somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্র-পুরাণ ও সাহিত্যে

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবীতে প্রাণীজগৎ বেঁচে ও টিকে থাকার জন্য জল অপরিহার্য। জলের প্রধান উৎস সমুদ্র। পৃথিবীর মোট আয়তনের তিন ভাগ জুড়ে রয়েছে জলের অবস্থান। ৫টি মহাসাগর ও ৬৬টি সাগর-উপসাগরে বিভক্ত এই বিস্তীর্ণ জলরাশি, যার মোট আয়তন ৩৬১,০০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এই অথৈ জলের জগৎ এবং সময়ে সময়ে এর বিরূপ আচরণ সঙ্গত কারণেই আদিম মানুষদের মনে ভয় ও বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল। সমুদ্র ছিল তাদের কাছে মহাপরাক্রম এক অজেয় সত্তা।

সমুদ্র যেমন ছিল আদিম মানুষদের জীবিকার উৎস, তেমনি এর রুদ্রমূর্তি, প্লাবন ও মানুষকে ডুবিয়ে মারার কারণে তারা মনে করেছিল সমুদ্রের আড়ালে রয়েছে এক অদৃশ্য সত্তা। সুতরাং তারা সমুদ্রের উপর আরোপ করেছিল দেবত্ব এবং সমুদ্রকে বশে রাখার জন্য চালু করেছিল সমুদ্র পুজোর। তাই পৃথিবীর কোন কোন জাতির কাছে সমুদ্র দেবতা, আবার কোন কোন জাতির কাছে দেবী।

গ্রীক পুরাণে সমুদ্র দেবতার নাম পসেইডন। রোমানদের কাছে তিনি নেপচুন। টাইটান সাগর দেবতা ওশানের নাতনী অ্যাম্ফিট্রাইট হলেন পসেইডনের স্ত্রী। গভীর সমুদ্রের তলদেশে ছিল পসেইডনের রাজপ্রাসাদ। গ্রীক নাবিকরা সমুদ্রযাত্রার পূর্বে নির্বিগ্ন যাত্রা কামনা করে পসেইডনের কাছে প্রার্থনা করত এবং অশ্ব উৎসর্গ করত। প্যাপিরাস লিপি থেকে জানা যায় অ্যালেকজান্ডার সম্রাট তৃতীয় দারিউসের বিরুদ্ধে আইসাসের যুদ্ধের আগে দেবতা পসেইডনকে শান্ত করার জন্য সমুদ্রে চার ঘোড়া টানা রথ বলি দিয়েছিলেন। দেবী আফ্রোদিতির জন্ম হয়েছিল সমুদ্রের ফেনা থেকে। প্রথম দিকে গ্রীকরা আফ্রোদিতিকে সমুদ্রের দেবী হিসেবেই পুজো করতো।

মেসোপটেমীয় পুরাণে আছে সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর সমস্ত ভূ-ভাগ ছিল সমুদ্রের নিচে। দেবতারা পানি থেকে মাটি বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে অসুর বাঁধা দিয়েছিল। এতে প্রধান দেবতার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ হয় এবং অসুরকে হত্যা করে দু-টুকরো করা হয়। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের মাওয়ারী জাতির লোকজন বিশ্বাস করত তাঙ্গালোয়া ছিলেন সমুদ্রের অধিপতি। তিনি হলেন জলদেবতা। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে বিষ্ণু বা নারায়ণ কল্পের সাগরে শেষনাগের অনন্ত শয্যায় শায়িত ছিলেন। একবার দেবতা ও দৈত্যরা মিলে সমুদ্র মন্থন করলে সেই মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে ওঠে আসেন।

শুধু ধর্ম-পুরাণে নয়, সমুদ্র জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্যেও। সমুদ্রকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে প্রচুর গল্প-উপন্যাস-কবিতা-গান। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও আমরা সমুদ্রকে পাই। চাঁদ সওদাগরের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দেবী মনসা তার ছয় পুত্রকে হত্যা করেছিল এবং সাতটি বাণিজ্য জাহাজ সমুদ্রের ডুবিয়ে দিয়েছিল। বাকী পুত্র লখিন্দরের গল্প তো আমাদের সবার জানা আছে।

আর্ন্সট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উপন্যাস 'দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী' রচিত হয়েছে গভীর সমুদ্রে মাছে শিকারের কাহিনীকে কেন্দ্র করে। সান্তিয়াগো একজন বুড়ো জেলে। সে গভীর সমুদ্রে এক বিরাট আকৃতির মার্লিন মাছ শিকার করে। কিন্তু মাছটি এত বড় ছিল যে সমুদ্রের পানি থেকে একে টেনে তোলা সম্ভব হচ্ছিল না। তিন দিন ধরে মাছ আর মানুষের সংগ্রাম চলল সমুদ্রের বুকে। এই তিন দিনের কথাই উপন্যাসের আখ্যানভাগ।

বঙ্কিমের 'কপাল কুন্ডলা' উপন্যাসের নায়ক নবকুমার গঙ্গা ও বঙ্গপোসাগরের মোহনায় তীর্থ ভ্রমণ শেষ গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় কুয়াশায় নৌকা দিকভ্রান্ত হয়ে সমুদ্রতীরে উপস্থিত হয়। এই সমুদ্রতীরেই কাপালিকের পালিতা কন্যা কপাল কুন্ডলার সাথে তার দেখা হয়। বঙ্কিম এখানে সমুদ্র সঙ্গমের এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। নবকুমারকে নির্জন তীরে একাকী সমুদ্র সঙ্গমে দেখতে পেয়ে কপাল কুন্ডলা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে- 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ '?

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সমুদ্রের স্বাদ' গল্পটি অসাধারণ সৃষ্টি। গল্পের নায়িকা নীলা বাবার মুখে শুনেছিল পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্থল। আমাদের চারপাশ বেষ্টন করে আছে সমুদ্র এবং দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্র থেকে আসে শরীর জুড়ানো বাতাস, বৃষ্টির জন্য মেঘ, এমন কি আমাদের খাবার নুনটাও আসে সমুদ্রের জল থেকে। এসব শুনে নীলার মধ্যে জেগে ওঠেছিল সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসা। সমুদ্র দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখত। বাবা তাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে, এমন কথা দিলেও হঠাৎ তার মৃত্যুতে নীলার আর সমুদ্র দেখা হয়ে ওঠেনি। ছুরি দিয়া পেন্সিল কাটতে, বটি দিয়ে তরকারী কুটতে, কোন কিছু দিয়ে টিনের মুখ খুলতে, নিজের অথবা ভাইদের আঙুল কেটে গেলে প্রচলিত চিকিৎসা অনুসারে নীলা কাটাস্থানে মুখ দিয়ে চুষতে আরম্ভ করে। তাই রক্তের স্বাদ তার জানা আছে। শেষ পর্যন্ত নীলা চোখের জলে অনুভব করে সমুদ্রের স্বাদ অনেকটা রক্তের মতো নোনা।

'শ্রীকান্ত' ২য় পর্বে শরৎচন্দ্রের জাহাজে চড়ে বার্মা ভ্রমণের বর্ণনা পাওয়া যায়। গভীর সমুদ্রে তাঁর জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। দুর্জয় ঝড়ের শক্তি ও বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপ তিনি অনুভব করেছিলেন সমগ্র চেতনা দিয়ে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন এইভাবে-
''হঠাৎ মনে হইল, জাহাজের গায়ে কালো জল যেন ভিতরের ধাক্কায় বজ্‌বজ্‌ করিয়া ক্রমাগত উপরের দিকে ঠেলিয়া উঠিতেছে। দূরে চোখ পড়িয়া গেল-দৃষ্টি আর ফিরাইতে পারিলাম না। একবার মনে হইল এ বুঝি পাহাড়, কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভ্রম যখন ভাঙ্গিল তখন হাত জোড় করিয়া বলিলাম, ভগবান! এই চোখ -দুটি যেন তুমিই দিয়াছিলে, আজ তুমিই তাহাদের সার্থক করিলে। এতদিন ধরিয়া ত সংসারে সর্বত্র চোখ মেলিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু তোমার এই সৃষ্টির তুলনা ত কখনও দেখিতে পাই নাই। যতদূর দৃষ্টি যায়, এই যে অচিন্ত্যনীয় বিরাটকায় মহাতরঙ্গ মাথায় রজতশুভ্র কিরীট পড়িয়া দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে, এত বড় বিস্ময় জগতে আর আছে কি!''

মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ কাব্য' পাঠেও আমাদের সাথে সমুদ্রের সাক্ষাৎ ঘটে যায়। এই কাব্যের প্রথম সর্গের অংশবিশেষ সঙ্কলক-সম্পাদকরা নামকরণ করেছেন 'সমুদ্রের প্রতি রাবণ' কবিতাটির। এই কবিতায় সমুদ্রের প্রতি রাবণের চরম ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যায়। দূতের মুখে প্রিয় পুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ শুনে বিচলিত রাবণ পুত্রের শব দেখার জন্য প্রাসাদ শিখরে ওঠেন। রণক্ষেত্রে পুত্রের শব দেখে রাবণ ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তার দৃষ্টি পড়ে নিকটবর্তী সমুদ্রের প্রতি। রামের হাতে শৃঙ্খলিত সমুদ্র দেখে ও রামের প্রতি সমুদ্রের বশ্যতা স্বীকারে ক্ষুদ্ধ ও ব্যথিত হৃদয়ে রাবণ সমুদ্রের প্রতি ব্যাঙ্গোক্তি করেন। লঙ্কার প্রতি সমুদ্রের বৈরী আচরণের কারণে রাম লঙ্কায় আসতে পেরেছে, আর পতন ঘটতে যাচ্ছে লঙ্কার। তাই রাবণ সমুদ্রকে ধিক্কার দিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হওয়ার আহবান জানাচ্ছেন।

''এরূপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস-ঈশ্বর
রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর-মকরালয়। মেঘশ্রেণী যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে। দুই পাশে তরঙ্গ-নিচয়,
ফেনাময়, ফণাময় যথা ফনিবর,
উথলিছে নিরন্তর গভীর নির্ঘোষে।''

রবীন্দ্রনাথের সমুদ্রযাত্রা মোটেও সুখকর ছিল না। জাহাজে যে কয়টা দিন অতিবাহিত করেছিলেন, তাকে তিনি বলেছেন 'ব্যামো' কিংবা 'সমুদ্রপীড়া'। মশার কামড়ের ভয়ে ছয়টা দিন তিনি শয্যা থেকে ওঠেন নি। ছোট এক অন্ধকার ঘরে তাঁকে থাকতে হয়েছিল। সমুদ্রের জল প্রবেশের ভয়ে জানালাগুলোও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকত। একবার রাতে তিনি জাহাজের ডেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন আকাশে মেঘ ছিল। বাতাস বয়ে আসছিল বিপরীত দিক থেকে। যে দিকে তাকান সেদিকেই অন্ধকার, কেবল সমুদ্র ফুলে ফুলে ওঠছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'সে এক মহা গম্ভীর দৃশ্য'। এ তো গেল রবীন্দ্রনাথের সমুদ্রযাত্রার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আবার কবিতায় তিনি সমুদ্র ও মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। সোনার তরী কাব্যের 'সমুদ্রের প্রতি' কবিতায় তিনি সমুদ্রের সাথে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। ঝড়ে পুরীর তীর্থযাত্রীদের জাহাজ ডুবে যাওয়ার সংবাদ শুনে তিনি রচনা করেন 'সিন্ধুতরঙ্গ' কবিতাটি। এই কবিতায় সমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী রুদ্রমূর্তির সামনে অসহায় নর-নারীর আর্তনাদের সঙ্গে তিনি সৃষ্টি করেছেন গভীর দার্শনিক তত্ত্ব। কবিতার প্রারম্ভেই তিনি সমুদ্রকে বিভিন্ন রূপে উপস্থাপন করেছেন। কখনও সমুদ্রকে কল্পনা করেছেন 'দৈত্য' রূপে, কখনও 'সহস্র ফণাযুক্ত সর্প' রূপে, কখনও বলেছেন 'তীক্ষ্ণ শ্বেত রুদ্র হাসি', 'মত্ত দৈত্যগণ', 'জড়-প্রকৃতির', 'উম্মাদ', 'নীলাম্বুধি অন্ধকার' ইত্যাদি।

'' আকাশ সমুদ্র-সাথে প্রচণ্ড মিলনে মাতে,
অখিলের আঁখিপাতে আবরি তিমির।
বিদ্যুৎ চমকে ত্রাসি, হা হা করে ফেনরাশি,
তীক্ষ্ণ শ্বেত রুদ্র হাসি জড়-প্রকৃতির।''

আর্যরা সিন্ধু ও তার মোহনার বিশালতা দেখে সিন্ধুকে সমুদ্র বলেছিলেন। কবিরাও সিন্ধুর মধ্যে খোঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃত সমুদ্রের উম্মত্ততা। নজরুলও 'সিন্ধু-হিন্দোল' কাব্যে 'সিন্ধু' কবিতার তিনটি তরঙ্গে তুলেছেন উত্তাল অস্থিরতার আলোড়ন। তাঁর ক্ষোভ-অসীম বেদনা-দ্রোহের ছন্দ এই তরঙ্গের সাথে একাকার হয়ে গেছে। 'সিন্ধু' কবিতার তরঙ্গে তরঙ্গে নজরুল চিত্ত একীভূত হয়ে যায়। তাই বিক্ষুদ্ধ জলরাশি সংকুল সিন্ধু হয়ে যায় কবির বন্ধু। কেননা সমুদ্র ও নজরুল চিত্ত দুই চিরঅশান্ত। তিনি সিন্ধুকে প্রশ্ন করেন-
''কথা কও, হে দুরন্ত, বলো
তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল ?
কিসের এ অশান্ত গর্জন ?''

'সিন্ধু' কবিতার দ্বিতীয় তরঙ্গে তিনি সিন্ধুকে দেখেছেন বিদ্রোহী ও ভুমিগ্রাসী হিসেবে। এর ভেতর প্রকৃত যে রূপটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেখানে দেখা যায় এক নিস্ফল আক্রোশের আস্ফালন।
''সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছে মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া
ধরণীরে তিলে তিলে!
হে অস্থির! স্থির নাহি হতে দিলে
পৃথিবীরে! ও গো নৃত্য-ভোলা,
ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা।''

'সিন্ধু' কবিতার তৃতীয় তরঙ্গে এসে সমুদ্রের সঙ্গে নজরুলের সখ্যভাব আর থাকে না। সমুদ্রের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কের জালটি তিনি বুনে দেন। এখানেও সমুদ্র চরম ভুবুক্ষ ও বিক্ষুদ্ধ। নজরুল বলেন-
''দুরন্ত গো মহাবাহু,
ওগো রাহু,
তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী!
সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী।''

ফররুখ আহমদের 'সাত সাগরের মাঝি' নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাব্যকর্ম। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী রেনেসাঁ সৃষ্টির জন্য এই কাব্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয়। এই কাব্যে 'সিন্দবাদ', 'বা'র দরিয়া', 'দরিয়ার শেষ রাত্রি', 'সাত সাগরের মাঝি' ও 'পাঞ্জেরী'কে ফররুখের সামুদ্রিক বিষয়ক কবিতা গুচ্ছ বলা যায়। এই কবিতাগুলোতে যেমন রয়েছে ইসলামী ঐতিহ্য ও জাগরণমূলক চেতনা, তেমনি রয়েছে সমুদ্র অভিযান বিষয়ক আবেদন। এখানে সমুদ্রই তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ। ভাবে, রূপকে, রোমান্টিক চিত্রকল্পে তিনি সমুদ্রকে তুলে এনেছেন কবিতায়।
''দোয়ারে তোমার সাত-সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না ? তবু তুমি জাগলে না ?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে তস্‌বির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।''

জীবনানন্দ মানসেও রয়েছে এক প্রবল সামুদ্রিক আকর্ষণ। ধূসর পাণ্ডুলিপির 'পাখিরা' কবিতায় দেখি বসন্তের রাতে বিছানায় শুয়ে থেকেও তিনি শুনতে পান সমুদ্রের স্বর। সাগর জলের বাতাসে তাঁর হৃদয়ও সুস্থ হয়ে যায়। তাই অনেক লবণ ঘেটে সমুদ্রেই তিনি পেয়ে যান মাটির ঘ্রাণ। কিন্তু 'বনলতা সেন' কবিতায় দেখি সমুদ্র তাঁকে আর শান্তি দিতে পারেনা। একটু শান্তির খোঁজে তিনি সিংহল সমুদ্র অর্থাৎ ভারত মহাসাগর থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত ঘুরেছেন। কেবল দেখেছেন তাঁর জীবনের চারদিকে সমুদ্রের ফেনার মতো হতাশা আর ক্লান্তি। তাঁর এই জীবন ব্যাপী দু-দণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন শুধুমাত্র বনলতা সেনের কাছে।

''হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।''

'সমুদ্র নিষাদ' কবিতাটি সোনালী কাবিন কাব্যের অন্তর্গত। এই কবিতায় আল মাহমুদের আত্মায় মিশে আছে সমুদ্র। 'নিষাদ' শব্দটির রয়েছে বহুমাত্রিক অর্থ। বর্তমান ধীবর বা জেলে সম্প্রদায় হল আদি নিষাদ গোত্রের লোক। সমুদ্র নির্ভর জীবন-জীবিকায় এরা বেঁচে থাকে। জলদস্যু রূপকের আড়ালে কবি ধীবর সম্প্রদায়ের কথাই ব্যক্ত করেছেন। কবিতাটি রোম্যান্টিক মেজাজের হলেও এতে ফোটে ওঠেছে সমুদ্র ও ধীবরের মধ্যে এক সুদৃঢ় বন্ধন। তাই প্রেমিকার সাথে ঘর বাঁধার ডাকে সাড়া না দিয়ে, বরং তাকেই সমুদ্রে নেমে আসার আহবান জানাতে দেখি।
''স্বপ্নের মতো মেয়েটিকে বলি শোনো,
ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নামবো গিয়ে অথৈ তলে,
কেন মিছিমিছি তটের বালুকা গোনো
নেমে এসো সাথে মাণিক কুড়াবো জলে।''

সমুদ্র-সন্তান মুহম্মদ নূরুল হুদার মানসজগতে সমুদ্র সর্বদা বহমান এক সত্তা। কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষায় সমুদ্রকে বলা হয় 'দইজ্জা',যার প্রমিত শব্দ 'দরিয়া'। নূরুল হুদা এই 'দরিয়া' শব্দেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই দরিয়া হল কক্সবাজারের উপকণ্ঠে বিস্তীর্ণ জলরাশির বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রজাত এই ভূখণ্ডকে তিনি দরিয়ানগর হিসেবেই দেখেন। 'দরিয়ানগর' কবিতায় তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য স্বীকারোক্তি আমাদের মুগ্ধ করে। তিনি বলেন-''এই মহাপৃথিবী আমারও ঘর। আমারও জন্মভূমি দরিয়ানগর।'' দরিয়ানগরে জন্ম বলে তাঁর হৃদয়ে রয়েছে সামুদ্রিক উদারতা। তারই প্রকাশ দেখি 'বরণকুলা' কবিতায়। এখানে তিনি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানান এভাবে- ''জগৎ অতিথি তুমি এসো এই ঘরে/পেতেছি বরণকুলা দরিয়ানগরে।'' তাঁর এই দরিয়া-প্রীতির একটি উৎকৃষ্ট সৃষ্টিকর্ম 'দরিয়ানগর কাব্য'। এই কাব্যে অত্র অঞ্চলের মানুষের সাথে দরিয়ার যে নিবিড় সম্পর্ক, তাই তিনি সুনিপুণ দক্ষতায় বিনির্মাণ করেছেন। বিশেষ করে 'দইজ্জার মানুষ', 'দরিয়ানগরের সফেন সন্তানেরা', 'দরিয়ানগরের উদয়পুরুষ', সমুদ্র সংস্কৃতি', 'সমুদ্রনিদান', 'দরিয়াশিশু','ঠিকফদ্দ','বরণকুলা' প্রভৃতি কবিতায় রয়েছে দরিয়া মনস্কতার সমুজ্জ্বল চেতনা। এই চেতনা তাঁকে পরিণত করেছে একজন খাঁটি দইজ্জার মানুষে। তাই তাঁর অভিলাষ এই দরিয়ানগরে যেন হাজার বছর বেঁচে থাকেন। কেননা এই দরিয়ার সাথেই তাঁর ঘরবসতি। দরিয়া জড়িয়ে আছে তাঁর সত্তা জুড়ে, তাই দরিয়ার উদ্দেশ্যে তাঁকে বলতে দেখি-
''অ দইজ্জা, ন যাইস দূরে, কাছে কাছে থাক
তর ফুয়ারে আরার বিয়া দিইয়ে আল্লা পাক।''

মানুষ ও সমুদ্র কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে। বিজ্ঞানীরা বলেন আদি সমুদ্রের তলদেশে প্রথম প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল। আর সমুদ্র ও মানুষের মধ্যে দেখা যায় এক আশ্চর্য আত্মিক সম্পর্ক। সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে মানুষ আজ সমুদ্র বিজয়ী। তাই মানুষ সমুদ্রকে ছাড়তে পারে না। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষকে সমুদ্রে ভাসাতে হয় জাহাজ। হয়ত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমুদ্রে কাটানো কোন নাবিকের হৃদয়ের আকুতিই ধ্বনিত হয়ে ওঠেছিল প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল জব্বারের কণ্ঠে---'ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া'।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:২১
৩টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×