কোয়ান্টাম ফিজিক্স, নিউরো-সাইন্স এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ শতকে বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের বিশ্ব দৃষ্টিকেই পাল্টে দিয়েছে। যে বিজ্ঞান ছিল দীর্ঘদিন বস্তু কেন্দ্রিক, নিউটনিয়ান মেকানিক্সের নিগড়ে বন্দী, সে বিজ্ঞানই এখন হয়ে পড়েছে চেতনা নির্ভর। পাশ্চাত্যের পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন এসে একাত্ম হয়েছে প্রাচ্যের সাধকদের বিশ্বদৃষ্টির সাথে, মন কেন্দ্রিক বিশ্ব দর্শনের সাথে।
বিজ্ঞানী নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েলের সূত্র অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞান উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এক সুশৃঙ্খল বিশ্ব দৃষ্টি উপস্থাপন করে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছুই এক নিয়মের অধীন, সেখানে বিজ্ঞানীর কোন ভূমিকা নেই। বিজ্ঞানী সেখানে একজন দর্শক মাত্র। আর পুরো প্রক্রিয়া হচ্ছে দর্শক-মন নিরপেক্ষ। এই বিশ্বদৃষ্টিতে প্রথম ফাটল ধরান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘থিউরী অব রিলেটিভিটি’ উপস্থাপন করে। এই নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে বস্তুগত বাস্তবতা প্রতিষ্ঠায় দর্শকের আগমন ঘটে। বস্তুগত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞানীও এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে পরিণত হন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভব ঘটার সাথে সাথে দর্শকের ভূমিকা বস্তুগত ঘটনা বা মতবাদের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বস্তুগত মতবাদ কাঠামোয় বা যে কোন বিষয় ব্যাখ্যায় দর্শকের মন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় এই আমূল পরিবর্তন কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞানীদের বিস্ময়াবিস্ট করে তোলে। এবং তাঁরা মানব মন ও দর্শন সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়নে নিমগ্ন হন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোন যুগেই নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীরা এত বিপুল সংখ্যায় তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের দার্শনিক ও মানবিক মূল্যায়ন করে নিবন্ধ বা পুস্তক রচনা করেন নি।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়ার্নার হেইসেনবার্গ তাঁর “Philosophical Problems of Quantum Physics’-এ লেখেন যে, প্রকৃতির নিয়ম সংক্রান্ত গবেষণা এখন আর শুধু মৌল কণাসমূহ নিয়ে আলোচনা করে না। এখন তা আলোচনা করে এই কনাসমূহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিয়ে অর্থাৎ আমাদের মনের বিষয়বস্তু নিয়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল সমীকরণ প্রস্তুতকারী বিজ্ঞানী এরউইন শ্রডিঞ্জার ১৯৫৮ সালে Mind and Matter নামে এক অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বিজ্ঞানের এই নতুন তত্ত্বের আলোকে দার্শনিক অলডাস হাক্সলির আত্মিক বিশ্বদর্শনের সাথে নিজেকে একাত্ম করেন। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রডিঞ্জারই প্রথম প্রাচ্যের দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে সমমর্মিতা প্রকাশ করেন। এরপর থেকে আধুনিক বজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে পাশ্চাত্যে দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ হচ্ছ, ফ্রিটজিয়ফ কাপরা-এর ‘The Tao of Physics’ এবং গ্যারী জুকাভ-এর ‘The Dancing Wu Li Masters’.
ডারউইনের পর থেকে মানবীয় আচরণকে একটা জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রচুর চেষ্টা করা হয়েছে। আবার জৈবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে শুধুমাত্র শারীর বৃত্তীয় কার্যক্রম হিসেবে। এদের বক্তব্যকে কার্ল সাগান ‘The Dragons of Eden’-এ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন: ‘আমরা যাকে কখনও কখনও মন বলিতা হচ্ছে ব্রেন। আর এই ব্রেনের কার্যক্রম এর অঙ্গ ও শারীর-বৃত্তীয় কার্যক্রমের ফলাফল ছাড়া কিছুই নয়। এখানে মন বলে কিছু নেই।’ আর মলিকুলার বায়োলজিস্ট ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর বই ‘Of Molecules and Men’-এ লিখেছেনঃ ‘সকল প্রাণী বিদ্যাকে অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন দিয়েই ব্যাখ্যা করতে হবে।’
জীবন, প্রাণ, মনকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, মন থেকে শুরু করে আবার মনেই ফিরে আসতে হয়। যেমন প্রথমত ধরুন, চিন্তা ও চেতনাসহ মানব মনকে কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেমের তৎপরতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যাকে আবার অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও শারীর বৃত্তীয় কার্যক্রম হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সকল স্তরের জৈবিক কর্মকান্ড পরমাণু বিজ্ঞানের আলোকে পুরোপুরি বোঝা যেতে পারে। কারণ প্রতিটি জৈবিক কার্যক্রম কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদির পরমাণুর পারস্পারিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সর্বশেষে, পরমানু বিজ্ঞানকে পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর মাধ্যমে বুঝতে হবে। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর সাথে মন হচ্ছে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দর্শক মনের ভিত্তি ছাড়া কোয়ান্টাম প্রক্রিয়াই হচ্ছে অসম্পূর্ণ।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রসেফর সৈয়দ শফিউল্লাহ তাঁর ‘অস্তিত্বের অতলান্তে’ গ্রন্থে কোয়ান্টাম সূত্র প্রসঙ্গে সাব-এটমিক পার্টিকেলের স্পিন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছনঃ ‘পারমাণবিক কিংবা অব-পারমাণবিক পর্যায় অবিশ্যি চাক্ষুষ্মান জগতের স্পিনের সাথে তুলনা করলে বিপাকে পড়ার সম্ভবনাই বেশি। বিশেষ করে নিজ অক্ষের চারপাশে আবর্তনের কথা উঠলেই দিক নির্দেশনার কথা ওঠে। মনে আসে একটা রেফারেন্স অক্ষের। ইলেক্ট্রন স্পিনের দিক নির্ণয়ের জন্যে বিদ্যুৎ কিংবা চুম্বকীয় ফিল্ডকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই, রেফারেন্স ফিল্ডকে যে দিকেই বসাই না কেন ইলেক্ট্রন স্পিন ঠিক ঠিক রেফারেন্স ফিল্ডের সাথে অ্যালাইন্ড হবে অর্থাৎ পাশাপাশি অবস্থান করবে। ব্যাপারটা যেন খানিকটা ্টেমন যে, ইলেক্ট্রন যেন আগে থেকেই বুঝতে পাছে নিরীক্ষণকারী কিভাবে তার নিয়ম থেরি করতে যাচ্ছেন। আরেকভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, নিরীক্ষণকারীর মনই ঠিক করছে নিরীক্ষণের ফলাফল কি হবে। এক্ষেত্রে জড়বস্তুর উপর মানব মনের কর্তৃত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ তো গেল স্পিন সম্পর্কে বিশ্বজনীন অনিশ্চয়তার একটা গুরুত্বপূর্ণ গভীর দিক। আরেক দিকে দেখা যায় সাব-পারমাণবিক জগতে স্পিন একটি ধ্রুব বাস্তবতা। এই স্পিনের কারণেই পরমাণুদের মৌলগত ভিত্তিতে এত সমাহার, রাসায়নিক বন্ধনের অন্যতম উৎসের উদ্বোধন এবং তার থেকে জীবনের উৎসব।’
মনের বস্তুকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নিউরো-সাইন্টিস্ট স্যার জন একলস-এর বক্তব্যও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। নিউরো-সাইন্স বিকশিত হয়েছে গত ৩০ বছরে। গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য মানব মস্তিস্ক বা ব্রেন। তারপরও ব্রেন সর্ম্পকিত জ্ঞান এখনও রয়েছে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। বিজ্ঞানী একলস প্যারাসাইকোলজিস্টদের সম্মেলনে মন বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা যখন চিন্তা করি, তখন প্রতিটি চিন্তার সাথে সাথে ব্রেন নিউরোনে অবস্থিত কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু স্থান পরিবর্তন করে। কার্বন, হাইড্রোজেন ইত্যাদির পরমাণু হচ্ছে বস্তু আর চিন্তা হচ্ছে বস্তু অস্তিত্ব বিবর্জিত।’
বিশ্ব দৃষ্টি পরিবর্তনে বিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এই বিজ্ঞানের মূলকথা হচ্ছে, জীবকোষের মূলকেন্দ্র ডিএনএ-আরএনএ। সেখানে সংরক্ষিত তথ্য ভান্ডার দ্বারাই সকল প্রাণ বিকশিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই তথ্য ভান্ডারে পরিবর্তন আনয়ন করে প্রাণের বিকাশকে প্রভাবিত করা যায়। এই বাস্তবতা বস্তুর উপর চেতনা ও তথ্যের কর্তৃত্বকেই নতুন সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
মন ও চেতনার ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সার সংক্ষেপ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তাঁর ‘Remarks on the Mind-Body Question’ নিবন্ধে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, অধিকাংশ পদার্থ বিজ্ঞানীই এই সত্যকে মেনে নিয়েছেন যে, চিন্তা অর্থাৎ মনই হচ্ছে মূল। ‘চেতনার উল্লেখ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর নিয়মকে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা সম্ভব নয়।’ (It is not possible to formulate the laws of Quantum mechanics in a fully consistent way without reference to the consciousness’.) নিবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানী উইগনার বলেছেন, ‘বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত চেতনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’ (Scientific study of the world led to the content of consciousness as an ultimate reality’.) আর এভাবেই আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ এসে একাত্ম হয়েছে প্রাচ্যের প্রাচীন সাধকদের মনকেন্দ্রিক বিশ্ব দর্শনের সাথে। আর আধুনিক মানুষ নতুনভাবে ব্রতী হয়েছে চেতনার শক্তিকে, মনের অসীম ক্ষমতাকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের। কোয়ান্টাম মেথড এই অসীম শক্তিকে ব্যবহারের সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৯:৫৭