ফটো- বৈতরণী নদী
বৈতরণী ----
হিন্দুশাস্ত্র মতে জগত তিনটি । স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল । তাদের স্বর্গ ঊর্ধ্বলোকে অবস্থিত । স্বর্গের সংখ্যা সাতটি । মর্তলোকের নিম্নদিকে অধোলোক বা পাতাল । যাকে বলা হয় নরক । নরকের সংখ্যাও সাত কিংবা আটাশ। আরো অধিক সংখ্যক নরকের কথাও জানা যায় । পাপ-পুণ্যের তারতম্য অনুসারে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন স্বর্গ-নরকে নিপতিত হবে । এক মত অনুযায়ী ত্রিজগত ধ্বংস হবে না, ধ্বংস হবে কেবল প্রাণীজগত । অপর মতে, মহাবিশ্ব ধ্বংস ও পুনঃসৃষ্টি হবে । স্বর্গগমন কারো পক্ষে সহজ হবে না । প্রত্যেক ব্যক্তিকে পার হতে হবে বৈতরণী নামক একটি নদী । এ নদী কুমির, রক্ত-মাংস ও হাড়গোড়ে পরিপূর্ণ । এর জল দুর্গন্ধময় এবং অগ্নিবৎ গরম ।ওড়িষ্যায় বৈতরণী নামে একটি নদী আছে। সেটি একালের নদী।
ফটো- বুক অব ডেথ থেকে প্রাপ্ত পরকালের বিচারের দৃশ্য
ভয়ঙ্কর দরজা-----
প্রাচীন মিসরীয়দের ‘মৃতদের বই’ থেকে জানা যায়, মৃত্যুর পর প্রত্যেক মিসরবাসীকে শেষ বিচারের মুখোমুখি হতে হবে । সেখানে তাদের হৃদয়কে একটি নিক্তির উপর রাখা হবে এবং দেবী মাতের একটি পালক দিয়ে ওজন করা হবে । যে পালকটি সত্য, ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা নীতির প্রতীক । কারো আত্মার ওজন যদি পালকের চেয়ে হাল্কা হয়, তাকে পাপের সাথে যুক্ত করা হবে এবং পরকালে নিক্ষিপ্ত হবে । কেউ যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, সে সত্যের কন্ঠস্বর বলে বিবেচিত হবে এবং সুখি ও শ্বাশত জীবনে গমন করবে । এমন কি তাদের বিশ্বাস ছিল প্রতিটি আত্মাকে পরকালে যাওয়ার পূর্বে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দরজাগুলো পাড়ি দিতে হবে । প্রত্যেকটি দরজা একজন ভিন্ন ভিন্ন দেবীর সাথে যুক্ত আছে। আত্মাকে সেই বিশেষ বিশেষ দেবীকে চিনতে হবে । কিছু আত্মা দেবীদের চিনতে সক্ষম হবে আর যেসব আত্মা ব্যর্থ হবে তাদের একটা অগ্নির হ্রদে (দোজখ) নিক্ষেপ করা হবে । সেখানে তারা তীব্র দৈহিক যন্ত্রনায় ভুগবে ।
চিনাভাদ পুল -----
প্রাচীন ইরানীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পর শাস্তি ও পুরস্কার আছে । মৃত্যুর পর মানবদেহ দানবে অধিকার করে নেবে । সে সময়ে আত্মা অজ্ঞান অবস্থায় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকে । তৃতীয় দিবসে আত্মার পুনঃ জ্ঞান সঞ্চার হয় । সেই রাতে আত্মাকে ভয়ঙ্কর চিনাভাদ নামক সেতু পার হতে হবে । যে ব্যক্তি চিরজীবন ধর্মানুষ্ঠান ও সৎকাজ করেছে, সে অনায়াসে সেতু পার হতে পারবে । তাদেরকে যাজদগণ (স্বর্গদূত) সঙ্গে করে চিরশান্তিময় বেহেস্তে নিয়ে যাবে । সেখানে তারা প্রভু অহুর মজদার সাথে মিলিত হবে এবং স্বর্ণসিংহাসনে সমাসীন হয়ে ‘হুরান-ই বেহিস্ত’ (ইসলামের হুর) নামের পরিগনের সহবাসে সর্বপ্রকার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে । যে সব পাপী চিনাভাদ পুল পার হতে পারবে না, তারা দোজখ নামক অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবে । সেখানে তারা অশেষ দুঃখ-কষ্ট ও নরকযন্ত্রণা ভোগ করবে । কোন পাপী কতদিন শাস্তি ভোগ করবে তা অহুর মজদা নির্ধারণ করে দেন ।
ফটো- স্টিক্স নদী
স্টিক্স নদী------
গ্রীক মিথোলজি অনুসারে, মৃতব্যক্তির আত্মা গমন করে পাতালপুরীর উদ্দেশ্যে। দেবতা হেডস ও তার স্ত্রী পার্সিফোন হচ্ছেন পাতালপুরীর রাজা। হেডস হলেন গ্রীকদের আত্মার দেবতা। জিউসের পুত্র হার্মিসের দায়িত্ব হচ্ছে মৃতব্যক্তির আত্মাকে পাতালপুরীর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া। কেউ যাতে পথ হারিয়ে না ফেলে সেই জন্য দরকার হতো গাইডের। আর হার্মিস গাইডের দায়িত্ব পালন করতেন। পাতালপুরীকে ঘিরে রেখেছিল 'অ্যাকাইরন', 'ককেটাস', 'ফ্লেগেথন', 'লেথ' ও 'স্টিক্স' নামে পাঁচটি নদী। সবাইকে স্টিক্স নদী পার হয়ে পাতালপুরীতে প্রবেশ করতে হতো। এই নদী হলো জীবন ও মৃত্যুর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। নৌকার মাঝির নাম ছিল 'কারো’। নদী পারাপারের জন্য দিতে হতো ভাড়া। মৃত ব্যক্তির ঠোঁটের উপর একটি কয়েন রেখে দিয়ে সেই ভাড়া পরিশোধ করা হতো। কেউ যদি অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হতো, তাহলে পৃথিবী ও পাতালপুরীর মধ্যবর্তী এক স্থানে শোচনীয় অবস্থায় দিন কাঠাতে হতো।
নদী পার হলে দেখা মিলতো 'সেরবেরাস' নামক তিন মাথাওয়ালা এক কুকুরের। সেরবেরেসকে অতিক্রম করে ভেতরে ডুকে উপস্থিত হতে হতো তিনজন বিচারকের সামনে। এরা হলেন হ্যাডামেন্থাস, মিনোস ও ঈকাস। এই বিচারকদের কাছে জীবদ্দশায় মৃত ব্যক্তির আত্মা যা যা করেছে তা বর্ণনা করতো। তার কাজকর্মের উপর ভিত্তি করে তিন রকমের ফলাফল আসতো।
১) অধিকাংশ আত্মাকে পাঠানো হতো ধূসর বর্ণের অ্যাসফোডেল প্রান্তরে। সেখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতো তারা।
২) এলিসিয়াম নামক স্বর্গে থাকতো বীর ও ভালো মানুষগণ।
৩) পাপাত্মাদের পাঠানো হতো তার্তারুসের গর্তে। পাতালপুরীর একেবারে নিচে ছিল এর অবস্থান। অন্ধকার ও মেঘাচ্ছন্ন সেই জায়গায় অনেকরকম শাস্তির মধ্য দিয়ে যেতে হতো তাদের। মাঝে মাঝে সেখানে ঝড় উঠতো। একজন আত্মাকে উঠিয়ে নিলে পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত সে আর মাটির দেখা পেত না।
সূত্রবৎ সূক্ষ্ম সেতু ------
ইহুদীদের ধর্মমতে শেষ বিচারের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই সেতুর উপর দিয়ে গমন করতে হবে । এই সেতুর নিচে থাকবে দোজখ । পাপীদের পক্ষে সেতু পার হওয়া সম্ভব হবে না । তারা দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে । মানুষের পাপ-পুণ্য দুটি গ্রন্থে(আমলনামা) লিপিবব্ধ থাকবে । শেষ বিচারের দিন পাল্লার দুই পাশে রেখে তা ওজন করা হবে । পাপের ভার অধিক হলে তাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে এবং পুণ্যের ভার বেশি হলে স্বর্গ লাভ করবে । খৃষ্টান ধর্মেও ইহুদী মত অনুসরণ করা হয়েছে ।
ফটো- পুলসিরাত
আল সিরাত বা পুলসিরাত---
ইসলামে দোজখ সাতটি, জান্নাত আটটি । প্রত্যেক ব্যক্তিকে জান্নাত গমনের পূর্বে আল সিরাত সেতু পার হতে হবে । সেতুর বর্ণনায় বলা হয়েছে, এটি চুল অপেক্ষা সূক্ষ্ম এবং তরবারি অপেক্ষা তীক্ষ্ণ ধারসম্পন্ন । সেতুর নিচে থাকবে অগ্নিময় দোজখ । পুণ্যবানগণ নিমেষে সেতু পার হয়ে জান্নাতে গমন করবে আর পাপীগণ সেতু পার হতে পারবে না, তারা দোজখে পতিত হবে । জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরের ঊর্ধ্বভাগে আল্লাহর আসন থাকবে ।
ছবি- গুগল