বিসিএস দিবো এমন ইচ্ছে কখনোই ছিলো না এখনো নেই কিন্তু যারা বিসিএস দিতে চান তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য, হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী বইটা পড়েছিলাম সাহিত্য সম্পর্কে জানতে চেয়ে। আপনারা হয়তো ভাবছেন বুক রিভিউ লিখছি, আসলে তা নয়। লাল নীল দীপাবলির শেষ দিকে এসে একটা নামে আটকে পড়েছিলাম।
১৭৬০। হুমায়ুন আজাদের মতে সাহিত্যের দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ। প্রথমটা তো সবারই জানা। সেটা হলো ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল। এই অন্ধকার যুগ বলার কারণ সেই সময় তেমন উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য কর্ম খুঁজে পাওয়া যায় নি।
যা বলছিলাম ২য় অন্ধকার যুগ।সেটা আঠারো শতকের মাঝামাঝি। সেই সময় বাঙলা সাহিত্যে কবিগান ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। ছোট বেলায় একবার কবিগান দেখার এবং শোনার সৌভাগ্য হয়েছিলো। মনে আছে, কবিগানের এক পর্যায়ে আমরা যারা ছোট তাদের সেই কবিগানের অনুষ্ঠান থেকে বের করে দিয়েছিলো কিন্তু বুঝিনি কেন বের করে দিয়েছেন বড়রা। খুব রাগ হয়েছিলো কিন্তু এখন আমি জানি কেন বের করে দেওয়া হয়েছিলো।
লাল নীল দীপাবলি পড়ে যে নামটা পড়ে অবাক হয়েছিলাম সেই নামটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে গত কয়েকদিনে। নামটা হলো অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন পর্তুগিজ। এইটুকুই জানতে পেরেছিলাম অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সম্পর্কে। তাঁর জন্ম কোথায় এবং কিভাবে মৃত্যু বরণ করেছিলো এর কিছুই জানতে পারি নাই। কিন্তু এই নামটা মাথায় গেঁথে ছিলো।
গত কয়েকদিন ধরে একটা মুভিই দেখছি সেটা হলো জাতিস্মর। এখন পর্যন্ত মুভিটা ৫/৬ বার দেখা হয়ে গেছে। এই এখন যখন এই পোষ্ট লিখছি তখনো জাতিস্মরে ডুবে আছি। কেন লিখছি এই পোষ্ট? বা কেনই বা এতোবার দেখা এই মুভি। এর কথায় উত্তর হলো আমি আঠারো শতক খুঁজে পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি সেই সময়ে বাঙলা কেমন ছিলো। কেমন ছিলো এখানকার রীতিনীতি।
মজার ব্যাপার হলো আমরা রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সতীদাহ প্রথা রোধ এবং বিধবা বিবাহের প্রচলনকারী হিসেবে প্রতিকৃৎ হিসেবে জানি। কিন্তু জাতিস্মর মুভিটা দেখার পর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি ওনারা সতীদাহ প্রথা রোধ কিংবা বিধবা বিবাহ প্রচলনের প্রায় একশত বছর আগে এই কাজটি করে গেছিলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সতীদাহ দেখে তাঁর অনুচরদের নিয়ে সেই সতীদাহে হামলা চালিয়ে এক বিধবাকে রক্ষা করেছিলেন এবং সেই বিধবাকে বিয়ে করেন, বিধবা বিবাহের প্রচলন করেছিলেন। যদিও রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রোধ করেছিলেন ১৮২৯ সালে আর বিধবা বিয়ে চালু হয় ১৮৫৬ সালে।
সতীদাহে বাঁধা হিন্দু বিধবাকে বিয়ে করায় অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিকে সেই সময় কি পরিমান সামাজিক রোষানলে পড়তে হয়েছিলো সে তো অনুমেয়। এই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি-কে নিয়েই জাতিস্মর মুভিটি।
এক গুজরাটি ছেলে এক বাঙালী মেয়ের প্রেমে পড়ে। ছেলেটা বাঙলা বলতে পারতো না ঠিকভাবে। যদিও সে বাঙলা বলার চেষ্টা করতো কিন্তু মেয়েটা ছেলেটাকে পছন্দ করতো না। কেননা ছেলেটা বাঙালিদের রীতিনীতি জানে না। একপর্যায়ে মেয়েটা ছেলেকে বলে যদি ছেলেটা মেয়েটার জন্য একটা গান লিখে এবং পরিষ্কার উচ্চারণে সেই গান গেয়ে শোনাতে পারে তবে ছেলেটার ব্যাপারে মেয়েটাকে ভেবে দেখবে। এমনি সিনেমাটিক স্টাফ দিয়ে মুভি শুরু।
ওদিকে এক এসিস্টেন্ট লাইবেরিয়ান যে কিনা পূর্ব জন্মের কথা মনে করতে পারেন! এইজন্মের ঘটনাবলীর সাথে মিশতে পারছেন না আবার পূর্বজন্মের ঘটনাবলীও ভুলতে পারছেন না। ভদ্রলোকের এই কনফ্লিক্টিং সিচুয়েশনে এসে হাজির হয় সেই গুজরাটি ছেলে।
ছেলেটি এসেছে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সম্পর্কে জানতে কেননা এটা তার ডিসার্টেশন টপিক। আর লাইব্রেরিয়ান চাচ্ছে তাঁর পূর্বজন্মের কথা বলতে কিভাবে সে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি হয়ে উঠেছিলো। কিভাবে তাঁর বাঙলা ভাষা শিখা হয় কিভাবে তিনি কবিয়াল হয়ে উঠেন।
আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির জীবনী শুনে গুজরাটি ছেলেটিও এক সময় বাঙলা ভাষা রপ্ত করে ফেলে এবং বাংলায় গান লিখতে এবং গাইতে শিখে যায়।
এই মুভি কেবল এই ছেলে মেয়েদের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে নয়। এখানে প্রেম ভালোবাসা গৌন বিষয়। মূল বিষয় হলো ইতিহাস।
জাতিস্মর সিনেমার কলাকুশলীরা এক নজরে ----
জাতিস্মর
Actor : প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, রাহুল ব্যানার্জী
Actress : স্বস্তিকা মুখার্জী, রিয়া সেন, অনন্যা চ্যাটার্জী, মমতা শঙ্কর
Director : সৃজিত মুখোপাধ্যায়
Music Director: কবীর সুমন
Singers : কবীর সুমন, অনুপম রায়, রূপঙ্কর বাগচী, সাকি।
আমি মুভি দেখতে পছন্দ করলেও এর সূক্ষ্ণ অনেক ব্যাপার ধরতে পারি না। যেমন কাস্টিং, দৃশ্যের সিকোয়েন্স কি হওয়া উচিত বা মুভিতে গান থাকলে তা কতোটা যুক্তি সংগতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এই সিনেমা অনেকবার দেখার কারণে যা বুঝতে পারলাম সিকোয়েন্সের সাথে মিলিয়ে কিভাবে গান পরিবেশন করতে হয়। আর অভিনয়ের কথা বলতে চাচ্ছি না আসলে। এর কারণ হলো এতোবার মুভিটা যেহেতু দেখেছি তার পেছনে অবশ্যই অভিনেতা অভিনেত্রীদের অসামান্য ভূমিকা আছে।
সবশেষে, একটা উপলব্ধির কথা বলতে চাই, বাঙলা ভাষাকে ভালোবেসে একজন পর্তুগিজ হয়ে উঠেছেন নায়ক। অথচ আমরা যারা বাঙালী তারা বাংলাকে পাশে সড়িয়ে ইংরেজি কে নিয়ে পড়ে আছি। এটিএম মুস্তফা কামাল ভাইয়ের একটা কথা খুব কানে বাজে। তিনি বলেন-- " যদি প্রভুদের ভাষা শিখলে উন্নতি করা যেত তবে পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত জাতি বা দেশ হতো আফ্রিকানরা। কেননা তারা তাদের প্রভুদের ভাষা আকড়ে আছে।"