কাটা দিয়ে কাটা তোলা
___________________________________________________________
নার্ভলেস অস্ত্রটা দেখতে ঠিক হাতলওয়ালা বড় দাঁতওয়ালা চিরুনির মত। এর চিরুনির মতো দাঁতগুলো ইলেকট্রিক প্রোব হিসেবে কাজ করে, যা ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক পালস তরঙ্গ আকারে নিক্ষেপ করতে পারে। এগুলো মানুষ বা যে কোন প্রাণীর নার্ভকে সাময়িকভাবে অচল করে দেয়। শিকারের শরীরে কোন আঘাতের কোন চিহ্ন থাকে না বলে গোয়েন্দাদের খুবই পছন্দের অস্ত্র। ছুড়ির মতোই চালাতে হয়,তবে তা দূর থেকে,বাতাসে। হাত লক্ষ্য করে নার্ভলেস চালালে হাত সাময়িকভাবে অচল হয়, পায়ে প্রয়োগ করলে চলন ক্ষমতা থাকে না আর ঘাড়ে প্রয়োগ করলে অজ্ঞান। শিকার কিছুই বুঝে উঠার আগেই সব কিছু হয়ে যায় অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার।
অরুপের জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে খুবই দামি একটা হোটেল স্যুইটে আবিস্কার করে। তার চশমা পর্যন্ত পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তায় কোন কিছুকেই ছাড় দেওয়া হয় নাই। তার ভাবনায় ছেদ টানলো এক সুন্দরী মেয়ে। সুন্দরী মেয়েটা তাকে খাবার দিয়ে গেল। খাবার দেখে তার পেট ক্ষুধায় মোচর দিয়ে উঠলো। অন্য সময় হলে তার চিন্তায় ঐ মেয়েটাই থাকতো। কিন্তু যখন জান নিয়ে টানাটানি তখন স্বর্গও নরক লাগে।
খাওয়া হলে এক বৃদ্ধ রুমে এসে তাকে অনুসরণ করতে বলল। সে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো করে বৃদ্ধের পিছন পিছন গেল। অরুপ ভেবেছিল সে কোন অত্যাধুনিক ল্যাবে ঢুকবে। কিন্তু না, সে শুধু একটা চেয়ার রাখা টর্চার সেলের মতো রুমে ঢুকল। বৃদ্ধ তাকে রেখে চলে গেল। অরুপের হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি পিটানো শুরু হল।
হঠাৎ একটা গমগমে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর তাকে পাসওয়ার্ড দিতে বলল। স্বর যাতে বোঝা না যায় তাই ভয়েস সিনথেলাইজার ব্যবহার করছে। কোথা থেকে যেন রেটিনা স্ক্যানারসহ বাকি সবকিছু এসে গেল। সব দেওয়ার পর কিছুক্ষন নীরবতা। অরুপ অনুমান করলো, তার দেওয়া পাসওয়ার্ড পরীক্ষা করে দেখছে। তারপর সেই কণ্ঠস্বর বলল, DONE.
বৃদ্ধ লোকটা আবার ঘরে ঢুকল। তার হাতে একটা নার্ভলেস। তিনি অরুপের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বাতাসে তার ঘাড় বরাবর নার্ভলেস ছুড়ির মতো করে চালালেন। অরুপ পিছন ফিরে তাকে দেখার আগেই একপাশে হেলে পড়ে গেল।
যখন তার ঘুম ভাঙল সে নিজেকে নিজের বিছানায় পেল। ধড়পড় করে উঠে বিছানা থেকে নামতেই পায়ে একটা মোটা চামড়ার বড়সড় কালো ব্যাগ পেল। ব্যাগ খুলতেই সে ধপ করে বসে পড়ল। এক বিলিওন টাকা! এই টাকা দিয়ে সে কি কি করবে ভাবতে না ভাবতেই দরজায় কেউ টোকা দিল। ব্যাগ লুকিয়ে দরজা খুলতেই পুলিশের প্রবেশ। একটু খুঁজতেই টাকাটা পেয়ে গেল, যে টাকার উৎস নেই। পুলিশের পরে এল পরিচালক। অরুপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, Sorry, my boy. কাটা দিয়েই কাটা তুলতে হয়।
অরুপের সামনে সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল। এ সবই পরিচালকের চাল ছিল। কি সুন্দর চাল! অরুপ এখন কি করবে? তাকে এখন বাকি জীবন জেলে কাটাতে হবে।
এতদিনের পরিশ্রম সব বৃথা হয় গেল। বৃথা হয়ে গেল। এখন কি ফাঁস হয়ে যাবে তার আসল পরিচয়?
আগুন্তক
___________________________________________________________
-ওফ,আমাকে একবারও বিষয়টা জানালে না কেন?
অরুপ মুখটা চোরের মত করে বলল, বিষয়টা এত দ্রুত ঘটে গেল যে জানানোর সময় পাই নাই। এখন কি করব?
আগুন্তক রাগের সাথে বলল, জেলে পচতে থাকো।
-তাহলে, আপনাকে সাথে নিয়ে পচবো।
-দেখ, বেশি কথা বল না। তুমি কে তা কি ভুলে গিয়েছ? আমি কে তা কি ভুলে গিয়েছ?
অরুপের সবকিছু ফ্ল্যাশ ব্যাক করা শুরু হল।
তার খুব কষ্টের কিন্তু সুখের একটা পরিবার ছিল। স্ত্রী আর ছোট্ট পুতুলের মতো মেয়ে, নাদিয়া। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আশ্রয় নেয় পাশের একটা দেশে। ক্ষুধায়,মহামারিতে আর অনাহারে সে তার পরিবারকে হারায়। তার দেশ হেরে যাওয়ায় শুরু হয় তার নির্বাসিত নিঃসঙ্গ জীবন। আত্মগোপনের সময়। তখন কোন একভাবে এই আগুন্তকের সাথে দেখা। অরুপকে একটা ছোট্ট কাজ দেওয়া হয়। একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। সে প্রযুক্তির খুব বেশি কিছু জানে না। নতুন একটা জীবন দেওয়ার পুরুস্কার হিসেবে সে দেড় বছর ধরে কিছু কথা আর কাজ সেই সাথে অভিনয় মুখস্ত করতে থাকে, তারপর প্রতিযোগিতায় যায়। সে পরিচালককে যা বলেছে আসলে সে তার কিছুই বুঝে না। শুধু মুখস্থ আওড়ে গিয়েছে।
এই আগুন্তক অনেক শক্তিশালী সে সম্পর্কে অরুপ শতভাগ নিশ্চিত। কারণ, প্রথমত সে আজ পর্যন্ত সেই লোকটার পরিচয় তো দূরে থাক নাম পর্যন্ত জানতে পারে নাই আর দ্বিতীয়ত, শক্তিশালী না হলে এভাবে পুলিশ থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারতো না যেখানে পরিচালক নিজে বসে থেকে কেস তৈরি করে দিয়ে গিয়েছে।
ছাড়িয়ে নিয়ে আগুন্তক দামি স্কাইকারে করে একটা অজপাড়াগাঁ টাইপ জায়গায় তাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, আপাতত খবর ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকো। অরুপ অবাক হল, এই অত্যাধুনিক সময়ে এত পিছিয়ে থাকা এলাকা দেখে। অরুপ মনে মনে বলল, “মানুষ স্বর্গ নরক সবই গড়তে পারে”। অরুপ ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরতেই আগুন্তক চলে গেল। অরুপ ভাবতে লাগলো কত সহজেই সবকিছু পাল্টে গেল। আবার এল আত্মগোপনের সময়।
কিন্তু না,সবসময় সবকিছু নিজের ভাবনামতো ঘটে না। এলাকায় প্রবেশ করতেই সে পড়ে গেল মাথায় ভোতা আর ভারি কিছুর আঘাতে। জ্ঞান হারাবার আগে দেখতে পেল কিছু যুবক তাকে ঘিরে ধরেছে, একজন তার চোখে কিছু একটা স্প্রে করলো। তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। অরুপ এই স্প্রের সাথে সেই যুদ্ধের সময় থেকেই পরিচিত। এটা ব্লাইন্ড হরমোন স্প্রে। নির্দিষ্ট সময় মানুষকে অন্ধ করে রাখে। এবার সে কার শিকার হল?
প্রজেক্ট এক্স
___________________________________________________________
জ্ঞান হবার বেশ কিছুসময় পর তার দৃষ্টি স্বাভাবিক হল। যুদ্ধের সময় দুবার এই স্প্রের শিকার হয়েছিল। সে শুয়ে আছে অন্ধকারাচ্ছন এক রুমে নোংরা বিছানায়। দরজা খোলার আওয়াজে অরুপ শব্দের উৎসের দিকে ঘুরল। একজন পেশিবহুল লম্বা চওড়া লোক ঢুকল। গায়ের রঙ ময়লা, পোশাকও ময়লা।
-জ্ঞান ফিরেছে তাহলে?
অরুপ ভয়ার্ত স্বরে বলল, কে তোমরা? কি চাই তোমাদের?
-আমরা কিছু চাই না। দরকার তোমার। একটা সার্ভারের। যা আমরা তোমাকে দেব।
-মানে?
-মানে, কিছু না। আমার নাম ইলিয়াড। হোমারের ইলিয়াড না কিন্তু। হা হা হা। এখন থেকে তুমি যুক্ত হলে প্রজেক্ট এক্স এ।
-প্রজেক্ট এক্স?
কথা বলতে বলতেই অরুপকে নিয়ে ইলিয়াড প্রবেশ করে হলঘরের মতো বিশাল এক রুমে। চারদিকে নানা আকারের তার ঝুলানো আর নানা রঙের এলইডি বাতি জ্বলছে। সেই সাথে চলছে শত শত মনিটর। জনাবিশেক লোক চারদিকে বসে টাচ কি বোর্ড চাপছে। এ যেন এক এলাহি কাণ্ড। আর ইলিয়াড একটু পর পর হা হা করে হাসে, যা ঠিক জোকারের মতো। যেটা শুনলে অরুপের গা ঘিন ঘিন করে।
ইলিয়াড বলল, হুম প্রজেক্ট এক্স। পৃথিবীতে রাজত্ব করার প্রজেক্ট। হা হা হা।
অরুপ বিস্ময়ের সাথে বলে, মানে?
-এখন তুমি আছো পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন স্থানে, সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যাকারদের আস্তানায়। হা হা হা। কারো ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করা থেকে শুরু করে দুই দেশে যুদ্ধ সবই করা যায়,করা হয় এখান থেকে। প্রজেক্ট এক্স অনেক পুরনো প্রজেক্ট। একবিংশ সাল থেকে যার যাত্রা শুরু। এখন ৩৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আমরা এখন লক্ষ্যের কাছাকাছি। আমরা এমন এক ভাইরাস তৈরি করছি যা ভেঙ্গে ফেলবে পৃথিবীর সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মহাকাশ পর্যন্ত চলে আসবে আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিখুঁত হয়েছে বহুগুনে। তুমি যেই ১৫ স্তরের নিরাপত্তা ভেঙ্গে দিয়ে এলে সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি সবার হাতে চলে যায় তবে আমাদের আরও ৩৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহৃত হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে। হা হা হা।
অরুপ বিস্ময়ের সাথে বলে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার!
-হুম, অনেক আগের ধারণা। অনেক আগে তৈরিও হয়েছে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তৈরি হয়েছে কিছুদিন আগে। সেই ২০১১ সালে প্রথম ১৬ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়েছিল। কিউবিট(QuBit) হল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একক। যেমন সাধারণ কম্পিউটারের একক বিট। সাধারণ কম্পিউটারের এই বিটের মান 1 অথবা 0 হয়। যার মানে, ১ বিট হলে ১টি মান, ২টি হলে ২টি, ১০০ টি হলে ১০০টি। কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র দিয়ে চলে। এই স্তরে কিউবিটের মান 1অথবা 0 অথবা 1,0 একসাথে হতে পারে। যে কারণে ১ কিউবিট হলে ২টি মান (00/01/10/11- এই চারটির যেকোন একটি জোড়া), ২ কিউবিট হলে ৪টি মান (00,01,10,11), তার মানে n সংখ্যক কিউবিটের মান হবে 2^n. হা হা হা। প্রতিটা কিউবিট একেকটা পরমানুর মধ্যে থাকে। ৩০০টা পরমাণু (মানে ৩০০ কিউবিট) জমা রাখতে পারবে 2^300 টি মান। যা পৃথিবীর মোট পার্টিকেলের চেয়েও বেশি। হা হা হা। মজার না?
অরুপ না বুঝে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হুম।
-রাশিয়ান নামক জাতির তৈরি প্রথম কিউবিট ছিল মসৃণ এলুমিনিয়াম রিং , যার ভেতরে ২-৩ ন্যানোমিটার প্রস্থের খাদ ছিল। ওটাকে গনিতবিদ বানাতে কোয়ান্টাম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে সুপারফাস্ট সেমিকন্ডাক্টরে রূপান্তরিত করতে পৃথিবীর নিম্নতম তাপমাত্রায় (মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ঠাণ্ডা করতে হত। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল। হা হা হা। তবে ওটা কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড বেঁচে থাকতো। তারপর যেই লাউ সেই কদু। কিন্তু ঐ অল্প মাইক্রোসেকেন্ডেই শালা কয়েক লক্ষ হিসেব করে ফেলত। হা হা হা। তবে সেটা আমাদের মাথা ব্যথা না।
অরুপ চিন্তিত ভঙ্গীতে বলে, তাহলে?
-কারণ এখনকার সেলফোনে ওইটার চেয়ে শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার আছে। মাথা ব্যথা হল নতুন মানবীয় সুপার কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেটা নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেটা নিয়ন্ত্রণ করবে আগামীর বিশ্ব। যদি এটাকে থামিয়ে দিতে না পারি তবে আমরা কিছু মানুষের প্রযুক্তির হাতের খেলনা হয়ে যাব। কারণ এই কম্পিউটারের ব্যাকডোরের চাবি কেবল কিছু মানুষের হাতে থাকবে। মজার বিষয় কি জানো?
-কি?
-ঐ সুপার কম্পিউটারের প্রজেক্টের নামও “প্রজেক্ট এক্স”।
-ও! তো আমি এখন কিভাবে কি করব? আমি তো এসবের কিছুই বুঝি না।
-বুঝতে হবে না। শুধু আমাদেরকে ভাইরাসটা দাও।
-আমার কাছে তো সেটা নেই।
-তোমার সব খবর আমাদের কাছে আছে। তোমার গোপন ইমেইলটার সন্ধানও আমরা পেয়েছি। সেখান থেকে ড্রাফটে সেভ করে রাখা ভাইরাসটাও নামিয়েছি কিন্তু বায়োলজিক্যাল পাসওয়ার্ড তো আর আমরা ভাঙতে পারি না। তাই ওটা নিয়ে কাজ করতে পারি নাই। হা হা হা।
অরুপ বুঝতে পারলো সে ধরা পড়ে গিয়েছে। পালানোর কোন পথ নেই। আসলেই কি নেই?
>>>চতুর্থ পর্ব
পড়তে পারেন ন্যানো সায়েন্স ফিকশনঃ বিবর্ধক
আমার লেখাটা কেমন লাগছে তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু ...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৬