মানুষের অসীম শক্তি ও সম্বাবনাকে সবসময় শৃঙ্খলিত ও পঙ্গু করে রাখে সংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে প্রচলিত ধারণার শৃঙ্খলে সে ক্রমান্বয়ে বন্দী হয়ে পড়ে। পরিবেশ যা তাকে ভাবতে শেখায় সে তা-ই ভাবে, যা করতে বলে তা-ই করে। যে হতে পারত যুগস্রষ্টা বিজ্ঞানী, হতে পারত শতাব্দীর অভিযাত্রী, অমর কথাশিল্পী, হতে পারত মহান নেতা বা বিপ্লবী, হতে পারত আত্মজয়ী বীর বা ধর্মবেত্তা, সেই মানব শিশুই ভ্রান্ত ধারণার বন্দী হয়ে পরিণত হচ্ছে কর্মবিমুখ, হতাশ, ব্যর্থ কাপুরুষে। এ ব্যর্থতার কারণ মেধা সামর্থ্যের অভাব নয়, এ ব্যর্থতার কারণ বস্তুগত জিঞ্জির নয়, এ ব্যর্থতার কারণ মনোজাগতিক শিকল।
প্রতিটি মানবশিশু সুপ্ত মহামানবরূপে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কায়েমী স্বার্থ সৃষ্ট মনোজাগতিক জিঞ্জির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে তাকে পরিণত করে এক অসহায় নিরুপায় প্রাণীতে। সার্কাসের হাতির জীবনের দিকে তাকালে এই মনোজাগতিক দাসত্বের বিষয়টি বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না।
জঙ্গল থেকে দুরন্তপ্রাণ চঞ্চল হস্তি শাবককে ধরে এনে ৬ ফুট লোহার শিকল দিয়ে শক্ত পাটাতনের সাথে বেঁধে রাখা হয়। প্রথম দিকে হস্তি শিশু শিকল ছেঁড়ার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায়। কিন্তু এত ছোট। শরীর দিয়ে সে জিঞ্চির ভাঙতে পারে না। উল্টো তার পা-ই রক্তাক্ত হয়ে যায়। ফলে এক সময় এই গন্ডি ও বন্দিত্বের কাছে হস্তি শিশু আত্মসমর্পণ করে। এভাবে তার মধ্যে তৈরি হয় সংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। সে বিশ্বাস করতে শুরু করে এই গন্ডী, এই জিঞ্জির থেকে তার মুক্তি নেই। এটাই তার নিয়তি।
হস্তি শিশু বিশাল দেহী পূর্ণাঙ্গ হাতিতে পরিণত হওয়ার পরও শিকল দিয়ে তাকে ছাগল বাঁধার খুঁটির সাথে বেঁধে রাখলেও সে ৬ ফুট বৃত্তকেই তার পৃথিবী ধরে নেয়। যখনই শিকলে টান পড়ে তখনই সে তার বৃত্তের আরও ভেতরে প্রবেশ করে। ভ্রান্ত বিশ্বাস তাকে বলে এর চেয়ে আর এগুনোর সাধ্য তোমার নেই। এমনকি দেখা গেছে সার্কাস মেলায় আগুন লাগলেও হাতি তার শিকল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেনা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কারণ ভ্রান্ত বিশ্বাস তাকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখে। যখন তার দেহের শক্তি দিয়ে এক টানে খুঁটিসহ সব কিছু উপড়ে ফেলতে পারে, তখনও সে ভাবে এই ৬ ফুট বৃত্তই আমার নিয়তি। তার এই শৃঙ্খল লোহার শিকলের নয়, খুঁটির নয়। এ শৃঙ্খল হচ্ছে মনের।
আমাদের অবস্থাও এখন তা-ই। আমাদের প্রতিটি মানুসের প্রতিটি পরিবারের পুরো জাতির বিপুল সম্ভাবনা, শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সংস্কার, ভ্রান্ত বিশ্বাস, শোষক ও পরাভববাদীদের আরোপিত মিথ্যা ধারণার শৃঙ্খলে আমরা নিজেদেরকে গন্ডীবদ্ধ ও বন্দী করে ফেলেছি। দুর্দশাগ্রস্থ ও গ্লানিকর জীবনকেই আমরা আমাদের নিয়তি ও ভাগ্যরূপে মেনে নিচ্ছি। সার্কাসের হাতির মতই পুড়ে মরে গেলেও শিকল ভাঙার কোনো চেষ্টা করছি না। কিন্তু শুধু মাত্র একবার এই সংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা ঝেড়ে ফেলে দিলে দেখতে পাব আমরা প্রত্যেকে এক বিপুল শক্তির আধার। এই ভ্রান্ত ধারণার শেকল ভেঙে মুক্ত বিশ্বাসে উপনীত হওয়াটাই হচ্ছে মানুষের আসল স্বাধীনতা। কারণ মুক্ত বিশ্বাস হচ্ছে সকল সাফল্য, সকল অর্জনের ভিত্তি। বিশ্বাসই রোগ নিরাময় করে, ব্যর্থতাকে সাফল্যে আর অশান্তিকে প্রশান্তিতে রূপান্তরিত করে। বিশ্বাসই মেধাকে বিকশিত করে, যোগ্যতাকে কাজে লাগায়, দক্ষতা সৃষ্টি করে।
মুক্ত বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় মানুষের মানবিকতার উত্থান পর্ব। তখনই সে বুঝতে পারে, সে সৃষ্টির সেরা, আশরাফুল মখলুকাত। নিজের অসীম শক্তি ও সম্ভাবনাকে বুঝতে পারে। লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি, কাপুরুষতা ও প্রবৃত্তির শৃঙ্খল যে অনন্য মানবসত্তাকে বন্দী করে রেখেছে, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার শক্তি তার মধ্যে জন্ম নেয়। সে মুক্তি পায় প্রাত্যহিক জীবনের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি থেকে। মুক্ত বিশ্বাস প্রতিটি কাজে চিত্তকে করে একাত্ম। আর কাজের সাথে একাত্ম হতে পারলে প্রতিটি কাজ হয়ে ওঠে আনন্দের উৎস।
দৈনন্দিন জীবন বেশির ভাগ চিন্তাশীল মানুষের জন্যেই যুগে যুগে ছিল এক ক্লান্তিকর বিড়ম্বনা। এ ক্লান্তিকর বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির পথ সচেতন মানুষ সব সময়ই খুঁজেছে। এক শিষ্য গুরুর কাছে বললেন, এই ভাত খাওয়া, গোসল করা, কাপড় পরা, সংসার করা, প্রার্থনা করা-এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চাই।
গুরু বললেন, ভাত খাও, গোসল করো, কাপড় পরো, সংসার করো, প্রার্থনা করো।
কিছুদিন পরে শিষ্য আবার আর্তি জানালেন।
গুরুর সেই একই জবাব। একই নির্দেশ।
গুরুর বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে শিষ্যের লেগেছিল এক যুগ। এক যুগ পরে তিনি বুঝেছিলেন, যান্ত্রিকতার স্বয়ংচালিত ক্রিয়ার মত কাজ করে যাওয়ার ফলেই প্রাত্যহিক কাজে একঘেয়েমি চলে আসে। বেশিরভাগ সময়ই মন অতীতে বা ভবিষ্যতে বিচরণ করে বলেই আমরা বর্তমানকে পুরোপুরি উপভোগ করতে ব্যর্থ হই। বর্তমান হয়ে ওঠে একঘেয়ে। দিনের প্রতিটি কাজের সাথে চিত্তকে একাত্ম করতে পারলে, প্রতিটি কাজের মাঝে আত্মনিমগ্ন হতে পারলে, মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারলেই যান্ত্রিকতার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রতিটি কাজই হয়ে ওঠে আনন্দের উৎস। তখন প্রতিদিনের প্রতি লোকমা আহার, প্রতিবারের গোসল, প্রত্যেক কাপড়, স্ত্রীর সাথে আলাপন, দৈনন্দিন কর্তব্য ও দায়িত্ব – অর্থাৎ প্রতিটি কাজই মনে হবে এ এক নতুন জগৎ, এ এক নতুন জীবন, এ এক নতুন আনন্দলোক। তখন প্রতিবারের প্রার্থনাতেই আপনি পুলকিত হবেন, চমকিত হবেন, স্রষ্টাকে উপলব্ধি করবেন নিত্য নব মহিমায়। প্রতিটি চাওয়া পরিণত হবে পাওয়ায়। প্রতিটি সেজদা পরিণত হবে মেরাজে।
ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কারের শৃঙ্খল মুক্তির পথ হচ্ছে মেডিটেশন। দৈনন্দিন কাজের একঘেয়েমিকে নতুন আনন্দলোকে রূপান্তরিত করার পথও মেডিটেশন। কারণ মেডিটেশন আপনর মনকে বর্তমানে নিয়ে আসে। মেডিটেশন অতীতের ব্যর্থতার গ্লানি আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে মনকে মুক্ত করে। বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তে সংযোজন করে নব নব মহিমা। প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্লোকে মনকে প্রবেশ করায়। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ সচরাচর বিষয়কেও নতুন পর্যবেক্ষণী আলোয় নতুন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর করে তোলে। মেডিটেশন আপনাকে আত্মনিমগ্ন করে। অন্তর্লোককে উদ্ভাসিত করে নতুন জ্ঞান আর উপলব্ধিতে। মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে। এই আত্মশক্তির আবিষ্কার ও আত্ম অনুভব এমন এক মুক্ত বিশ্বাস-যা আপনাকে সকল শিকল থেকে মুক্ত করবে, দৈনন্দিন একঘেয়েমি রূপান্তরিত হবে আনন্দে।
মেডিটেশনের পথ ধরেই আপনি অতিক্রম করবেন আপনার জৈবিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা। আপনার উত্তরণ ঘটবে অনন্য মানুষে। আপনি পাবেন আপনার প্রথম ও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:৫৪