somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি আরবের কালো মেয়ে

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জন্মেছেন বৈরুতে, থাকেন কানাডায়, পশ্চিমা বিশ্বে রাফিফ জায়েদাহ্ তবু ‘ফিলিস্তিনি শরণার্থী’! কারণ, তাঁর পিতামহ ছিলেন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু। রাফিফ কখনো ফিলিস্তিনে বাস করেননি, কিন্তু ফিলিস্তিন তাঁর মধ্যে বাস করে সব সময়। ফলে তিনি যেখানেই যান, এই দুর্ভাগা দেশটাকে বহন করে নিয়েই যান। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন, সেখানে একদিন ফিলিস্তিনি ছাত্ররা এক সমাবেশ করে। রাফিফ জায়েদাহ্র পরিকল্পনা ছিল তাঁরা একটা ইসরায়েলি তল্লাশি চৌকি তৈরি করে দেখাবেন ইসরায়েলি সেনারা কীভাবে ফিলিস্তিনি মানুষকে হয়রানি করে। রাফিফ সেই দৃশ্যে একটি ফিলিস্তিনি নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে রাস্তায় শুয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে যেন এক ইসরায়েলি ছাত্র ছুটে এসে তাঁর তলপেটে লাথি মেরে বলল, সন্ত্রাসী বাচ্চা পয়দা করার আগে তোদের সত্যি সত্যিই ধর্ষণ করা উচিত!
যে ঘৃণার প্রকাশ রাফিফ সেই ইসরায়েলি ছাত্রটির চোখেমুখে দেখেছিলেন, তার জবাবেই তিনি লেখেন ‘শেইডস অব অ্যাঙ্গার’ (ক্রোধের বয়ান) নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কারণ, রাফিফ মনে করেন, একমাত্র ভাষার মাধ্যমেই এই দুর্মর ঘৃণার জবাব দেওয়া সম্ভব। যে দুর্মর ক্রোধের ডালপালা লতিয়ে উঠছে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের রক্তাক্ত হৃদয়ে, কবিতার মাধ্যমেই সেটি মূর্ত হয়ে উঠতে পারে। ২০১১ সালে রাফিফ জায়েদাহ্র পড়া এই কবিতার একটি ভার্সন ইউটিউবে তোলা হয়। এ পর্যন্ত দুই লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে সেটি।
ক্রোধ কি কবিতাকে উদলা করে দেয়? বিশেষ করে, রাফিফ জায়েদাহ্র বাপের ভিটায় যখন পাইকারি হারে আছড়ে পড়ছে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র; ফসলের বীজ নয়, রক্ত আর কান্নাভেজা জমিতে বুনে দিতে হচ্ছে ছিন্নভিন্ন শিশুদের লাশ! কই, এভাবে যখন লিখছি, কোনো কিছুই তো ভণিতার বাইরে থাকছে না। ক্রোধ মানেই তবে আভরণহীনতা নয়! জায়নবাদ, প্রাচ্যবাদ, বর্ণবাদ আর পুরুষতন্ত্রকে একসঙ্গে যখন কোনো কবি তাঁর কবিতায় মোকাবিলা করবেন, তখন ক্রোধ ছাড়া আর কোন মায়াবী ভণিতার নন্দনতত্ত্বে মুখ ঢাকবেন তিনি? রাফিফ যখন এই কবিতাখানি লিখছিলেন, কিংবা আপনিও যখন এই কবিতাখানি পড়ছেন, তখন গাজা উপত্যকায় বৃষ্টির মতো ঝরছে ইসরায়েলি গোলা, ফেসবুক আর পত্রিকার পাতা ভরে উঠছে রক্তাক্ত লাশের ছবিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে এই যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, পশ্চিমা মানবতাবাদ কেবল নিষ্প্রাণ বিবৃতি দিয়ে তার নিন্দা করতে পারে। কবিতা কী করবে তখন? এই বেশুমার খুলির বাগানে বেকুব বোগেনভেলিয়া হয়ে ফুটে থাকবে শুধু? না, রাফিফকেই আদর্শ নমুনা মানতে হবে এমনটা নয়। পাবলো নেরুদা, ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি. লুই আরাগঁ, মাহমুদ দারবিশ কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়নি তো! কবিশরীরকে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিয়ে কেউ কবিতাকে রেহাই দিতে চান। এই ক্ষীণজীবী অবিশ্বাসীদের হেদায়েত করুক রাফিফ জায়েদাহ্র ক্রোধের বয়ান। প্রতিবন্ধী উপমা–সংসারী হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে কবিতা ঢুকুক না একবার হামাস টানেলে !

রাফিফ জােয়দাহ্
ক্রোধের বয়ান

আমি আরবের কালো মেয়ে



আমাকে আমার আরবি জবানে হল্লাচিল্লা করতে দাও
তারা আমার ভাষার শরীরে লাগাম পরানোর আগে
আমাকে আমার মায়ের ভাষায় বাতচিত করতে দাও
তারা তার স্মৃতির পায়ে ঘুঙুর পরানোর আগে
আমি আরবের কালো মেয়ে
আমরা আসছি আপামর ক্রোধের সিঁড়ি বেয়ে

ঘুম থেকে জেগে, জীবনের প্রতিটি সুবেহ সাদিকে
আমার পিতামহ খুঁজেছে তার নামাজনিষ্ঠ স্ত্রীকে
জাফা আর হাইফা নগরীর মাঝখানে লুকিয়ে থাকা কোনো গ্রামে

যে মাটিতে, একটি জলপাই গাছের নিচে জন্মেছে আমার মা
তারা বলছে, সেই মাটি নাকি আমার নয়!
কিন্তু তাদের সেই ব্যারিকেড, তাদের তল্লাশি চৌকি
তাদের বর্ণবাদী দেয়াল সব টপকে আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরে যাবই
আমি আরবের কালো মেয়ে আর আমরা আসছি যাবতীয় ক্রোধের সিঁড়ি বেয়ে

তুমি কি শুনেছ, আমার বোনটি যখন চেঁচাচ্ছিল
তল্লাশি চৌকিতে—গতকাল বিয়োবার সময়
ইসরায়েলি সৈন্যরা তার দু’পায়ের ফাঁকে তাকিয়ে খুঁজছিল
ভবিষ্যতের মূর্তিমান হুমকিখানিকে, এবং ডাকছিল তাকে ‘জানিন’ নামে

শুনেছ কি, জেলখানায় বসে আমনি মনা যখন চিৎকার করছিল
‘আমরা ফিরছি প্যালেস্টাইনে!’
তারা তখন তার সেলে টিয়ার শেল ছোড়ে
আমি আরবের কালো মেয়ে আর আমরা আসছি যাবতীয় ক্রোধের সিঁড়ি বেয়ে

তোরা বলিস আমার ঔরস থেকে কেবল সন্ত্রাসবাদীই বেরোবে
কেবলি জন্ম হবে দাড়িঅলা, বন্দুক ঝোলানো, পাগড়িধারী মরুনিগ্রোর
তোরা বলিস, আমরাই নাকি আমাদের বাচ্চাদের মরতে পাঠাচ্ছি
কিন্তু আমার আকাশে যে তোদেরই শকট, তোদেরই বোমারু বিমান
আলেন্দে আর লুলুম্বাকে মেরেছিল কারা
ওসামার ওস্তাদ ছিল কে
আমার দাদারা কিন্তু শাদা টুপি, শাদা হুডি পরে ঘুরে বেড়ায়নি
কালো মানুষের গলায় দড়ি পরানোর জন্য ভাঁড়ের মতো ছোটাছুটিও করেনি
আমি আরবের কালো মেয়ে আর আমরা আসছি যাবতীয় ক্রোধের সিঁড়ি বেয়ে

‘এই শ্যামলা নারীটি কে, মিছিলে যে চেঁচাচ্ছে?’
মাফ করবেন, আমার কি চেঁচানো উচিত হয়নি?
আপনার প্রাচ্যবাদী খোয়াব ছিল যত
বোতলবন্দী জিন, বেলি-নর্তকী, হারেম-কন্যা, মুখচোরা আরব রমণী
আমি ভুলে গেছি সবই
জি মহারাজ, না মহারাজ
আপনার বোমারু বিমান থেকে নেমে আসা
পিনাট বাটার স্যান্ডউইচগুলোর জন্য শুকরিয়া
জি, আমার ত্রাতাপ্রভুরা এখানে এসেছেন আমার শিশুদের হত্যা করার খায়েশে
তারপর একে তারা আদর করে বলবেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’
আমি আরবের কালো মেয়ে আর আমরা আসছি যাবতীয় ক্রোধের সিঁড়ি বেয়ে

কাজেই, শোনো বলি, আমার ঔরস থেকে
কেবল বিদ্রোহীই জন্মাবে
যার এক হাতে থাকবে পাথর, অন্য হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা
আমি আরবের কালো মেয়ে
সাবধান! আমার ক্রোধ থেকে সাবধান!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×