করোনা ভাইরাস
পৃথিবী হচ্ছে সৃষ্টিশীল গ্রহ। বিশেষ করে প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী গ্রহ। প্রাণ সৃষ্টির জন্য যে কয়টি মৌলিক উপাদান দরকার তার সবকটি পৃথিবীতে বিদ্যমান। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ যেমন প্রাণী তেমনি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসও প্রাণ, যদিও এদের অণুজীব বলা যাবে কিনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। এসব ক্ষতিকর জীবাণু মানব দেহে প্রবেশ করে রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি করে। এমন কি অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু মানুষের জন্য ক্ষতিকারক তা নয়, পশুপাখির জন্যও এরা ক্ষতিকারক। তবে উপকারি ব্যাকটেরিয়াও আছে। যেমন দধিতে থাকে এমন ব্যাকটেরিয়া।
অনেক সময় এসব জীবাণু মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন মানবসমাজে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি একসময় প্লেগ নামক রোগটি পৃথিবীতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। প্লেগ হল ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। প্রায় ৩০০০ হাজার বছর পূর্বে এই রোগটির অস্তিত্ব প্রথম জানা যায়। প্লেগ ইঁদুর থেকে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত শিশু
প্লেগকে ভারতীয়রা বলত মহামারী। ভগবত গীতায় (১৫০০-৮০০ খৃষ্টপূর্ব) এর উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঐ ঘর তারা দ্রুত পরিত্যাগ করত যেখানে ইঁদুর মরে পড়ে থাকত। খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। মধ্য এশিয়া, ভারত ও চীনে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ১৬৬৪-৬৫ সাল পর্যন্ত প্লেগ লন্ডনে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে মাঝেমধ্যে এই রোগের আবির্ভাব হত।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে প্লেগ গুজরাট, কাথিওয়ার ও কুচ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে হায়দারাবাদ, আহমেদাবাদ ও ধলেরা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে রাজপুতনার পালি শহরে এবং পরে আজমীর-মারওয়াতে এই রোগের বিস্তৃতি ঘটে। এরপর বেশ কিছু বছর প্লেগের সংক্রমণ না ঘটলেও ১৮৪৯-৫০ এবং ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে আবার প্লেগ ভয়াবহ ভাবে দক্ষিণ ভারতে বিস্তার লাভ করে। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৮৯৬-১৯১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে প্লেগের কারণে মৃতের সংখ্যা ছিল ৯৩ লাখ ১৫ হাজার ৮ শত ৯২ জন। ঐতিহাসিকদের মতে, প্লেগ মহামারীতে সারা পৃথিবীতে ২০০ বছরে প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
কলেরা আর একটি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির নাম। ইউরোপীয়রা বলত এশিয় কলেরা। এটিও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। আক্রান্ত ব্যাক্তির মল থেকে এই রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটে। একসময় ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। তৎকালীন বঙ্গে এই রোগকে বলা হত ওলাওঠা। এই রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য হিন্দুরা ওলাইচণ্ডী দেবীর পূজা করত। মুসলমানদের কাছে এই দেবী ওলাবিবি নামে পরিচিত ছিল। ওলাইচণ্ডী হলেন হিন্দুদের লৌকিক দেবী। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে এই দেবী বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দের দিকে কলেরা পৃথিবীতে মহামারীর রূপ নেয়। এইসময়ে রাশিয়া ভারত ও চীনে প্রায় ৪ কোটি মানুষ মারা যায়। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই রোগের ভয়াবহতা ছিল মারাত্মক।
ওয়াল্ডিমার হাভকিন
রাশান বংশোদ্ভুত ইহুদী বিজ্ঞানী ওয়াল্ডিমার হাভকিন প্লেগ ও কলেরার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে মানবজাতিকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর নামে ডাক টিকেট ছাপিয়েছিল।
ম্যালেরিয়া, যক্ষা, গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, সার্স, এইডস, ইয়েলো ফিভার প্রভৃতি মরণঘাতী ব্যাধিতে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বে এই ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় তিন শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে চীনে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বৈশ্বিক জরুরী অবস্থাও ঘোষণা করেছে।
আগুনে ঝলসানো মৃত ক্যাঙ্গারু
আমি লেখাটা এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর ও ব্যাখ্যা খোঁজে পাচ্ছিলাম না। নেপাল ও জাপানের ফুকুশিমাতে যখন ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রচুর প্রাণহানী হয়েছিল, এক শ্রেণীর মানুষ আহ্লাদী হয়ে বলত এটি আল্লাহর গজব। অস্ট্রেলিয়ায় যখন দাবানলে বন থেকে বনান্তর পুড়ে ছাই হলো, ৫০-৬০ কোটি বন্য পশুপাখি আগুনে ঝলসে মারা গেল, তখনও তারা বলল, সেটি আল্লাহর গজব। এখন সেই গজব এসেছে নাকি চীনের উপর। করোনা ভাইরাসও আল্লাহর গজব।
১। প্রশ্ন- কোরআনে সুরা কাফিরুনের শানেনজুল হল (সংক্ষেপে) ''তোমার প্রভু তোমার, আমার প্রভু আমার। তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার''। কোরআনের এই বিধান মতে নেপালি ও জাপানীরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখে। তাহলে তাদের উপর গজব দেয়ার কারণ কি ?
২। প্রশ্ন- ইসলামে পশুপাখি ও বৃক্ষরাজির ঈমান আনার কথা বলা হয়নি। তাই এদের উপর কোন আরোপিত ধর্ম নেই। তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশুপাখি ও বৃক্ষরাজি কি পাপ করেছিল যে তাদের উপর অগ্নি গজব নাজিল করতে হয়েছে ?
৩। প্রশ্ন- দেখা যায় আল্লাহর গজবের রোষানলে পড়ে মায়ের কোলের শিশুরও মৃত্যু হয়। এই মাসুম শিশুরা কি পাপ করেছিল যে, তাদের উপর গজব দিতে হয়েছে ?
৪। প্রশ্ন- বলা হয়ে থাকে গজব, এসব রোগব্যাধি আল্লাহ্ পরীক্ষার নিমিত্তে দিয়ে থাকেন। তাহলে শিশু, পশুপাখি, বৃক্ষ-এদের পরীক্ষার মান কি ?
কেউ এটিকে নেচিবাচক হিসেবে দেখবেন না। প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নিশ্চয় অন্যায় কিছু নয়।