somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কোমা

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“If girls could spit venom, it'd be through their eyes.”
― S.D. Lawendowski

১।

কনকনে ঠাণ্ডা বা গরমের হলকা গরম নয় - বরং খুব মিহি, শীতল এবং আরামদায়ক বাতাস তার শরীর ঘিরে খেলা করতে থাকে। শরীর জুড়িয়ে যায়। কোথা থেকে আসে এই অপরিচিত বাতাস? সে কি তার মায়ের কোলে? এত আলো চারপাশে, মনে হয়, কিন্তু সে কিছু দেখতে পায় না কেন? তার মুখ কি মায়ের শাড়ির আঁচলে ঢাকা? কে জানে! সে কি এখনও মায়ের কোলে? এটাও তো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না! মা তাকে সবসময় কোলে নিয়ে ঘোরে না। কখনো কখনো মা তাকে তেল চিটচিটে কিছু একটা জিনিসের ওপর শুইয়ে রেখে হারিয়ে যায় কোথাও। চারদিকে থাকে নরম বালিশের ঘের। এমন সময় তার গলা ফাটিয়ে মা' কে ডাকতে হয়। মা তখন দৌড়ে ছুটে আসে। তারপর, কখনো কখনো মা তাকে পায়ের ওপর রেখে দোল খাইয়ে ঘুম পাড়ায়। আবার কখনো তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঘরময়। এই ঘুরে বেড়ানোর সময়টা ওর সবচাইতে বেশী ভালো লাগে। আরও ভালো লাগার সময় একটা আছে অবশ্য, তবে তার জন্যে ওর বেশ খানিকটা শারীরিক কসরত করতে হয়। যখন ওর পেটে ক্ষিধে থাকে, ও ট্যাঁ ট্যাঁ করে চ্যাঁচ্যাঁয়। মা তখন শরীর থেকে কাপড় সরিয়ে বের করে আনে তার সুডৌল স্তন। স্তনবৃন্ত ওর মুখে পুরে দেয়া মাত্রই সে ক্রমাগত সেটা চুষতে থাকে প্রাণপণে। মায়ের শরীর নিঃসৃত প্রাণরস তার মুখ - গলা - কণ্ঠনালী হয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছায়। ক্ষুধা দূর হয় সেই উষ্ণ তরলের আঁচে। ঠিক এখন যেমনটা তার মুখ গড়িয়ে কণ্ঠ হয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছাচ্ছে সেই উষ্ণ তরল। মায়ের বুকে খুব কোমল একটা ঘ্রাণ থাকে। সে ঘ্রাণ মায়ের ঘ্রাণ। মুখে যতবারই মা তার উন্মুক্ত স্তন মেলে ধরে, ততবার সেই ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্রে এসে পরম নির্ভরতা ছড়িয়ে দেয়। ঠিক যেমন এখন ওর নাক জুড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি এক ঘ্রাণ। একটু অচেনা, কিন্তু মায়ের ই ঘ্রাণ। তাই হবে ঠিক ঠিক। কিন্তু একটা বিষয়ের হিসেব সে মেলাতে পারছে না - মা যখন তাকে বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে পরম মমতায় স্তনদান করে তখন মায়ের বুকের দারুণ এক ওম তার সারা শরীর জুড়ে থাকে। সেই উষ্ণতা আজ কোথায়? কোথায় সেই নরম - স্নিগ্ধ কোমলতা?

আঁতিপাঁতি করে শিশুটি মায়ের নরম বুক খুঁজতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে - ওর হাত পা নড়ছে না। আরও জোরে সে শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করে। প্রাণপনে, শরীরের সবটুকু জোর খাটিয়ে, ঝটকা মেরে সে উঠে বসতে চায়। পারে না। মা কই গেল? মা নেই কেন কাছে? মা কি দেখছে না ওর এই অসহায় অবস্থা? এই তবে মায়ের ভালোবাসা ওর প্রতি? এই হচ্ছে তার আদর সোহাগের নমুনা? তীব্র অভিমানে সারা শরীর বাঁকা করে ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায়। কিন্তু পারে না। চেষ্টা করে জোর করে মায়ের স্তন থেকে মুখ সরিয়ে নিতে, অনুভব করে যে - সে মাথাও নাড়াতে পারছে না। তার ভয়াবহ একা লাগে, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয় নিজেকে। ভেতরে ভেতরে এক ভয়াবহ চীৎকারে সে ভেঙ্গে পড়ে, তার সমস্ত হাত পা শরীর কুঁকড়ে আসে। ছোট হয়ে, কুণ্ডলী পাকিয়ে পুনরায় ফিরে যেতে চায় সেই অন্ধকার নাতিশীতোষ্ণ স্থানে - যেখানে তার শরীরকে আলাদাভাবে কোন কাজ করতে হত না। তাকে কিছু চাইতেও হত না যেখানে, চট করে সময় মত সবকিছু হাজির হত। তার কাজ ছিল কেবল ক্রমাগত সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠের উষ্ণ তরলে ঘুরপাক খাওয়া।

সে অনুভব করে, তার মুখ - শরীর - সমস্তটাই ইষদোষ্ণ তরলে ভেজা। তবে কি তার জন্ম হয় নি এখনও? সে কি তার মায়ের পেটে? এখানে বসেই সে তার অনাগত জন্মের মুহূর্তের পর কি কি হবে, তার স্বপ্ন দেখছে? সে কি প্রবলভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে মায়ের পেটের তরলে? সে কি ঘুরছে? সে কি প্রবল একটা টান অনুভব করছে কোথাও? নাড়ি ছেঁড়া একটা টান? তার কি এখনই জন্ম হবে? এত আলো কোথা থেকে আসছে হঠাৎ? এত আলো?

আস্তে আস্তে পুরো অবয়বটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার সামনে। সুডৌল স্তনদুটি তার সামনে, তার প্রিয় মাতৃস্তন, তার মাতৃদুগ্ধ, কিন্তু সে স্তনের বোঁটা তো তার মুখে নেই! তবে কি সে তার মায়ের দুধ খাচ্ছে না? তবে...

প্রকারান্তে প্রায় উন্মুক্ত হয়ে ঝুলে থাকা স্তনদুটি আংশিক আবৃত - কালো অন্তর্বাসে এবং বড় গলার কামিজের আড়ালে। চোখের ঘোলা ঘোলা ভাব কেটে যাবার পর এখন সে স্পষ্টতই দেখতে পায়, ফুলতোলা নকশাকাটা একটা কামিজের ওপর সাদা এপ্রন জড়িয়ে কেউ খুব যত্নে তার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। যে কাজটি করছে, সে কি নারী না পুরুষ - তা নিয়ে বিভ্রান্ত হবার কোন সুযোগ তার প্রায় উন্মুক্ত হয়ে ঝুলে থাকা বিশালাকৃতির স্তনদ্বয় দিচ্ছে না। সাথে সাথে সে এখন এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে - এই ভদ্রমহিলা তার মা না আর সেও তার শিশু নয়, এবং বয়সের দিক থেকেও সে শিশু নয়। এটা সে নিশ্চিত হতে পারে ভদ্রমহিলার হাত নাড়ানোর ফলে স্তনযুগলের অল্প অল্প দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে তার তলপেটে এক অতি পরিচিত তোলপাড়ের মাধ্যমে। কিন্তু তার গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে যে দুধের মত তরল - সেটা কার? অথবা, সেটা কি?

- "হুমায়ূনের কি অবস্থা এখন রেবা? আর মুখ মোছার আগে পেশেন্টের মুখ থেকে খাবারের নলটাতো সরিয়ে নাও!"

একটা কণ্ঠ অদূরেই শোনা যায়। হাসপাতালের আইসিইউর বেডে শুয়ে থাকা পেশেন্ট হুমায়ূনের কয়েকটি ধাঁধাঁ সমাধা হয়ে যায় একই সঙ্গে। প্রথমত, তার নাম হুমায়ূন। দ্বিতীয়ত, সে এখন হাসপাতালে (কিন্তু কেন, বা কিভাবে সে এখানে - সেটা সে এখনও নিশ্চিত নয়)। তৃতীয়ত, সে দুধ খাচ্ছে না, নল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তার শরীরে প্রবেশ করছে তরল কিছু (কিন্তু এটা কি খাবার, না স্যালাইন না ঔষধ - তা সে নিশ্চিত নয় যদিও। স্বাদ নেই কোন)। এইরূপ অনেকগুলি বিষয় নিশ্চিত হবার পর সে এইভাবে এই হসপিটালে পড়ে আছে কেন, তার কি হয়েছিল, সে কিছু বোধ করছে না কেন, তার শরীর আর কখনো বোধশক্তি ফিরে পাবে কিনা - ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক এবং অতীব জরুরী বিষয়াদি নিয়ে মাথা ঘামান শুরু করছে করবে - এমতাবস্থায় তীব্র আলোর ঝলকানিতে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। সেই আলোই বা আসে কোথা থেকে? দূর থেকে আস্তে আস্তে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে থাকে সূচালো একটি আওয়াজ। তার তীক্ষ্ণতা বাড়তে থাকে ক্রমাগত। ছোটবেলায় মসজিদের ইমাম সাহেব রুকুতে বা সিজদায় গেলে কখনো কখনো মসজিদের সস্তা দরে কেনা মাইকে সমস্যার কারণে তীব্রস্বরে ক্যাঁ করে একটা ভোঁতা আওয়াজ কানের পর্দা প্রায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত হানত প্রায়ই। লক্ষাধিক মাছি একসাথে গুণগুণ করে ওঠার সে আওয়াজের যন্ত্রণায় নামাজে স্রষ্টার দিদার লাভ তো অনেক দূরের কথা - নিজের প্রাণটি নিয়ে নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হতে পারবে কিনা - সে বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়ে যেত। শৈশবের সেই ভয়াল আওয়াজ আরও লক্ষগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আইসিইউতে নিস্পন্দ শুয়ে থাকা হুমায়ূনের মস্তিস্ক ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে থাকে। শৈশবের একটা পর্যায় পর্যন্ত মাইগ্রেনের ব্যাথা ছিল প্রবল। কল্পনায় ভরপুর শৈশবে মাইগ্রেনের ব্যাথাকে মনে হত তার কপাল, নাক কানের আগ পর্যন্ত অংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুচকুচে কালো এক তরল পদার্থের মত। ব্যাথা কমানোর উদ্দেশ্যে অন্ধকার ঘরে বালিশের নীচে মাথা লুকিয়ে ছটফট করতে থাকা হুমায়ুনের মন চাইত একটা সিরিঞ্জের সূঁচ কপালের মাঝ বরাবর ঢুকিয়ে প্রচণ্ড টানে কালো তরলরূপি সমস্ত মাথাব্যাথার জীবাণু বের করে আনতে। আজকে ঠিক কত দিন পর - তা আর মনে নেই, কিন্তু সেই ইচ্ছেটাই ঘুরেফিরে আবারো হুমায়ূনের মাঝে ফিরে আসে। মন চায় মাথার ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেখানে সদ্য গড়ে ওঠা মৌমাছির চাকটা খুলে বের করে এনে প্রচণ্ড জোরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে। অবর্ণনীয় কষ্টে সে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। প্রচণ্ড ব্যাথা, যেন দুটো বুলডোজারের মত করে করোটির দুপাশে চাপ দিতে থাকে হুমায়ূনের মস্তিস্ক চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার অভিপ্রায়ে। মালাকুল মউত বুকের অপর চেপে বসেছে, আর বেশী সময় নেই। হুমায়ূন তার বুকের ওপর অস্পষ্ট ধোঁয়াশার মত আজরাইল ফেরেশতার অবয়ব দেখতে পায়।

ঠিক এমন সময় হুমায়ূন টের পায় তার গালে কোমল একটি হাতের স্পর্শ। এ কার হাত? একি সেই নারী?

- "জলদি এই ইঞ্জেকশানটা পুশ করো রেবা। পেশেন্টের হার্টবিটের রেট খুব অস্থিরভাবে ফ্লাকচুয়েট করছে। ইট উইল কাম হিম ডাউন।"

রেবা নামের নার্সের হাতের স্পর্শেই যেন হুমায়ূন বোধ করে তার মাথা ব্যাথা দ্রুত প্রশমিত হচ্ছে। নার্স রেবা একটু ঝুঁকে হুমায়ূনের দিকে সরে আসে। জানালা থেকে আলো রেবার মুখে প্রতিফলিত হয়। প্রথমবারের মত হুমায়ূন নার্স রেবার চেহারা দেখতে পায় এবং সাথে সাথেই, আজ হতে অনেকগুলো বছর আগের এক বিকেলের স্মৃতি।

হুমায়ূনের মনে পড়ে সেই বিকেল বেলার কথা যেদিন তাদের এসএসসির রেজাল্ট দেয়া হয়েছিল মান্দারিবাজার ইশকুলের মাঠে। দপ্তরী, অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটে হেঁটে ইশকুলের মাঠের দক্ষিণপাশে যে শহিদ মিনার, তার সামনে রাখা ব্ল্যাকবোর্ডে টাঙ্গিয়ে দিয়ে আবার গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল ইশকুলের ভেতরে। শ' দেড়েক ছেলেপেলের সাথে কুস্তি করে এঁটে ওঠার মত ক্যান্ডিডেট রোগাপ্যাংলা হুমায়ূন ছিল না। তাই, প্রায় সবার রেজাল্ট দেখা শেষ হবার পর দুরুদুরু বুকে বোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সাদাকাগজের গুড়িগুড়ি হরফে লেখা তাদের দশ বছরের আমলনামায় চোখ বোলানো শুরু করে। সেই আকুল দৃষ্টির পেছনে ছিল বাবার মৃত্যুর পর মা এবং তিনবোনকে নিয়ে হাঁসফাঁস করে চালানো সংসারের পাহাড়সম চাপ। এই রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে নির্ভর করছিল হুমায়ূন আর পড়াশোনা করবে নাকি এখনই একটা চাকরী জোটানোর ফিকিরে নামবে এরকম একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত। হুমায়ূন, ঐ ভঙ্গুর বোর্ডে টাঙ্গানো রেজাল্ট শিটের দিকে তাকিয়েছিল খুব আশা নিয়ে। কারন পড়াশোনা করতে - কোন এক আজগুবি কারণে, অনেকটা গরীবের ঘোড়ারোগের মতই, হুমায়ূন বিষম ভালোবাসতো। কেন, তা সে নিজেও জানতো না। এমন নয় যে সে খুব মেধাবী ছিল। বরং পাছার ওপর অংকের শিক্ষক কাশীনাথ স্যারের জালি বেতের বাড়ি এড়াতে বহুবার তাকে স্কুলের পেছনের বাঁশঝাড়ে গিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তবুও, মান্দারিবাজারের একটু ভেতরে দরিদ্র মানুষের যে জনপদ, তার ওপর দিয়ে অজগর সাপের মত আঁকাবাঁকা পথের পেট চীরে বুকে বইখাতা বুকে চেপে ধরে হেঁটে যাবার মধ্যে অচেনা এক গর্ববোধ করতো হতদরিদ্র হুমায়ূন।এসএসসির রেজাল্ট শিটে নিজের নামের পাশে বোল্ড হরফে লেখা ফেইল দেখে হুমায়ুনের মনে হয়েছিল - হতে হতেও হল না। তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন যেন হাতের মুঠো ফসকে বেরিয়ে গেল।

সাদা অ্যাপ্রন পরিহিতা এই নার্সকে দেখে তার দশ বছর আগের সেই অনুভূতিটাই আবার স্পষ্ট হয়। তার মনে হয়, এত ঘনিষ্ঠ হয়ে তার পাশে বসে থাকা এই নারীর সাথে তার হতে হতেও হবে না। এসএসসির রেজাল্টের আগে দুঃসম্পর্কের এক মামার রেফারেন্সে ঢাকায় এসে একটা পত্রিকা অফিসের টাইপিস্ট হিসেবে চাকরী নেবার আগে, পাওয়ার খুব কাছাকাছি এসেও হারানোর যে বেদনা সে অনুভব করেছিল, সেটাই আবার ফিরে আসে নার্স রেবার মুখের দিকে চেয়ে। প্রবল মাথা ব্যাথা প্রশমিত করার জন্যে, কিংবা ডাক্তারের ভাষ্যমতে তার হার্টবিট কামডাউন করানোর জন্যে এখনই তাকে ইঞ্জেকশন পুশ করা হচ্ছে বা হবে। যদিও এখনো তার জানা নেই সে কেন এই হাসপাতালের বেডে চিতপটাং, কেন সে হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছে না। তার উচিৎ মনে প্রাণে এখন আল্লাহতা'লাকে ডাকা, তার সাহায্য চাওয়া, ঠিক তখনি কেন যে প্রথম কৈশোরের সাঁঝবেলার মত এক বিষণ্ণ বাউরি বাতাস তার মনকে দোলা দিয়ে যায় এবং সে সূত্র ধরেই বিষণ্ণতা অযাচিত অতিথির মত এসে তার মনে আসন দখল করে বসে - এই চিন্তা থেকে যে , এই নার্স রেবা মেয়েটি, যে এতো কোমলতার সাথে তার যত্ন নিচ্ছে, এমন একটি মেয়ের সাথে একবার দেখা হয়ে যাবে এই আশায় সে তেজতুরিবাজারে তার মেসের জানালা দিয়ে কতগুলো সকাল এবং সন্ধ্যা নিস্পলক পার করেছে , তা রেবাকে কখনোই হয়তো জানানো হবে না। হুমায়ূন কাব্য করতে শেখেনি। শিখলে হয়তো বলতো - হুমায়ূনদের জীবনে স্বপ্নগুলো আকৃতিতে পানির মত। আকারবিহীন, আবার ধরতে গেলে মুঠো গলে পড়ে যায়।

হুমায়ূনের চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসে।

২।

- "এই পেশেন্ট আদৌ সারবে? কি মনে হয়?"
- "স্যার তো বললেন উনি খুব দ্রুত উন্নতি করছে"
- "কোমার পেশেন্ট এর আগে আমি কখনো দেখি নি জানিস"
- "আমিও না"
- "অদ্ভুত না কেমন যেন?"
-"হ্যাঁ, এনি তো আবার সারাক্ষণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন, তারপরেও নাকি কিছু হুঁশ নেই ওনার।"
- "আমার অবশ্য দেখে কি মনে হয় জানিস, আমার কেন যেন মনে হয় - উনি সবই দেখছেন, শুনছেন, বুঝতে পারছেন।"
- "ওঁর চোখের দিকে তাকালে আমারও তাই মনে হয়। চোখে জ্যোতি আছে কিনা জানি না - কিন্তু কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে, চোখ দু'টায় যেন প্রাণ আছে।"
- " কিন্তু আজ প্রায় চার দিন হয়ে গেল এ এই কেবিনে, তার আগে যখন জখমগুলো খুব বেশী ছিল - তিন দিন ছিল আইসিইউ তে। এই হাসপাতালের যে খরচ, এর তো ভিটে মাটি বেচার বন্দোবস্ত করতে হবে। খরচ দেবে কোত্থেকে?"
- "বেচারার খবর জানিস না তুই? অনেক বড়লোক একজনের গাড়ির নীচে চাপা পড়েছিল বা ধাক্কা খেয়েছিল এমন কিছু। সেই ভদ্রলোক নিজের গাড়িতে করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে ডাইরেক্ট।"
- "উনিই সব খরচ বহন করছেন?"
- "এমনটাই তো শুনলাম। পরে অবশ্য ডক্টর স্যাররা এও বলাবলি করছিল যে পেশেন্ট নাকি কোন পত্রিকা অফিসে চাকরী করে। সেই ভয় থেকেও এই যত্নআত্তি হতে পারে। তবুও, এমন ভাগ্যই বা কয়জনের হয়।"
- "সে নাহয় ঠিক আছে, কিন্তু একটা কথা বল তো রেবা, এই এক প্যাশেন্টের বেডের পাশে তোকে সারাক্ষণ সেঁটে লেগে থাকতে দেখা যায় - তার কারণটা কি? এমন তো না যে তুই এখানে নতুন, এর আগে কোন পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করিস নাই, বা তোর জানা নেই কতটুকু কি করতে হয়।"
- "কারন একটা আছে, কিন্তু সেটা তোকে বলা যাবে না।"
কিছুক্ষণ সময় নীরব থেকে রেবা নিজেই বলে ওঠে
- "আচ্ছা এখন ওনাকে আবার খাবার আর ঔষধ দেবার সময় হয়েছে, তুই তোর কেবিনে যা।"
- " হ্যাঁ, যাই। আজ আমার নাইট ডিউটি নেই আর। রাততো কেবল বারোটা বাজে, বেরিয়ে যাবো কিছুক্ষণের মধ্যেই।"
- "আচ্ছা, যা"
এই বলে রেবা হুমায়ূনের প্রায় খালি হয়ে আসা সেলাইন বদলায়। একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বের করে তাতে ঔষধ নিতে নিতে ঘুরে দাঁড়ায়
- "আচ্ছা, আজকে গোটা ওয়ার্ড এত খালি খালি লাগছে কেন বলতে পারিস?"
- "গতকাল থেকেই তো এই ওয়ার্ড পুরো খালি, পেশেন্ট নেই একজনও"
- "খালি আমার কেবিন ছাড়া?"
- "খালি তোর কেবিন ছাড়া।"
- "ঠিক আছে।"

অনেক দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজের মত করেই হুমায়ূনের কানে শব্দগুলি ভেসে আসে। তার মনে হয়, আস্তে আস্তে সে তার শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে। বহু চেষ্টার পর তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে সে একটু সাড়া পেয়েছে অথবা পায় নি এমন সময় রেবার সাথে অন্য নার্সটির কথোপকথনের ঐ অংশটি, যেখানে রেবা স্বীকার করে যে বিশেষ কোন কারণে সে হুমায়ূনের টেক কেয়ার খুব যত্নসহ করে, সেটা তার কানে আসার পরই হুমায়ূন আর কিছু করার কোন তাড়না ভেতর থেকে অনুভব করছে না। সে এখন ভাবছে রেবাকে নিয়ে।

অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরই এখন হুমায়ূনের জানা। সে এখানে কেন এবং কিভাবে এখানে এসেছে, তাও সে জানে। সবচে বড় স্বস্তি তাকে দিয়েছে - যার গাড়ির নীচে সে চাপা পড়েছিল উক্ত বড়লোকই তার সমস্ত চিকিৎসাভার বহন করবে এটা জেনে। ভদ্রলোক, হুমায়ূনকে আই সি ইউ থেকে সাধারণ কেবিনে স্থানান্তর করার পর একদিন এসেছিলেন হুমায়ূনের অবস্থা দেখতে। আজ সকালেও হুমায়ূনের পত্রিকা অফিসের সম্পাদকসহ আরও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন আগে থেকেই। তাদের উপস্থিতিতেই ঐ ভদ্রলোককে হয়তো উদ্বুদ্ধ করে পুনরায় ঘোষণাটি দিতে -

- " প্রয়োজনে এই পেশেন্টকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার পয়সাতেই পুরো খরচ বহন করা হবে ওর চিকিৎসার।"

কাজেই এখন হুমায়ূন জানে যে তার অন্তত টাকা পয়সার চিন্তা নেই। এখানে তার চিকিৎসা শেষ হওয়া মাত্রই তাকে মুক্তি দেয়া হবে। সে হেঁটে হেঁটে ফিরে যেতে পারবে নিজ বাসভবনে। তাকে কেউ আটকে রাখবে না। হসপিটাল থেকে ছাড়ের আগে অযথা বিশাল অঙ্কের টাকা চেয়ে কেউ তার ডিসচার্জ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এখন, হুমায়ূন এও জানে যে এই রেবা নামের নার্স মেয়েটি কোন এক অদ্ভুত কারণে তার কেবিনে থাকতে ভালোবাসে, তার যত্নআত্মি করে অনেক।

এই তিনদিনে হুমায়ূনের রেবার প্রতি দরদ উঠলে উঠেছে মারাত্মক। যারা পৃথিবীতে না চাইতেই সবকিছু পায়, তাদের ভেতরেও খবিস কিসিমের মানুষের অভাব নেই। সে দিক বিবেচনায় হুমায়ূন তো নিতান্তই কোনমতে টেনেটুনে পেট চালিয়ে যাওয়া এক মানুষ। রাস্তাঘাটে, পথে প্রান্তরে, লোকাল বাসের তীব্র ঠেলাঠেলিতে যে সে দু' দশবার আড়চোখে মেয়েদের শরীরে বদনজর দেয় নি তা নয়, কিন্তু সেটা কখনোই হাঁ করে চেহারা গেলার মত করে না, কারো গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা তো দূরে থাক। এমনটাও নয় যে সে কাজটা করতে পারলে পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করতো না, কিন্তু ধরা পড়ে গেলে যে কি মারটা খেতে হবে - এই ভয়েই কখনো সে লাইনচ্যুত হয় নি। কিন্তু আজ সে এই অসুস্থ শরীরে স্বীকার করে, তারা একজনও রেবার মত নয়। জন্মের পর থেকে অসংখ্য নারীর মুখ সে দেখেছে। তাদের কারো মুখই রেবার মুখের মত মায়ায় ভরা নয়। কি অদ্ভুত যত্নই না নিতে পারে এ মেয়েটি তার! কি পরম মমতায় আর ভালোবাসায়! এ ক' দিনে
তাই কেবল একটি কথাই তার মনে ঘুরপাক খেয়েছে -এই মেয়েটিকে ভালোবাসা যায়। সে এই মেয়েটিকে ভালবাসতে পারে। কি খাওয়াবে, কি পরাবে, কই নিয়ে রাখবে - এই চিন্তার বাইরে গিয়ে, এই সব পার্থিব দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে এই মেয়েটাকে সে ভালবাসতে পারে। তার জীবনের অভিজ্ঞতা সীমিত, তার পরিচিত মানুষের গণ্ডি খুব বড় নয়, সবার সাথে সে মিশতে পারে নি - কিন্তু তার সে সীমিত অভিজ্ঞতাই তাকে শিখিয়েছে যে একজন পুরুষের পক্ষে শরীরের প্রয়োজনে এমনকি সম্পূর্ণ অচেনা এক নারীর সামনেও কাপড় খুলে নিজেকে নগ্ন করে মেলে ধরা যত সহজ, নিজের মনকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে খুব চেনা এক নারীর সামনেও মেলে ধরা ততটা সহজ নয়। হাজারো ভীতি, হাজারো আশংকা, হাজারবার হারিয়ে ফেলার ভয় প্রেমের তাড়নায় পাগল একজন পুরুষকে ক্রমাগত কুরে কুরে খায়। তা সে পুরুষ প্রেসিডেন্ট হোক কিংবা রাস্তার ভিখারি, ধার্মিক হোক কিংবা অধার্মিক - ভালবাসলে হারানোর ভয় কাজ করবেই। কিন্তু রেবার মুখ দেখেছে হুমায়ূন। এই মুখ মিথ্যে বলে না! পাপের কোন চিহ্ন নেই এই মুখে। এই তো, এই তো - তার পাশে এসে বসলো রেবা। কি পরম মমতায় মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে তার! কপালে রাখছে হাত! নিজের আত্মার আত্মীয়ের বিপদে যেমন শঙ্কিত হয়ে থাকে মানুষের মুখ, ঠিক সেরকম উদ্বিগ্নতা সারা মুখে ছড়িয়ে তার পাশে বসে আছে এখন রেবা! হাত নিজ থেকে ওপরে তোলার ক্ষমতা এখনও অর্জন করে নি হুমায়ূন। শীঘ্রই সে ক্ষমতা ফিরে পাবে। সে জানে। তার মন বলছে। মন সুখবর আগে থেকেই দিতে পারে। মনের সে ক্ষমতা আছে। নিজের হাতের অপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ফিরে পাবার পর প্রথমেই হুমায়ূন দুই হাত উপরে তুলে ধরে আল্লাতা'লার শুকরিয়া আদায় করবে। এরপরেই, সেই হাত উঠিয়েই সে দোয়া করবে আল্লাতা'লার কাছে যাতে সে রেবাকে পায়। যেন রেবা তার হয়। দোয়া শেষ হলে সে রেবার কাছে গিয়ে রেবাকে বলবে যে তার অভাবের সংসার। সংসার ঠিক বলা চলে না, কারন তার পরিবারে এখন আর কেউ নেই। কেউই বেঁচে নেই। সে রেবাকে বলবে সে চায় এই অভাবের মধ্যেই এক দারুণ সংসার পেতে বসতে, রেবাকে নিয়ে। তার আর রেবার মিলিত উপার্জনে বেশ ভালো করেই চলে যাবে তাদের দিনগুলি। তার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট তাকে ফেলে দিয়েছিল হতাশার চরম গহ্বরে। তার সাথে রেবার মুখ মেলানোই হয়েছে চরম গাধামো। হয়তো তার অশিক্ষার ফসল। রেবা কখনোই এমনটা করবে না। রেবা এরকম নয়।

এভাবে কতক্ষন চলে হুমায়ূন জানে না। ঘুমঘুম একটা ভাব তাকে প্রায় কব্জা করে নিয়েছিল এমন সময় তার কেবিনের দরজা মৃদুভাবে খোলার একটা আওয়াজ হুমায়ূনের কানে এসে লাগে। রেবা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।

- " সুইট নার্স! আমার পেশেন্টের কি অবস্থা?"

দরজা খুলে প্রবেশ করে যে, তার গলা শোনা যায়। হুমায়ূন চিনতে পারে, এ সেই ভদ্রলোক যার গাড়ির সাথে সে ধাক্কা খেয়েছিল। যার বদান্যতায় সে আজ এই আলিশান ফাইভ স্টার হোটেলের মত হাসপাতালে।

- "স্যার, আপনার মত কেউ যখন কারো মাথার উপর হাত রাখে, তার আর খারাপ থাকার উপায় আছে?"

রেবার রসমালাইয়ের মত ভেজা মিষ্টি গলা হুমায়ূনের কানে আসে। বড় বিবেচক মেয়ে রেবা। কি ঠিক কথাটাই না বলেছে সে! কি দয়ার শরীর এই স্যারের! হুমায়ূনের মত লোকজন রাস্তাঘাটে পোকামাকড়ের মত অহরহ মরে। কে কার খবর নেয়? উনি তার খবর নিতে এত রাতে চলে এসেছেন হাসপাতালে? হুমায়ূন ঠিক করে তার আর রেবার বিয়ে ঠিক হলে সে অবশ্যই এই ফেরেশতার মত লোকটিকে দাওয়াত করবে। উনার আশীর্বাদ ছাড়া হুমায়ূন আর রেবার বিয়ে হতেই পারে না। সম্ভব হলে অনুরধ করবে তাকে রেবার উকিল বাপ হতে। রাজি হবেন না উনি? অবশ্যই হবেন! উনার যে দয়ার শরীর!

- "বুদ্ধিমান মেয়ে তুমি। কি যেন নাম তোমার?"
- "রেবা! আমার নাম রেবা, স্যার"
-" হ্যাঁ, রেবা। তোমার মত এত সুন্দর মেয়ে এই হাসপাতালে কি করে? এই ঘাটের মরাগুলির সেবা করে জীবন নষ্ট করার কি আছে? ঘেন্না হয় না তোমার?"

কথাটায় হুমায়ূনের আঁতে খানিকটা ঘা লাগতো, যদি হুমায়ূনের আঁত বলে কিছু থাকতো তবে। কিন্তু তখনও তার অন্তর এই লোকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু। হুমায়ূনের মনে হয়, ভদ্রলোক সত্য কথাই বলছেন। রেবার মত মেয়ের তার মত আধমরা মানুষের যত্নআত্তির জন্ম হয় নি। তাই তো সে রেবাকে বিয়ে করে এই পেশা থেকে বের করিয়ে আনতে চায়। কিছুক্ষণ আগে তার আর রেবার মিলিত উপার্জন দিয়ে সংসার চালানোর ইচ্ছা থেকে সরে আসে সে। রেবাকে সে ঘরেই রাখবে, আর পূজা করবে। টাকা উপার্জনের ঝক্কি ঝামেলার মধ্যে সে রেবাকে পড়তে দেবে না আর।

-"তোমার চাকরীর একটা বন্দোবস্ত আমার অফিসে করতে পারি। কাজ তেমন কিছুই না, আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের মত। কাগজপত্র এগিয়ে দেয়া, চা কফি বানিয়ে দেয়া। বদলে এখানে যা পাও তার তিনগুন বেতন পাবে। চলবে?"

হুমায়ূন খুব সতর্কভাবে রেবার উত্তরের অপেক্ষা করে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে রেবার মুখ। দুঃচ্ছাই! ঘাড়টা এখনও নড়াতে পারছে না সে! ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ শোনা যায় কেবল, কিন্তু কোন উত্তর রেবার মুখে শোনা যায় না।

কিছুক্ষণ পর, অথবা অনেকগুলো মুহূর্ত পেরিয়ে তরল হাসির শব্দ বহুদূর থেকে ভেসে এসে হুমায়ূনের কানে ধাক্কা দেয়। মৃদু ধস্তাধস্তির আওয়াজও যেন সে শুনতে পায়। হাসির মধ্যেই যেন সে শুনতে পায়, তার পরিচিত এক নারী কণ্ঠ বলে চলেছে -
- "ছেড়ে দেন স্যার, ছেড়ে দেন - কি করছেন!"
এই বলে আবার হাসির দমকে ভেসে পড়া!
- "এখন আমি খুব হাইথটের একটা কথা বলবো রেবা, আমি জানি যদিও তুমি সেটা হয়তো বুঝবে না, তবুও বলবো। তোমার ফিগার দেখে ঠিক এই মুহূর্তে এটা আমার মাথায় এলো।"
- "স্যার, কেউ এসে দেখে ফেললে আমার চাকরী চলে যাবে!"
- "আরে! কে কি দেখবে? আমি এসেছি পেশেন্ট দেখতে! কে আমাকে কি বলবে? এরকম হসপিটাল দশটা কেনার সাধ্য আছে আমার! দেখি আসো, কোলে এসে বস আমার!"
- "স্যার..."
- "এই ব্রা আবিষ্কার হয়েছে কেন জানো? এটা আবিষ্কার হয়েছে নারী শরীরের এক পরম সৌন্দর্যকে রহস্যাবৃত করে রাখার জন্যে। মানুষের মন রহস্য পছন্দ করে। আরও দেখতে চায়। যা কিছু সৌন্দর্য আর চোখের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে রাখে তার সব কিছু ছিঁড়ে ফেলে চায় আরও দেখতে, দেখতে যে কি আছে কাপড়ের ঐ পাড়ে! এত যত্ন করে ঢেকে রাখার দরকারটা কি!"

হুমায়ূনের কানে কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ আর রেবার অস্ফুট কাতরানোর আওয়াজ ভেসে আসে।

- "স্যার, অন্তত পেশেন্টকে অন্তত রাতের ইনজেকশনটা দিয়ে নিই। জেগে থাকলে ঘুমিয়ে যাবে।"
- "আরে রাখো! ও শালা ঘাটের মরা কোমার রোগী। না কিছু দেখছে, না কিছু শুনছে! মনে করো এই রুমে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউই নেই।"

বেশ জোরেই ক্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাচ করে একটা শব্দ হয় হুমায়ূনের বেডের পাশে রাখা একটা বেডে। কিছুক্ষণ মৃদু ধস্তাধস্তির শব্দ ভেসে আসার পর একটা ছন্দবদ্ধ ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ ক্রমাগত হুমায়ূনের কানে এসে ধাক্কা মারে। হুমায়ূন প্রাণপনে চোখ-কান সহ তার সমস্ত ইন্দ্রীয়গত অনুভূতি বন্ধ করার চেষ্টা করে। মুখ দিয়ে তার আওয়াজ বেরয় না, কিন্ত তার অন্তরআত্মা চিৎকার করতে থাকে - আল্লাহ! আমারে কালা করে দাও আল্লাহ, আমারে কানা করে দাও! আমি যেন কিছু শুনতে না পাই, আমি যেন কিছু দেখতে না পাই! এই আওয়াজ যেন আমার কানে আর না আসে!

ক্রুদ্ধ কান্নার মিশেলে একটা চিৎকার রাত দেড়টা বাজে উক্ত হাসপাতালের নিস্তব্ধ ওয়ার্ডের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছুঁড়ে ফেলে গুলশানের রাস্তায় -

- "ঐ খাঙ্কির পোলা! আঁই তো মরিই যাইতেছিলাম, তোরা আঁরে বাঁচাইলি কিল্লাই!

(গল্পটি উৎসর্গ করলাম দু'জন প্রিয় ব্লগার প্রফেসর শঙ্কু এবং জাহাঙ্গীর আলমকে। যদিও এতে তাদের কিছুই আসে যায় না। তারা নিজের গুণে অনন্য মানুষ। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সামুতে ব্লগিং করি আমি। প্রফেসর শঙ্কু ছিলেন এই সময়ে আমার দেখা সামু ব্লগের সবচে শক্তিশালী গল্পকার। জাহাঙ্গীর আলম ভাই লিখতেন খুবই কম, কিন্তু তার মন্তব্যে বোঝা যেত তার জ্ঞানের পরিধি ও পঠনের গভীরতা। খুব উপভোগ করতাম কমেন্ট সেকশানে তাদের সাথে বিশাল বিশাল কমেন্টের থ্রুতে মতামতের আদান প্রদান। হুমায়ূন আহমেদ বলেন - "সেই দিন আর নাইরে দাদা, আমিও গাধা তুমিও গাধা"। হুমায়ূন আহমেদের কথাকে সত্যি প্রমাণ করে আমাদের গাধা বানিয়েই তারা অন্তরালে চলে গেলেন, পৃথিবীর আর সব রহস্যাবৃত চরিত্রের মতই। বিশেষ করে প্রফেসর শঙ্কুর কথা আবারও বলবো। তিনি বাংলাদেশের লেখক ছিলেন না কলকাতার লেখক ছিলেন, জানার উপায় নেই। অন্তত আমি জানি না। কিন্তু তার মত শক্তিমান লেখকের লেখা কখনো পত্রিকায় ছাপার হরফে পড়তে পেলাম না কেন, জানি না। অদ্ভুত রহস্যময় এক পৃথিবীতে বসবাস আমাদের।
সমসাময়িক ব্লগারদের মধ্যে যাদের এই দুই গুণী ব্লগারের লেখার সাথে পরিচয় নেই তাদের উদ্দেশ্যে তাদের ব্লগ লিঙ্ক শেয়ার করা হল।

প্রফেসর শঙ্কু - Click This Link

জাহাঙ্গীর আলম - Click This Link )
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:০১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×