একটু আগে ফেইসবুক-এ লগ-ইন করার পরপরই এক বন্ধুবরের লেখা একটি চিরকুট পেলাম। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার ভিত্তিতে একটি ছোট গল্প, যদিও জানি না আসলে এটাকে গল্প বলাটা যুক্তি সঙ্গত কি-না! গল্পটি এরকম -
মিটিং ও উন্নয়ন উন্নয়ন খেলা
"দপ্তরী কালীপদ, ফজলু কিংবা শামসু এসিগুলা চালু করে। ঘড়-ঘড় আওয়াজ করে এসিগুলা চালু হয়। সুসজ্জিত কক্ষটি ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে। কক্ষটিকে সুসজ্জিত বলার নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। লম্বা লম্বা দুই বা তিনখানা কিংবা একখানা টেবিল পাতা রয়েছে। টেবিলটি অতিশয় পরিষ্কার করা হয়েছে। দপ্তরী কালীপদ, চাঁন মিয়া কিংবা বজলু মিয়ারা যত্ন সহকারে টেবিলগুলা পরিষ্কার করে রেখেছে। কালো কিংবা বাদামী রঙের টেবিলটি ঘিরে সমান দূরত্বে রট আয়রনের বেশ কতগুলি চেয়ার রাখা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেগুলো টেবিলের চাইতেও পরিষ্কার। প্রতিটি চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপরে একটি করে অসম্ভব পরিষ্কার কাঁচের গ্লাস,এন,বি,আর এর প্লাস্টিকের খোসা মারা মাম পানির বোতল, ঢেকে রাখা কাপ-পিরিচ এবং প্রতি দু'টি চেয়ারের মাঝে টেবিলের ওপরে রয়েছে বেশ বড়সর সাইজের একটি বসুন্ধরা কিংবা ফে কোম্পানির টিস্যুর বাক্স। ও হ্যাঁ, প্রতিটি গ্লাসের নিচে একটি চমৎকার পিরিচও রয়েছে। কক্ষের সাজসজ্জার কথা গেল। এবার আসি টেকনিক্যাল সাপোর্টের বিষয়ে। লম্বা টেবিলের কোন এক মাথায় একখানা বড়সর স্ট্যান্ডসহ মাইক্রোফোন। বেশকিছু তার এদিক সেদিক চলে গিয়েছে। সম্ভবত সেগুলো গিয়ে মাইকে যুক্ত হয়েছে অথবা সেখানে কোন তার নেই। টেবিলের সামনে বেশ বড়সর একটি সাদা স্ক্রীন বিদ্যমান। ছাদ থেকে একটি খাঁচা বন্দী মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরও উপস্থিত।
এ সকল আয়োজন মাননীয় ও সম্মানিত অতিথিদের জন্য। যে সকল অত্তিথিরা আজ আসবেন তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাদের অনেকের পেপার আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের অধিকাংশের বাসার স্টিল আলমারিতে নর্থ আমেরিকা কিংবা ইউরোপের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির সার্টিফিকেট আছে। তারা রাষ্ট্র অথবা সমাজে বিদ্যমান কোন ভয়াবহ সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলবেন। সেজন্য তারা হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। তাদের মাঝে কেউ একজন বা কয়েকজন ব্যাগে করে ল্যাপটপ কম্পিউটার নিয়ে এসেছেন। তাদের পকেটে সম্ভবত ৮ গিগাবাইটের একটা করে পেনড্রাইভও আছে। তারা হাজির হওয়ার পরে অনুষ্ঠানের সভাপতি কিংবা আয়োজক গোছের ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলাগণের দৌড়াদৌড়ি যথেষ্ঠ পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। দপ্তরী কালিপদ, ফজলু কিংবা আবুলরা চা কিংবা কফির বড় জগ নিয়ে হাজির হয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাপ ভরে দিয়ে যাবে। কখনও কখনও সেখানে আলাদা করে দুধ-চিনি মেশানোর ব্যবস্থা থাকবে। অধিকাংশ মাননীয় অতিথি 'র'চা কিংবা ব্ল্যাক কফি খাবেন। প্রধান অতিথির কাছে সঞ্চালক গোছের বিশিষ্ট ব্যক্তি আলোচনা শুরু করার জন্য অনুমতি চাইবেন এবং প্রধান অতিথি অবশ্যই অনুমতি প্রদান করবেন। আলোচনা শুরু হবে। তারবিহীন অথবা তারয়ালা মাইক্রোফোন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে ঘুরে বেড়াবে অথবা প্রত্যেক বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য একটি করে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা থাকবে। আলোচনা জমে উঠতে থাকবে। একেকজন বিশেষজ্ঞ একেক ধরণের আধুনিক কায়দায় সমস্যাটিকে ব্যাখ্যা করবেন এবং সেই সমস্যা সমাধানের জন্য অভিনব সব পথ বাতলে দেবেন। এক পর্যায়ে একজন ব্যক্তি তার ল্যাপটপটি অন করবেন অথবা আগে থেকে কক্ষে অবস্থিত কোন কম্পিউটারে পকেটে করে আনা পেনড্রাইভটি প্রবেশ করাবেন। চমৎকার একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন হবে। তার প্রেজেন্টেশনটা উপস্থিত সকলকে নাড়িয়ে দেবে। এই প্রেজেন্টেশনটি হবে ঐ বিশিষ্ট ব্যক্তির রাত জেগে ইন্টারনেট ও বই-পুস্তক ঘেটে তৈরি করা একটি চমৎকার কাজ। আর হ্যাঁ, পুরো অনুষ্ঠানটি হবে কোন একটি আলোচনা সভা কিংবা গোলটেবিল বৈঠক। এ সভা বা বৈঠকে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে একজন বা কয়েকজনকে রাখা হবে কোন কোন সময়ে। তারা হৃদয়স্পর্শী ও চমৎকার কোন বক্তব্য কিংবা আইডিয়া দিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে চমকে দেবেন এবং অবশ্যম্ভাবিতভাবে বিশেষজ্ঞগণ তরুণ প্রজন্মের ভূয়সী প্রশংসা করবেন এবং তাদেরকে বেশ কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিবেন। আলোচনা সভা কিংবা গোলটেবিল বৈঠকটি একটি সফল অনুষ্ঠান হিসেবে সমাপ্তি লাভ করবে। এরপর মাননীয় অতিথিবৃন্দের হাতে একটি করে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হবে। সেই প্যাকেটে অনুষ্ঠানের সময় ও ব্যাপ্তির ওপর নির্ভর করে ভাল কোন খাবারের দোকানের বিরানী, তেহারি, চাইনিজ খাবার কিংবা চিকেন প্যাটিস, কাগজে মোড়ানো সন্দেশ,কলা অথবা কমলা কিংবা আপেল,কেক, সফট ড্রিংসের ক্যান বা বোতল ইত্যাদি থাকবে। বড় বড় সমস্যার সমাধান খোঁজা নিয়ে আয়োজিত এ সকল অনুষ্ঠানে সমস্যার চাইতেও বড় বড় সমাধান উঠে আসবে এবং সেগুলো ব্যাপক প্রশংসার দাবি রাখবে। সকলে বিদায় নেবেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের আয়োজকবৃন্দ বাইরের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যাবেন। এরমধ্যে দপ্তরী কালিপদ, আবুল কিংবা শামসুরা টেবিল পরিষ্কারে মনোযোগী হবে এবং এসিগুলো বন্ধ করে দিবে। খানিকক্ষণ পরে আমরা কক্ষের বাইরে অবস্থিত ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে বেশ কয়েকটি খাবারের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখব। তার ভেতরে সম্ভবত আপেলের মাঝখানের "খাওয়া যায় না" এমন অংশটি অথবা কমলার ছোকলা অথবা কলার খোসাও থাকবে। পরের দিন সেখানে আমরা সেগুলো আর দেখতে পাব না কেননা সুবিধামত সময়ে দপ্তরী কালিপদ, বাবুল কিংবা চাঁন মিয়ারা সেগুলো সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে।"
- আহমদ ইকরাম আনাম
১০।০৩।২০১১
রাত ৯ টা ১০।
এর উপরই রচিত আমার প্রাসঙ্গিক চিন্তা-ভাবনাগুলো।লেখাটা আসলেই মজার! লক্ষ্য করার মতো বিষয় -- আমাদের সমস্যাকে পুজি করে সমাধানের নামে ও অন্যান্য নানা কৌশলে কিছু বেজন্মা তাদের উদরপূর্তি করছে এবং নতুন নতুন সুবিধাবাদের পথ করে নিচ্ছে -তাও আবার আমাদের টাকায়(অল্প কিছু ডোনেশনের উছিলায়)!! এমনিভাবে এরা উদ্ধারকর্তা-র বেশে সমস্যা সমাধান ও দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে বড় বড় সেমিনার, প্রেস কনফারেন্স করে এবং দেশে যতো না দুর্নীতি তার চেয়ে বেশি বড় ও ফলাও করে তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে! অথচ এ সকল ডোনেশনের ও নিজেদের খরচের সম্পূর্ণরূপে সঠিক ও বৈধ উৎস এরা নিজেরাই দেখাতে অপারগ!! এরা নিজ দেশের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে অন্য দেশকে টেনে আনে ও ভালো করার নামে সেমিনার করে করে তা ফলাও করে সারা বিশ্বে প্রচার করে। এরা সুযোগ-সন্ধানী হায়েনা। ঠিক একইভাবে, এককালীন স্বার্থান্বেষী বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তৎকালে প্রেস কনফারেন্স করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এতো এতোবার জঙ্গিদের প্রসঙ্গ টেনে আনে ও বিদেশিদের সম্পৃক্ত করে যে বাংলাদেশ 'জঙ্গি রাষ্ট্র' হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে খুব বেশিদিন সময় লাগে না! দেশের প্রয়োজনে এরা কেউই আসে না...আসে সেমিনারের নামে কিছু টাকা উঠানো যায় কি-না সেটা পরখ করতে। এতোই যদি চাইত, তবে ঐ সেমিনারের টাকা দিয়েই অনেক সময় কিছু পরিবারকে দাড় করিয়ে দেয়া সম্ভব; ঐ ডোনেশনের টাকা সেমিনার না করে বরংচ কোনও প্রকৃত উন্নয়নমূলক ও constructive কাজে ব্যয় করতো-যাতে করে দেশ ও দশের আয় হতো; ভালো মত মানুষ খেয়ে-পড়ে চলতে পারতো।
মানুষ স্বার্থান্বেষী - সে অনুযায়ী এ ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি সর্বনাশ করে আবার বড় বড় গলায় উন্নয়নের কথা বলে এবং বাহবা পাবার চেষ্টা করে, তবে তারচেয়ে ঘেন্নার আর কিছু নাই। আমাদের দেশের রাজাকারদের সাথে এদের অসম্ভব মিল। শুধু পার্থক্য এই যে -এরা আরো বেশি চতুর, ধুরন্ধর, শক্তিশালী; এদের রয়েছে ভালোমানুসিকতার মুখোশ পরা এক গুপ্ত সিন্ডিকেট; এদের ব্যাক-আপ দেয় বিশ্বনেতারা-প্রয়োজনে এরাই সময়ে সময়ে হাজারো রাজাকার তৈরী করে।
পরিশিষ্টঃ
আমি মানুষটা বড়ই খারাপ - বাংলায় যাকে বলে নষ্ট ছেলে! কেনো জানি এদের চেহারা সামনা-সামনি দেখতে আমার বড়ই ভালো লাগে। তাই সময়-সুযোগ পেলেই এ বেজন্মাদের দেখতে ছুটে যাই কোনো ফ্রি সেমিনারে, যেমনি করে বাচ্চারা শিশুকালে বানর-শিম্পাঞ্জি দেখতে মহোৎসাহে চিড়িয়াখানা যায়। অবাক হলেও সত্যি - ওদের কর্মকান্ডে ও বক্তৃতার জোয়ারে মাঝে-সাঝে খেই হারিয়ে ফেলি। খুশিতে আটখানা হয়ে হাততালি দেই -ঠিক শিম্পাঞ্জির মতোই!
মাঝে মাঝে অবশ্য বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায় এ মন - মন চায় প্রতিবাদ করি। সেই বেদবাক্য মনে পড়ে –‘যারা সাহসী-নির্ভীক, তারা মরে একবার; আর কাপুরুষ মরে বারবার’। কিন্তু পরক্ষনেই এ রক্ত ঝিমিয়ে পড়ে। শত হলেও – বাঙালি তো! সেই ঔপনিবাশিক আমল থেকে চলে আসা দাসত্বের যে বীজ আমাদের ভেতর রয়েছে –তা থেকে এতো সহজেই কি বের হয়ে আসা যায়?! মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর কি!