বুঝলেন ভাই!
কয়েক সপ্তাহ্ আগে ইউকে আসলাম। বিলাত। এই কয় দিনে আমি সব বুইঝালাইছি, এ্যারা যে কত্ত বেকুব। তালিকা বানাইছি বুঝলেন, তালিকা।
১. সবাই সব সময় এক কথাই কয়, যখনই দেখা হয় বলে, “ ইঁউঁ ওঁয়াইঁট?” কি কয়? এজনেরে জিংগাইলাম। ইংলিশে তরজমা কইরা দিলো, "(are) You all right?” বঙ্গানুবাদ, “তুমি ঠিক আছ?” আহারে বলদ রে, আমি কি যন্ত্র যে ঠিক থাকুম?
২. অটোমেটিক দরজা। যেখানে যাই সেখানেই অটোমেটিক দরজা, কনফিউজিং আর মাথা খারাপ অবস্থা। বাস, টিউব, ট্রেন, দোকান, অফিস, সবকিছু। আজকে এক বাসার দরজার সামনে খাড়ায়া আছি তো খাড়ায়া আছি, ওম্মা! দরজা দেখি খুলেনা। প্রচন্ড শীতে সবকিছু ছোট হইয়া যখন কিসমিস অবস্থা, কি মনে কইরা নক করলাম। তখন বুঝলাম ওই দরজা অটোমেটিক না।
৩. কনটাক্টলেস পেমেন্ট। সব খানে। কার্ড কিংবা মোবাইল ফোন অথবা হাতঘড়ি। এক জায়গায় টাচ্ করলো, ইলেক্ট্রনিক পাঁদের আওয়াজ, “প্যাঁৎ!” পয়সা দেওয়া হইয়া গেলো। একবার এক বেটিরে দেখি বড় একটা ভ্যানিটি ব্যাগের তলদেশ টাচ্ করাইলো, “প্যাঁৎ!” - অ খোদা! পেমেন্ট হইয়া গেলো? - মাথায় একটা জ্ঞানী প্ল্যান আছে, বেকুব গুলাত্থেইক্কা একটা কার্ড চুরি করুম।
৪. বেকুবগুলা সবখানে লাইনে খাড়াইয়া যায়। ব্যাংক বা টিকেট কাটতে গেলে খাড়াইলো মানলাম। কিন্তু চা দোকান, বিঁড়ির দোকান, এমন কি কোনুখানে চান্দা দিবো ওইখানেও লাইন। পয়সা দেয় লাইন ধইরা? রাস্তার অবস্থা আরো খারাপ। সব গাড়ী লাইনে, ডাইনেরটা বাঁয়েরটা সব। এত ফাঁক ফোঁকর, কেউ ওইসব দিকে নাক হান্দাইয়া দেয় না। সবচেয়ে বড় বলদ পুলিশ, ওরা পারলে পিঁপড়ার লাইগাও খাড়ায়া থাকে।
৫. সবচেয়ে ভয়ংকর হইলো, শত শত গাড়ী। একটারেও হর্ণ বাজাইতে দেখলাম না। কেমনে চালায়? আমাগো দেশে হর্ণ ছাড়া গাড়ী চালানো কারো পক্ষে সম্ভব? আমার পক্ষে সম্ভব না।
৬. একদিন সকাল বেলা ফুটপাথে খাড়ায়া খাড়ায়া ফ্রী পত্রিকা পড়তাছি। কি রোদ! সব ফকফকা, দশ লাইনও পড়বার পারলামনা দেখি পানি পড়ে আমার পেপারে। মুখ তুইলা দেখি চারদিক সন্ধ্যার মত অন্ধকার। রোদ কই? নীল আকাশ কই? ধুসর মেঘ আর প্রবল বৃষ্টি। একেক ফোঁটা বৃষ্টির ওজন হবে পঞ্চাইশ গ্রাম। মুখচোপা ফাটায়া ফেলতেসে। হঠাৎ দেখি পত্রিকা হইয়া গেছে ইউজড্ টিস্যূ পেপার। বিলাতি বেকুব আবহাওয়া।
৭. সবচেয়ে বেশী হাসি পাইছে হাসপাতাল দেইখা। বিশাল বিশাল হাসপাতাল, ঠেলাঠেলিতো নাই-ই, কান্দাকাটিও নাই। বেকুবগুলা নাকি মরেওনা, বহু বছর বাঁইচা থাকে। আরো বড় বিষয় হইল, হাপাতালের সামনে কোত মৃতপ্রায় রোগীর সামনে দাঁড়ানো ক্রন্দনরত আত্মীয়স্বজন নাই। নাই কোন থ্রেট, “এত টাকা না নিয়া আসলে রোগীর চিকিৎসা সম্ভব না।” - এই কথা কইয়া উল্টা হাঁটা দিবার কোন সিস্টেমই নাই। মাইনষের চিকিৎসার সব খরচ মাইনষেই দেয় কারন দেশের সবাই মিল্লা সরকার-রে যে ট্যাক্স দেয় তার একটা অংশ চিকিৎসার খাতে চলে যায়। কি আজব, যদি কই আমি জিন্দেগীতেও হাসপাতালে যাই নাই অথচ আরেকজন মাসে চৌদ্দবার হাসপাতালে যায়, তাইলে সবার জন্য এক আইন ক্যারে? সবাই ট্যাক্স দিবো ক্যারে? সাফ জবাব, “জ্বী ভাই, সবার জন্য একই সিস্টেম।” এ্যারে আগে দেখো, ওই নেতারে ভি.আই.পি লাউন্জে নিয়া যাও এইসব সিস্টেম নাকি বিলাতে নাই। তোওবা তোওবা, বড় বড় নেতা-ক্ষ্যাঁতাদের কি মান ইজ্জত নাই? আম জনতার লগে লাইনে অপেক্ষা করন লাগে! আমাগো দেশ এত ফালতু না, ওখানে নেতার সর্দি রোগের জন্য বেড থিক্কা নামাইয়া সাধারণ রোগীরে বারান্দার ফ্লোরে হোতাইয়া রাখা হয়। এটাই ভদ্রতা, আমাগো হাসপাতাল কর্মীরা ভদ্রতার উপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। রক্ত লাগলে এক দৌড়ে হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে বসে থাকা রক্ত বিক্রেতার থুন রক্ত কিন্না আনন যায়। অথচ এইখানে কত তাফালিং, ‘নিজ রোগীর জন্য নিজ উদ্যোগে রক্ত আনা যাইবে না’ হাসপাতালই সব দিয়া দেয়। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রমাণীত হইলে চাকরীতো যায় ই, সংশ্লিষ্টদের লম্বা মেয়াদের জেলও হইয়া যায়। কি জঘন্য! কি জঘন্য!
. বিলাতিরা কি বেকুবের বেকুব জানেন! ওগো কোন ধারণাই নাই যে পৃথিবীতে এমনও দেশ আছে যেখানে ডাক্তার বা ক্লিনিকের হাতে পয়সা না আসলে ট্রিটমেন্ট বন্ধ কইরা দেয়। আবার রোগী মারা গেলে আই.সি.ইউ-তে রাইখা তিন-চার দিন পরে মৃত ঘোষণা করে এক্সট্রা বিল করার জন্য। আচ্ছা, বিলাতিরা এত অশিক্ষিত্ ক্যারে?
৮. বিলাতের বড় শহরগুলার জনপদে ঘুইরা বেড়াইলে মনে হয় জাতিসংঘের মহাসম্মেলনের মাইজখানে আছি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পোল্যান্ড, নাইজেরিয়া, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, আরব, জর্দান, লিথুয়ানিয়া, গ্রীস, হংকং, ফিলিপাইন, ব্রুনেই, মিশর, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, জাপান, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, বলিভিয়া, বুলগেরিয়া, পানামা, . . . (আল্লাহর দুনিয়ার মানচিত্রে যতগুলা দেশ/জাত আছে) সব আছে। এই জঙ্গলের মইধ্যে বেকুব বিলাইত্তারা কেমনে জানি থাকে। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হইলো বিলাইত্তাগো দেখাদেখি সব দেশ জাতপাত ভুইল্লা কি সুন্দর মিল্লা-মিশ্যা থাকে। বিয়াশাদীও দেয়। ধর্মকর্ম নিয়া কোন প্রকার খোঁচাখুঁচি নাই। সবচেয়ে বড় কথা কে কোন দেশের বা কোন বর্ণের এটা নিয়া বৃটিশদের কোন উচ্চবাচ্য নাই, কিছু বলা নিষেধ। এ বিষয়ে কঠোর আইনও বানাইছে।
৯. বিলাতিগো মধ্যে ডিভোর্স হয় প্রচুর। কিন্তু এগুলার যখন আমাগো কারো লগে বিয়াশাদী হয়, বেহায়ার মতন আজীবন থাইক্কা যায়। বেকুবের দল কি আরাম পায় কে জানে?
১০. রাজনীতি? ১০০ জনের মইধ্যে ৯৯ জনই জানেনা এই দেশে রাজনৈতিক দল কয় টা। রাজনীতি নিয়া প্রশ্ন করলে একেক বয়সের মানুষ একেক জবাব দেয়। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম জিংগাইলেও একেকজন একেক কথা কয়। ৯০ বছরর কাউরে জিংগাইলে কয়, “উইস্টন চার্চিল।” ৬০ বছরের কাউরে জিংগাইলে কয়, “মার্গারেট থ্যাচার।” ৩০ বছরের কাউরে জিংগাইলে কয়, “ঠোওনি (Tonny) ব্লেয়ার।”
“আচ্ছা, বর্তমান (বৃটিশ) প্রধানমন্ত্রী কোন পার্টি করে?” জবাবে বলে, “প্রধানমন্ত্রী আবার পার্টি করে নাকি?” একজনরেরে জিংগাইলাম, *“বরিস জনসন কে?”
উত্তর, “লন্ডনের মেয়র।”
বিরক্ত হইয়া কইলাম, “তাইলে সাদিক খান কি?”
নির্বিকার উত্তর, “সে লন্ডনের এশিয়ান মেয়র।”
আকাশের দিকে তাকাই, চোখে পানি, “ইয়া রাব্বুল আলামীন, কোন অশিক্ষিত্ রাজ্যে আমারে আইনা ফালাইলা।?”
(*তখন বরিস জনসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিল)
এক্সট্রা-লার্জ উপসংহার:-
এদের তুলনায় আমরা অনেক বেশী শিক্ষিত এবং জ্ঞানী। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যেখানে রাজনৈতিক শিক্ষার হার ১০০% (নাম সই করতে পারে ৭৩%, তাতে কি?)। সবাই রাজনীতি করে, গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ, স্বর্গ থেকে মর্ত্য, ভূমি থেকে মহাশূণ্য, ধনী থেকে গরীব, মোল্লা থেকে মেথর সবাই। ১৬ কোটি মানুষ সবাই রাজনীতি করে। রাজনীতি খায়, রাজনীতি পান করে, রাজনীতি হাগে, রাজনীতি মোতে, স্বপনে রাজনীতি, জাগরণে রাজনীতি, সম্মন্ধ করার সময় রাজনীতি, বাচ্চা হবার সময় রাজনীতি, স্কুলে ভর্তি হবার সময় রাজনীতি, পরীক্ষার সময় রাজনীতি, রেজাল্টের সময় রাজনীতি, স্কুল কলেজ থিক্কা বাইর হবার সময় রাজনীতি। ধর্মে রাজনীতি, অধর্মে রাজনীতি, গানে রাজনীতি, নাচে রাজনীতি, সংষ্কৃতিতে রাজনীতি, কৃষ্টিতে রাজনীতি, গাড়িঘোড়ায় রাজনীতি, চাল, ডাল, মাছ, গোস্ত, শুটকি, তরিতরকারী, মশল্লা, পেঁয়াজ, মরিচ, লবন, সর্বত্র রাজনীতি। মদ খেতে গেলে রাজনীতি, ড্রাগ (নারকোটিকস) ইয়াবা এসবের জন্য রাজনীতি তো বাধ্যাতামূলক। - সর্বক্ষেত্রে রাজনীতি, সর্বস্তরে রাজনীতি আমাদের দেশ এবং জাতিকে সম্মানজনক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
আমরা বিনয়ীও। আমাদের বিনয়মাত্রা জগতের সকল “বিনয়-সূচক” ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রয়োগ সর্বত্র। বড় কিংবা ছোট যে কোন পদবীর আগে-পরে “মাননীয়”, স্যর কিংবা “মহোদয়” ব্যাবহার করা এখন ‘কালচার’ - সেটা হতে পারে সকল ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, সিভিল সার্ভেন্টস, স্থানীয় সরকার, রাষ্ট্র থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত এন.জি.ও, ক্লাব অথবা যা ইচ্ছা তাই। উদাহরণ:- মাননীয় বড়ভাই, মাননীয় নেতা, মাননীয় নয়েনর মণি, মহামান্য ডিসি মহোদয়, মহামান্য এসপি মহোদয়, এস.আই মহোদয়, মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট, মাননীয় কাউন্সিলর ইত্যাদি। বিনয়-বিশেষণের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক নয় তবুও আমরা মনের অজান্তে বুঝে এবং না বুঝে মানুষ এবং বিল্ডিংয়ের উপর বিনয় প্রয়োগ করে থাকি। উদাহরণ:- হিজ ম্যাজেস্টি ক্লাব প্রেসিডেন্ট, মহান সংসদ, পবিত্র বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।
অথচ বিলাতিরা? ওরা শুধু বেকুব না, বেয়াদ্দপও।
একদিন কি কামে জানি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসার সামনের গলির মুখ দিয়া হাঁইটা যাইতেছিলাম। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। গলির মুখে বিরাট গেইট, অনেকগুলা পুলিশ। সবার হাতে বড় বড় বন্দুক, সারাক্ষন ট্রিগারে হাত। আমি দেখি এক বিলাতি পথচারী বন্দুকঅলা এক পুলিশরে জিংগায়, “বরিস বাসাত নি?” আর পুলিশের বিনয়ে বিগলিত উত্তর, “একটু আগে বরিস পার্লামেন্টে গেছে।” আমি টাশকি খায়া গেলাম! একটা পাবলিক আর একটা দেড় টাকার পুলিশ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরে? যাবার আগে পথচারী পুলিশরে যা কইলো শুইনা আমার মাথা ঘুইরা গেলো, “ইডিয়টটারে পার্লামেন্টে ঢুকতে দেয় কেন কে জানে!” বন্দুকঅলা পুলিশ একটা কথাও কইলোনা? খুব রাগ লাগসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরলো! আবার ইডিয়ট কইলো? এতবড় স্পর্ধা! আর পুলিশ???
ইচ্ছা করতেসিলো চীৎকার কইরা প্রতিবাদ করি;
গানের ভাষায়,
“ প্রধানমন্ত্রীরে ইডিয়ট ডাইক্কা
পুলিশের নাকের সামনে দিয়া
অপরাধী হাঁইট্টা যায়।
ফাইট্টা যায়,
ওরে বুকটা ফাইট্টা যায়। ”
ওরা বেয়াদ্দপ, আমরা না। ওরা বেকুব, আমরা না। আসুন ওদের জন্য দোয়া করি, ওরাও যেন আমাদের মত হয়ে যায়।
"ইয়া রাব্বুল আলামীন, এদের দয়া কর, এই জাতিকে উন্নত কর। ব্রিটেনকে বাংলাদেশ বানায়া দাও। - আমীন।।"
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী, লন্ডন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৩ বিকাল ৩:১৯