ঐশ্বরিয়ার প্রিয় রঙ কি?
চমকে উঠলাম। মনে হল প্রশ্নটা খুব কঠিন, এর উত্তর আমি জানি না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কোথায় যেন পড়েছিলাম তার প্রিয় রঙ সাদা, নীল এবং লাল। আর প্রিয় খাবার আইসক্রিম না চকলেট কি একটা যেন। অনেক আগে কোন একটা বিনোদন পাতায় পড়েছি, ভাল মনে নেই। কিন্তু এসব প্রশ্ন আমাকে করা হচ্ছে কেন? আর জানা থাকা সত্ত্বেও উত্তর দিতে পারছি না কেন? মনে হচ্ছে বোবায় ধরেছে। ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে ।
হাতে মোবাইল লেগে ঘুম ভেঙ্গে গেল, বুঝতে পারলাম দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম, সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে। মোবাইলে ভাইব্রেশন হচ্ছে, কিন্তু রিসিভ করার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই। ২য় বার ভাইব্রেশন হওয়ার পর কোনরকম রিসিভ করলাম। সায়না ফোন করেছে, তার দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এল শিরদাঁড়া বেয়ে।
সায়নাঃ কি চাকরিবাকরির কিছু হল? [কণ্ঠে হতাশা]
আমিঃ হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েকটা দিন। কার্ড পেয়েছি। যোগাযোগ করছি, টাকা রেডি।
সায়নাঃ কিছুদিন আগেওতো একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এলে, কিছু ত হল না।
আমিঃ এবার হয়ে যাবে আশা করি।
কি বলব গুছিয়ে নিচ্ছি এসময় খট করে একটা শব্দ হল, সায়না ফোন রেখে দিয়েছে। কিছুদিন হল সায়না বিরূপ আচরণ করছে। সে নিজেও জানে ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি পাওয়াটা টাফ। সব জায়গায় চায় মাস্টার্স / এম,বি,এ সেই সাথে ৩-৫ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু বিয়ে বিয়ে করে মাথাটা খারাপ করে ফেলছে তার ফ্যামিলি মেম্বাররা।
গত সপ্তাহে একটি প্রজেক্ট এর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। মাত্র ৬ মাসের প্রজেক্ট। এ নিয়ে আর যাই হোক কোন পাণিপ্রার্থী মেয়ের বাবার সামনে দাঁড়ানো যাবে না। তারপরও মুকিত ভাইয়ের অনুরোধে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। অন্তত হাত খরচটা চালাতে পারলে পরবর্তীতে ভাল চাকরির জন্য ট্রাই করা যাবে। মনে করেছিলাম ভাই সব বলে রেখেছেন, অ্যাটেন্ড করলেই চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু গিয়ে দেখি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বেশ পরিপাটি একটি রুম। দরজা জানালা বন্ধ। এসি চলছে। আমার আবার ঠান্ডার ধাত আছে, এসি রুম স্যুট করে না। ঠাণ্ডা লাগলেই কোল্ড এলারজি মাথা চাড়া দেয়। ইতিমধ্যেই হাত পা চুলকানো শুরু করেছে। প্রচন্ড গরমেও ঠান্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর চলে আসবে। টেনশনটা এখানে একটা বড় কারণ হতে পারে। এসিটা কমাতে বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তা সম্ভব না। দেখা গেল এসি কমাতে বললাম কোন এক ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন; এটা ইন্টারভিউ বোর্ড, মামার বাড়ি না! তাই চুপচাপ নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
পাঁচজন গম্ভীর মুখে বসে আছেন। মাঝের ভদ্রলোক, বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। নিবিড় মনযোগ দিয়ে আমার বায়োডাটা দেখছেন। বাকিরা আমাকে অবজারভ করছেন। আমার পালপিটেশন শুরু হয়ে গেল।
আপনার নাম?
স্বপ্নাতুর
অর্থ?
যে স্বপ্ন দেখে
ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাই হাসাহাসি শুরু করল। যেন এরকম হাসির কথা তাঁরা জীবনে কোনদিন শোনেননি।
তা কি স্বপ্ন দেখেন আপনি?
আমি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কি বলব বুঝতে পারছি না। ডিপ্লোম্যাটিক অ্যানসার দিতে হবে। কিছু কিছু লোকের সবসময় মন জুগিয়ে চলতে হয়, প্রেমিকা আর ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নকর্তা। প্রশ্নের উত্তর সবসময় প্রশ্নকর্তার অনুকূলে চালনা করতে হয়।
আমি কিছু বলার আগেই মাঝের ভদ্রলোক বললেন (যিনি সিভি দেখছিলেন, দেখছিলেন বললে ভুল হবে, নিরীক্ষণ করছিলেন) “সিভি দেখলাম, আপনার কোন কো কারিকুলার এক্টিভিটিজ নেই”। বুঝলাম তাঁর কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড স্ট্রং, ছাত্রাবস্থায় হয়তবা স্টেজ পারফর্মও করতেন। ভাইভা বোর্ডে স্টুডেন্টের নয় বরং প্রশ্নকর্তার স্ট্রং পয়েন্ট থেকে বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হয়। না পারলে প্রশ্নকর্তা মধুর ভঙ্গিতে হাসবেন। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিবেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে না। প্রজেক্ট রান করার ক্ষেত্রে কো কারিকুলার এক্টিভিটিজ এর ভূমিকা কি তা আমার বোধগম্য নয়। মাঝে মাঝে গান শুনিয়ে কিংবা নাচ দেখিয়ে সকলকে চাঙ্গা রাখতে হবে নাকি কে জানে! এরকম হলে আমাকে বাদ দিতে হবে না, আমি নিজেই চলে যাব। গান/নাচ এর কোনটাই আমি পাড়ি না।
আমাকে পরবর্তীবার দেখা করতে বলা হল। বুঝতে পারলাম ভদ্র ভাষায় রিজেক্টেড। রিজেক্টেড হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার কোন প্রতিভা নেই, আমি যা পারি তা হল বুদ্ধি খাটাতে, আর পরিশ্রম করতে। আর পারি স্বপ্ন দেখতে, ক্রিয়েটিভ কিছু করার স্বপ্ন।
রিটেনে কোয়ালিফাই করে আজ আবার ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি রিজ-এ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির। আমার লিঙ্ক হিসেবে যিনি কাজ করছেন তাঁর নাম রঞ্জু। আমার বড় ভাই এর পরিচিত, এই লাইনে অর্ধ যুগ ধরে আছেন। তিনি যা বললেন তা অনেকটা এরকম। “তদবির করে কোন লাভ হবে না, তবে কিছু মালপানি ছাড়লে কাজ হতে পারে।’’ বা হাতের কাজটা ইনারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। বিফলে নাকি আবার মানি ব্যাক, পুরাই ইউনিক ব্যাপার। দেখি এই স্রোতধারা আমাকে কোথায় নিয়ে যায়!
শেভ করে, ক্লিঞ্জার ইউজ করে চেহারা কিছুটা ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করলাম। তবে চোখের নিচ থেকে কালি দূর করতে পারছি না। রাত জেগে পড়াশুনা আর টেনশন এই দুরবস্থার মুল কারণ। আর্টিস্টদের কাছে সাঙ্কেন আই এর আলাদা কদর থাকলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রশ্নকর্তাদের কাছে এর বিন্দুমাত্র মুল্য নেই।
রিকশা তিন রাস্তার মোড় পেড়িয়ে যাচ্ছে। ওই তো কর্পোরেট বিল্ডিংগুলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু এরকম ঝাপসা লাগছে কেন? আমি কেমন যেন আন-ইজি ফিল করছি। কেন যেন মনে হচ্ছে আমার চাকরিটা হবে না। হয় টাকা ঠিক জায়গায় পৌছাবে না কিংবা রঞ্জু ভাই কিছু করতে পারবে না। আমার মন বলছে কোন না কোন সমস্যা হবেই। হয়ত রঞ্জু ভাই হাসতে হাসতে বলবেন “ভাই অনেক চেষ্টা করছি, ৪/৫ হাজার টাকাও এদিক ওদিক দিছি। কিন্তু নাহ! শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারলাম না”।
হঠাৎ আমার কি হল বুঝতে পারলাম না। সাব কনশাস মাইন্ড অ্যাক্টিভ হয়ে উঠল। বিবেক নামক ঘুমন্ত সত্ত্বাটি জেগে উঠল। বিবেক নামক বস্তুটা কোন কাজের না, খামোখাই অসময়ে ঝামেলা করে। আমার মনে চিন্তার ঝড় বইতে লাগল। চায়ের দোকানে, বটতলায় যে আমি এতদিন দুর্নীতির বিপক্ষে ঝড় তুলেছি; সেই আমি আজ কি করতে যাচ্ছি? এভাবেই তাহলে আমার দুর্নীতির শুরু! আমিও একদিন হব বিষধর সাপের মত বিষাক্ত! আমার তীক্ষ্ণ দাঁত কেটে দেবে জীবনের জটিল বন্ধন, বহু মেধাবির স্বপ্ন! নিজের উপর তীব্র ঘৃণা হতে লাগল।
ডিসিশন চেঞ্জ করলাম। এভাবে কাপুরুষের মত বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। রিকশাওয়ালাকে বললাম “মামা রিকশা ঘুরাও”। রিকশাওয়ালা বেশ বিরক্ত হল, বলল “এইভাবে বিজি রোডে হুট হাট রিকশা ঘুরাইতে কইবেন না, ওইদিকে এখন জামু না”। কিছু টাকা বেশি দেয়ার কথা বলে রাজি করালাম। জীবনের কি জটিল মেলবন্ধন! একটু আগেও আমি ছিলাম চাকরি প্রার্থী এক যুবক, এখন পুরোদস্তর বেকার! জগত সংসারে আমার মূল্য রিকশাওয়ালাও বোঝে। তাই তো এই অবহেলা। নীরবে সহ্য করে গেলাম।
এখন আমার প্রথম কাজ হল সায়নাকে জানানো। সায়নার বাবা ফোন রিসিভ করলে তাঁকেও কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে হবে আজ। মোবাইল থেকেই কল করলাম ল্যান্ডফোনে। কিন্তু আজ আর অন্য কেউ ধরল না। সায়নাই রিসিভ করল, যেন আমার কলের জন্য ফোনের পাশেই বসে ছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, পানি পিপাসা পাচ্ছে। বুকে সামান্য ব্যথা অনুভব করছি।
সায়নাঃ তোমার না ইন্টারভিউ?
আমিঃ ইন্টারভিউ দিচ্ছি না।
সায়নাঃ ও! কেন জানতে পারি?
আমিঃ আচ্ছা, তুমি কি চাও আমি অবৈধভাবে পাওয়া কোন চাকরিতে জয়েন করি?
সায়নাঃ নাহ!
সায়নার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। তার চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসছে যার ১% অ্যাকুয়াস হিউমার আর ৯৯% ইমোশন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:২১