চোখ ঝলসানো সোনালী রোদের দুপুরে ক্লান্তি বিনাশে খানিকটা বিশ্রাম নেয় গণি শেখ। আম গাছের শোভন ছায়াতে আসন্ন বিদায়ী চৈত্রের উষ্ণ বাতাসের দাপট কিঞ্চিৎ কম মনে হলো তার। গামছায় গতর খাটানো ঘাম মুছে ফসলের মাঠের দিকে তাকালো। পর্যাপ্ত জলের অভাবে চৌচির মাঠের বিদীর্ণ নিঃশ্বাস জাগিয়ে তুলে তার বুকের গভীরে চিতার দহন। ধানের কচি লিকলিকে আগাজুড়ে অপুষ্টির অসুখ। বৃষ্টি দরকার । ঝমঝম বৃষ্টি ছাড়া এই মুহূর্তে তার আর কিছু চাওয়ার নেই। গণি শেখ জানে বৃষ্টির মালিক আল্লাহ্। তাঁর মর্জি ছাড়া বৃষ্টি কীভাবে হবে ? সে মনে মনে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির আবেদন জানালেও সাধারণ অভিজ্ঞতায় বুঝেছে যে, বিনামেঘে বৃষ্টি হবে না। ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টি ফিরালে প্রচন্ড নীলাকাশ তাকে হতাশ করে।
গণি শেখের মনে পড়ল, সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ দৌড়ে এসে তার হাত চেপে ধরে সাত বছরের রেশমা বায়না ধরেছিল, এক শিশি আলতার। দু’দিন পর বৈশাখি মেলা। আলতায় পা রাঙিয়ে রেশমা মেলায় যাবে। আহা, এখন থেকে মেয়েটির কী যে আনন্দ উচ্ছ্বাস ! এ পর্যন্ত গণি শেখ মেয়েটির কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি। মাটি হতে দেয়নি মেয়েটির কচিমুখের আনন্দ।
গণি শেখ ঘরে ফিরে হরিচরণের মুদির দোকান থেকে কেনা আলতার শিশি লুকিয়ে রাখল রেশমার অগোচরে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই রেশমাকে আলতার শিশিটি দেবে না। মেয়েটি মনখারাপ করলে করুক। হুজুরের কথা তো আর ফেলনা নয়। আসার পথে শফি হুজুরের কথা কয়টি এখনো তার কানে প্রতিধ্বনি তুলছে। হুজুর বলেছে, ‘মাইয়ালোকের শরীরে রঙ মাখা হারাম। তোমরা বাপ-বেটি দোজখের আগুনে জ্বলবা’।
রেশমা আলতা না পেয়ে মুখভার করে বসে আছে জলচৌকির উপর। বাপের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে সে। গণি শেখ দেখে এই দূরত্বের মাঝখানে কেবল জমাটবদ্ধ অভিমান আর অভিমান। মেয়ের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতর কালবৈশাখি যেন মোচড় দিয়ে উঠে। তারপরও সে গোপনে চেপে রাখে ভেতরের তোলপাড়। মায়ের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও রেশমা রাতে খাবার খেল না। তার মা স্বামীর উপর উষ্মা প্রকাশ করে। বলল, ‘হাতি-ঘোড়া চাই নাই মাইয়া। এক শিশি আলতা চাইছে, তাও ভুইল্যা গেলা ! কেমুন বাপ তুমি’ ? গণি শেখ নির্লিপ্ত হয়ে থাকে। স্ত্রীর কথার কোনো জবাব দেয় না। বুঝতে পারে সিদ্ধান্তহীনতার কষ্ট অনেক বড়। সে মেয়ের কাছে এসে বলল, ‘ভাত খাইয়া ল, সকালে আইন্যা দিমু’। রেশমা জলার্দ্র চোখ নিয়ে তাকাল। বলল, ‘হাঁচা’ !
সকালে ঘমু থেকে উঠে মাঠে গেল না গণি শেখ। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সারারাত হুজুরের বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভেতর। সামান্য আলতার জন্যে দোজখের আগুনে পোড়ার কোনো অর্থ হয় না। এক প্রকার অন্তর্গত দ্বন্দ্বে পার করে দিয়েছে রাত। কিন্তু সকালে সম্পূর্ণ বদলে গেলো সে। মেয়ের হাতে আলতার শিশি দিয়ে বলল, ‘তোর যত মন চায় আলতা লাগা’।
আলতার শিশি হাতে নিয়ে রেশমার কচিমনের সুনির্মল হাসি তাকে ভুলিয়ে দিল হুজুরের বলা কথাগুলো। রেশমা ঘরের দাওয়ায় বসে পায়ে আলতা লাগাতে মনোযোগ দিল। গণি শেখ তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। তার মনে ভেসে উঠে কাল সকালে আলতা রাঙা পা ফেলে ফেলে মেলায় যাচ্ছে রেশমা। আলতার রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে পথের গাছপালা, ফসলের মাঠ। গণি শেখ দেখতে পায় গ্রীষ্মের চৌচির প্রান্তরে নেমে এসেছে আলতার মতো লাল লাল বৃষ্টি।