যে গল্পটি এতটা তোলপাড় তুললো, পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক ক্ষমাপ্রার্থণা করলেন তাদের কারো প্রতি আমার আবেগ নেই--বরং প্রথমআলোর সাম্রাজ্যবাদপ্রীতি অর্থাৎআমেরিকান প্রপোগান্ডা ও নেক্কারজনক ইউনুসবাদ বাঙলাদেশের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিরকারণ বলেই আমি মনেকরি। আজ বাঙলাদেশের যতটুকু দুর্দশা তারজন্য জামাত ও প্রথমআলো সমানভাবে দায়ী বলে আমার মনে হয়। তবে যে কথাটি বলার জন্যএই ভূমিকাটুকু টানলাম তার কারণটি হলো‘টিভি ক্যামেরারসামনে মেয়েটি’ শীর্ষক যে গল্পটির সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো টানা হচ্ছে তা আমি যথেষ্ট চিন্তাপ্রসূত নয় বলেই মনে করি। আমিএমনকি মনেও করতে পারছিনা যে এই গল্পটি কোনো ভাবে স্লোগানকারী নারীটির বা কোনো টিভিসাংবাদিকের সম্মানকে ক্ষুণ্ন করে। যদিও জানি ওই দুই পক্ষ থেকেই ফলাও করে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। প্রথমআলো যে একটি চরিত্রহীন গোষ্ঠীর প্রতিনিধি তার পক্ষে যখন-তখন ক্ষমা চাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়; এরআগে যেমন একটি কার্টুনের জন্য বায়তুল মোকাররমে গিয়ে ক্ষমা সম্পাদক চেয়েছিলেন, এখনও সেই বাণিজ্যরক্ষার তাগিদে ও বৃহত্তর আমেরিকান প্রপোগান্ডা চালানোর জন্য সম্পাদকের ক্ষমা চাওয়া আশ্চর্যের বিষয় নয়।আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে লেখকের ক্ষমাপ্রার্থণা করতে চাওয়ার ব্যাপারটি এবং আর কোনো গল্পগ্রন্থে তাঁর গল্পটিকে স্থান দিবেন না বলে যে অঙ্গিকার করেছেন সেই ব্যাপারটি। লেখককি নিজে স্বেচ্ছায় ক্ষমাচেয়েছেন, নাকি কূটবুদ্ধিসম্পন্ন রাষ্ট্রঘাতী প্রথমআলো কোনোভাবে বাধ্য করিয়েছেন লেখককে ক্ষমা চাইতে?
এখন গল্পটি কেন স্লোগানকারী নারীটির বা কোনো টিভিসাংবাদিকের সম্মানকে ক্ষুণ্ন করে না তা ব্যাখ্যা করি:
যদি পাঠক আপনি গল্পটি পড়ে থাকেন--আমি আবার বলছি: যদি গল্পটি আপনি আসলেই পড়ে থাকেন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি দেখবেন যে গল্পের কোথাও এই নারীস্লোগানিস্টটি যে আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের তার উল্লেখ নেই। এখানে উল্লেখ আছে একটি জমায়াতের--ঠিক যেমন করে কোনো আণ্দোলনে একটি জমায়েত তৈরি হয়ে থাকে। সেখানে যেমন বিভিন্ন শ্রেণির উল্লেখ থাকে, ঠিক তেমনি। গল্পকার কিন্তু বলেননি যে এই ঘটনাটি ঘটছে শাহবাগে! যদিও এখানে শাহবাগের কথা একবার উল্লেখ আছে সেটা আবার এই মিছিলের ঘটনার ধারাবাহিকতায় নয়, বরং সেই দৃশ্য বোঝাতে যেখানে পহেলা বৈশাখের একটি কাভারেজ দিতে সেই স্লোগানিস্ট টিভি রিপোর্টার হিসেবে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। অর্থাৎযথন সে আর স্লোগানিস্ট নেই, যে কিনা মাসে নিয়মিত ১৫০০ টাকা ভাতা পেয়ে, দলের নেতাদের অনিয়মিত শরীর দিয়ে তার কর্মীজীবন পার করেছে, যাকে নিয়ে আসা হয়েছে মফস্বল থেকে, ঢাকায় কলেজে ভর্তি করাহয়েছে সরকারি দলের মদদে। একটি স্থানে এ পসঙ্গে জমির চাচা, যে ওই সীমা নামক মেয়েটিকে মফস্বল থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে, বলছে যে:
“কলেজ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে। বললেই অ্যাডমিশন হয়ে যাবে।হোস্টেলেও জায়গা পেতে অসুবিধা হবে না। সবইতো রাজনৈতিক দলের কন্ট্রোলে, যখনযারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের।এখন আমরা আছি, সবসিদ্ধান্ত আমরাই নিই।কে অ্যাডমিশন পাবে, কার জন্যসিট খালি করাতে হবে—এ সবই আমাদের আওতায়।”
তো এই উদ্ধতিতে আমরা কী বুঝতে পারি যে দলে সীমা মফস্বল থেকে এসে ঢুকেছে সেটা কোনো বামদল নয়, কোনো গণজাগরণমঞ্চ নয়, বরং ক্ষমতাসীন দল। এইদলকে আওয়ামী লীগ বলতে পারি যদি গল্পের সময়কালটা কে বর্তমানকাল হিসেবে বিবেচনা করি বা বলতে পারি বিএনপির যদি এটাকে তারও আগের হিসেবে ধরি।
অবশ্য আমার মতে বিএনপি ধরার সুযোগ কম এই কারণে যে, (যখন এইগল্পটির সময়কাল, যদিও খুব স্পষ্টকরে বলা হয়নি সেটা) তখনকার দলটি লাল-সবুজ রঙ-এর ব্যবহার করে আন্দোলনটি চালিয়ে যাচ্ছিল।বিএনপি কখনও লাল-সবুজের আবেগ নিয়ে রাস্তায় নামেনি, ভণ্ডামো করেও তারা জাতীয়পতাকার কথা বলেনি কখনও!
যদিও গণজাগরণ মঞ্চে জাতীয় পতাকাররঙ ব্যবহার করা হয়েছে বারবার, তাই এই আন্দোলনের প্রকৃতির সাথে ওই লাল-সবুজের প্রসঙ্গের মিল খায় কিন্তুএই তথ্য গল্পের আরেকটি তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে যখন আমরা উপরের উদ্ধৃতির বাস্তবতটা মেনে নেই যেখানে জমির চাচা বলছে যে ‘এখন আমরা আছি, সবসিদ্ধান্ত আমরাই নেই’।তখন কোনোভাবেই গণজাগরণমঞ্চের কোনো নেতার বক্তব্যতা প্রতীতি হয় না।
সুতরাং এই গল্পে যদি কারো প্রকৃতই ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা সেটা হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের নারীকর্মীদের!
এখন পাঠকের ভাবা উচিৎযে, যদি সীমা নামক মেয়েটি গণজাগরণ মঞ্চের না হয়ে আওয়ামী লীগের নারীকর্মী হয়ে থাকে, বা আলোচনার খাতিরে ধরেই নিলাম যে বিএনপিরই হয়ে থাকে, তাহলে সীমারশরীর দানের ঘটনাটিতে কিএমনই ক্ষুব্ধ হবেন? নাকি তখনও বলবেন যে, ওই দলগুলোতে মাইক নিয়ে রাজনীতি, লাইমলাইট নিয়ে আসা রাজনীতির চর্চা মোটেই ঘটে থাকে না? বিতর্কের জন্য নয়, বরং তথ্য হিসেবে সত্যতার জন্যএই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করা জরুরি মনে করি।
তবে হাসনাত আবদুল হাই এই গল্পে ‘মঞ্চ’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করেছেন, এবং ব্যবহার করেছেন যে, আন্দোলনকারীদের বারবার টিভিতে দেখাচ্ছে, ওখানে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যে স্লোগান দিচ্ছে সে সেলেব্রিটি হয়ে পড়ছে’--তাতে ধারণা হওয়াটা স্বাভাবিক যে এটা গণজাগরণমঞ্চের, কিন্তু ধারণা আর বাস্তবতা এক নয়; ধারণার উপর নির্ভর করে কোনো লেখককে আক্রমণ করা যা্য় না; কারণ এটির জন্য লেখক দায়ী নন, দায়ী ধারণাপোষণকারী।
যে কোনো লেখকেরই সম্পূর্ণস্বাধীনতা রয়েছে যে কোনো ঘটনা থেকে চিত্রকল্প ধার করার; কারণ ঘটনাকে জীবন্ত করে তুলতে হলে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আনতেই হবে; সব বড় লেখাই এই প্রমাণ বহন করে। লেথককে বাস্তবের কাছে যেতে হয়, আবার হুবুহু বাস্তবতাও যদিও গল্পের চরিত্রের জন্য হানিকর, তাই বাস্তবতা থেকে সরেও আসতেহ য়। হাসনাত আবদুলই হাই সেই কাজটিই করেছেন বলে আমি মনে করি। বর্ণনায় তিনি গণজাগরণ মঞ্চের আদলের অনেকগুলো চিত্রকল্প হাজির করেছেন, যা তাঁর গল্প লেখার রসদ জুগিয়েছে সত্য, কিন্তু তাই বলে তিনি ওই আন্দোলনের কোনো কর্মীকেও অপমাণিত করেছেন তা বলা যায় না।
বরং আমি মনে করি তিনি স্লোগানিস্ট সীমাকে অনেকটা মুক্তিদান করেছেন যেই মুক্তির প্রত্যাশায় সীমা বলছিল:
“আমার একটা চাকরি দরকার। ভদ্রলোকের, ভদ্রমেয়ের মতো চাকরি।আপনি দিতে পারেন।”
সেই চাকরি পেয়েই তো সীমা চলে যায় ক্যামেরার সামনে, আর তখন গল্পটির নামকরণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে।
নামটি পাঠককে আমি ভালোভাবে খেয়াল করার কথা বলছি: ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’।এর মানে হচ্ছে গল্পকারবলতে চান সীমা মেয়েটি আগে যে কর্মে নিযুক্তছিল, সেটা ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি এখন টিভি ক্যামেরার সামনে এসে পড়েছে, অর্থাৎমেয়েটির বাঞ্চিত জীবনেই মেয়েটি এসে উপনীত হতে পেরেছে।সীমা তো এই চেয়েছিল, তাই নয় কি? আমরা কি এই কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছি যে মেয়েটি তথাকথিত স্লোগান ছেড়ে, পরের ১৫০০ টাকা দান পরিত্যাগ করে আত্মকর্মসংস্থানে সক্ষম হয়েছে?
সংক্ষুব্ধ পাঠকের ভাববার দরকারআছে।
গল্পকার কিন্তু বলেননি যে ‘টিভি ক্যামেরারর সামনের মেয়েটি’। ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’ আর ‘টিভি ক্যামেরার সামনের মেয়েটি’ কথা দুটোর মধ্যে কি আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে! আপনি কি লক্ষ করেছেন যে ‘সামনে’ ও‘সামনের’ শব্দ দুটি কীভাবে গল্পের বক্তব্যকে বদলে দেয়? ‘সামনে’ বললে বোঝা যায় যে আগে পেছনে ছিল, এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।আর ‘সামনের’ বলে বোঝাই যায় যে চরিত্রটির কোনো ক্রমবিকাশ ঘটেনি, অর্থাৎ চরিত্রটি সবসময় সামনেই ছিল, তার উত্তরণ ঘটেনি!
প্রথমআলোর অবশ্য এগুলো বুঝবার কথা না, হয়ত তারা ‘সামনে’ কে ‘সামনের’ মনে করেই গল্পটির ব্যঞ্জনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, তাতে আমেরিকা যে গণজাগরণের মঞ্চ পছন্দ করে না, তার হয়ে কিছুটা দালালি করাহয়ে গেল, কিন্তু গল্পকারের তো এগুলো জানবার কথা? তিনি যদিও মনে মনে অনুতাপ বোধ করতে থাকেন যে ‘কেন গল্পের চিত্রকল্পগুলো গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ধার করতে গেলাম!’, তাহলেও আমি বলবো যে এটা তাঁর আমলামানসিকতাপ্রসূত শঙ্কামাত্র--যার সঙ্গে তাঁর লেখক সত্তার নিশ্চই অনেক বিরোধ রয়েছে।