“দোস্ত আমারে একটা ‘গার্লফ্রেন্ড’ দে”। - বাসের মধ্যে দাড়িয়ে আছি বললে ভুল হবে। কোনোমতে ঝুলে আছি হ্যান্ডেল ধরে। আর তখনি বিনয় প্রোজেক্টের খোঁজে বিজি। আমাকে ডাক দিলো।
আমি অন্তর্মুখী। কথা কম বলা ধরনের মানুষ। কথা বলি কম, কাজ ও করি কম। কারোর একূলেও নাই, ও কূলেও নাই। প্রোজেক্ট খোঁজাতে আমাকে খুব একটা দেখা যায় না। অপরিচিত, নতুন কারোর সাথে কথা বলতেও অনেক লজ্জা লাগে। তাই প্রোজেক্ট খোঁজা আমার কাজ না। আমি বললাম, “তোর সাথে লাইন করানোর জন্য আমার কোন বান্ধবী পরিচিত নাই। আগে আমাকে তোর বান্ধবী দে কিছু, পরে তোরে লাইন লাগিয়ে দিবো”। বিনয় মর্মাহত হল ! মাত্র কয়দিন আগেও ডিপার্টমেন্টের একটাকে প্রপোজ করে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসলো !! তাই অন্য ডিপার্টমেন্টে খুজছে এখন। “তোর জন্য ‘শুভ’-কামনা রইলো”, আমি হেসে বললাম।
একটু পরে আমরা বাস থেকে নেমে গেলাম। একটা রিকশা ধরে সোজা বাসার দিকে। বিনয়কে ওর বাসায় নামিয়ে দিলাম। একটা একটা করে লেন পার হচ্ছি। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখছি। চোখের দেখা সব কিছু হল নিজের জন্য একটা করে অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত সেই ঝুলিতে অভিজ্ঞতা ভরছি। আমাদের বাসা হল একটা মহল্লার ভিতর। বিশাল এরিয়ার মধ্যে একসাথে অনেকগুলা গায়ে গা লাগানো দালান। প্রতিটা প্রায় ৮-৯ তলা করে। এই মহল্লার ৯০% বাসিন্দা কখনো বারান্দায় বসে চাঁদ দেখতে পারে না। আমিও পারি না। তাই ওদের জন্য আফসোস এবং নিজের জন্য মায়া অনুভব করি। জোছনা আর নিভে যাওয়ার মতো করে জ্বলতে থাকা মিটমিটে আকাশের তারাগুলো আমার পছন্দ। আর পছন্দের কোন কিছু না পাওয়া সবসময়ই আফসোসের সৃষ্টি করে।
মহল্লার গেট দিয়ে ঢুকে চমকপ্রদ দৃশ্য দেখলাম। পুরো রাস্তাটায় লাল-নীল-সাদা আলোর খেলা চলছে। অতি সাধারন আটপৌরে ইটের রাস্তাটাকে আজ রাজপ্রাসাদের রাস্তা মনে হচ্ছে। খুব সুন্দর করে, মোহময় ভাবে সাজানো। উপরে তাকিয়ে দেখলাম লেখা “বিয়েবাড়ি” নিওন বাতির আলোতে। সকাল থেকে সারাদিন ভার্সিটিতে কাটানোর জন্য এইসব সাজসজ্জার কিছুই দেখিনি। বাসজার্নি, ধাক্কাধাক্কি আর সব ক্লান্তি কেটে গেলো একসাথে। কিছুক্ষণ বাসার নিচে দাড়িয়ে সেই আলোর খেলা দেখলাম। তারপর আবার বাসায়।
একঘণ্টা পরে যেতে হল কমিউনিটি সেন্টারে। বাসায় টেবিলের ওপর পরে ছিল দাওয়াতের কার্ডটা। দাওয়াত তো পেয়ে গেছি, আমার খাওয়া দাওয়া আটকায় আর কে !! একলাই ঘুরছি আমি বিয়ে বাড়িতে। দেখা হল অনেকের সাথেই। ছোট মহল্লায় থাকার সুবিধা হল যে যেখানেই যাই না কেন, পরিচিত মানুষ ২-৩ জন থাকেই। প্রায় ৩ বছর পর দেখা হল স্কুল ফ্রেন্ড দীপ্তর সাথে। আগেই শুনেছিলাম বুয়েটে চান্স হয়েছে ওর। দেখা হয়নি অনেকদিন, তাই কোলাকুলি করে শুভেচ্ছা ও জানানো হয়নি। ওকে দেখে ভালো লাগলো। “আরেহ মাম্মা” বলে যেই না ওর সাথে কোলাকুলি করলাম, পিছনে চোখ পড়লো !!
আমি কথা বলি কম। তাই বলে চোখে কিন্তু কম দেখি না !!
দীপ্তর কাঁধের উপর ভর দিয়ে প্রায় হা করে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। মিষ্টি গোলগাল একটা চেহারা। হাসি দিলেও দাঁত বের হচ্ছে না। শুধু গালে টোল পড়ে। চুলগুলা মডেলদের মতো স্ট্রেইট একদম। আর সামনের একটু চুল বাম চোখের উপর এসে পড়েছে। গায়ের রঙ সাদা আর বাদামীর মধ্যে। চেহারাতে মেকআপ এর প্রয়োগ হয়নি তেমন। কপালে লাল টিপ দেখে একদম খাটি বাঙ্গালী বাঙ্গালী লাগে। চোখ আর পাপড়িগুলো বড় বড়। পুরো চোখ জুড়ে চোখের মণি, একদম ঘন কালো, সাগরতলের মতো সুগভীর। সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা হল যে, মুখ, হাত আর পায়ের রঙের মধ্যে রঙের পার্থক্য নেই। ভালো লাগলো। মেয়েটা নীল রঙের ড্রেস পড়া। সাদা জুতার সামনে একটু নীল ডিজাইন। কানের দুলের পাথরটা নীল রঙের। হাতে ২ গোছা নীল চুড়িও আছে। নীলপরী দেখতে কেমন জানি না, তবে যদি নীলপরী নামের কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তবে এরচেয়ে বেশি সুন্দর হতে পারবে না।
এইসব কথা চিন্তা করতে করতে ‘নীলপরী নীলাঞ্জনা’ নাটকটার কথা মনে পড়লো। মেয়েটার হাতে ফুচকা। ফুচকাটা মুখে দেওয়ার সময় দাঁতগুলাও সব দেখলাম। টুথপেস্টের মডেল বানানো যাবে। “আরেহ আরেহ করস কি ?” আমার কাণ্ড দেখে হাসছে দীপ্ত। “কিছু নারে। তোরা সেন্টারটা ঘুরতে থাক। আমি একটু আসছি”, দীপ্তকে বিদায় দিয়ে এক প্লেট গরম জিলাপি নিলাম।
খেতে খেতে আবার আগের জায়গায় ফেরত এসেছি। এইসব কখনো করিনি। কিন্তু আজ যখন একজনকে পছন্দ হয়েছে, আজ আর ছাড়বো না। আমার লাইফের ফার্স্ট প্রোজেক্ট এটা। বৃথা যেতে দিবো না। আমি কাছেই দাড়িয়ে আছি মেয়েটার। চেয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে, শুধু একবার চোখে চোখ পড়ুক। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি ওকে। এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে নিশ্চয়ই। বারবার এদিকেই, আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি আমার মতোই নার্ভাস হয়ে গেছি। সামনে গিয়ে কথা বলবো সেই উপায় নেই। গলা শুকিয়ে গেছে, বুক ঢিপঢিপ করছে। টেনশনে বসে পড়লাম একটা খালি চেয়ারে। বউই দেখি, যেহেতু কথা বলার সাহস নেই আমার। সাথে আমার সঙ্গী জিলাপি আর দীপ্ত। কিছুক্ষণ আড্ডা হল। উঠে গেলাম। মানুষ দেখছি। আমার প্রিয় কাজ মানুষ দেখা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো শুধু মানুষের ভুল দেখে দেখে শেখা যায়।
হঠাৎ দেখলাম সেই বিনয়কেই। শালা মাঞ্জা মেরেছে অনেক !! পুরা ফর্মাল সেজে আছে। ওদের কেমন যেন আত্মীয় হয়, তাই ওরাও দাওয়াত পেয়েছে। ওর সাথে কোলাকুলি সেরে আবার ঘুরতে লাগলাম পুরো সেন্টার। গরম গরম জিলাপি আমার খুবই পছন্দের। লাইনে দাড়িয়ে আবার জিলাপি নিলাম। আমার হাতে জিলাপির প্লেট আর বিনয়ের প্লেটে শ্রিম্প ফ্রাই। প্রথম বার শেষ হয়ে গেলে আবার প্লেটটা ফুল করে নিলাম। বিনয়ের প্লেটটা অনেক উঁচা। আমি খাচ্ছি আর মানুষ দেখছি। আর মানুষ বিনয়কে দেখছে। খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে একসময় বিনয় বলল, “চল, কার বিয়ে খেতে আসছি, তাকে দেখে আসি”।
আবার বউ দেখতে গেলাম। সেখানে গিয়ে পড়লাম বিপদে। এক আন্টির ধাক্কাতে আমার জিলাপিগুলো পরে গেলো। আবার নিয়ে আসতে হবে। আমি আন্টির দিকে তাকাতেই আমাকে বকা দিয়ে বলল, “ এই ছেলে, দেখে শুনে চলতে পারো না?” আমি তো বুঝে গেলাম। উনার সাথে তর্ক করা মানে নিজেকে উনার লেভেলে নিয়ে যাওয়া। আন্টিকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে মনে করছি, কোন মনীষী যেন বলেছেন, কখনো বোকার সাথে তর্ক করতে নেই। ভালোই হয়েছে কিছু বলিনি।
‘বিনয়, কি ভিড় হয়েছে দেখলি ?? ফ্রি ফুচকা চটপটি খাওয়ার সুযোগ ছাড়তে চায় না কেউ। শালার বাঙ্গালী ফ্রি খাওয়ার কাঙ্গাল’। - এইসব বলে আমিও নিজে ভিড়ের ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমাকে এক প্লেট “ঐটা” দেন, আমাকে এক প্লেট “এইটা” দেন - কানের পাশে শুধু চিৎকার শুনছি। তাই দেখে আমি দ্বিগুণ জোরে বললাম, “আমাকে জিলাপি দেন না ক্যারে ?”। আমার কথা শুনে বিষম খেল বিনয়। শ্রিম্প ফ্রাইটা মানে চিংড়ি মাছটা মুখ থেকে পেটে না গিয়ে ব্রেনে উঠে গেলো। আমি এক হাত ভরা জিলাপি নিয়ে আরেক হাত দিয়ে বিনয়ের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি। সাথে সাথে আমিও সাবধান, আবার যেনো জিলাপি না পড়ে। কিন্তু ঠিকমতো পিঠও চাপড়ে দিতে পারছি না। দৃশ্যটা খুবই কেমন জানি !
“প্লেটটা আমাকে দাও। আর ওর পিঠে কিল মারো কয়েকটা”, একটা মিষ্টি কণ্ঠ থেকে কথাগুলা ভেসে ভেসে আমার কানে আসলো। আমি খেয়াল করিনি কে বলেছে। না দেখেই প্লেট ২টা তার হাতে দিয়ে আমি বিনয়কে পাশের টেবিল থেকে নেওয়া মামের বোতলটা ধরিয়ে দিলাম। বিনয় ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। কোলাহলের মধ্যে এইবার একটু সামনে চোখ বোলানোর সময় পেলাম। “আমার জিলাপি কইরে বিনয় ?”, চোখের সামনে কাউকে খুজে পেলাম না, “আমার জিলাপি” !!!
“কিরে বিনয়, কি করিস?” দাওয়াত খেতে আসলি, শুধু চিংড়ি দিয়ে পেট ভরবি কেন ?”, পিছন থেকে মেয়ে কণ্ঠের কেউ বলল। “আর তুই তোর জিলাপি নে। ঠাণ্ডা হয়ে গেলো তো”। তাকিয়ে দেখি আরেকটা স্কুল ফ্রেন্ড সিনথিয়া। খুব সুন্দর করে কথা বলে ও। ওকে কিছু বলতে গিয়েই পাশে চোখ পড়লো। সেই মেয়েটি আবার ! আবার আমি অপ্রস্তুত। বিনয়, সিনথিয়া আর সেই মেয়েটি কথা বলছে। বিনয়ের খুব ভালো ফ্রেন্ড মনে হয়। আমাদের বিনয় খুবই মজার মানুষ। অনেক চরম চরম জোকস বলতে পারে। বিনয়ের মজার মজার কথাগুলোতে হেসে কূল পাচ্ছে না মেয়ে দুজন। আমিও না হেসে পারছি না।
আর তাকিয়ে আছি ওর দিকে। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করলো। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে আমার গলা শুকিয়ে যায়, বুক ঢিপঢিপ করে। আর এতো সুন্দরী !! শুধু সুন্দরী না, সুপার ডুপার সুন্দরী। নাম বলতে গিয়ে ২ বার ঠেকলাম। খুব কষ্টে নামটা জিজ্ঞেস করলাম। কিছুক্ষণ হাসল কিন্তু নামটা বলল না। মনে হয় আমাকে নার্ভাস করতে পেরে হাসছে। হঠাৎ বিনয়কে কানে কানে কিছু বলে সিনথিয়াকে নিয়ে ফুড়ুৎ করে চলে গেলো। আমি বিনয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
“কি বলল তোরে ? আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে ? আরেহ দোস্ত কিছু তো বল। আচ্ছা তুই ক্যামনে চিনস ওরে ?“ বিনয় চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “শালা মাইয়া দেইখা নামও জিজ্ঞেস করার সাহস নাই তোর। আজকে ক্যামনে পারলি রে ?” আমি ঠাট্টা গায়ে মাখলাম না, “দোস্ত নামটা বল না। ফেসবুকে একটু সার্চ দিয়া দেখবো। আমার পছন্দ হইসে রে দোস্ত” “ওই শালা থাম, এইটা আমার হবু ভাবী। অনিকদার গার্লফ্রেন্ড এইডা। সুন্দর নারে ?” বলেই আরেকটা চোখ টিপ দিল, “আর কোনোদিন ভাবীর দিকে এমন করে তাকাবি না”। আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসছে সে। আমি কিছুটা আশ্চর্য এবং সেই সাথে হতাশ।
কাউকে পছন্দ হল, এবং তাকে না পাওয়ার হতাশা অনেক ভিতরে গিয়ে লাগে। তারপর, তার আর পর নেই। খাওয়া দাওয়া করলাম। ড্যান্স দেখলাম। ম্যাজিক শো দেখলাম। আর ১০ টা বাজলে বাসায় চলে আসলাম।
জানালার কোনা দিয়ে বিছানায় একটু চাঁদের আলো পড়েছে। হাতটা রাখলাম সেই আলোর উপর। আলোটা আমার হাতে এসে পড়লো। চিন্তা করছি আমার হবু ভাবীর কথা। আমার জীবনের প্রথম প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে গেলো। এখন আমি আবার নতুন কোন প্রথম প্রোজেক্টের আশায় বসে আছি......।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪