একটি ছেলে আর একটি মেয়ের গল্প বলব। দুজনের পরিচয় ফেসবুকে, যদিও দুজন দুজনকে অনেক আগে থেকেই চিনত। মেয়েটি ছিলো লাজুক প্রকৃতির আর ছেলেটি বেশ উৎফুল্ল স্বভাবের। দুজন দুই মেরুর। ফেসবুকে অনেকদিন কথা বলতে বলতে একদিন ছেলেটি হঠাৎ করেই কি জানি একটা ভাবল কিন্তু কিছু বলল না।
বেশকিছুদিন পরের কথা ছেলেটি একদিন হঠাৎ করে মেয়েটিকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল। মেসেজটি ছিল অনেকটা এরকম - .................
........
.......... I Love You..................
ওহ!!!! ছেলেটির নাম অপু আর মেয়েটির নাম মৌ।
প্রথম দেখার পর থেকে অপুর পৃথিবী মৌকে ঘিরেই আবর্তিত হত। তবে প্রেমে পড়লে যেসব রোগ হয় তার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয়নি। ছেলেটির মনের কোনে স্বাভাবিক কবিত্ব থাকলেও মেয়েটি ছিলো ঠিক তার উল্টো। মৌ ছিল একটু শান্ত গোছের বেশ গোছালো আর কিছুটা লাজুক কিন্তু অপু সম্পূর্ণ উল্টো। মাঝে মাঝে বিপরীত দিক থেকে আসা স্রোতগুলোও একসাথে মিলে একটি স্রোতে পরিণত হয় তাহলে আর কেনইবা হবে না মোহনায়ও তো তিনটি নদী একসাথেই মিলে। বেশ যাচ্ছিল দিনগুলো। তবে আহামরি কোন ন্যাকামো কারো মধ্যেই ছিল না।
অপু প্রেমের কবিতা লিখতে পারত না যখন ভাবছিলো সবকিছু একেবারে ছেড়ে দেবে ঠিক তখনই মৌয়ের শীতল স্পর্শ তার হাতে পুনরায় কলম ধরায়। লিখতে গেলেও পাশে কাউকে প্রয়োজন হয় তাহলে। অগোছালো আর খেয়ালী স্বভাবের অপু এক এক করে লিখে চলে। আর মৌ তার পাশে সেগুলো পড়ে আর হাসে। এমন হাসি অপু আর কাউকে হাসতে দেখেনি। মুগ্ধতার চেয়েও তাতে বেশী কিছু আছে। প্রতি বিকেলে অপু আর মৌ দেখা করত। আর যখন ব্যস্ত রাস্তায় রেললাইনের সমান্তরাল পাতের ওপর দিয়ে পাশাপাশি দুজন হাঁটার চেষ্টা করত, অপু পরে গেলেই হাহাহাহা.......... করে হেসে উঠত মৌ। অপু দেখত মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে
মৌকে খেপানোর জন্য অপু মাঝে মাঝে ওর মেয়েবন্ধুদের ছবি নিয়ে এসে দেখিয়ে বলত, "দেখো এটা আমার আরেকটা গার্লফ্রেন্ড "। মৌ একটু রাগ করলেও কখনও তা প্রকাশ করত না। বেশিরভাগ দিন অপু না খেয়ে কলেজে আসত আর মৌ ওর মুখ দেখেই বুঝে যেত আর জোরাজুরি করত খাবার জন্য। অপু সবসময়ই অজুহাত দেখাত আর যেতে চাইত না। একবার মৌ নিজেই সকালের নাস্তা করেনি অপুর সাথে রাগ করে তবে সে রাগ টিকত একঘন্টা বা দুইঘণ্টা। মৌয়ের একটা অভ্যাস ছিল যে অপুর সাথে দেখা করতে আসলেই মৌ তার একটা বান্ধবীকে নিয়ে আসত যা অপুর একেবারেই পছন্দ ছিল না।
বেশ কাটছিল তাদের দিনগুলো। হাসি, ঠাট্টা, আনন্দ আর মান অভিমানের মধ্য দিয়ে। অপু ছিলো একটু কাঠখোট্টা স্বভাবের। মৌ যদি কোনদিন রাগ করত অপু কখনোই তার রাগ ভাঙ্গাতো না।
বেশকিছুদিন পর অপু মৌয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে কোন একটা কারনে কিন্তু সে তার ভালবাসার কমতি তখনও ছিলো না। শুধু প্রকাশ হত না। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে আবার তারা নতুন করে শুরু করে সব। মৌ মেয়েটা অপুকে খুব ভালবাসত কিন্তু খেয়ালী অপু সেদিকে নজর দিত খুব কমই। মৌ কখনোই চাইত না অপু তার থেকে দূরে থাকুক তবে পরিবার নিয়েও সে ছিলো যথেষ্ট চিন্তিত। অপুর খেয়ালীপনার কথা আর বললাম না একটু পরেই নিজের চোখেই তা প্রত্যক্ষ করবেন।
অপুর মাথার বিচিত্র সব খেয়ালের মধ্যে একটি হলো নিজের সাথে খেয়ালীপনা করা। কাজটা করে অপু খুব মজা পেত। অপু একবার কবিতা লিখতে বসে ভাবল দুয়েকটা যদি বিরহের কবিতা লিখলে খারাপ হয় না। হঠাৎই সে ভাবল মৌয়ের সাথে তার সম্পর্কটা যদি ভেঙে ফেলা যায় তাহলে হয়তো সেই অনুভূতিটা কাজে লাগানো যেতে পারে। বস্তুত তার কাছে তখন মৌ থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কবিতা লেখা। সে একটি উপযুক্ত কারনও পেয়ে গেল আর সে সুযোগটা তৈরী করে মৌ নিজেই নিজের অজান্তে। সেই পুরোনো অভিমানটাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আর অপু সিদ্ধান্ত নিল সে আর রিলেশন রাখবে না।
প্রথম দু - একদিন টের না পেলেও কিছুদিন যেতেই অপু মৌয়ের অনুপস্থিতি অনুভব করল খুব ভালভাবেই। ভালবাসা হারানোর বেদনা এমনিতেই জন্ম দেয় হাজার হাজার কবিতা তার জন্য নতুন করে আর কবি হওয়া লাগেনা। আস্তে আস্তে অপুর এসব উপলব্ধি হতে থাকে। অপু একসময় বুঝতে পারে যে আর যাই হোক নিজের সঙ্গে বাজি ধরে কখনও জেতা যায় না। মৌকে নিয়ে যে বাজি সে ধরেছিল নিজের সাথে সে বাজিতে অপু হেরে গেছে। তার দুনিয়া যে শুধু মৌয়ের জন্যই।
মৌ অনেকবার অপুকে ফোন দিয়েছে আবার সব ঠিক করার জন্য কিন্তু অপু রাজি হয়নি। এখন মনে সেটা ছিল চরম ভুলগুলোর মধ্যে একটি। মৌয়ের চোখের পানিকে সে কখনোই মূল্য দেয়নি। সেটা ছিল অপুর অপারগতা। মৌ মাঝে মাঝে অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে অপুর কন্ঠস্বর শুনে লাইন কেটে দিত, অপু বুঝেও না বোঝার ভান করত। মেয়েটির আবেগ অপুর কাছে ছিলো নেহাতই খেলা।
অপু তার ভুলগুলো বুঝতে পেরে আবার যখন মৌয়ের কাছে ফিরে যেতে চাইল ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। মৌ তাকে আর গ্রহণ করেনি। পুনরায় যাতে কষ্ট না পেতে হয় হয়ত সে ভয়েই আর ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগেনি। অপু একাই দগ্ধ হত মনে মনে। মাঝে মাঝে হয়ত অশ্রু ঝরতে চাইত তবে ঝরত না সেটা পরিণত হত অশ্রুশূণ্য রোদনে। দম বন্ধ করে যাওয়াটা এই রোদনের চেয়ে অনেক ভাল। মৌয়ের মনের কথা অপু কখনোই বুঝতে পারেনি।
দশদিন পর -
অপু ছোট একটি কাগজের টুকরার দিকে চেয়ে আছে নিষ্পলক ভাবে। অপুর সামনে ছিলো একটা খাতা আর কলম কিছু একটা লিখতে চাইছিল মনে হয়।
ছোট কাগজটায় বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখা ছিল - " ওপারে দেখা হবে "। অপু কলমটা হাতে নিল ধীরে ধীরে। এতটা স্থির অপুকে আর কখনও কেউ হতে দেখেনি। দু তিন লাইন লিখল আবার কেটে দিল। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে লেখা শুরু করল ----
ভেঙে গেছে খেলার আসর,
মুছে গেছে রঙিন বাসর,
শুভঙ্কর দিয়েছে ফাঁকি,
রাখেনি আর কিছুই বাকী।
নিয়ে গেছে অনেককিছু
যা ছিল অনেক দামী।
একা তাই ভাল লাগেনা।
অপেক্ষা কর। আসছি আমি।
টুং করে একটা ছোট আওয়াজ হলো। তারপর শুনশান নিরবতা।
জানালাটা খোলা ছিলো। দমকা বাতাসে জানালার পর্দাটা উড়ছিল উদভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক। হঠাৎ বাতাস লেগে ডায়েরির কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে গেল। একটি পৃষ্ঠায় কয়েক লাইন লেখা ছিলো। তারিখ দেখে বোঝা গেল একদিন আগের লেখা। লেখাটা ছিলো ---
"সময়টা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গত বছরের সাথে এই বছরটার অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করছি। সুখ দুঃখের মাঝেও অনেক পার্থক্য। একাকিত্বের রঙও পাল্টে গেছে। কেউ আসছে কেউ চলে যাচ্ছে। যাবার সময় তার পায়ের ছাপ রেখে যাচ্ছে। স্রোতে একবার ভেসে যাচ্ছি আবার সাঁতরে পাড়ে উঠছি। আচানক সব যেন নতুন নতুন লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এ দুনিয়া তো আমার না আমার জগৎ তো এমন ছিল না। তাহলে কোন দুনিয়ায় আমার পদার্পন হচ্ছে!!!! খেয়ালের রঙে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। কিছুটা শুন্যতা ঘিরে রাখছে প্রহরগুলোকে পূর্ণতা তাতে খুব অল্প। আগের দখিনের হাওয়া এখন আসছে এখন আসছে উত্তর দিক থেকে। চঞ্চলতায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। তাঁরায় তাঁরায় ঠোকাঠুকি এখন আর লাগেনা।রুক্ষতায় ঢেকে গেছে সজীব কোমলস্পর্শগুলো। বিশালতার মাঝে ক্ষুদ্রতার আধিপত্য বেশ ভালভাবেই জানান দিচ্ছে, হয়তো একসময় পুরোটাই গ্রাস করে নেবে। চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতা মনে হয় কমে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এখন আর মনে শিহরণ জাগায় না। কেমন একটা শিরশির ঠান্ডা অনুভূতি হয়। বহুকাল ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বটতরু হঠাৎ করেই পাতাগুলোকে ফেলছে। আগের সজীবতা কোথায় যেন হার মানছে বারবার।
শুভ্র মেঘের হাসির শব্দ আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। কালো মেঘ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পলাশের লাল রঙে একটু পরিবর্তন এসেছে, কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। চাঁদের আলোটাও কমে আসছে। আমার আকাশে ভোর হচ্ছে- রক্তিম ভোর। প্রকৃতি এখন আর সবুজ লাগে না। সেদিনের বিকেলের বৃষ্টির পর থেকে আর কোন স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পাইনি। রুক্ষতায় ভরে গেছে চারপাশ। সূর্যের গগন পোড়ানো তাপ শীতল হয়ে গেছে অনেকটা। পাখিহীন আকাশটা খাঁ খাঁ করছে। ফিকে হয়ে গেছে সবুজের গাঢ় রঙ। রাতের জোনাকগুলো এখন মিটিমিটি জ্বলে না। লুকোচুরি খেলাতেও এসেছে পরিবর্তন। শুধু ঝিঁঝিগুলো তারস্বরে চিৎকার করে চলে রাতভর। এর কোন পরিবর্তন তো চোখে পড়ছে না। কান্না তবে কান্নাই রয়ে যায়, বদলায় না একটুও। আমি কিন্তু একটা হাতছানি দেখতে পাচ্ছি। অনেক দুরের হাতছানি.......... (পুরোটা পড়তে পারিনি।)"
খেয়ালের বশে এমন ফুল না ঝরিয়ে প্রকৃতি যদি তাকে ফুটতে দেয় তাহলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়। প্রকৃতির এই আচরণটাই বা কেন?? যদি কলির ফোটার অধিকার নাই থাকে তবে তকে জন্মানোর অধিকারই বা কেন দেয়া হয়?? দুদিনের এই মোহ যদি এতটাই অপরাধ হয় তবে তাকে জন্মাতে দেয় কেন?? অদ্ভূত প্রকৃতির খেয়াল। অদ্ভূত তার মনের ইচ্ছা। কাউকে ভরিয়ে দিতে কোন দ্বিধা করে না আবার গ্রাস করতেও দ্বিতীয়বার ভাবে না। আজব দুনিয়া!!!!
রেললাইনের মাঝ দিয়ে এখন আর কেউ হাটে না। ছোট ফাস্টফুডের দোকানে কেউ আর খাবার নিয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কলেজের ল্যাবরেটরির বারান্দাটাও ফাঁকাই পড়ে থাকে। হয়তো সে অপেক্ষায় থাকে অন্য কারোর মান - অভিমানের সাক্ষী হয়ে থাকবে
অনিক
২৭/৭/১৩
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২২ রাত ১১:৪৭