উত্তরের আকাশ থেকে হিমালয় ছুঁয়ে আসা হিমেল হাওয়ার ভেতর ঝোলে আছে ধূসর কুয়াশার চাদর। পৌষের শেষ যামিনী রাতভর দিয়ে গেছে শুষ্ক তৃষিত মাটিকে শীতার্থ ভালোবাসা। দূর্বাঘাস-বৃক্ষ-পুষ্প-পাতা শিশির-স্নানে সিক্ত হয়ে একটু রোদের প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। আদৌ কি সূর্যদেব জেগে ওঠবে আকাশে! হয়ত ওঠবে, হয়ত ওঠবে না। এই সম্ভাবনার দোলাচালে কনকনে শীতের শিশির ভোরে ক্যামেরা নিয়ে অবন্তী বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে।
অবন্তীর মনে হল আজ ঠান্ডার প্রকোপ অন্যদিনের চেয়ে বেশি। যদিও সে ফুলস্লিভ জ্যাকেট পড়েছে, কিন্তু শীত যেন তার শীতবস্ত্রকে পাত্তাই দিচ্ছে না। তবু সে শীতের কাছে পরাভব মানবে না। আজ সারাদিন হাওর-বাওর-বিলে-ঝিলে ঘুরে বেড়াবে। এই সময়ে সাইবেরিয়া, এন্টার্টিকাতে শীতের তীব্রতা ভয়ানক রূপ নেয়। প্রবল তুষারপাতে পাখিরা হয় আশ্রয়হীন। দেখা দেয় খাদ্য সঙ্কট। জীবন বাঁচাতে পাখিরা ঝাঁকবেঁধে ওড়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ দেশে। আমাদের দেশেও অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করেছে।
অবন্তী পাখি গবেষক। এখন পর্যন্ত সে তিন শত পাখির ছবি তোলেছে। অনেক তথ্য-উপাত্ত্য নোট করেছে। তবু তার মনে স্বস্তি নেই। সে মনে করে পৃথিবীতে দশ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে তার কাজ নিতান্ত অপ্রতুল। সাফল্যের সোনার হরিণ এখনও অনেক সুদূরে। তার নাগাল পেতে তাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে। পাখির পিছে ছুটতে ছুটতে এখন তার নিজেকেই বিহঙ্গ বিহঙ্গ মনে হয়। পাখিরা কতো মুক্ত। অবাধ স্বাধীনতায় তারা পেরিয়ে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। তাদের নেই কোন দেশের সীমারেখা। যেন পৃথিবীটাই তাদের দেশ।
অবন্তীর মনে পড়ে, গেল বছর এই সময়ে সে টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়েছিল। পূর্বেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিল টাঙ্গুয়ার হাওরে হরেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। সেবার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল সে। জার্নিটা মোটেও সুখকর ছিলনা। ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত গিয়েছিল ট্রেনে। শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি একটা জায়গায় ট্রেন আটকে ছিল দুই ঘণ্টা। যাত্রাপথে এরকম বিড়ম্বনায় আগে কখনও পড়েনি। সিলেট থেকে চেপেছিল সুনামগঞ্জের বাসে। তারপর কিছুটা পথ রিক্সাভ্যানে, আর কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছেছিল টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের অথৈ জলরাশির উপর রোদের সোনালী কিরণে রকমারি জলচর পাখির বিচরণ দেখে অবন্তী ভুলেছিল পথের ক্লান্তি।
জলের ওপর বসে থাকা একটি জলপিপি পাখির ছবি তোলার জন্য অবন্তী মাটিতে শুয়ে পজিশন নিল। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল তার শরীর ঘেঁসে একটি সাপ নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠল। তার হাত থেকে ক্যামেরা পড়ে গেল মাটিতে। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। তার কিছুদূরে এক বৃদ্ধ জেলে জাল ফেলে বসেছিল হাওরের চড়ায়। বৃদ্ধটি তরমুজের বীচির মতো দাঁত বের করে হেসে বলল-আপা ডরাইচুন নি, ইতা পানখ সাপ, বিষ নাই।
অবন্তীর চিৎকার শুনে জলপিপি ওড়ে খানিকটা দূরে গিয়ে আবার জলে বসে পড়ল। সে ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়ে পরিষ্কার করতে করতে পাখিটির দিকে তাকিয়ে রইল। এখনও তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দটা স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে তো ছুটছে। আসলে অবন্তী খুব ভয় পেয়েছিল। ভয় মানে পরাজয়ের পূর্বাভাস। কিন্তু সে দমে যাবার পাত্রী নয়। সে ওঠে দাঁড়ায়। সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে যায় জলপিপি পাখিটির দিকে। সে একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করার পূর্বে চারিপাশটা একবার দেখে নেয়। সে বোঝতে পারে তার মন থেকে এখনও সরীসৃপ আতঙ্ক মিলিয়ে যায়নি। ক্যামেরা তাক করতেই অবন্তী মনে হল হাত কাঁপছে। ছবি তোলাতে তার মনসংযোগ হচ্ছেনা। এই অবস্থায় কাজ করা সম্ভব না। অগত্যা অবন্তী হোটেলে ফিরে আসে।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে অবন্তী দেখতে পেল ভারী কুয়াশাপাত হচ্ছে। এক মহাজাগতিক ধূসর জগতে প্রকৃতির রূপ-রঙ বিলীন হয়ে গেছে। দশ হাত দূরত্বেও কোনকিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছেনা। এই পরিবেশে পাখির ছবি তোলা সম্ভব না। ক্যামেরায় কুয়াশার ঝাপসা ক্যানভাস ছাড়া আর কিছু ধরা পড়বে না। অবন্তীর মন ভীষণভাবে খারাপ হয়ে গেল। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া তার অন্যকোন কাজ নেই। সে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে নোটপ্যাড বের করে সরীসৃপ উইকিপিডিয়া খুলে গভীর মনোযোগে পাঠ করতে লাগল।
সরীসৃপ সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্যগুলো জেনে তার মন থেকে সর্পভীতি উবে গেল। সে বেদে সম্প্রদায়ের কথা ভাবে। সাপ যাদের জীবিকার প্রধানতম অবলম্বন। যাদের সংসারে সাপ অন্যতম সদস্য হয়ে আছে। অবন্তী বোঝতে পারে অজ্ঞতা থেকে ভয়ের জন্ম। সাপ সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা ছিল না বলে সে ভয় পেয়েছিল বেশি। যেমন সে ভুতে বিশ্বাস করেনা, তাই তার ভুতের ভয়ও নেই। এভাবেই বিভিন্ন যুক্তিবোধে অবন্তী নিজের মনকে আরও সুদৃঢ় করে।
তিনদিন পার হয়ে গেল। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। ভারী কুয়াশার ভেতর মানুষ,গাছপালা,ছুটন্ত গাড়িগুলোকে ছায়া ছায়া লাগে অবন্তীর। হাড় কাঁপানো শৈত্য প্রবাহ যেন শরীরে তীব্র কামড় বসিয়ে দিচ্ছে। এভাবে অলস সময় কাটতে চাইছে না। অস্থির হয়ে ওঠল সে। ফিরে যাওয়ার কথাও ভাবল। কিন্তু মানুষের স্বভাব বুঝি আশায় আশায় দিন কাটানো। আশায় বুক বেঁধে সে আরও একটা দিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। চতুর্থ দিন কুয়াশা কেটে গেল। আকাশে জেগে ওঠল সূর্যের হাসি। অবন্তী ছুটে গেল টাঙ্গুয়ার হাওরে।
কয়েকটি নতুন প্রজাতির পাখি দেখতে পেল সে, যেগুলো আগে দেখেনি। এক ঝাঁক পাতি সরালি পাখির ছবি তোলে সে খুব আনন্দিত হয়েছিল। এসব অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে অবন্তী পৌঁছে গেল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে।
পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য, অহেতুক ঢিল ছুঁড়ে পাখিদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে এখানে প্রতি বছর অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মানুষের এরকম আচরণে অবন্তী খুব কষ্ট পায়। কেন তারা পাখির প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ করে, কেন তারা পাখি প্রেমিক নয় সে বোঝে ওঠতে পারেনা। এক ঝাঁক চিতাটুপি পাখি দেখতে পেয়ে অবন্তী সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দ্রুত কয়েকটি ছবি তোলে ফেলল। আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সে পেয়ে গেল মানিকজোড়, নাকতা, পাতারি প্রজাতির পাখি। সে এসব পাখির ছবি তোলা শেষ করে মনে মনে আরও এক প্রজাতির পাখির খোঁজ করছিল। সেটি হলো লাল গুড়গুটি। অবন্তী জানে এই প্রজাতির পাখিরা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকই পাছন্দ করে। প্রতি বছর নাকি আসে, কিন্তু অবন্তীর চোখে একবারও পড়েনি। অবন্তী লেকের বিভিন্ন দিকে ঘুরে ঘুরে খোঁজতে লাগল লাল গুড়গুটি। হঠাৎ অবন্তীর সামনে পড়ে গেল একজন পাখি শিকারি। তার দুহাতে অনেকগুলো পাখি। সবগুলো ল্যাঞ্জা হাঁস। অবন্তীর মেজাজ গরম হয়ে ওঠল। অবন্তী পাখি শিকারি লোকটিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল,পাখি ছেড়ে দাও, না হয় এক্ষুনি পুলিস ডাকব। লোকটি তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
আজ সারাদিন অবন্তীর মনটা খারাপ হয়ে রইল। লেখালেখিতে মোটেও মন বসাতে পারেনি। বারবার ল্যাঞ্জা হাঁসগুলোর কথা মনে পড়ছিল। রাতে কিছুই মুখে তোলল না। পেটে ক্ষিধে নিয়ে হাঁসগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝরাতে অবন্তী স্বপ্ন দেখল, হাঁসগুলো তাকে চিৎকার করে ডাকছে। অবন্তী ! অবন্তী ! বাঁচাও। আমাদের বাঁচাও।
অবন্তীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে বিছানা থেকে নেমে পানি খেল এক গেলাস। তারপর জানালা খুলে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। এক পশলা শীতল হাওয়া এসে তাকে কাঁপিয়ে দিল। অবন্তী উপলব্ধি করল হাঁসের মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে শীতের যন্ত্রণা তেমন কিছু নয়।