমার জন্যে এরই মধ্যে একটা হিরের আঙটি কিনে পাঠিয়েছে। আমি বললাম বিয়ে আগে এসব কেনো? আমি তো গয়নাগাটি পরতে পছন্দও করিনা। সে বলে কিনা, তুমি পরবে বলে তো আংটিটা পাঠাইনি-দোকানে আংটিটাকে দেখলাম আর মনে হলো আমাকে বলছে যে আংটিটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে পরতে চায়। তাই সাথে সাথে কিনে পাঠালাম তোমার জন্যে। দেখ কি কান্ড! এই দেখনা কতোবড়ো সাইজের হিরা। দেখ! এতোবড় হিরে সারাদিন পরে থাকা যায়?
অরু নুজহাতের আঙ্গুলের বিশাল হিরার আংটি দেখে, দেখে বিমোহিত হবার চেষ্টা করে, কিন্তু বিমোহিত হতে পারেনা। ঘেন্নায় তার গা শিরশির করতে থাকে।
বাবাকে বলেছি বিয়ের অনুষ্ঠান সেনাকুঞ্জে করতে, বুঝলি? বিয়েতে আমি পরবো সাবিয়াসাচি লেবেলের ডিজাইনার লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গা এর মাঝেই অর্ডার করা হয়েছে বুঝলি? সাবিয়াসাচি কিন্তু খুব বিখ্যাত লোক। তোরও পছন্দ হবে দেখ, সেইভ বেঙ্গলি হ্যান্ডলুম হ্যাশট্যাগ দিয়ে ছবি আপলোড করেছে।
আচ্ছা, কতো টাকা খরচ করতেসিস তুই বিয়েতে? তোর আব্বুর কষ্ট হয়ে যাবে না?
টাকা কি আর আমার দেখার দায়িত্ব নাকি? জীবনে তো একটাই বিয়ে করবো। সারাজীবন এতো চাকরি করেছে কেন? মেয়ের বিয়েতে খরচ করবে না তো কোথায় খরচ করবে? এতো হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ছেলেকে রেখে তাদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছি-তার জন্যে ট্যাক্স দিতে হবে না?
মানে, ছেলের চেহারা তোর পছন্দ হয়নাই? তোকে কোথাথেকে কোন জামাই বেছে এনে দিলো আর তুই তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি?
কি যে বলিস না রে তুই অরু! ছেলেমানুষ বেশি সুন্দর দেখে পছন্দ করতে আছে? ধর আমি যেহেতু ফর্সা, সেহেতু একটু শ্যামলা রঙের ছেলে খুঁজে নিয়েছি যাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে তার পাশে আমাকে বেশি সুন্দর লাগে। তাছাড়া হাসবেন্ড যদি খুব বেশি সুন্দর হয় তাহলে সারাক্ষণ তোর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে কখন অন্য মেয়ের সাথে ধানাই পানাই করে। এখন আমাকে নিয়েই ছেলে সারাদিন এতো আহ্লাদে থাকবে যে আর অন্য কারো কথা ভাবারই সময় পাবেনা।
আচ্ছা, তাইলে যদি তোর হাসবেন্ড উলটা তোকে সন্দেহ করে কারণ তুই তার তুলনায় অনেক বেশি সুন্দরী?
নুজহাতের মুখ ম্লান হয়ে গেলো। সে এইভাবে ভেবে দেখেনাই।
উফ অরু! এই হলো তোর সমস্যা-কথায় কথায় তর্ক করিস শুধু। এসেছিলি আমার বিয়ের গল্প শুনতে, উলটো আমাকেই উপদেশ দেয়া শুরু করলি।
আচ্ছা স্যরি স্যরি। বল, কি দেখে পছন্দ করলি তোর জামাইকে? চিনিস না, জানিস না একটা মানুষের সাথে শুতে রাজি হয়ে গেলি?
তোর চিন্তাভাবনাই নোংরা, বুঝলি? প্রথমে তো প্রেম করবো, একজন আরেকজনকে চিনবো। তারপর যা হবার ন্যাচারালি হবে।
ন্যাচারালি কেমন করে হবে? আগে থেকেই তো তুই জানিস যে ফুলশয্যার রাতে তোদের একসাথে শুতেই হবে। এর মাঝে ন্যচারালের কি আছে? ব্যাপারটা উলটো বরং একটা টাইম বোমের মতন। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ফাটবে আর পুরোটা সময় ধরে তুই জানবি যে ফাটার সময় ঘনিয়ে আসছে।
আরে ওইরকম তো একটু করতেই হয়। তাছাড়া একসাথে এতোদিন দেখাসাক্ষাৎ করতে করতে এতো বেশি আনইজি লাগেনা। আর বিয়ের পরে জীবনটা কতো সুন্দর হয়ে যাবে সেটা ভাবতে গেলেই এইগুলা আর গায়ে লাগেনা। যখন ইচ্ছা তখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরতে যাবো, জামাইয়ের পয়সায় খাবো দাবো-কোন টেনশন নাই। স্বামীর পায়ের নিচেই ডিস্কো করার বেহেশত, বুঝলি দোস্ত?
স্বামীকে নাইলে তুই রূপ দিয়ে আঙ্গুলের উপর নাচাবি-কিন্তু শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কি করবি? রান্নাবাটা-ধোয়া মোছা--আর সাসুমা?
আরে ধুর, ওইসব খালি সিরিয়ালেই দেখায়। আমার শাশুড়ি কতো ভালো আমার সাথে। মেয়েরা নিজেদের দোষে উলটাপালটা করে আর অকারণেই শুধু শ্বশুরবাড়ির দোষ দেয়। আমার তো রান্না করতে ভালোই লাগে, আর ফ্যামিলির জন্যে একটু যদি স্যাক্রিফাইস না-ই করতে পারি তাহলে আর ফ্যামিলি বানাতে যাবার দরকার কি?
আর বিয়ের পর যে তোর বিদেশে চলে যাইতে হবে সবকিছু ছেড়েছুড়ে? তখন খারাপ লাগবে না ফ্রেন্ডদের জন্যে, আমাদের জন্যে?
ওইসব তো নতুন জীবনের জন্যে একটু করাই লাগবে। তাছাড়া আমার হাজবেন্ড আবার ওখানে খুব এসিমিলেটেড বুঝলি? তার বন্ধুবান্ধব সব হলো অরিজিনাল ক্যানাডিয়ান। তাই আমার বন্ধুবান্ধবও তো একটু আপডেট করা লাগবে। এখনকার সবাই যে একদম ভালো-সেটাও তো চোখ বুজে বলে দেয়া যায়না। বিয়েটা হলে অন্তত ছেলেপুলেগুলো বন্ধু বন্ধু ভান করে প্রেম-সুডোপ্রেম করার ধান্দা করবে না।
নুজহাত কাকে নিয়ে টিপ্পনি কাটছে ভালোমতই জানে অরু। মাহিন আর ওর সম্পর্ক নিয়ে ক্যাম্পাসে কানাকানির কোন অভাব নেই। একসাথে বড়ো হয়েছে ওরা, একসাথে একজন আরেকজনকে বড়ো করে তুলেছে ওরা। তবু কোনদিন প্রেম করেনি সরাসরি। আসলে প্রেম করার মতন কখনো এভেইলেবলই ছিলো না অরু। একটার পরে একটা বয়ফ্রেন্ড পিঠাপাঠি করে থাকতো ওর। আর এক বয়ফ্রেন্ড থাকতেও বাকি ছেলেরা লাইন মারতে থাকতো-এমনকি নিজের বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডরাও পিছু ছাড়তো না।
এইজন্যেই অরুর বান্ধবী টিকতোনা। ওর ক্লাসের মেয়েরা ওকে দেখতে পারতো না কখনোই। স্কুলে থাকতেও একই অবস্থা ছিলো। তাছাড়া নুজহাত যে কারণে সুন্দর ছেলে বিয়ে করতে চায়না-সেই কারণেও অনেকে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতোনা। বড়ো সুন্দর ছিলো অরু মেয়েটা ছোট থাকতে। গোলাপের পাপড়ির মতন গাল-টুকটুকে ঠোঁট আর ঘন কালো চুল। ওর ক্লাসের ছেলেরা তো বটেই-বড়ো ছোট সব ছেলেপুলেরাই ওর পেছন পেছন ঘুরতো। ওর বান্ধবীরা ওকে ডাকতো এটুজেড বলে কারণ এ থেকে জেড পর্যন্ত যত নাম জানা ছিলো-সবাই কখনো না কখনো অরুর সাথে প্রেম করবার চেষ্টা করেছে।
আর অরুরও যে এই মনোযোগটুকু খারাপ লাগতো তা নয়। প্রতিদিন নতুন নতুন প্রেমপত্র পেতে কারই বা খারাপ লাগে? বাসায় বাবা থাকতো ব্যস্ত সবসময় আর মাও খুব একটা আদর করতে জানতো না। তাই ভালোবাসার জন্যে পৃথিবীর কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিলো অরু।
পৃথিবী অরুকে আপন করেছিলো, আর অরুও নিজের ঘর ভুলেছিলো।
তবে একসময় অরুকে ঘর ডাকতে শুরু করলো আবার। বাবা ঘরে ফিরলো। ঢাকা শহরে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে লাগলো বাবা-মা। তিন বেডরুমের ছোট একটা ছিমছাম বাসা। সেখানে ছোটবোনকে নিয়ে সুন্দর একটা নীড় গড়ে তুললো ওরা। প্রতি মাসের শেষে ভার্সিটির থেকে ফিরে ঘরে থাকতে শুরু করলো অরু। এখন আর চাকরির চাপ নেই এতোটা। ঘরে ফিরতেই অরু মা অরু মা করে ঘর তোলপাড় করতে থাকতো বাবা।
সাতসকালে বাজারে গিয়ে টেংরা মাছ কিনে আনতেন বড় দেখে। মেয়েটা টেংরা মাছ পছন্দ করে খুব।
টেংরা মাছের সাইজ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয় অরু। টেংরার লোভে আরো বেশি বেশি করে বাসায় আসতে থাকে সে। এতো বড়ো টেংরা সে নাকি জীবনেও দেখেনাই।
এরকম একদিন বাজারে গিয়ে বাবার দেখা হলো সোলায়মান সাহেবের সাথে-বাবার অফিসের বড়সাহেব।
কি সুব্রত বাবু, আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন কবে? অনেকদিন বিয়ে খাই না।
বাবা চিন্তায় পড়ে যান। আসলেই মেয়ের বয়েস হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের খোঁজখবর রাখা হচ্ছেনা মনোযোগ দিয়ে। এতোদিন চাকরিবাকরির কাজে খুব বেশি ব্যস্ত ছিলেন। ছেলেমেয়ের খেয়াল রাখা হয়নি। এখন ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।
ছেলে খোজা শুরু হলো। এক ভাতিজি আমেরিকা থাকে। তার পাঠানো ছেলেই বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখা হলো। মেয়ে খালি বলছিলো মাস্টার্স করতে আমেরিকা যাবে-বিদেশ দেখার অনেক শখ বোধহয় মেয়েটার আহারে! বিদেশে থাকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে সেই সাধটা মিটবে।
কাজেই অরুকে আবার নতুন উদ্যমে ছেলে দেখা শুরু করতে হলো। ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে আসা ছেলেদের সাথে দেখা করতে আড়ংএর শোরুমে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। একেকবার দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ইচ্ছে করতো সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে ক্যাম্পাসে চলে যেতে-আর কোনদিন ঘরে না ফিরে আসতে। কিন্তু বাবার ভালোবাসার লোভ ছাড়তে পারলো না শুধু। টেংরা মাছের লোভে অরু একের পর এক ছেলের সাথে দেখা করতো, তাদের সাথে মিঠে মিঠে কথা বলতো, তাদের শরীরে চোখ বোলানো সহ্য করতো আর একটার পর একটা অজুহাত বানিয়ে তাদের বাতিল করতো। ভাবতো এভাবে করে ঝুলাতে থাকবে অনন্তকাল। নিজের পরিবারকে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে আর দুই জগতের থেকেই ভালোবাসা পেতে থাকবে। টিএসসিতে ফুচকা থাকবে, বাড়িতে টেংরাও থাকবে।
তবে একসময় অরু আবিস্কার করলো ঘরে আর বড়ো টেংরা আসছে না। ছোট ছোট টেংরা আসছে। মা মনোযোগ দিয়ে ঝোল রান্না করছে না-শিউলিকে দিয়ে রান্না করাচ্ছে, তরকারিতে স্বাদ হচ্ছেনা। বাবা রাতে ঘুমাচ্ছেন না, মা রাতে কাঁদছেন। বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছে যে অরুর একটা প্রেম রয়েছে। সবাই ভাবছে সেইজন্যেই কোন ছেলে পছন্দ করছে না। এ আবার কোন নতুন বিপদে ফেললো অরু! সারাজীবন শুধু বিপদই ডেকে এনেছে এই অলক্ষী মেয়েটা।
অরুর কপালে ভাজ পড়লো। ওর প্রেমিককে নিয়ে তেমন কিছু এসে যায়না ওর। ছেলেটা শুধু দেখতে লাল টুকটুকে বলে ওকে এতোদিন পুষেছে ও। ভাগিয়ে দেয়া কোন ব্যাপার না। সমস্যা হলো বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়া। অরু ভালোমতই জানে যে বিয়ে করলে আর পড়াশুনা করা হয়ে ওঠে না। নুজহাত বিয়ে করে এখন পেশাদার গৃহিণী হয়ে গেছে। আর ওর সোশিওলজির পড়াশুনাকে গুরুত্ব দেবার মতন পরিবার বাংলাদেশে পাওয়া যাবে এমন আশা করারও কোন কারণ নেই।
কি করা যায় বল তো মাহিন?
ব্রেক আপ করে ফেল সাদমানের সাথে। তুই তো আজীবনই আমাকে বলে আসছিস যে তুই ওকে ভালোবাসিস না।
আরে ধুর! ওইটা তো কোন সমস্যা নাই। বিয়া নিয়ে কি করবো?
বিয়া নিয়ে কি করবো মানে? দি গ্রেট অরুণিমা চক্রবর্তী বিয়ে করার কথা ভাবতেসে? সারা ঢাকা ইউনিভার্সিটি একত্রে আত্মহত্যা করবে কিন্তু!
চুপ কর মাহিন! আমি ফাইজলামি করতেসিনা। কতোগুলা ছেলের হৃদয় ভাঙ্গা নিয়ে আমার বাবা মায়ের হৃদয় ভাঙ্গা আমার কাছে বেশি গুরুতর।
আমি ছেলেদের কথা বলতেসিনা অরু! আমি মেয়েদের কথা বলতেসি। শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্টের কতোগুলা মেয়ে তোকে দেখে এখনও সাহস করে মন দিয়ে পড়ালেখা করতেসে জানিস তুই? কতোজন বিসিএস গাইড ফেলে থুয়ে স্কলারলি জার্নাল পড়তেসে জানা আছে তোর? তুই যদি বিয়ে করিস, দেখিস এরাও একেকজন লাইন করে বিয়ে করা শুরু করসে।
আরে ধুর, তুই সবকিছু বাড়ায়ে বাড়ায়ে বলিস। তোর মনে হয় আমাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে।
উহু, তোকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে না-তুই একা একটা পৃথিবী বানাচ্ছিস। যেই পৃথিবীতে বাংলাদেশের মেয়েরা সাহস করে নিজেদের মতন বেচে থাকে। বিয়ে করে আরেকজনের কাঁধে ওঠেনা। এইসব কথা তো তুই-ই আমাকে বলতি অরু। তোর কি হইলো এখন?
বুঝতেসস না তুই মাহিন! আমার বাবা-মা কোনদিন আমাকে এতোটা গুরুত্ব দেয়নাই। কোনদিন আমার হাতে আমার বাবা মায়ের জীবনে সুখ আনার এতোটা ক্ষমতা ছিলোনা। কোনদিন আমার বাবামায়ের এতো ভালোবাসা পাইনাই আমি। এতোকিছু পেয়ে আমি সবকিছু হারাইতে পারবোনা মাহিন।
তুই কি বুঝতেছিস না অরু-এইসব ভালোবাসাই কন্ডিশনাল।আনকন্ডিশনাল ভালোবাসা বাংলাদেশের বাবা মায়েরা বাসতে জানেনা। তাদের ভালোবাসার পেছনে একটা না শর্ত থাকে সবসময়। আজকে বিয়ের শর্ত দিচ্ছে, তার পরে বাচ্চার শর্ত দেবে, মেয়ে হলে তারপর ছেলে বাচ্চার শর্ত দেবে। একটার পর একটা শর্তই শুধু পূরণ করতে থাকবি তুই। নিজের শর্তে বাঁচতে পারবি না আর কোনদিন।
চুপ কর তো মাহিন। আমার কথা আমাকে শুনাবি না শুধু।
তাহলে কি বলবো বল? কবিতা শুনবি?
হ্যাঁ শুনবো, শোনা।
গলা গম্ভীর করে কবিতা পড়তে শুরু করে মাহিন-
এক দেশে ছিল এক বোকা মেয়ে,
সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।
কারণ,মেয়েটা খালি বোকা বোকা প্রশ্ন করতো,
প্রশ্নগুলো বাকি সবাইকে বোকা করে দিতো।
এমন প্রশ্ন করতে নেই,বোকা মেয়েটা জানতোনা
তাই বোকা মেয়েটা এতো বেশি বোকা ছিলো।

অন্যের মুখে নিজের লেখা কবিতা শুনতে লজ্জা লাগে অরুর। ফোন রেখে দেয় সে। ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসে। তার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট। বিড়িতে দুইটা টান দিলে হয়তো মাথাটা আরেকটু পরিস্কার হবে তার।
সিগারেট ধরাবার আগেই মা এসে দাঁড়ায় অরুর পাশে। শান্তভাবে সিগারেটের প্যাকেটটা পায়জামার প্যাকেটে লুকিয়ে ফেলে অরু।
‘তোর বাবা এখনো ঘুমাতে পারেনাই’
‘জানি মা।’
তুই এমন করিস কেনো মা? সবসময় শুধু নিজেরটা চিন্তা করিস। আর কারোটা ভাবিস না। এমন করে কি মানুষের চলে? মাঝেমাঝে অন্যদের কথাও ভাবা লাগে। অন্যদের জন্যে কিছুটা স্যাক্রিফাইস করা লাগে।
অরু হেসে দিলো। তারপর মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কবিতা শুনবে মা?’
‘না! কবিতা শোনবো না এখন! কখনো কোনকিছুকে গুরুত্ব দিয়ে শুনিস না তুই…’
আরো শতকথা বলতে থাকে মা।
মায়ের কথার উপর দিয়েই নিজের কবিতাটা পড়া শুরু করে অরু। মাহিন মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন বেরই হচ্ছেনা মাথার থেকে।

বোকা মেয়েটির মা ছিলো বুদ্ধিমতি
তিনিও একদিন বোকা ছিলেন;এখন বুদ্ধিমতি
তাই তিনি জানেন-
কিভাবে বোকা মেয়েকে বুদ্ধিমান বানাতে হয়
তিনি অনেক খুজে খুজে
একটা বহুমূল্য ওড়না কিনলেন মেয়ের জন্য।

এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ছেলেকে পছন্দ করে ফেললো অরুণিমা। নিজের হাতে বেছে নেয়া লাল শাড়ি পড়ে কপালে টিপ দিয়ে চোখে কাজল মেখে আড়ং-এর শোরুমে গেলো। তারপর হাসিমুখে বাড়ি ফিরে বাবা মাকে বললো বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাতে গিয়ে অরু দেখলো নিচে দাঁড়িয়ে আছে মাহিন। গত এক সপ্তাহ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর ফোন ধরছে না অরু। এবারে নিজেই ফোন করলো অরু।
মাহিন। শোন-আমার পরিস্থিতিটা একটু বোঝার চেষ্টা কর…
আমাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবেনা অরু। ঐদিন কবিতাটা শোনানো শুরু করলাম যে-শেষ করতে ফোন দিলাম। শেষটুকু পড়ি?
পড়।
বাসায় হইহই গমগমের উপর দিয়ে অরু শুনতে থাকে নিজের লেখা কবিতা। কবিতার নাম-বোকা মেয়ের গল্প-
মা ভাবলেন,ওড়না দিয়ে কান,মাথা,বুক পেচিয়ে দিলে
বোকা মেয়েটার বোকা বোকা প্রশ্নগুলো
আর বাইরে বের হতে পারবেনা,
ভিতরেই রয়ে যাব।
তখন আর কেউ তাকে বোকা বলবে না।
বোকা মেয়েটা ওড়নাটা পেয়ে
সেটা গলায় জড়িয়ে ফাঁস দিয়ে মরে গেল
তখন সবাই হাসতে হাসতে বললো,
দেখেছো,কি বোকা মেয়ে!
একটা ওড়নাও ঠিকমতো পরতে জানেনা।


অরু যখন নোনাজড়া ঘুম ভেঙ্গে উঠলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। কিসের একটা ভোঁতা শব্দ বোধহয় শোনা গেলো বাইরে। শব্দটা না হলেও অরু উঠে যেতো। কত ঘুমাবে আর?
মাঝে বোধহয় এক জীবন কেটে গেছে।
দরজার সামনে শুয়েই ঘুমিয়েছিলো-আস্তে আস্তে হেলান দিয়ে উঠে বসলো। দরজার কাঠে মাথা ঠেকিয়ে সে আরেকবার ভেবে দেখে আজকে সকালে কি হয়েছে। সব কি কল্পনা ছিলো-নাকি বাস্তব?
বাস্তবই। কারণ অরুর হাত পুরো রক্তে ভেজা। মাথার মাঝে খুব তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা। ব্যাথাটা যেহেতু সত্যি ঘটনাটাও নিশ্চিত সত্যি। তাই যদি হয়, তাহলে মাথাটা যে ভাঙ্গেনি এটাই কম কথা নয়-যেভাবে পড়েছিলো অরু! জান যায়নি এই ভাগ্যি। দরজার কাছে আসতেই অরুর নাকে কেমন একটা গন্ধ ভেসে এলো। খাবার! ইশ! এতো ব্যাথার মাঝেও অরুর মুখে একটু হাসি ফুটলো। আহারে! কতোদিন খায়না অরু। কতোদিন! দরজার পাশে একটা বাটিতে টেংরা মাছের ঝোল আর ঠান্ডা ভাত। টেংরা মাছের ঝোল সবচেয়ে পছন্দ অরু। নিশ্চয়ই নিরু রেখে গেছে। মেয়েটা অরুকে খুব বেশি কাছের থেকে চেনে। নিরু খুব ভালো করে জানে যে যত সমস্যাই থাক-টেংরা মাছের ঝোল থাকলেই অরুর সব মুশকিল আসান।
কত্তোবড় মাছ একটা। অরুর মাথার সমান সাইজ। নিরু ইচ্ছা করে বড়োটা দিয়েছে।
কিন্তু আজ টেংরা ভাল্লাগছেনা। কেমন যেন গন্ধ করছে। তরকারি এখনো গরম-কাজেই পচে যাবার সম্ভাবনা নেই-তবু কেমন যেন লাগছে অরুর। এক গ্রাসের বেশি খেতেই পারলোনা সে। রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করেই সে আস্ত টেংরা মাছ-অলা ভরা প্লেটটা এঁটো করে পাশে রেখে দিলো।
দরজার ফাঁকা দিয়ে বসার ঘর দেখা যাচ্ছে। বসার ঘরের টিউবলাইটটার ভোল্টেজ কম। আজকে আলোটা দপদপ করে লাফাচ্ছে। এম্নিতে ওইখানটাতে বসে বাপি খবরের কাগজ পড়ে। খুব উত্তেজনাকর কিছু পেলে মায়ের হাতে দিয়ে বলে-পড়ো দেখি জোরে জোরে-আমরা সবাই শুনি। স্বামীর মুখে হঠাৎ পড়তে হবে-আদেশ শুনে মাস্টার্স পাশ মায়ের অক্ষরজ্ঞান উলটেপালটে যায়। আইসক্রিমকে আসক্রিম বলে মা-আর বোতলকে বলে বতোল। তাই নিয়ে কতো হাসাহাসি। অবশেষে পাঠের ভার পড়ে নিরুর উপর। মেয়েটার কন্ঠ ভারী মিষ্টি।
সবাই মিলে খুব সুন্দর গোছানো একটা নীড়। এইসবার মধ্যে খালি অরুই কেমন যেন একটু বেখাপ্পা-বেমানান। বেয়াড়াপনা করে সারাজীবন সংসারের সব অশান্তি টেনে এনেছে সে।তাইতে সবশেষে সব ছেড়েছুড়ে বাপ মায়ের মর্জিমাফিক সংসার পেতে একটু এই গোছানো সংসারে আলো আনতে চেয়েছিলো।
ক্ষণিকের জন্যে সত্যিসত্যি সেটা আনতে পেরে অরুর গর্বের শেষ ছিলোনা।
কিন্তু এখন? এক সকালের কয়েকটা ঘটনার কারণে ধীরে ধীরে এতো কষ্ট করে সাজানো শান্তির তাসের ঘর ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে যাবে?
এই নিয়ে ভাবতে গেলেই কেমন মাথাটা গুলিয়ে ওঠে অরুণিমার। তাই সে একটু উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যেই ধীরপদে পায়চারি করার চেষ্টা করে।
একসময় ঘরের ওপারের দরজা একটু ফাঁকা হয়েই আবার সন্তপর্ণে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ হয়তো ঘরে আসতে চাইছিলো-কিন্তু শেষ মুহুর্তে আর আসলোনা। অরু ধীরে গিয়ে দরজা ঘেষে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছে করে একবার ডাকে-কে ওখানে? কিন্তু সাহস হয়না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে। কাল সকালেও যখন সে লক্ষ্মী মেয়ে ছিলো তখন সকলে একবার দরজা খুলে তাকে দেখবার জন্যে জীবনপাত করে দিচ্ছিলো-আর এখন তার দরজা হাট করে খোলা-তবু কেউ তাকে দেখতে চায়না। বরং দরজার ওপারে আস্তে করে ছিটকিনি লাগিয়ে দেবার শব্দ শোনা যায়।
অলক্ষ্মীকে কেউ চায়না।
রাত আরেকটু বাড়তেই কারেন্ট চলে গেলো। এবার প্রথম অরু একটু সবার ফিসফাস শুনতে পেলো। সবাই মিলে পা টিপে টিপে এঘর ওঘর করে বেড়াচ্ছে আর বুদ্ধি আটছে যে এই মেয়েকে নিয়ে কি করা যায়!
যাহোক-কমপক্ষে এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে যে কালকে সকালের আগে আর কেউ অরুর ঘরে আসছে না।
সেটাও বেশ একটা খারাপ না। ভালো একটা সময় পাওয়া গেলো কিছুক্ষণ নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্যে। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকতে থাকতে অরু হঠাৎ নিজেকে চিনতে পারে না। এতো বছর ধরে এই ঘরে কে বাস করছে-কেন করছে? নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করে একবার নিরিখ করে দেখতে চাইছে অরু।
নিরিখ করতেই লজ্জায় কুঁকড়ে এলো সে। প্রেমিকদের কথা মনে পড়লো তার-মনে পড়লো টিএসসির কথা-পার্টির কথা-মাহিনের কথা। নিজের থেকে নিজেকে লুকাতেই হয়তো সে গড়িয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়লো সে। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় সে এমনি করে সবসময় খাটের তলে লুকিয়ে পড়তো। কেউ খুঁজে পেতো না। এখন দেহটা আরেকটু বড় হয়েছে-খাটের তলে আটতে চায়না। জোর করতেই আবার ব্যাথা করে ওঠে অরুর। তবু জোর করে।
সারারাত সে খাটের নিচেই কাটালো। কিছুক্ষণ ঘুমালোও-কিন্তু বারবার জেগে উঠতে লাগলো তীব্র ক্ষুধার জ্বালায়। আবার কিছুক্ষণ কাটলো নিজেকে শান্ত করতে-শান্তি,শান্তি,শান্তি! সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সকাল হতেই ওপারের দরজা খুলে নিরু এলো। মেয়েটা চমৎকার একটা থ্রীপিস পরেছে। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কি ভয়াবহ সুন্দরী হয়ে গেছে। দেখলেই চোখ আটকে যায়-চোখের থেকে মায়া ঠিকরে বেরুচ্ছে মেয়েটার।
নিরু ঘরে ঢুকেই অরুকে দেখতে পেলোনা-কারণ অরু ছিলো খাটের নিচে। প্রায় পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় কুকুরকুন্ডলী হয়ে রক্ত আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে ছিল অরু।খাটের নিচে অরুকে এই অবস্থায় দেখে নিরু পুরো আৎকে উঠে দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো।
বের হতেই বোধহয় মেয়েটার অনুশোচনা বোধ হচ্ছিলো কারণ কিছুক্ষণের মাঝেই সে ফিরে এলো। অরু খাটের কোনা দিয়ে ঘাড় বের করে নিরুকে দেখে। নিরু কি দেখবে যে অরু কালরাতে কিছুই খায়নি?
নিরু যদি না দেখে তাহলে অরুর এখন বেরিয়ে পড়ে অরুর পায়ে পড়ে ওর কাছে খাবার জন্যে ভালো কিছু একটা চাইতে হবে।খিদেয় তার মারা পড়ার উপক্রম।
তবে সৌভাগ্যক্রমে নিরু দেখলো যে অরু টেংরা মাছের থালা এঁটো করে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে। নিরু ধৈর্য ধরে পুরো জায়গাটা ন্যাকড়া দিয়ে পরিস্কার করে নিয়ে গেল।
অরু পুরো অন্তর দিয়ে অপেক্ষা করছিলো টেংরার যায়গায় নিরু নতুন কি আনে সেটা দেখার জন্যে। সময়টা কাটানোর জন্যে সে কল্পনাও করতে লাগলো যে নিরু কি কি আনতে পারে। কিন্তু নিরু যা নিয়ে আসলো-সেটা অরু স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনাই।নিরু রীতিমতো ঘরের সব খাবার তুলে এনেছে-অরুর কি খেতে ভালো লাগে সেটা দেখবার জন্যে। মাংস, সবজি,নুডুলস,গরম ভাত,পান্তা ভাত,বাসি মাছের তরকারি,টকে যাওয়া ডাল;সবকিছুর সাথে এক গ্লাসে জল-অরুর গ্লাসে-অরুর ছোটবেলাকার গ্লাসে।
সব রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিরু। যাবার সময় বাইরে থেকে সন্তপর্নে ছিটকিনিও তুলে দিলো সে।
শান্তিতে অরুর চোখে পানি চলে এলো প্রায়। শেষমেশ খেতে পাবে সে।
ব্যাথাট্যাথাগুলো একটু সেরে গেছে-তাই নড়াচড়া করতে এখন আর বিশেষ সমস্যা হচ্ছেনা।একেবারে আয়েশ করে পেট ভরে খাবে সে এখন।
এক নিশ্বাসে হাভাতের মতন করে অরু পান্তাভাত,বাসি তরকারি আর টকে যাওয়া ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। দিনকে দিন শ্বশুরবাড়িতে সবার খাওয়ার পরে রয়ে যাওয়া বাসিটুকু খেতে খেতে এখন ওগুলোই ভালো লাগে তার। টাটকা খাবার একটুও মুখে রুচলো না । এমনকি সেগুলোকে একটু দূরেও ঠেলে দিলো অরু। গন্ধটা অসহ্য লাগছিলো।
খাবার পর অনেকক্ষণ অরু হাত পা ছড়িয়ে ওখানেই শুয়ে থাকলো। একসময় নিরু আবার আস্তে করে ছিটকিনিটা খুলে ঘরে এলো।
ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনে আধাঘুমের মধ্যেই হঠাৎ চমকে গিয়ে তাড়াহুড়া করে খাটের নিচে ঢুকতে গিয়ে অরু আবার মাথায় ব্যাথা পেলো।কিন্তু এবার ওই ছোট্ট জায়গাটাতে ঢুকে থাকতে তার একটু কষ্টই হলো। খেয়েদেয়ে একটু ফুলে যাবার পরে ওই চিপাটুকুতে বসে থাকতে আরো কষ্ট হচ্ছিলো। দমবন্ধ ভাব সহ্য করতে করতে অরু দেখলো কিভাবে করে দুইবোনের মাঝে লক্ষ্মী বোনটা বজ্জাত বোনটার ছড়ানো ছিটানো নোংরাটুকুন ফুলঝাড়ু দিয়ে মুছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মাথায় বুদ্ধিও অনেক-কারণ সে খুব তাড়াতাড়ি কাজটুকু করে চলে গেলো। সে যেন বুঝতে পারছে যে খাটের নিচে লুকিয়ে দিদির অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাজ সেরে নিরু বেরিয়ে যাবার পরই অরু খাটের নিচে থেকে বের হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল।
অরু এখন থেকে রোজ এমন করেই খাবার পেতো। সকালে একবার-যখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি তখন আর রাতে একবার-যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে তখন। বাবা মা-ও কখনো চাইতো না যে অরু অভূক্ত থাকুক-কিন্তু তবু হয়তো অরুর প্রতি অত্যধিক ভালোবাসাই তার এই রূপান্তরের প্রতি তাদের অত্যধিক ঘৃণার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তারা বরং নিরুর মুখের থেকে গল্প শুনেই যথেষ্ট শিহরিত।নিরুও চেয়েছিলো যাতে বাবা মাকে একই রকম তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে না হয় যেটা সে রোজ ভোগ করছে।
ওরা এম্নিতেই অনেক কষ্টে আছে।
অরু কখনো জানেনি পারবেনা যে তালা চাবিওলা আর ডাক্তারকে বাপি-মা কি বলে ভাগিয়েছে কারণ তাদেরকে সত্যি কথা বলে কোন লাভ নেই। সবাই একদানে পাগল বলে ছেড়ে দেবে। তাই সমাজের প্রতি বাপি মায়ের বক্তব্যকে অরুর নিরুর দীর্ঘশ্বাস আর প্রার্থনার মাঝে খুঁজে নিতে হতো।অরু কখনো এর বাইরে পরিবারের আর কোন সমাচার শুনতে পায়নি। সারাটাদিন একটু ফিসফাস শুনলেও সে দরজায় কান পেতে থাকতো। খুব কদাচিৎ একটা দুইটা কথা শোনা যেত। সব কথার মূল কথা একটাই-এখন আমরা কি করবো?আর যতক্ষণ তারা কথা বলতো-তারা কথা বলতো তিনজনের একটা পরিবারের মতন।
শিউলিটা প্রথমদিনই চলে গিয়েছিল। সে যতটা দেখেছে-তা দেখার পর আর এই বাড়িতে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার নানী বলেছে যে পাগল লোকের আশেপাশে থাকলে সন্তান পাগল হয়। সে এখন পোয়াতী-কাজেই এখন তার পক্ষে এইবাড়িতে কাজ করা সম্ভব না। তবে সে যথেষ্টই বিশ্বস্ত-মাথার দিব্যি দিয়ে গেলো যে বাপের জন্মে কাউকে বড়আপার পাগলামির কথা বলবে না।
এখন নিরুকে রান্নার কাজেও হাত লাগাতে হতো। যদিও রান্না না করলেও খুব একটা এসে যেতো না কারণ কেউই খেতো না। অরু প্রায়ই শুনতো-ওরা একজন আরেকজনকে ক্লান্ত গলায় খেতে বলছে আর সবাই সবার উত্তরে বলছে-খেতে ইচ্ছে করছে না।
প্রথম দিন ফুরোনোর আগেই বাবা অরুর মা আর নিরুকে সমস্ত বুঝিয়ে বলেছেন। বাবা ডাক্তার আংকেলের সাথে গোপনে কথা বলেছেন। রোগের সমস্ত লক্ষণ আর উপসর্গ বলেছেন। অরুকে সামনাসামনি না দেখে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা কিন্তু ডাক্তার আংকেলের ধারণা অরুর বাইপোলার ডিসঅর্ডার হয়েছে। এটা একটা মানসিক রোগ। কঠিন মানসিক চাপের কারণে এই রোগ হতে পারে। রোগীর হঠাৎ চূড়ান্ত মন খারাপ-আবার কখনো চূড়ান্ত মন ভালো হতে পারে। ডায়াবেটিসের মতন কখনও এই রোগ ঠিক হয়না-কিন্তু ওষুধে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো এই রোগে আক্রান্তরা ভয়াবহ বিষণ্ণ হয় আর যেকোন মুহুর্তে আত্মহত্যা করতে পারে।
এই রোগের কোন ওষুধ নেই-আর রোগটা কখনও সারেনা। তার মানে দাঁড়ায়,যে অরু সারাজীবনের জন্যে পাগল হয়ে গেছে। এই পাগল মেয়েকে কি আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ফেরত নেবে?
সেদিনের ঘটনার পরের থেকে দীর্ঘদিন শ্বশুরবাড়ির সাথে অরুর বাবা মায়ের কোন যোগাযোগ নেই। অরুর বাবা বেশ কয়বার ফোন করে ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। অরুর মা মাঝেমাঝেই অরুর বাবাকে বলেন এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে বেয়াইবাড়ি চলে যেতে-কিন্তু বাবার সাহস হয়না। বাবার মেজাজ বড় চড়া-অপমান সহজে সহ্য করতে পারেন না। তার ভয় হয়-শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা কোন একটা দুর্বব্যহার করলে যদি তিনি রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু বলে বসেন-তাহলে মেয়েটার বিয়েটা হয়তো সত্যিই পুরোপুরি ভেঙ্গে যাবে।
অরুর বিয়ে নিয়ে আর আশা করে লাভ নেই-সব ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেয়াই কর্তব্য।কিন্তু নিরুটাকে যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি পার করতে হবে। যদি কোনভাবে তার আগেই অরুর বিয়েটা ভেঙ্গে যায়-তবেই সর্বনাশ। নিরুর জন্য আর ছেলে পাওয়া যাবেনা।বড়বোনের পাগলামির খবর পাবার পরে ছোটবোনকে আর বিয়ে করতে চাইবে কে? অরু সবসময় বাপি মাকে বোকাসোকাই মনে করেছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধির ঝলক দেখে অরু মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।
বাবা মায়ের কাছে অরু ততদিনে মোটামোটি পরিত্যক্ত। এখন অরুর কাছের মানুষ বলতে কেবল নিরু। তবে নিরু যেনো অরুর ঠিক বিপরীত। অরুর কাঠখোট্টা সোশ্যাল সায়েন্সে আগ্রহ-নিরুর আগ্রহ চারুকলায়। মেয়েটা খুব ভালো ছবি আঁকে। নিরুর আঁকা ছবির দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতো অরু। বেশিরভাগ সময়ে ভার্সিটির হলেই থাকতো অরু-তবে বাসায় আসলেই নিরুর সাথে ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে কথা বলতো। দেশে বাবা মা কোনদিনই নিরুকে ইচ্ছামতন পড়তে দেবে না। তাই অরুর ইচ্ছা ছিলো নিরুকে প্যারিসে ফাইন আর্টস পড়তে পাঠাবে। বাবা-মা এইসব আকাশ কুসুম কথাবার্তা পছন্দ করতো না,কিন্তু অরু একটু গোয়ার্তুমি করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে প্রয়োজনে নিজের টাকায় বোনকে প্যারিসে পাঠাবে সে। সেইজন্যে চার বছর ধরে টিউশনির টাকা জমাচ্ছিলো সে।
নিরুর জন্মদিনে সব কথা একবারে বলে সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছিলো অরু।
কিন্তু এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। এখন অরুর দিন কাটে দরজার সাথে কান ঠেকিয়ে। মাঝে মাঝে নিজের উপরই ক্লান্ত হয়ে পড়ে অরু। তখন একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বেসামাল মাথাটা দরজায় ঘষে একটু শব্দ হয়। একমুহুর্তে পিনপতন নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাড়িটা। নতুন করে আবার কি কান্ড ঘটাচ্ছে মেয়েটা?
তারপর আবার একসময় তারা নিজেদের কথোপকথনে ফিরে যায়।
মাকে বুঝানোর সময় বাপি প্রায়ই এক কথা বারবার বলতো। মায়ের মোটা মাথায় সহজে কোন কথা ঢোকেনা বলে। বাপি একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে রেগেমেগে চিৎকার করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে আবার সব নীরব হয়ে যায়। রাত গড়ালে আঁধার চিরে একটা তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। মা কাঁদছে।
মা সবসময় নীরবে কাঁদার চেষ্টা করে। জন্মের পরের থেকেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক সংকুচিত থাকে মা। বোকামি করে করে সবার পথের কাটা হয়ে থাকে বলে তার অনেক লজ্জা। সেই লজ্জা আরো বেড়ে যায় যখন মনে পড়ে যে সংসারে সে একটা কড়িও আয় করে আনতে পারেনি। রান্নার হাতও তার বিশেষ ভালো নয়। শুধু খুব সুন্দর হাতের কাজ করতে পারে মা। পুতুল-শোপিস-বালিশের ওয়াড়। পুরো বাসা জুড়ে মায়ের হাতের শিল্পের ছোঁয়া। দেখলে মনে হয় কোন বাহারী দোকানের শো রুম।
কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি-বরং ক্ষতি হয়েছে। ছোট মেয়েটা ঝুঁকেছে এইসব অর্থহীন আঁকিবুঁকির দিকে-পড়ালেখায় মন দেয়নাই। মা সারাজীবন শুধু ছেলেমেয়েদের অভ্যাসই নষ্ট করেছে। ছোটবেলাকার অভ্যাস রাত জেগে পড়া-সেই থেকে রাতে ঘুমাতে পারে না। তার থেকে দেখে দেখে শিখেছে ছেলেমেয়ে। সারারাত জেগে থাকে। জেগে জেগে ফোনে ইটিশপিটিশ। আর সারাদিন ঘুমানো-সব শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। তাই মার খুব লজ্জা।
সেই লজ্জাও এতো নির্লজ্জ যে মায়ের কান্না বালিশচাপা দিতে পারেনা। চাপার ফাঁকফোকর দিয়ে চল্লিশ বছরের জমানো চিৎকার বেরিয়ে আসে। মা কাঁদলে বাসার সবাই টের পায়। অরুও। কেউ ঘুমাতে পারেনা। সবাই চোখ বুজে জেগে থাকে।
এমনিতে রাত জেগে থাকলে এসময়ে মা অরুর বাবার কাছে কঠিন ঝাড়ি খায়। আজ বাবা কিছু বলছেনা। তার চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে নাকের উপর এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। জল মুছতে পারছেনা বাবা-কারণ নড়লেই মা বুঝে যাবে যে বাপি ঘুমায়নি। সাথে সাথে ভয়ে কান্না বন্ধ করে দেবে।
থাকনা-একটু কাঁদুক মেয়েটা। মেয়ে মানুষকে মাঝে মাঝে কান্না করতে দিতে হয়।
অরুও মায়ের কান্না শোনে। সে শুনছে ছোটবেলার থেকে। তখন থেকেই মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে আসছে সে। পারেনি কখনো। কখনো পারবেনা আর।
পারে নিরু। তাই নিরুকে মাঝেমাঝে অনেক ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। এই ছন্নছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা সংসারে মেয়েটা আশার আলো জ্বেলেছে। আর এই অদ্ভুত রূপান্তরের পরের থেকে নিরু যা করেছে তার জন্যে তাকে কিছু বলার ক্ষমতাও নেই অরুর। ভাবলেই কেমন মাথার একপাশে ভোঁতা যন্ত্রণা হয়।
তবে নিরুর কখনো ধন্যবাদ লাগেনা-লাগেওনি কখনো । সে এতই সতর্ক যে সে জানে যে দিদির ঘরে এক মুহুর্ত বেশি থাকলেও দিদির কষ্ট করে লুকিয়ে থাকা লাগে। তাই সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে বেরিয়ে পড়তে চায়। দিদিকে যতটুকু দেখে ফেলে- ততটুকু না দেখার ভান করে। যতটুকু ভয় পায়-লুকিয়ে রাখে। যতটুকু কান্না পায়-জমিয়ে রাখে। দিদির ঠিক পাশে ঘরে থাকে বলে কখনো কাঁদতেও পারেনা নিরু। শুনলে দিদি কষ্ট পাবে।
একদিন নিরু যাবার আগে দেখলো যে দিদি খাটের কোণা দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বন্ধ জানালাটির দিকে চেয়ে আছে। যাবার আগে তাই জানলাটি একটু খুলে দিলো। দেখলো তখন দিদি কেমন যেন জন্তুর মতন গোঙ্গানি দিয়ে বাচ্চাদের মতন মূঢ় শূণ্য দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে দিলো।
সেদিন নিরু মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে।ওই একদিনই-আর কাঁদেনি।
মাও অরুকে দেখতে আসতে চায়। কিন্তু মার সাহস নেই। কিন্তু তবু সে প্রায়ই নিরুকে বলে, ‘আমি একটু মামণিকে দেখে আসি রে? আমার ছোট্ট মেয়েটা। সেইদিনও কাদার মধ্যে পিছলে গিয়ে হাত পা ছড়িয় কাঁদছিলো। আজ দেখ-বড় হয়ে কতো কষ্ট পাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছেনা আমার ছোট্ট মেয়েটাকে। একটু বোঝ মা। আমাকে একটু যেতে দে।’
নিরু বলে, ‘যাও,তোমাকে তো আমি মানা করিনি।’
‘যাবো? পরে যদি কোন সমস্যা হয়ে যায়? যদি কিছু উল্টোপাল্টা করে ফেলি-আর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়?’
মার সাহস হয়না। মা ভয় পায়। তারপর একদিন ঘরের দরজার সামনে আসে। তারপরের দিন ফাক করে একটু ভিতরে দেখে। তারপরের দিন বলে-নিরু,আমি যাবো আজকে।
নিরু প্রথমে ঢুকে দেখে নেয় যে সব ঠিক আছে। তারপর মা-কে ভেতরে আসতে বলে।
মা ভেতরে আসে। ঘুরেফিরে দেখে।এরপর নিরুকে জিজ্ঞেস করে-অরু কোথায়? নিরু বলে-ওই খাটের নিচে।দিদিকে জ্বালিও না।
না না,জ্বালাচ্ছি না। কিন্তু এই ঘরটা এতো ঘিঞ্জি কেন? চারদিকে পর্দা! আলোবাতাস ঢোকারই কোন পথ নেই। এখানে থাকলে তো সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যাবে।
মা! দিদি পাগল হয়নি।
ও হ্যাঁ।তা-তো বটেই! কিন্তু-তুই-ই দেখ। ঘরটা কেমন ঘিঞ্জি না? একটু খালি করে দিলেই আমার মেয়েটা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
কোমর বেঁধে মা আর নিরু মিলে ঘর খালি করা শুরু করলো। সারাদিন ঘরময় আসবাব টানাটানির শব্দ। এইদিকে ছোট্ট একটা খাটের তলে অরুর ধুলোয় দমবন্ধ হয়ে মরার জোগাড়।
প্রথমে আলমারি,তারপর টেবিল,ড্রেসিং টেবিল-আয়না।
অবশেষে একসময় খাট ছাড়া সব আসবাব টেনে বের করা হয়ে যায়।
অরু এতক্ষণ খাটের ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে ছিলো দেয়ালের হলুদ রঙের একটা পোস্টারের দিকে। ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে নিজে ছাপিয়েছিলো সে। ফেমিনিজমের পোস্টার। রোসি দ্য রিভেটার হাতের পেশি ফুলিয়ে বিশ্বকে বলছে-আমরাও পারি।
পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অরুর মাথার পিছনে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়। কিন্তু তবু অরু চোখ সরাতে পারে না। কেমন যেন একটা দুর্নিবার আকর্ষণ। যন্ত্রণা পাবার মধ্যেই কেমন একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়।
কিন্তু হঠাৎ অরুর দর্শন রোধ করে দাঁড়ায় অরুর মা। তিনি ঘরের দেয়াল পরিস্কার করছেন। কাজেই এই পোস্টারটিকে তিনি টেনে তুলে ফেলবেন। ঘর পরিস্কার হলে এম্নিতেই মেয়ের মাথা পরিস্কার পরিস্কার মনে হবে। তাই দেয়াল পরিস্কার করতে হবে।
দেয়াল পরিস্কার করতে যেই তিনি পোস্টারটা ধরে টান দিলেন-ওমনি খাটের নিচ থেকে অরু না-না বলতে বলতে সব ধাক্কা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ করে অরুর এমন ভয়ংকর মূর্তি দেখে বোকা মা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। ভয়ের চোটে তার হাতের টানে পোস্টার একটু ছিঁড়ে গেলো।
না...না...না...না...না…
কেমন অন্ধ পাগলের মতন সব ভুলে গিয়ে অরু ধাক্কা দিয়ে মা কে দূরে সরিয়ে দিলো। বোকা মা এমন ভয় পেয়েছেন যে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে পারলেন না। উলটে পড়ে গিয়ে দেয়ালে মাথা বাড়ি খেলেন। এরপর ভয়ে নাকি আঘাতের কারণে কে জানে-মা জ্ঞান হারালেন।
অরু তখনও সারা শরীর দিয়ে তার পোস্টারটি আগলে ধরে রেখেছে। তার গোলাপী ঠোঁট কাপছে। হাত দিয়ে পোস্টারের ফেমিনিস্টকে জড়িয়ে রেখে সে অশ্রুসজল কন্ঠে বলছে,না...না...না…
এমন সময় দরজা ঠেলে বাবা ঘরে ঢোকে। মেঝেতে মা কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তার কান্ডজ্ঞান ঠিক থাকেনা।
বজ্জাত মেয়ে...বেয়াদব মেয়ে...সারা সংসার নষ্ট করিসিস,এখন মায়ের গায়ে হাত তুলিস?
থাপ্পড় খেয়ে অরু বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ে, বসে পড়ে কেমন অব্যক্ত মূঢ় কন্ঠে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে…
বাবা,আমি...করিনি....বাবা...আমাকে...মারেনা...বাবা...আমি..ভয়...বাবা...খুব ভয়...ওরা নিয়ে যাবে আমাকে বাবা...খুব ভয় দেয়...বাবা আমাকে ওদের কাছে পাঠায়ে দিয়েনা বাবা...আমি ভালো মেয়ে হয়ে যাবো...বাবা...খুব ভালো মেয়ে...
পচিশ বছর বয়েসী মেয়ের মুখে এহেন অদ্ভুত অর্থহীন প্রলাপ শুনে বাবার মাথা আরো গরম হয়ে যায়। পা ঝামটা দিয়ে অরুকে সরিয়ে দেয় বাবা।
দূর হ...তুই...দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে…
অরু বেচারা ততক্ষণে ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওর খাটের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে চাচ্ছিলো।
কিন্তু ইতোমধ্যে বাবা রাগের মাথায় অরুর দিকে ওর ছোট্টবেলাকার সিরামিকের মগটা ছুঁড়ে মেরেছে। মগটা গিয়ে লাগলো অরুর ডান উরুতে।
মাগো...মা...মা...ও মা…
বলতে কঁকিয়ে উঠে অরু তার খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে।
চুপ...আরেকটা শব্দ করলি গলা টিপে মেরে ফেলবো!
ভয়ে দুই ঠোঁট একসাথে চেপে ধরে একদম চুপ হয়ে যায় অরু। হাত চেপে ধরে মুখের ওপর। চুপ!একদম চুপ।
সাথেসাথে অরুর বাবা ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।
অনেকক্ষণ পর রায়বাড়ির সরগরম বন্ধ হয়ে চারিদিক কেমন একটা ভোঁতা নিরবতা নেমে এলো।


কারো আর অরুর খোঁজ নিতে যাওয়ার সাহস ছিলো না।
আপাতত সবার কাছে সে একজন ভয়ংকর প্রাণি।
হয়তো তার এই ভয়ংকর প্রানি হয়ে ওঠাটাই অনেকদিন পর রায়বাড়িতে নতুন একটা ঘটনা ঘটালো। সবাইকে মনে করিয়ে দিলো যে অরুও কমপক্ষে একটা প্রাণী-শুধু একটা সমস্যার নাম নয়।
এমনকি বাপিরও অরুর জন্যে মায়া হচ্ছে। সেইদিনের পর থেকে বাপি আর ঘুমায়নি। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। ছোটবেলায় একবার অরুকে বেত দিয়ে খুব পিটিয়েছিলেন তিনি। তারপর তার আর রাতে ঘুম হয়না। আজও হচ্ছেনা।
অরু বেচারী পায়ের ব্যাথায় নড়তে পারছেনা। আর কখনো পারবে কিনা সে জানেও না। আসলে তার আর ইচ্ছাও নেই। খাটের নিচে এখন আর তার দমবন্ধ লাগে না-খাটের নিচের থেকে বের হলেই দমবন্ধ লাগে। সে শুধু খাটের এই কোনা দিয়ে আধাছেড়া ফেমিনিজমের পোস্টারটা দেখতে পায়। দিনরাত সে পোস্টারটার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
দরজা খোলা থাকে বলে এখন খাটের নিচ থেকেও খাবার ঘরের টেবিল দেখা যায় । কিন্তু এখন আর আগের মতন করে ওরা কোন আলাপ আলোচনা করেনা। অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে যার যার মতন দ্রুতবেগে খেয়ে নেয়-তারপর উঠে চলে যায়। খাবার মাঝে সবাই ছোট ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কখনও আলাদা আলাদা-কখনও সবাই একসাথে। পরিবার বলতে এখন এতটুকুই বেঁচে রয়েছে।
সরাসরি শারীরিক আঘাতটুকু মায়ের উপর হয়েছিলো বলেই হয়তো মা একটু বেশি দায়িত্ববোধ অনুভব করে। সেই দায়িত্ববোধের থেকে প্রতি রাতে বাবাকে বলে-‘অরুর বাবা,অরুকে একটু বলো না উপরে উঠে শুতে।’
বাবা ঘুমানোর ভান করে। মা আরো কিছুক্ষণ বাপিকে নাড়াচাড়া করে নিশ্চিত হয়। তারপর কাঁদতে বসে।
বাবা আর কাঁদেনা। তার বুকে পাথর। সে জানে মা তাকেই দোষারোপ করছে। জ্ঞান ফেরার পর অন্যের মুখে গল্পটি শুনলে বাবাকেই দোষী মনে হবে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি কখনো তার নিজের মেয়ের দিকে দিকে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারে?
হয়তো মারেনা। হয়তো বাবারই দোষ। আসলে বাবারই দোষ। ছোটবেলা থেকে অরুকে যথেষ্ট সময় দেয়নি বাবা। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলো। ছুটি পেলেও মেয়েদের সময় দিতোনা। তারচেয়ে বড় কথা-বাবা মেয়েদের বুঝতো না। সারাজীবন পরিবারের জন্যে খাটাখাটনি করে কেটেছে। মেয়েদের চেনার বা জানার মতন বিলাসিতা করবার সময় তার ছিলোনা।
মেয়েদের নিয়ে তার ইচ্ছেগুলো ছিলো সহজ সরল। দাদুমার কোমরে বড় ব্যাথা ছিলো-কোন ডাক্তারে সারতো না। বাবার ধারণা ছিলো-অরু যদি ডাক্তারি পড়ে এসে দাদুমার চিকিৎসা করে-তাহলে হয়তো দাদুমা সহজেই সেরে উঠবে। রোগ তো আর পুরোটা শারিরীক নয়-কিছু মানসিক।
কিন্তু মেয়েটা ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেলোনা। চান্স পেলো দূরের একটা মেডিকেলে। বাবা চেয়েছিলেন অরু সেখানেই যাক। কিন্তু অরু গেলোনা। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে-সোশিওলজিই পড়বে। ঘরের থেকে গোয়ার্তুমি করে বেরিয়ে যাবার উপক্রম। শেষে বাবা মেনে নিতে বাধ্য হলো।
কিন্তু যখনই বাবা শুনতো যে তার কোন কেরানীর মেয়ে ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছে-অথবা কোন কলিগ বলছে শরীর খারাপ হলে তার ভাতিজার কাছে চেকাপ করাতে যেতে-তখনই তার বুকের বাম পাশে একটা ব্যাথা হতো। তখন থেকেই তার বুকের ব্যাথা শুরু। ব্যাথাটা এখনও হয়। অরুর মা বারবার বলে ডাক্তার দেখাতে-অরুর বাবা দেখায়না।
ডাক্তারদের উপর তার বড় অভিমান।
মেয়ের উপর কখনো রাগ করতে পারেনা বাবা। বড় আদরের মেয়ে। সেইদিন জন্মালো মেয়েটা-ধবধবে সাদা গা। শরীর থেকে যেন আলো বেরোচ্ছে। বাবা ভাবলেন-আমি তুচ্ছ মানুষ-আমার ঘরে এমন দেবশিশু এলো কোথা থেকে?
অরু যখন জন্মেছিলো তখন সূর্য উঠলো-তাই অরুণিমা নাম রেখেছিলো দাদুমা। কিন্তু বাবার বড় ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে দেবী বলে ডাকবার।কিন্তু নামটা টিকলোনা। কারণ দাদুমা বলেছিলেন যে মেয়ের নাম দেবী রাখলে সত্যিকারের দেবী অখুশী হতে পারেন। অমঙ্গলের ব্যাপার।
তবু বাবা মাঝেমাঝে অরুকে দেবী ডেকে ফেলতেন। বহুদিন অনুশীলন করে ধীরে ধীরে অভ্যাস করেছিলেন। মাঝেমাঝে খুব ডাকতে ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করে থাকতেন কখন দাদুমা হাঁটতে বেরোয়। বেরোলেই বড় মিষ্টি স্বরে ডাকতেন-দেবী! দেবীরে...কই মা?
ছোটবেলা থেকে অনেক দেবীকে ডেকেছেন বাবা। কোনদিন কেউ সাড়া দেয়নি। কিন্তু নিজের মেয়ে দেবীকে ডাকতেই সাড়া পাওয়া যেতো। ঝুটি দুলাতে দুলাতে আসতো অরু-আজ্ঞে বাবা।
অরু চলে আসলে পরে বাবা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতেন। তিনি তো ডাকবেন বলেই ডেকেছিলেন-ডেকে কি বলবেন-সেটা তো ভাবেননি। তিনি আমতা আমতা করে বলতেন-স্নান করেছিস?
করেছি।
কই করেছিস?তুই তো স্নান করিসনি?
করেছি তো-এই দেখো মাথা ভেজা।
মাথা জল দিয়ে ভিজিয়ে আনলেই বুঝি স্নান করা হয়! মাথার সামনে ভেজা-পিছনে ভেজেনি কেনো? যাও-এক্ষণ গামছা নিয়ে এই বাথরুমে স্নানে যাও।কোন কিন্তু নাই।
অরু মুখ গোজ করে গামছা কাঁধে বাথরুমে ঢোকে। পেছন থেকে অরুকে দেখে বাবা মুগ্ধ হয়ে যান। সারাবাড়ি জুড়ে এতো সোনা মোর-ছড়াইয়া গেছে কারা!
জোর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে বাবা আর কখনো অরুকে দেবী বলে ডাকেননি।
আজ ডাকছেন।
অরুর ঘরের দরজা পেরিয়ে খাটের কাছে হাটু গেড়ে বসে বাবা অরুকে ডাকছেন-দেবী,ও দেবী...মা রে...
অরু কুঁকড়ে শুয়েছিলো। আজকাল মানুষের পায়ের আওয়াজও ভয় লাগে তার। বাবার পায়ের শব্দে লুকিয়ে কুকড়ে গিয়েছিল আরো। বাবার পায়ের আওয়াজ সে চেনে ভালমতো।
তবু দেবী ডাক শুনে সে আর লুকিয়ে থাকতে পারলোনা। ছোটবেলার অভ্যাসে বলে ফেললো-আজ্ঞে বাবা।
মা,তোর মনে আছে,ছোটবেলায় একবার তোর টনসিল অপারেশন হলো?
হুঁ
তোকে যখন অপারেশন করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো তখন তুই আমাকে কি বলেছিলি মনে আছে?
আমাকে নিয়ে যাচ্ছে বাবা-আমি যাবো না…
হ্যাঁ। তখন আমি ডাক্তারদের আটকে দিলাম। বললাম আমার মেয়ের টনসিল অপারেশনের দরকার নেই।তোকে অপারেশন টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আসলাম। মনে আছে তোর?
হুঁ
তোর ভয় হলে আমাকে বলবি না মা? তোর ভয় হতে দেই আমি? ভয় হলে বাবাকে বলতে হয় না-পাগলী? শ্বশুরবাড়ি যেতে না চাইলে যাবিনা। আমি তোকে পাঠাবোনা।তুই বাবার মেয়ে-বাবার কাছে থাকবি। ঠিক আছে?
অনেকক্ষণ কিছু শোনা যায়না। এরপর হালকা ফোঁপানি শোনা যায়। তারপর তীক্ষ্ণ কান্না। বাবা মেঝেতে শুয়ে পড়ে। এরপর বিছানার তলা থেকে অরুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরে। বাবার বুক জড়িয়ে ধরে কি জান্তব সুখে অরু হুটোপুটি খায় আর চিৎকার করে কাঁদে। বাবার বুক ভিজে যায়।
আমার ভালো মা-আমার লক্ষ্মী মা!
রায়বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। অনেকদিনের ভোতা দুখের মাঝে এইটুকুই অনেক বেশি। অরু খাটের নিচের থেকে বের হয়েছে। অনেক বেশি।
মা আদুল গায়ের অরুকে ডলে ডলে স্নান করিয়ে দেন-ঠিক যেন তার বয়েস বারো। বাবা হাসিমুখে বাজার করতে যান। নিরু রান্নাঘরে যায়-আজ সে টেংরা রান্না করবে। অনেকদিন বাসায় কেউ আরাম করে খেতে পায়না।
অরু কিছুই খেতে চায়না। শুধু হাসিমুখে সবার দিকে চেয়ে থাকে। সবার সুখে সেও বড় সুখী। তার ভালো লাগছে। এখন আর ভয় লাগছে না। বাবা বলেছে ভয় হলে বাবা সব ঠিক করে দেবে। আর ভয় নেই।
অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একসময় বাবা অরুকে একটু কোল্ড ড্রিংক খেতে রাজি করান। কোল্ড ড্রিংক দেয়ার আগে তাতে মিশিয়ে দেয়া হয় ডাক্তার আংকেলের দেয়া অষুধ।অষুধ খেয়ে দীর্ঘদিন পরে অরু নেতিয়ে পড়ে।
আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ে অরু।
দুঃস্বপ্নহীন-যন্ত্রণাহীন নিকষ কালো ঘুম।
ঘুমের মাঝে অরুর ঠোঁটে একটু হাসিও হয়তো দেখা যায়।
অরু ঘুমিয়ে পড়তেই অরুর মা ডাক্তার আংকেলকে ফোন করেন।
-জ্বী,আপনার কথামতো অষুধ খাইয়ে দিয়েছি।
-নিজের ইচ্ছায় খেয়েছে-নাকি জোর করেছেন?
-না,না। জোর করতে হয়নি। অরুর বাবার কথায় রাজি হয়ে শান্তভাবে খেয়েছে।
-অরুর বাবা আবার অরুকে রাগিয়ে দেবার মতন কিছু বলেননি তো?
-না,না।আপনি ভয় পাবেননা। যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন-তাই বলেছে।
-যাক-তাহলেই ভালো।কিন্তু মাথায় রাখবেন-কেউ কোনভাবেই ওকে রাগিয়ে দেবার মতন বা কষ্ট দেবার মতন করে কিছু বলবেন না। একটু হিসেব করে চলবেন। যদি তেমন কিছু না হয়-তাহলে অষুধ খেয়েই রোগ দমে আসবে।এখন কি করছে অরু?ঘুমাচ্ছে?
-হ্যা,ঘুমাচ্ছে।
- ঘুমাক,ঘুমালেই ভালো। জেগে থাকলেই সমস্যা। ঘুমেই থাক অরু।
৫ 
একসময় অরুর ঘুম ভাঙ্গে। জেগে উঠে শূণ্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়। বুঝতে পারেনা সে কোথায়-কেন? মা এগিয়ে আসে-‘কিরে মা?কেমন লাগছে শরীরটা এখন?’
অরু কিছু বলেনা-মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়। শরীর ভালো লাগছে।
মাথাব্যথা করছে? তেল দিয়ে দেবো?
অরু আবার মাথা হেলিয়ে দেয় ডানে। তেল দিয়ে দিক মা।
মা একটা স্টিলের বাটিতে নারিকেল তেল ঢেলে নেয়। অরুকে মেঝেতে বসিয়ে মা দুই পা ছড়িয়ে খাটের ওপরে বসে। একটুখানি তেল হাতে নিয়ে ঘষে নেয়। এরপর অরুর লম্বা চুলে মেখে দেয়। চুল ভর্তি জট। চুলে তে মাখতে গিয়ে টান লেগে জট ছিড়ে যাচ্ছে।খুব ব্যাথা!
কিন্তু অরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শূণ্য দৃষ্টিতে আয়নার দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে সে কাকে দেখছে-সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। হয় নিজেকে-নয় মা কে-নয় সবকিছুকে। সারা দুনিয়াকে সে এক অদ্ভুত শূণ্য দৃষ্টি দিয়ে ঘিরে রেখেছে।
মাথায় তেল ডলতে ডলতে মায়ের মুখ থেকে মৃদু স্বরে জ্ঞানের বাণী বের হয়। এই জ্ঞানের বাণী মা শিখেছে তার মামার বাড়িতে। মা বাবামায়ের মেজোসন্তান। সহজ করে বলতে হয় মেজো ‘মেয়ে’। অনেক মন্দিরে মানত রাখার পর শিবরাম বসাকের চতুর্থ সন্তান হয় ছেলে। কাজেই বাকি তিন তিনটি মেয়ের ভার বহন তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তিন মেয়ের মধ্যে প্রথমটি বড় আদরণীয়া।প্রথম সন্তান বলে কথা! তৃতীয়টি দুরন্ত। বাপের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়ি যাবার কথা বললে শিবরাম বসাককে সে কামড়ে দেবার সম্ভাবনা আছে। তাই মদ্যিখানের নম্র-ভদ্র-সভ্য মেয়েটাকেই তার মামারবাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
তাকে বোঝানো হলো-ভালো শিক্ষার জন্যে শহরে পাঠানো হচ্ছে। বাপ-মা তাকে কম ভালোবাসেনা। কিন্তু মামা-মামীরা আরো বেশি ভালোবাসে।
মামা-মামীর বাপ-মাকে টক্কর দিতে খুব একটা কষ্ট করতে হতোনা-কিন্তু তারা সেটুকু করতেও অরাজি ছিলেন। মধ্যের মেয়েটিকে তাই ছোটবেলা থেকেই গলগণ্ডের মতন অপরের বোঝা হয়ে থাকা শিখতে হয়েছে। কাজেই গিন্নিবিদ্যার সে বড় সুনিপুণ। কেমন করে অপরের আগ্রাসনের তলে মাথা নিচু করে থাকতে হয়-তার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। তাই মেয়ের মাথায় তেল দিতে দিতে তার কন্ঠে সেইসব জ্ঞানের অমৃতকথা ঝরে পড়ে।
মামনি-তুই যদি তোর শ্বশুরমশায়ের কথায় রাগ করে থাকিস-তাহলে ভুল করছিস। নতুন বিয়ের পরপর ওরকম শ্বশুরবাড়ি নিয়ে সবার একটু কষ্ট হয়। তুই যখন আমার পেটে-তখনও তোর দাদুমা আমাকে দিয়ে বাসন মাজাতো। ব্যাথায় কাজ করতে না পারলে বলতো আমি কামচোর। তাই ব্যাথা হলে জানলার গ্রীল চেপে ধরে ব্যাথা লুকাতাম। তাই করতে গিয়ে একবার গ্রীলের চাপে হাতের মাংস থেঁতলে গেলো। এই দেখ, আমার হাতে এখনও একটু একটু দাগ দেখা যায়
তবু কি আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে গেছিলাম? যাইনি! তখন যদি আমি সব সহ্য না করে তোর মতন এমন সংসারে ইস্তফা দিয়ে চলে আসতাম-তাহলে কি তোরা আজকে এতো ভালো একটা ঘরে থাকতে পারতি? পারতি না! কাজেই সংসারের জন্যে মাঝেমাঝে একটু আপোষ করতে জানতে হয়। বুঝলি?
অরু বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যায়না। সে চুপচাপ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একদিকে।
এভাবে দিন কাটে। অরুকে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে দেয়া হয়না। কে জানে-কখন কিসে আবার পাগলামি বেড়ে যায়। অরু জেগে থাকে বড়জোর দুই কি তিন ঘন্টা। এই দুই তিনঘন্টা সে আতিপাতি করে তার ফেমিনিজমের পোস্টারটা খোঁজে। কিন্তু খুঁজে পায়না। কারণ সেইদিনের পর তাকে অন্যঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই ঘরের চার দেয়াল ধবধবে সাদা। সাদায় চোখ ঝলসে আসে। এই সাদা ঘরটা থেকে তাকে বের হতে দেয়া হচ্ছেনা।
ডাক্তার বলছে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন আর কোন পাগলামির লক্ষণ নেই। চুপচাপ হয়ে গেছে খুব। সেটা খুবই ভালো লক্ষণ। এভাবে একটা অষুধ আর দুই সপ্তাহ আর একটা অষুধ টানা এক বছর চালিয়ে গেলে অনেকটা সেরে আসবে।
কিন্তু ডাক্তারসাহেব, ওর হাজবেন্ড ফোন করেছিলো। সে নাকি তার বাসায় ম্যানেজ করেছে যাতে অরুকে ফিরিয়ে নেয়। সে ওদের বুঝিয়েছে যে অরু এখন সুস্থ। তারা অরুকে দেখতে আসতে চাইছে। দেখতে চাইছে অরুর পাগলামি সুস্থ হয়েছে কিনা। তাদের সাথে দেখা করার মতন অবস্থায় কি এখন অরু পৌঁছেছে?
এখনো নয়। তাদেরকে বলুন আরো সপ্তাদুয়েক পরে আসতে।ততদিনে আরো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। অরু কোথায়-ওকে দেখতাম একটু।
ঘুমাচ্ছে। আজকাল সারাদিন ঘুমায়।
ঘুমাক,ঘুমালেই ভালো। জেগে থাকলেই সমস্যা। ঘুমেই থাক অরু।


আজ সকালের ফ্লাইটে মিসেস অরুণিমা চক্রবর্তী লন্ডন চলে গেছে।
এয়ারপোর্টে এসেছিলো অরুর শ্বশুরবাড়ির সব লোকজন। সি-অফের সময় তাদের প্রণাম করতে করতে অরুর কোমর ব্যাথা হয়ে গেলো।
অরুদের বাসা থেকে এসেছিলো খালি অরুর বাবা আর মা-নিরু আসেনি।
লন্ডনে গিয়ে ফোন করেছিলো অরু-তার সাথে দেখা হয়েছে দেবব্রতের। দেবব্রতের সাথে কথা বলে বাবা মা নিশ্চিত হয়েছে যে অরু ভালো আছে-সুস্থ আছে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে দেবব্রতকে এক এক করে অরুর সবগুলো অষুধ খাবার সময়সূচি বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন বাবা।
বাড়ি পৌঁছেই বাসায় স্কাইপে ফোন করেছে অরু। বাবা মায়ের সাথে কথা বলার পরে নিরুর কাছে ট্যাব এসেছে। ট্যাবের অন্যপারে সে তার বোনকে দেখতে পাচ্ছে। তার চোখের নিচে যেন ক্লান্তির বস্তা পড়েছে, গালের চামড়া ঝুলে গেছে যৌবনের বার্ধ্যকে, চোখের মাঝে লাল লাল শিরা হয়ে আছে, দাঁতে হলদে দাগ পড়েছে। হয়তো ওষুধের প্রভাব এগুলো। হয়তো সাইকায়াট্রিস্টের এলোপ্যাথি ওষুধের প্রভাব অথবা বাবা মায়ের আদেশ উপদেশ আর সাবধানবানীর প্রভাব ।
দিদিকে পেয়েই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ধবধবে সাদা ঘরে শ্যামলা মায়ার মেয়েটা ঝলমল করে ওঠে, দিদির সাথে গল্প করার পসরা সাজায়।
কিরে দিদি! কেমন চলতিসে সবকিছু? গাব্বার সিং তোমাকে বেশি জ্বালাচ্ছে না তো?
এই! তোর দাদাকে নিয়ে এমন বলবিনা একদম। এতো ভালো একটা লোক, তুই অকারণেই পিছু লাগিস।
ওমা! তুমি নিজেই তো আগে গাব্বার সিং ডাকতে।
সেতো আমার জামাইকে আমি কি ডাকবো সেটা আমার ব্যাপার, তুই ডাকবি কেন?
ওরে বাবা, জামাই কি তোমার মন জয় করে ফেলেছে নাকি? তুমি না বলতা যে গাব্বার তোমার দেহ পাবে, কিন্তু মন পাবেনা?
আরে তখন কি বুঝেছি নাকি যে তোর দাদা এতো ভালো মনের একটা মানুষ। কি করেছে শোন না- আমার জন্যে এরই মধ্যে একটা হিরের নেকলেস কিনে এনেছে। পরের উইকেন্ডে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে ভার্জিনিয়া বিচে। আমাকে বলেছে ওখানে গিয়ে নাকি সুইমস্যুট পরতে দেবে। কি লজ্জার কথা বল!
বাহ! ভালোই তো। তুমি তো মনে হয় সুখেই আছো।
বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসে নিরুর। এজন্যে না যে তার মনে হচ্ছে যে দিদি মিথ্যে বলছে-তার ভয় হয় কারো তার কাছে মনে হচ্ছে দিদি সত্যি বলছে। দিদি আসলেই সুখে আছে, আসলেই হিরের নেকলেস নিয়ে আদিখ্যেতা করছে তার বিপ্লবী বড়োবোন।
মাহিন ভাইয়ার বিসিএস হইসে, শুনসো? মেজিস্ট্রেট হইসে। বিয়েও করতেসে সামনের মাসে।
তাই নাকি? ভালো তো! আমাদের মধ্যে ওই ছিলো একটু ব্রাইট টাইপের। এখন দেখ লাইফ সেটেল একেবারে। আর কোন চিন্তা নাই। ওর বউটা কতো লাকি বুঝতেসিস? ম্যাজিস্ট্রেটের বউ! বাংলাদেশের হিসাবে ক্লাসটা চিন্তা কর। ভাবসাবই আলাদা।
আচ্ছা, বাদ দাও। ভাল্লাগে না এইসব নিয়ে কথা বলতে। তোমার পড়ালেখার কি অবস্থা বলো। পেপার যেটা লিখতেসিলা ওইটা শেষ হইলো? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কি অবস্থা?
হবে হবে, সবই হবে। এখন তো তোর দাদার খুব চাপ যাচ্ছে, পিএইচডি ডিফেন্স আর কয়েকদিন পরেই। এইসময়ে তো কেউ একজন ঘরে থাকা লাগে-তাইনা? ঘরের একটু দেখভাল করা লাগে। ওর ডিফেন্সটা হয়ে যাক, তার কয়দিন পরেই আমাকে পড়ানো শুরু করবে জিআরইর জন্যে, বুঝলি। তুই আবার ভাবিস না আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিসি একদম। রান্নাবান্নার মাঝে আমি মাগুশ জিআরই এপে শব্দ মুখস্থ করি। আমি জাস্ট একটু ব্রেক নিচ্ছি আরকি এইসব থেকে তোর দাদার প্যাড়াটা পার হবার জন্যে। সংসারের জন্যে মাঝেমাঝে একটু আপোষ করতে জানতে হয়। বুঝলি?
ও আচ্ছা।
কি জানি একটা জিজ্ঞেস করবি তুই বলতেসিলো মা?
না, কিছুনা। এমনিই খোজখবর নেয়া আরকি। অন্য কোন কথা নাই।
অন্য কথা ছিল, তবে সেই কথা এই মিসেস চক্রবর্তীকে বলার মতন কথা বলে মনে হয়নাই নিরুর কাছে। গাব্বার সিং ওর দেহ পেয়েছে, মনও পেয়েছে, কিন্তু মগজটা পায়নি-অন্তরটা পায়নি-আত্মাটা পায়নি। সেটাকেই নিরুর এখন খুব দরকার।
নিরু ব্যর্থ হয়ে ভেতরের ঘরে ফিরে আসে। ট্যাবটা ফেরত রাখতে হবে।
ঘরের ভেতর ধুন্ধুমার কান্ড। রায়বাড়িতে আজ খুব সুখের দিন! ঘরের লক্ষ্মীকে সফলভাবে সুপাত্রে সম্প্রদান করা গেছে। মা একটু পরপর ফুপিয়ে কাদছেন-কিন্তু সেই কান্নাটুকুও রীতিমাফিক। বাবার মনটাও একটু ভার-কিন্তু এই মন ভারের ভেতরেও একটা নির্ভারতা লুকিয়ে রয়েছে। এবারে মেয়েটা আরেকটু সুস্থ হলেই তাকে একটা ছেলেপুলে নেবার কথা বলতেই হবে। তাহলে শান্তিমতন মরতে পারেন তিনি।
শুধু নিরুর মনটা সত্যিসত্যি ভীষণ খারাপ।আর এই মন খারাপের কথা বলার মতন আর কেউ নেই তার। আগে দিদিতে বলতে পারতো-এখন তো দিদি চলে গেছে পরের বাড়ী। নিজের কন্যাকে সম্প্রদান করার সাথে সাথে নিরুর বাবা তাকে জিজ্ঞেস না করেই তার দিদিকেও সম্প্রদান করে দিয়েছেন।
কাল নিরুকে দেখতে আসবে একদল মানুষ। তাদের একজন নিরুকে বিয়ে করতে চায়। তাকে নিরু চেনে না এবং সেও নিরুকে চেনে না। তবু সে যদি নিরুকে বিয়ে করার বায়না করে-নিরুর তাকেই বিয়ে করতে হবে। এরপর একসময় টাইম বোমার মতন করে এগিয়ে আসবে ফুলশয্যা। ওই অপরিচিত মানুষটার সাথে শুতে হবে নিরুর। বাবা মায়ের মুখের ওপর না বলার সাহস নেই ওর। অরুদিকে বিয়ে করবার জন্যে অনেক ছেলে লাইন দিয়ে ছিলো। ওকে বিয়ে করার জন্যে ছেলেদের রাজি করাতে সবার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে-জানে ও।
কখনো বাবা মায়ের একটুকু সুখের কারণ হতে পারেনি নিরু-সেই সামর্থ্য তার ছিলোনা। অরুর মতন সুন্দরী নয় সে-অরুর মতন পড়ালেখাতেও ভালো নয়। সুখ যখন দিতে পারেনি বাবা মা-কে, তাদের সামান্যতম দুঃখের কারণ হবার অধিকার নেই তার।
দিদি পারেনি-সে পারবে কেমন করে? দুইজনের মধ্যে দিদিই ছিলো বেশি সাহসী।
সেই ছোটবেলার থেকে দস্যি ছিলো দিদি। যা চাইতো-করতো। আর নিরু তার সব কাজের নিরব সহযোগী। কি করছে-কেন করছে-কখনও সেটাও জিজ্ঞেস করতোনা নিরু। দিদি যা করছে-ঠিক করছে। দিদিকে অনুসরণ করার মাঝে একটা অন্ধ নিশ্চয়তা ছিলো। দিদির পিছনে পিছনে হেঁটে এসেছে সে সারাটা জীবন। পরম আনন্দে-পরম নির্ভরতায়।
কিন্তু এখন কি করবে নিরু? কোথায় যাবে সে? দিদির পায়ের ছাপ এগুতে এগুতে হঠাৎ নিরুদ্দেশে। নিরুরও কি তাই করার কথা? নিরুরও কি দিদির পিছন পিছন যাবার কথা?
নিরুরও কি হারিয়ে যাবার কথা?
হঠাৎ মনে হয় সব ছেড়ে পালিয়ে যাবে নিরু। সাহস হয়না। দুইজনের মধ্যে কখনই সে সাহসী জন ছিলোনা। সে ছিলো ভীতু-দিদি ছিল তার সাহস। এতো চিন্তা করার কথা তো ছিলোনা নিরুর। তার শুধু দিদির পিছনে হাটার কথা ছিলো। দিদির কথা শুনে চলার কথা ছিলো। দিদি কোথায়?
নিরু হেঁটে দিদির ঘরে ঢুকে দাঁড়ায়। ঘরটা এখন ফাঁকা। এক পাশে অবহেলায় পড়ে আছে বিছানা।চাদর বদলানো হয়নি বহুদিন। এই ঘরে এই পরিবারের কেউ ঢোকেনা। অন্ধকার দিনগুলির কথা অনেক কষ্টে ছিপি দিয়ে রেখেছে সকলে এই ঘরে-সেই ছিপি খোলবার সাহস করেনা আর কেউ।
নিরু তবু এখানেই ফিরে এসেছে। কারণ তার স্মৃতিতে সে কখনো ছিপি লাগাতে পারেনি। বরং এই ঘরের বন্ধ গুমোটে যেন তার একটু শান্তি লাগে।
চিরপরিচিত চারদেয়ালের মাঝে এসে দাঁড়ায় নিরু। একদেয়ালে তাকভরা বই, টেবিলের ওপর ছড়ানো খাতাপত্র আর দেয়ালে ফেমিনিজমের একটা হলদে পোস্টার। পোস্টারটা অরুণিমা নিজে প্রিন্ট করিয়েছিলো। রোসি দ্য রিভেটার পেশি ফুলিয়ে ঔদ্ধত্যময় দৃষ্টিতে পৃথিবীকে বলছে-আমরাও পারি।
পোস্টারটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অরু দিশেহারা হয়ে পড়ে। দিদির জন্যে জমানো প্রশ্নগুলো করতে থাকে পোস্টারের রোসিকে।
সবাই কি শেষে হেরে যায় দিদি? সবাই কি শেষে মা হয়ে যায়? তুমি আর আমি না কতো হাসাহাসি করতাম মা কে নিয়ে, দিদি? সেই আমরাও কি শেষে ‘মা’ হয়ে যাবো?
হঠাৎ নিজের ওপর খুব রাগ হয় নিরুর। কি করছে ও? একটা নির্জীব পোস্টারের সাথে কথা বলছে কেনো পাগলের মতন! প্রচন্ড রাগে আর ক্ষোভে নিরু ঘরের মাঝে দাপাদাপি করতে থাকে। অদ্ভুত ক্রোধ ঢেলে দেবার জন্য তার নিরপরাধ কাউকে দরকার। নিরপরাধকে শাস্তি দিলেই কেবল এই রাগ কমতে পারে।
তখনই নিরুর চোখে পড়লো সেই হলদে ফেমিনিজমের পোস্টারটা। সব নষ্টের গোড়া। শুরুতে এইসব না থাকলে-শেষে এতো কষ্ট হতো না।বজ্জাত হলুদ পোস্টার! পাগলের মতন পোস্টারটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে নিরু। সে ছিড়ে ফেলবে-কুটিকুটি করে ফেলবে সবটা।
তখনই যেন কে ডাকলো তাকে।
নিরু!এই নিরু।
গলাটা ঠিক যেন অরুদির মতন। কোথা থেকে আসছে?নিরু কি ভুল শুনলো?
না-ভুল মোটেই নয়। খাটের নিচের থেকে নিরুকে ডাকছে কেউ।
কুঁজো হয়ে বসে খাটের নিচে তাকালো নিরু।
কুকুরকুন্ডলী হয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে অরু।
তুমি! তুমি! তুমি এখানে কেমন করে? তুমি না চলে গেলে? তুমি এখানে কেমন করে?
আমি আবার কোথায় গেলাম রে? আমি তো কোথাও যাইনি! আমি তো এখানেই ছিলাম। ওই যেদিন ওরা আমাকে তাড়িয়ে এখানে লুকিয়ে দিলো-তখন থেকে আমি এখানেই আছি-বের হইনিতো কখনো! যে চলে গেছে সে অরুণিমা চক্রবর্তী, আমি তো শুধুই অরু। রায়ও নই-চক্রবর্তীও নই-একলা সেই ছোট পুরোনো অরু। আমি এখানে রয়ে গেছি। লুকোচুরি খেলার মতন লুকিয়ে আছি।কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা। দারুণ লুকিয়েছি এইবার।
দিদি...ওরা আমাকে নিয়ে যাবে দিদি...ওরা নিয়ে যাবে...আমি যাবো না…
যাস না। এখানে আয়।আমার সাথে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাক। আমি তোকে লুকিয়ে দেবো। আমার কাছে কোন ভয় নেই। সব ভয় দূর করে দেবো আমি। এখানে আয়-মা! আর কেউ তোকে খুঁজে পাবেনা।
অরুর স্বর অনুসরণ করে নিরু খাটের নিচে ঢুকে পড়ে-পরম নির্ভরতায়-পরম বিশ্বাসে।
তারপর চার হাত পা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে অরুকে।
ওদের আর কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৫৩
৪৫৬ বার পঠিত
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরুর রচনা.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৬

একজন সাধারণ পাঠক হলেও দেশী-বিদেশী আমার প্রিয় লেখক সাহিত্যিকদের তালিকা বেশ দীর্ঘ! বনফুল, যার আসল নাম- বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়। শখের বশে তিনি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। পেশায় চিকিৎসক ছিলেন।
বলাই চাঁদ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন রাজনৈতিক দলকে খারিজ বা সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে নয় জামাত!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫


কোনো রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেই বলে জানিয়েছেন দলটির আমির আমির ডা. শফিকুর রহমান। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাঁঝের মায়া

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৮


সেদিন সন্ধ্যায় ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। হঠাৎ অচেনা একটা নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন এলো। “হ্যালো, কে?” আমি জিগ্যেস করলাম। ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ অস্পষ্টভাবে কী যেন বলছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলিয়েন স্বীকৃতি না দেয়ার কারন

লিখেছেন সরকার পায়েল, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:১৯

এলিয়েন বলতে আমরা বুঝি অতি প্রাকৃত শক্তি সম্পন্ন জীব l যাদের শারীরিক সক্ষমতা মানুষ হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন l রক্ত মাংসের জীব থেকে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি l রক্ত মাংস... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজী মুক্ত সামু!!

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২







মনপুরা মুভিতে একটা ডায়ালগ ছিলো যে, গাজী বেটারে তুমি চিনো না, বেশি ফাল পাইরো না। এদিকে ব্লগের গাজীকে সবাই চিনে, যারা লাফালাফি করে তারা ব্যবস্থা নেয়,গাজী কিছু করতে পারে না,ব্যান... ...বাকিটুকু পড়ুন

×