বাবা একটা সাইকেল কিনে দিবেন হ্যা দেব আরও বড় হও, বড় হবার কি দরকার একটা ছোট সাইকেল কিনে দিলেই তো হয়।
এই হয় আর কোন দিন হয়নি। বাবা সাইকেল কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি রাখেন নি। ১৯৯০ সাল, তখন আমাদের বাসায় একটা ফনিক্স সাইকেল ছিল তখন আমার উচ্চতা এর চাকার থেকেও কম ছিল, কিন্তু স্বপ্ন ছিল ওই নরম সিটের উপর, আমার সেখানে ওঠা হয়নি, সব স্বপ্ন পূরণের জন্য হয়না, কিছু অধরা থেকেই যায়।
ছোট বেলায় আর সবার মতই আমার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, উনি বেশ দূর থেকে যাতায়ত করতেন, আমরা থাকি যশোর ক্যান্টনমেন্ট এ। কয়েকমাস আমাকে পড়ানোর পর স্যার জানালেন যে উনি আসতে পারবেন না আর,
আমার বাবা বললেন কেন? স্যার বলল যে উনার বড় ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে উনি আসতেন আমাকে পড়াতে, তার ভাই একটা কাজ পেয়েছে যেটা কিনা বাড়ি থেকে অনেক দূরে, সে সাইকেল নিয়ে যাবে, এ জন্য সাইকেল ছাড়া তার পক্ষে এতদুরে আসা সম্ভব না।
আমার বাবা শুনলেন বলে দিলেন কাল যেন একটু কষ্ট করে হলেও আসে, বাবা এর মধ্যেই অফিসের একজন কে দিয়ে একটা নতুন সাইকেল কিনে আনালেন, পরদিন বিকালে স্যার আসলেন, যথারীতি আমার পড়া শেষ করলেন, এরপর যাবার সময় বাবা কে জিজ্ঞেস করলেন কি জন্য আসতে বলেছেন, বাবা হাতে একটা সাইকেলের লম্বা তালা আর চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন নিন সাইকেল বারান্দায় রাখা আছে নিয়ে যান, এটা আপনার জন্য কেনা হয়েছে।
স্যারের চোখ মুখ দেখে মনে হল এখন ই কেঁদে ফেলবে। এমন খুশি মনে হয় উনি জীবনেও কোনদিন হন নি। নিরবে চোখের পানি মুছলেন।
আমার বাবা এমন ই এক মানুষ ছিলেন, দিনরাত মানুষের খুশি কিনতেন। টাকা পয়সা তার কাছে কখনোই বড় ছিলনা মানবিকতা থেকে।
পাড়ার মোড়ের সাইকেল মেরামতের দোকান দেখতে আমার খুব ভাল লাগত, আমি মগ্ন হয়ে দেখতাম একটা স্ট্যান্ডের উপর চাকা রেখে কেমনে ঘোরায়, গ্রিজ লাগায় কি চমৎকার চাকা ঘোরে, আমি মাঝে মাঝে টাকা জমিয়ে সাইকেলের পুরনো বিয়ারিং কিনতাম, স্পোক কিনতাম ছোট বেলায় অনেকেই এমন কিনত যাদের ছোটবেলা গ্রামে অথবা মফঃস্বলে কেটেছে। এ এক অন্যরকম আনন্দ আমরা লাঠিতে বিয়ারিং লাগিয়ে পাড়াময় ঘুরতাম, নানা বাড়ি গেলে তো কথাই নেই।
ক্লাস টু তে উঠার পরে আমরা হবিগঞ্জ চলে আসি, বাবার কাছে বায়না আমার একটা সাইকেল লাগবে, বললেন ক্লাস থ্রিতে উঠলে কিনে দেবেন, আমি টু পার করে থ্রিতে, বাবা ব্যবসায়ের নানা কাজে ব্যাস্ত, আমার সাইকেল তো আর আসেনা। এরপরে বললেন ফোরে উঠলেই কিনে দিবেন, যাই হোক আবারো নতুন স্বপ্নের জালবোনা।
আমার কাজিন শরীফ আর তার লাল সাইকেল আহারে কত জালাইছি তারে, সে আমার বাসায় আসত আর আমি তার সাইকেল নিয়ে হাওয়া।
আমার এই স্বপ্ন গুলো অন্যের প্যাডেলেই শহরের রাস্তার অলি গলি ঘুরেছে। কখনো কলাপাতা কখনো কারো দেয়ালের উপর দিয়ে ঝুলে পরা বাগান বিলাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে পথ ঘুরেছি, ফোরে উঠার পরে বাবার অসুস্থতা বেড়েই চলেছে, ঢাকায় নেয়া হল পিজি হাসপাতালে, সেখান থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেন, আমার বায়নার কথা বলতে ইচ্ছে করে না, বাবার মলিন মুখ দেখে, অসুস্থতা মানুষ টা কে একদম ঝিমিয়ে দিয়েছে, যে মানুষটার ভয়ে সবাই কাঁপত আজ মানুষ টা কেমন যেন হয়ে গেছেন, ততদিনে আমি সাইকেল চালানো শিখে গেছি, কিন্তু বলার মত আর কোন সাহস পাইনা।
কেঁদে বালিশ ভেজানো রাতগুলো আমার ইচ্ছেগুলো শুকিয়ে দিচ্ছে, শৈশবের স্বপ্ন গুলো বড্ড অভিমানী হয়। পিজি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দুই মাসের মাথায় আমার বায়না সাথে নিয়ে বাবা চলে গেলেন চিরতরে এমন জায়গায় যেখান থেকে কোন সাইকেল কিনে দেয়া সম্ভব না।
আমার আর সাইকেল কেনা হয়নি।
পাশের জায়গা টাতে একচালা টিনের ঘর, কিছু গার্মেন্টস কর্মী আর দিনমজুরদের বসবাস, আমি বাসায় ফিরছি এমন সময় একটা ছোট বাচ্চা ছেঁড়াফাঁড়া কাপড়ে একটা ভাঙ্গা সাইকেল চালাবার চেষ্টা করছে, কোনমতে এক পা দিয়ে এদিকে উঠলে ওদিকে আবার ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলছে, আমাকে দেখে বলল এট্টা ঠেলা দিবেন, বললাম তা না হয় দেব কিন্তু তুমি এই সাইকেল কই পেলে, বলে আব্বায় কিন্না দিছে, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, আমার শৈশবের স্বপ্ন জীর্ণ দশায় একদম জীবন্ত চোখের সামনে। আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে, ওরে বসিয়ে দিলাম ঠেলা, সে ওই ওই চলছে বলে কি যে খুশি।
এখন চাইলেই একটা সাইকেল কেনা যায় কিন্তু সে স্বপ্নটা যে আর নেই, স্বপ্নের আলনা ভেঙ্গে গিয়েছে, মেরামতের কোন ইচ্ছে জাগে না।
এই ছোট্ট ছেলেটার মত হৈহৈ করে সাইকেল চালাতে পারিনি কখনো, পারিনি কখনো আমার স্যারের মত সাইকেল পেয়ে চোখের পানি মুছতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৫৮