somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেল্টিক এবং নর্স পুরাণে কাক

০৩ রা এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৮:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেল্টিক এবং নর্স পুরাণে পশুপাখির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যায়। সেল্টিকরা এদেরকে যথেষ্ট সম্মান ও পবিত্রজ্ঞান করতো। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান এবং সৃষ্টির সাথে একত্রে বসবাসকে তারা মনে করতো এর একটি পবিত্র তাৎপর্য আছে। ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে, এমন কি শিল্পসাহিত্যে, জাদু ও ধর্মবিশ্বাসে পশুপাখি তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।

সেল্টিক বিশ্বে বহু শতাব্দী ধরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এবং ভাইকিংদের প্রভাব রয়েছে যা আজও স্পষ্ট। সেল্টিক ভূখন্ডে ভাইকিং আক্রমণ শুরু হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে। বর্তমান ছয়টি সেল্টিক জাতির সকলেই ভাইকিং আক্রমণের প্রভাব অনুভব করেছিল। ভাইকিংরা আসার সময় নিয়ে এসেছিল তাদের কিংবদন্তি, ঐতিহ্য, পৌরাণিক কল্পকাহিনী, যার প্রভাব দেখা যায় সেল্টিকদের সাহিত্যে, লোককথায় এবং ধর্মপুরাণে। সেল্টসের মতোই পশুপাখি নর্সের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাদের বিশ্বাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছিল। কাক প্র্রজাতির পাখির উপর ছিল সেল্টস ও নর্সদের অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস।

কাক গোত্রীয় পক্ষীদের বৈজ্ঞানিক নাম কর্ভিডে (Corvidae))। এদের মধ্যে ১২০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। দাঁড়কাক, পাতিকাক, রক, চৌগ, জ্যাকডো এবং ম্যাগপাই এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সেল্টিক পুরাণে দাঁড়কাকের পালক নিয়ে আছে অনেক কিংবদন্তি। এই বৃহৎ পাখিটির দেহ কালো পালকের স্তবকে ঢাকা থাকে, এটি ভক্ষণ করে মৃত পচা গলিত মাংস এবং কর্কশ স্বরের জন্য বিরক্তির উদ্রেক করে। এটিকে দু:খ-দুর্দশা, পাপ ও মৃত্যু শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখা হয়। এটিকে আবার শক্তির উৎস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। পৃথিবী ব্যাপী জীবিত ও মৃতদের সংবাদবাহক হিসেবেও দেখা হয়। দাঁড়কাক যুদ্ধের ময়দানে ওড়ে বেড়াচ্ছে, পতিতদের লাশের উপর ঝাঁপিয়ে বসতে প্রস্তুত, সেল্টিক যোদ্ধাদের কাছে এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তাই হয়ত তারা দাঁড়কাকের উপর দেবত্ব শক্তি আরোপ করেছিল।

আইরিশ পৌরাণিক টেইন বা কেইলেঞ্জের গল্প থেকে যুদ্ধের দেবী ব্যাডব এর কথা জানা যায়। এটি ছিল আইরিশদের ‘The Ulster Cycle’–এর মূল গল্প। ব্যাডব একটি দাঁড়কাকের ছদ্মবেশ ধারণ করে আলস্টার এবং কিংবদন্তি নায়ক চু চুলাইনের সাথে রানী ম্যাডব এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আবার এটাও বলা হয় যে মরিগ্যান (অভিশপ্ত বালিকা) একটি দাঁড়কাকের আকৃতি নিয়ে, মৃত্যুর সময় চু চুলাইনের কাঁধে বসেছিল।

ওয়েলশ পৌরাণিক কাহিনীতে বেন্ডিজিডফ্র্যান চরিত্রটির উল্লেখ আছে। এটি আরো উল্লেখ পাওয়া যায় মধ্যযুগিয় পুঁথির লোককাহিনীতে। বেন্ডিজিডফ্র্যান বা ব্র্যান ফেন্ডিগেইড চরিত্রটি ছিল মেবিনোবির দ্বিতীয় দাঁড়কাকের গল্প। সেখানে রোয়ানবির স্বপ্নে দাঁড়কাকটি দেখা দিয়েছিল। চৌদ্দ শতকে লিখিত ল্লিফার কোচ হার্জেস্ট এর রেড বুকে গল্পটির উল্লেখ আছে। এই গল্পটির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে পভিসের রাজপুত্র ম্যাডোগ এপ ম্যারেডুড এর সময়ে, যিনি ১১৬০ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। রোয়ানবি তার স্বপ্নের এই গল্পটি রাজা আর্থারকে বলেছিল। সে স্বপ্নে দেখেছিল আর্থারিয়ান কিংবদন্তি ওয়েন ম্যাব উরিয়েন এবং রাজা আর্থার দাবা খেলছেন। এই সময়ে আর্থারের কিছু কর্মচারী ওয়েনের দাঁড়কাকগুলোকে আঘাত করছিল। ওয়েন এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করার জন্য রাজা আর্থারকে অনুরোধ করছিল। কিন্তু আর্থার ওয়েনের অনুরোধ গ্রাহ্য করলো না। শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ওয়েনের দাঁড়কাকগুলো আর্থারের অনেক কর্মচারীকে হত্যা করেছিল।


কর্নিশ লোককাহিনীতে বলা হয় যে রাজা আর্থার মারা যাননি, তবে তাঁর আত্মা একটি লাল চঞ্চুওয়ালা কাকের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। পাখির লাল পা ও লাল চঞ্চু যুদ্ধের শেষের দিকে অত্যধিক সহিংসতার কারণ বলে মনে করা হতো। এই পাখিটির সাথে একটি সাংস্কৃতিক সংযোগও রয়েছে। খেলার সময় পাখিটি বাহুর উপর প্রদর্শিত হয়। এই পাখিটিকে হত্যা করা খুব দুর্ভাগ্য মনে করা হতো।



নর্স পৌরাণিক কাহিনীতে কাক একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কখনো কখনো ওডিনকে কাকের দেবতা মনে করা হত। তের শতকে রচিত পুরাতন নর্স কবিতার সংকলন ’এড্ডা’-তে হুগিন ও মুনিন নামে দেবতা ওডিনের দুটি কাকের কথা উল্লেখ আছে। এই দুটি পাখি সারা পৃথিবী ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে ওডিনের কাছে প্রেরণ করতো। গেরি ও ফ্রেকি নামে ওডিনের দুটি নেকড়ের কথাও জানা যায়, যারা তার পায়ের ধারে বসে থাকত, আর কাক দুটি বসত তার কাঁধে। Isle of Man বা মান্নিন এ (আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যবর্তী দ্বীপ,রাজধানী-ডগলাস) রয়েছে প্রচুর পরিমানে খোদায় করা সেল্টিক পাথরের ক্রস। এগুলোতে রয়েছে বহু সেল্টিক নকশা ও চিত্র। এসব পুরানো শিলালিপিকে বলা হয় ’ওঘাম’। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু নর্স পৌত্তলিক পৌরাণিক চিত্র এবং রুনিক লিপিও আছে। এগুলোর মধ্যে থোরওয়াল্ডস ক্রস শিলাটি দশম শতাব্দির। সেটিতে দেবতা ওডিনের কাঁধে একটি কাক বসে আছে সেরকম চিত্র রয়েছে। এটিতে আরো দেখা যায় ’ফেনরির’ নামে একটি নেকড়ে দেবতা ওডিনকে কামড় দিতে। এটিকে ওডিন ও নর্সদের অন্যান্য দেবতাদের বিপদের ভবিষ্যৎ বাণী হিসেবে দেখা হয়।

নর্স পুরাণে ভ্যালকিরির গল্পগুলোতেও কাকের উপস্থিতি দেখা যায়। কারা যুদ্ধে বেঁচে থাকবে এবং কারা মৃত্যুবরণ করবে কাক এমন নারীদের বাছাই করতো। এদের মধ্য থেকে কাক কয়েকজনকে বেছে নিত আইসিরের দেবতাদের বাড়ি অ্যাসগার্ডের ভালহল্লায় (নিহতদের হল) যাওয়ার জন্য। র‌্যাগনারকের আসন্ন যুদ্ধে দেবতা ওডিনকে সাহায্য করার জন্য তারা তৈরি হতো। মনে করা হতো এই যুদ্ধে পুরাতন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং নতুন পৃথিবী জন্ম নেবে। ‘Hrafnsmal’ নামে নবম শতাব্দির একটি কবিতায় ভ্যালকিরি ও কাকের মধ্যে বৈঠকের বর্ণনা আছে। তারা নরওয়ের প্রথম রাজা হ্যারাল্ড ফেয়ারহেয়ার এর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন।

ভাইকিংদের কাছে কাকের গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। তারা প্রায় বিভিন্ন চিত্রে কাকের ছবি ব্যবহার করতো। দীর্ঘজীবীর প্রতীক হিসেবে তারা বর্মে, হ্যালমেটে, শিল্ডে, ব্যানারে কাকের চিত্র অংকিত করতো। সন্দেহ নেই যে এটি ওডিনের শক্তি প্রকাশের জন্য করা হতো এবং তারা শত্রুর কাছে হারবে না, যুদ্ধে টিকে থাকবে। অর্কনির নর্স জার্লস নেতাদের মতো নর্স-গেইল নেতারাও কাকের ছবি ব্যবহার করতেন। আজো স্কটল্যান্ডের শেল্টল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বার্ষিক ভাইকিং ‘আপ-হেলি-আ’ উৎসবে কাকের ছবি ব্যবহার করে।

কাককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে সেল্টিক এবং নর্স পৌরাণিক কিংবদন্তি। কিন্তু সেল্টস ও নর্স লোককাহিনীতে আরো অনেক পাখির ভূমিকা দেখা যায়, তবে সেগুলোর পৌরাণিক গুরুত্ব নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৮:১৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×