স্কেটবোর্ড পার্ক পার হতেই দেখলো এশিয়ান একজন পুরুষের ব্যাক স্ট্যাক হ্যান্ডকাফ লাগানো। ফ্লেচার এগিয়ে হারিয়ে যাওয়া ফোনটা নাইজেলের হাতে তুলে দিলো। আইফোন। লক স্ক্রীনে একটা অপরূপা কিশোরীর সাদাকালো ছবি, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। নাইজেলের বুকে কেমন যেন অনুভূতি হল, অনেক ভালোলাগার। ছবিটা ওর মায়ের। ক্লডিয়া ছুটে একে নাইজেলের ডান বহুর উপর হাত রেখে স্বস্নেহে জানতে চাইলো ও ঠিক আছে কিনা। “ইয়েস আ’ম ফাইন ক্লড!” নাইজেল ভাবতে পারছেনা কাঠখোট্টা কলিগ ক্লডিয়া যে কিনা নাইজেলের দিকে কোনদিন ফিরেও চায় নি আজ সে সবার আগে ছুটে এসেছে। একটু পর পর নারী, পুরুষ সব অফিসাররেরা এসে এসে নাইজেলের খোঁজ নিচ্ছে ও ঠিক আছে কি না। সবার এত আন্তরিকতা দেখে নাইজেল আবেগ লুকাতে পারেনা। আরে বাবা ওর ফোন হারিয়েছিলো, অন্য কিছু না।
একশ নব্বই বছর ধরে লন্ডন মেট্রপলিটন পুলিশের এই ভাতৃত্বের সংস্কৃতি এখনও অটুট রয়েছে।
ইদানীং লন্ডন মেট পুলিশ রেসপন্স কারগুলোর আশি ভাগই ইলেক্ট্রিক। শতভাগ ইলেক্ট্রিক মানে শতভাগ পরিবেশ বান্ধব, হাইব্রীড জাতীয় দুনম্বরী নেই। বি এম ডাব্লিউ আই-থ্রী। কোন শব্দ করেনা, ভুতের মত। এক্সেলেটরে জোরে চাপ দিলেই বুলেট স্পীড উঠে যায়। মাত্র তিন সেকেন্ডে ৬০ মাইল বা ৯৬ কিলোমিটার স্পীড। গতির এই হঠাৎ পরিবর্তন খুব এনজয় করে নাইজেল। আজ সে ইলেক্ট্রিক কার নেয় নি, নিয়েছে একটা ম্যানূয়াল ভক্সহল এশট্রা ডিজেল কার। কারন সারাদিন ওটা পড়ে থাকবে হাসপাতালের সামনে। ওর পোষ্টিং পড়েছে স্যাল এর সাথে। অনেক অভিজ্ঞ, গত আট বছর ধরে মেট পুলিশের সাথে আছে। বেংগলি অফিসার, ওর বাবা কিংবা দাদা সিক্সটিজ-এ ইন্ডিয়া থেকে লন্ডনে এসেছিলো। এখন ইস্ট লন্ডনের এই এলাকা বাংলাদেশ হয়ে গেছে। অত্যন্ত সুভদ্র স্যাল এর ফুল নেইম সালাম মিয়া। নাইজেল স্যালের সাথে কাজ করে আরামও পায়, খুব সাপোর্টিভ আর তারুণ্যে ভরপুর এশিয়ান দক্ষ অফিসার।
হোয়াইটচ্যাপেল রোডের দক্ষিনে প্রায় রাস্তার গা ঘেঁষে বিশাল এলাকা জুড়ে সুউচ্চ আর অত্যাধুনিক রয়েল লন্ডন হসপিটাল দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না এই এলাকায় এত বিশাল, দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল থাকতে পারে। ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের বয়স বর্তমানে প্রায় ২৮০ বছর। ১৭৪০ সালে ছোট পরিসরে গঠিত এই আরোগ্যাশালার নাম ছিলো লন্ডন ইনফার্মারী, আট বছর পর নাম দেওয়া হয় লন্ডন হসপিটাল। ২৪৩ বছর পর ১৯৯০ সালে এর নাম রাখা হয় দ্য রয়েল লন্ডন হসপিটাল।
মেইন বিল্ডিংয়ের পূর্বদিকে মিলওয়ার্ড স্ট্রীটে যেখানে এ্যাম্বুলেন্সগুলো পার্ক করা থাকে সেখানে ডানদিকে সুবিধামত এক জায়গায় গাড়ী পার্ক করে নাইজেল আর স্যাল ছয়তলার সেকশন সি’র পিডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট (PCCU)-এ পৌঁছলো ততক্ষনে প্রায় সকাল পৌনে আটটা বেজে গেছে। যে দুজন অফিসার ডিউটিতে ছিলো তারা ভোর চারটা থেকে এখানে।
হ্যান্ডওভার নিতে গিয়ে যা শুনলো হতভম্বব নাইজেল। বিমূঢ় হয়ে স্যাল এর দিকে তাকিয়ে আছে। অভিজ্ঞ স্যাল ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলো। ভোর সাড়ে তিনটার দিকে রিসাস (Resuscitation ওয়ার্ড যেখানে মৃত্যুপথযাত্রি রোগীদের বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করা হয়) -এর ডাক্তার পুলিশে রিপোর্ট করে। একটা ছোট বাচ্চাকে রিসাসিটেশন ওয়ার্ডে আনা হয়েছে যার ইনজ্যূরি সন্দেহ জনক। একটি শিশুর পিতা ইমার্জেন্সীতে ফোন করে জানায় শিশুটির বাঁ কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। শিশুটির বয়স তেরো সপ্তাহ। মেয়ে। পিতা মাতা এশিয়ান বাংলাদেশী। শিশুটিকে দ্রুত হাসপাতালে আনার পর দেখা গেলো মা এক বর্ণও ইংরেজী বলতে পারেনা। বাবা বলছে সে ঘটনার বিস্তারিত জানেনা, সম্ভবতঃ বিছানা থেকে পড়ে গেছে।
সেখান থেকেই সন্দেহের শুরু। মাত্র তের সপ্তাহ বয়সি এই শিশুটির মাথার নরম খুলি ভেঙ্গে ব্রেনে পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঘাড়ের তিনটি ভার্টিব্রা ভেঙ্গে গেছে, ডান বুকে চারটি পাঁজরের হাঁড় ভেঙ্গে তিনটি হাঁড় ফুসফুস ভেদ করে ঢুকে পড়েছে। একটা শিশু শ্রেফ বিছানা থেকে পড়ে গেলে এত ভয়াবহ ইনজুরি হতে পারে না। রিসাস ওয়ার্ড থেকে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক এ্যাসেসমেন্ট শেষে শিশুটিকে পিডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটির বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। যে কোন সময় মারা যাবে, তখন এই মৃত্যু আর স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে গণ্য হবেনা। এটা ক্লীয়ার মার্ডার। সেজন্য পুলিশ গার্ডের ব্যাবস্থা। সবার আগে সন্দেহ আসবে পিতা-মাতার উপর। সব শুনে নাইজেলের অস্থির লাগছে, দুনিয়াটা এত কঠোর কেন? নাহ্ আর এই চাকরী করা যাবেনা।
মনের উপর এত চাপ, এত্তো চাপ সে নিতে পারবেনা।
চলবে. . .
পর্ব: ১
পর্ব: ২
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৪২