আবদেল মাননান-এর লালন দর্শন গ্রন্থের আলোচনা
সুধীর চক্রবর্তী, আহমদ শরীফ, ফরহাদ মজাহার ও সাম্প্রতিক আবদেল মাননান পর্যন্ত একটা র্দীঘ তালিকা করা যায় যাঁরা লালন চিন্তা ও দর্শন নিয়ে কাজ করেছেন। তালিকা যতই দীর্ঘ হোক ব্যাপারটা মোটেও বাতুলতা নয়, কারণ গবেষণার শেষ কথা বলে কিছুই নেই, বরং লালনের মতো অসীম মতাধর সৃষ্টিশীল সাধক নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে জিজ্ঞাসু মানুষের কাছে নতুনভাবে আবিষ্কার হবে এটাই তো কাক্ষিত। এমনেই মনোবাঞ্ছনা নিয়ে আবদেল মাননান-এর প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ লালন দর্শন পাঠে মনোনিবেশ করেছি। একজন পাঠক হিসেবে গবেষণাগ্রন্থে যে-বিষয়গুলো আমি প্রত্যাশা করি তা হল নির্মোহ অবস্থানে থেকে একজন গবেষকের বিষয়-সাপে যৌক্তিক আলোচনা। সাধারণভাবে সৃষ্টিশীল কবিরা ভাল গদ্য লেখেন। এটা আমরা বুদ্ধদেব বসু ও জসিম উদ্দীনের ক্ষেত্রে যেমন ল করেছি ঠিক তেমনে আবু হাসান শাহারিয়ার ও আবদেল মাননানের ক্ষেত্রেও। লেখকের নির্মেদ প্রাণোচ্ছ্বাসপূর্ণ সাবলীল অথচ গীতল গদ্যের জন্য যে-কোন রুচির পাঠকের কাছে দর্শন আলোচনার মতো গুরুগম্ভীর গ্রন্থটাও বেশ পাঠোপভোগ্য হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন্তু একজন জিজ্ঞাসু পাঠককে তো শুধু ভাষার যাদুকরী মোহে ভোলানো যাবে না। গবেষণা পাঠকের কাছে পাঠের মূল আধার বস্তুনিষ্ঠতা ও নির্মোহ যুক্তি। লেখক তার গ্রন্থের প্রাকভাষণে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বর্জনের ঘোষণা দিয়ে লিখেছেন যুক্তি দিয়ে নয় বরং ভক্তি দিয়েই তিনি লালনকে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে চান। লালন দর্শন নিয়ে লেখকের দাবি: ‘জগতে লালনচর্চার পরিবেশ তৈরি হতে পারেনি কোথাও। লালনদর্শন বিশ্বাসীগণ দেশে-দেশে সংগঠিত হলে পৃথিবী পালটে দেওয়ার কাজ অতিদ্রুত হয়ে উঠবে।’ লেখক লালন দর্শন নিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন! এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি লালনদর্শনের ভিত্তি কী? লেখকের মতে, আল কোরান-এর দর্শনের ভিত্তির সঙ্গে লালনদর্শনের যোগ অত্যন্ত নিবিড়। লালনকে হিন্দু বা মুসলমান বানানোর টানাহিঁচড়ে অনেক পুরোনো ইতিহাস। তবে প্রচলিত কোন ধর্মমতে যে লালনের আস্থা ছিল না এটা বুঝার জন্য বিশেষ কোন গবেষণার দরকার পড়ে না, তার সঙ্গীত শ্রবণ করলেই আঁচ করা যাবে। লেখক যদি বাউলমতকে ধর্মমত মনে করে থাকেন, সেক্ষেত্রে লালন যে ধার্মিক ছিল সে বিষয়ে দ্বি’মত নেই। সেই সাথে এ-কথাও সত্য, লালনের সঙ্গীত মৌলিক হতে পারে, তবে লালন তার সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে যে তত্ত্ব প্রচার করেছেন এটা নতুন বা মৌলিক নয়। লালন-জন্মের বহুকাল পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে গুরুবাদী মতের প্রচলন ছিল। যার মূল কথা সম্মুখগুরুকে সত্য জ্ঞান করে আত্মশুদ্ধি ও পরমেশ্বরের সন্ধান লাভ করা। বাউল কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিফলন নয়, বরং তিন ধর্ম- বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া ধারা, উপনিষিদের মায়াবাদ আর ইসলামের সুফিমতের মিলিত স্রোত। লেখক যে-দাবি করেছেন, লালনের মতের ভিত্তি হচ্ছে কোরান। আবার সেই কোরানও কিন্তু মৌলিক নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যভূমি টাইগ্রীস নদীর তীরে গড়ে উঠা সভ্যতা। সে-সভ্যতার মানুষেরা পৃথিবীতে নবীতত্ত্বের প্রচলন করে। ইতিহাসকে নিরপেভাবে বিচার করলে নবীদের আর্বিভাবের তেমন কিছু অলৌকিকত্বের খোঁজ পাওয়া যায় না, বরং ইহুদি বংশের (মোহাম্মদ ছাড়া) অগ্রসর মানুষেরাই নবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার একই সময় একই স্থানে একাধিক নবীর আর্বিভাবের ইতিহাসও আছে, যাঁদের মধ্যে স্বার্থসংশিষ্ট বিষয়ের দ্বন্দ্ববিরোধের উদাহরণও আছে। ইব্রাহিম ও লুত একই সময়ের নবী, যাঁরা আবার পরষ্পর আত্মীয় (চাচা-ভাইপো) ছিলেন। বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য আমি তৌরাত শরীফ থেকে উদ্ধুতি দিচ্ছি: ‘লুত যিনি ইব্রামের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তাঁর নিজেরও অনেক গরু-ছাগল-ভেড়া ও তাম্বু ছিল। জায়গাটা এমন ছিল না, যাহাত তাহাদের দুইজনেই এক জায়গায় বাস করিতে পারেন। পশু এবং তাম্বু তাহাদের এত বেশি ছিল যে ইহা লইয়া তাহাদের এক জায়গায় বাস করা সম্ভব ছিল না। ফলে ইব্রাম ও লুতের রাখালদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ দেখা দিল। তাহা ছাড়া সে সময় কেনানীয় ও পরিষীয়েরাও সেই দেশে বাস করিতে ছিল। তখন ইব্রাম লুতকে ডাকিয়া বলিলন, দেখ আমরা নিকট আত্মীয়। সে জন্য তোমার ও আমার মধ্যে এবং তোমার ও আমার রাখালদের মধ্যে কোন ঝগড়াবিবাদ না হওয়া উচিত। সমস্ত দেশটাই তো তোমার সামনে পড়িয়া আছে। তাই আইসো আমরা আলাদা হইয়া যাই’ (রুকু ১৩, আয়াত ৫, ৬,৭, ৮ ও ৯)। এই নবী তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদিয়া কোরানের উদ্ভব। সে বিবেচনায় কোরান কোন মৌলিক গ্রন্থ নয়। যাঁরা সেমেটিক ধর্ম গ্রন্থসমুহ পাঠ করেছেন তারা বুঝতে পারবেন কোরান এই গ্রন্থসমুহের সংস্করণকৃত রূপ মাত্র। তো লেখক একস্থানে লালনদর্শনকে কোরানের ভিত্তি হিসেবে দেখছেন, আরেক স্থানে লালনের গানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখছেন, ‘আসল নাপাক মনের বস্তু মোহ বা নারী মোহ (পৃষ্ঠা ২৯)। তাঁর এই উক্তিটা কি স্ববিরোধী হয়ে গেল না? কারণ, কোরানে তো মানুষের জৈবিকতাকে স্বাভাবিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর নারী মোহ বলতে যদি লেখক বহুগামী প্রবণতাকে বোঝান পুরুষের বহুগামী প্রবণতাকে কোরান কবুল করে নিয়েছে। লেখক দার্শনিক মত আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, হাজার বছর ধরে এখানে একটি মতের সাথে আরেকটি মতের বিরাট পার্থক্য ছিল। কিন্তু সকল মতের লোকেরা একজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে অভ্রান্ত বলে মানতো। সে-মহিলা হলেন ভগবতী শ্র“তি। বৌদ্ধ আর জৈন শ্র“তি মানতেন না, অথচ তারা জিনবচক বা বৌদ্ধবচককে অভ্রান্ত বলে মানতেন। আর্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিজাত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহস্বরূপ অনার্য রাজপুত্র শুদ্ধধন এবং মহাবীর যথাক্রমে বৌদ্ধমত ও জৈনমতের প্রতিষ্ঠা করেন। এই দুই মত হচ্ছে পৃথিবীর আদিতম সুসংগঠিত বস্তুবাদী মত। বুদ্ধ শব্দের অর্থই হচ্ছে জ্ঞান। ব্রাহ্মণদের শ্র“তিতে নয় বরং জ্ঞানের প্রতি আস্থা রেখেছেন গৌতম বুদ্ধ। তাঁর ভক্তদের উদ্দেশ্যে প্রধান যে পাঁচটা বাণী ছিল, তার মধ্যে দুইটি ছিল এই রকম, (১) আত্মাকে নিত্য বলে অস্বীকার করা (২) কোন গ্রন্থকে শাশ্বত বলে না মানা। পৃথিবীর অন্য সমস্ত মত যেমন কালের ধারায় বিকৃত হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন মত তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাসে কোন সন্ধিণে এসে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিতে পড়ে এই দুই মতের চরম বিকৃতি ঘটেছে তার বিস্তারিত আলোচনা প্রসঙ্গিক হবে না। তো, গ্রন্থের ১৯০ পৃষ্ঠায় ‘গুরুদের গুরু যিনি’ অধ্যায়ে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের বাউল প্রেমের কথা। উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন লালনের ভাব শিষ্য গগণচন্দ্র দাসের ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেঁরে’-এই গানের সুরে বিমোহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ইতিহাসটা রবীন্দ্র পাঠক মাত্রই জ্ঞাত আছেন। তবে লেখক নতুন যে-দাবি উত্থাপন করছেন, রবীন্দ্রনাথের অদৃশ্যগুরু লালন। পাঠক হিসেবে নিদেনপে আমার কাছে মনে হলো লেখক রবীন্দ্রনাথকে সতীর্থ ভেবে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার জন্যই এমন দাবি করছেন। কারণ একজন শিল্পি একটা সৃষ্টি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন শিল্প সৃষ্টি করার ঘটনা বিরল নয়। উদাহরণ দীর্ঘ না করে স্বল্প পরিসরে লিখছি। গ্যেটে তাঁর জগৎ বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ দ্য ফাউস্ট লিখেছেন কালিদাসের শকুন্তলা পাঠে অনুপ্রণিত হয়ে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ যে শুধু বাউল সূরে সঙ্গীত রচনা করেছেন তা নয়। তাঁর অনেক গল্প-উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছে ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে। ২০২ পৃষ্ঠায় কোরানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘মোহাম্মদী ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মহানবী মোহাম্মদ (সঃ)-এর সর্বোত্তম বংশীধারী মাওলা আলী (আ.) কে ধুরন্ধর মতালোভী স্বেচ্ছাচারী ওমর, আবু বকর, ওসমান অগ্রাহ্য করার ধারাবাহিকতায় কারবালায় আলীর তনয় ইমান হোসাইন (আ.)কে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এজিদ রাজশক্তি নিজেদের সীমাহীন পাপচারকে বৈধতা দেবার অপচেষ্টায় নবিবংশ ও কোরানের উপর এতো অত্যাধিক অপমান-অত্যাচার-অস্ত্রোপচার চালিয়েছে, যার ফলে পৃথিবী থেকে এ সত্যধর্মের মূলোৎপাটন হয়ে গেছে। লেখক তার কলমি মতায় যে-তিন মহাপুরুষকে ভৎসনা করেছেন, এটাও এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা। কারণ মোহাম্মদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐ তিন জনের অবদান আলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাছাড়া ঐ তিনজনই ছিলেন মোহাম্মদের নিকটাআত্মীয় (আবু বকর সিদ্দিক ও ওমর শশুর, ওসমান জামাতা) বিশিষ্ট চিন্তক আহমদ শরীফের মতে, রাজনীতি পুরোনো হলে হয় ইতিহাস। সেই ইতিহাসই সাী ঐতিহাসিক কারবালা আদপে কী ঘটেছিল? তবে একজন ইতিহাস-সচেতন মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়, ঐ হৃদয়বিদারক ঘটনার পেছনে যত না কাজ করেছে আদর্শ তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে ইগো ও মতার দ্বন্দ্ব। কতিপয় বিদ্রোহির হাতে ওসমান নিহত হওয়ার পর আলী মতায় আরোহন করেন। তখনই ওসমান হত্যার বিচারের দাবিটা জোরালো হয়ে ওঠে। ওসমান হত্যার বিষয়ে আলীর বিস্ময়কর নীরবতা আমাদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। তো, লেখকের লালন বিষয়ক একাধিক গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লালন ভাষা অনুসন্ধান-১, যে গ্রন্থের গৌরচন্দ্রিকায় লিখেছেন, ‘লালনের ভাষা ঊর্ধ্বলোকের রহস্যময় ভাষা, মর্ত্যলোকের মানুষ মনের অভাব প্রকাশের জন্যে মুখের কথা লেখার ভাষা-নির্ভর হলেও মহাগুরু লালন শাঁইজির ভাবের ভাষা তাদের মনের অতীত’। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, লেখক তো এই মর্ত্যলোকেরই মানুষ, তিনি সাধ্যাতীত এই ভাষাটা বুঝলেন কী করে?
রোদেলা প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।