১৪ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
সজল ক্রাউন রয়েল কানাডিয়ান ব্লু হুস্কির ছিপি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, মাল কোত্থেকে নিস ?
এয়ারপোর্ট ডিউটি ফ্রী সপ। ইশতিয়াক উয়িক এন্ডে আসে। ও আর আমি সারারাত চলে। তুই তো আগে আসতি। বাদ দিলি কেন ?
সজল গেলাসে পেগ ঢালতে ঢালতে বলল, আসলে আগের মত খাই না। সময়ও বের করতে পারিনা। পার্টির কাজে সময় দিচ্ছি বেশি। নে চিয়ার্স কর। বাদল ও সজলের গেলাস পরস্পরের সাথে টোকাটুকি করলে গীটারের তারে টান পড়ার মত একটা শব্দ হল।
সজল গেলাসে হাল্কা চুমুক দিয়ে একটা খাজুবাদাম মুখে দিয়েছে। এটার ফ্লেভারটা চমৎকার। পানি মিশানো লাগেনা। আইস কিউব দিলে চলে।
বাদল মাথা দোলাল। আমারও ভাল লাগে। খামার করার কথা ভাবছিস নাকি ? বাদল একটা গাজরের টুকরো মুখে দিল।
এখানে না। ভাবছি সুজানগরে করব। মণিকার ইচ্ছা সুজানগর থেকে ইলেকশন করি। সজল গেলাসে ঠোঁট ভিজাল। দু আঙুলের চিমটি দিয়ে এক চিমটি চনাচুর মুখে পুরে দিল। গ্রামে গেলে তো কিছু একটা করতে হবে। নাকি ? এলাকার সাথে যোগাযোগ না থাকলে জনগণ ভোট দিবে কেন ?
কথার ফাঁকে বাদল একটা বড় চুমুক নিল গেলাসে। তাহলে কী গ্রামে পার্মানেন্ট হয়ে যাবি ? সে একটা খাজুবাদাম তুলে নিয়ে আঙ্গুলে ধরে রাখল। মুখে দিল না।
আরে না। সজল মাথা ঝাঁকাল। কেন্দ্রের দায়িত্ব আছে না। সামনে হয়ত আরও বড় পোষ্ট পেতে পারি। আশা-যাওয়ার মধ্যে থাকব। ওদিকটা মণি সামলাবে।
বাদল গেলাস খালি করল। গুড ডিসিশান। মণিকা খুব ধীরস্থির। যেকোন বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারে। তোর কিন্তু আরও আগেই বিয়েটা সেরে ফেলা উচিৎ ছিল। এতদিনে নিজেকে আরও গুছিয়ে নিতে পারতি।
সজল গেলাসে দ্বিতীয় পেগ ঢালছে। ঠিক বলেছিস। মণি না হলে আমি সাহস করতাম না। হয়ত জীবনটা রাজপথেই কেটে যেত।
তনিমা ও মণিকা এল বসার ঘরে। তনিমার হাতে ফিস ফ্রাইয়ের প্লেট। সজলের সামনে প্লেট রেখে তনিমা বলে, নেতাজী ফিস ফ্রাই। খুব মচমচ করে ভেজেছি।
দুজনেই আসর জমিয়ে ফেলেছ। আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই ? মণিকা হাসছে।
বসে যাও মণিকা। বাদল বলল।
না বাদল ভাই। হার্ডড্রিংক পারি না। বীয়ার হলে সময় দিতে পারতাম।
বস, বাদাম আর চনাচুর খেতে থাক। বীয়ার এখন পৌঁছে যাবে।
মণিকা সজলের পাশে বসে বলল, আর কেউ আসতেছে ?
ইশতিয়াক আর জামান। সজল কথা শেষ করতে পারেনি নিচে গাড়ির হর্নের শব্দ শুনা গেল। বাদল বলল, ওরা এসে গেছে। আমি দেখছি।
সবাই পরিসর আরও বড় করে গোল হয়ে বসল। ইশতিয়াক ব্যাগে করে অনেকগুলো বীয়ার ও এক বোতল হুয়িস্কি আনল। ইশতিয়াক সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে, এসেই ঢালাঢালির দায়িত্ব নিয়ে নিলি। বেশ বেশ। তোরা কত নম্বর রাউন্ডে ?
সেকেন্ড। সজল বলল ।
ইশতিয়াক দুই হাত ঘষে বলে, একটু একটু শীত পড়ছে। ঢাল ঢাল, মাল ঢাল। আমি আর জামান কাভার করে নেব।
বাদল তনিমাকে বলল , ব্যাগের মধ্যে বীয়ার আছে। তোমরা নিয়ে নাও।
তনিমা ও মণিকা বীয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে ক্লিপ ওপেন করলে ফুটবল থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার মত শব্দ হল। ইশতিয়াক গেলাসে লম্বা করে চুমুক দিয়ে বলল, কি মণিকা বলেছিলাম না, তোমাদের বিয়েটা ইমিডিয়েট হবে। দেখলে কাঙালের কথা তাজা থাকতেই ফলে গেল।
মণিকা বীয়ারে হাল্কা চুমুক দিল। ইশতিয়াক ভাই আপনি জ্যোতিষ পেশায়ও ভাল করবেন।
ইশতিয়াক ও জামান গেলাস খালি করে সজলের সামনে রাখল। জামান বলল, ক্যারি অন দোস্ত।
সজল জামানের দিকে তাকাল। কী ব্যাপার ? রুহ আফজা সরবতের মত করে খেয়ে ফেললি দুইজনেই। আমি আর বাদল স্লো চালাচ্ছি।
ওটা আমাদের ফার্স্ট রাউন্ড। জলদি ঢাল, এখন তোদের সহযাত্রী হব। ইশতিয়াক বলল ।
সরি সরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। সজল বলল।
কিন্তু হাত দেখার জন্য প্যাশেন্ট কোথায় পাব মণিকা। ক্লিনিকে একটা সুন্দরী মেয়েও আসেনা। মনে হয় সুন্দরীদের অসুখ-বিসুখ হয় না। ঘরে গিয়ে শুধু লিপির হাত দেখে বলি, লিপি তোমার ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন। তোমার আরও একটি স্বামী হবে।
লিপি কী বলে ? মণিকা শসার স্লাইসে কামড় দিল।
লিপি আর কী বলবে। আমার মাথার চুল টেনে টেনে তুলে ফেলে। দেখতে পাচ্ছনা তালুর চুল কত পাতলা হয়ে গেছে। সবাই একদফা হেসে উঠল।
তনিমা আইস কিউব লাগবে। সজল তনিমার উদ্দেশ্যে বলল।
তনিমা কাজের ছেলেটাকে ডাকল। মিঠু !
মিঠু দৌড়ে এসে বলল, জে খালামণি।
বুয়াকে বল একবাটি আইস কিউব দেয়ার জন্য আর কাবাব হয়ে গেলে নিয়ে আসবি। মিঠু দ্রুত চলে গেল।
জামান বলল, কাল তো আট দল আবার হরতাল ডেকে বসল। কয়েকটা দিন ঠান্ডা ছিল। আবার শুরু হল আর কি।
এসব হরতাল দিয়ে কিচ্ছু হবে না। খামাকা জনগণের ভোগান্তি বাড়তেছে। এরশাদ পদত্যাগ করবে না। এরকম কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে না পারলে কিচ্ছু হবে বলে মনে হয় না। বাদল জামানের কথায় নাক গলায়।
ঐক্যবদ্ধ হবে কীভাবে ? বড় দলগুলোর মধ্যে ঈমানের ঘাটতি রয়েছে। ওরা একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সজল গেলাসের গায়ে আঙুল দিয়ে তবলা বাজায়।
তাছাড়া নেতৃত্বের সংকট তো রয়েছেই। জামান গেলাসে আইস কিউব দিয়ে বলল।
মণিকা বলল, নেতৃত্বের সংকট তো সবসময় ছিল জামান ভাই। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বলেন কিংবা পূর্ববাংলায়। জিন্নাহ ভারতের রাজনীতিতে যেভাবে জ্বলে উঠেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ফুটো বেলনের মত চুপসে গেলেন। মওলানা আকরাম খাঁ , নুরুল আমিন, খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রতি জনগণের আস্থা ছিলনা। মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা ছিলেন নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত। এরই সূত্র ধরে ভাসানি গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। উনার ছিল মস্কো-ভারতের প্রতি আনুরাগ। মুসলিমলীগের নেতারা বলতেন, মস্কো-ভারতের দালাল, কমিউনিস্ট, নাস্তিক ইত্যাদি ইত্যাদি। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আমেরিকা প্রেমিক এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুগত। ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা-ভাসানি-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট জনমনে কিছুটা আসার আলো দেখালেও সেটা ছিল নিতান্ত সাময়িক ব্যাপার। আবারো জনমনে হতাশা নেতৃত্ব সংকট নিয়ে। হঠাৎ আকাশের ধ্রুবতারার মত বঙ্গবন্ধু জ্বলে উঠলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তুরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা আশার আলো দেখলাম। কিন্তু পচাত্তরে এসে আমরাই আমাদের আলো নিভিয়ে দিলাম। জামান ভাই আপনি একটা বিষয় খেয়াল করবেন, চরম নেতৃত্ব সংকটেও বাঙ্গালিরা কিন্তু প্রত্যেকটা আন্দোলনে বিজয়ী হয়ে এসেছে। এবারো বিজয় আসবেনা তা নয়, কিন্তু সময় লাগবে।
সজল কিছু বলবি ? ইশতিয়াক মুচকি মুচকি হাসছে।
সজল মাথা নাড়ল। আমি স্পিকার সাথে করে নিয়ে এসেছি না।
মণিকা সজলের পেটে আঙুলের খোঁচা দিল। ভাল হবে না বলছি।
মণিকার এক্সপ্রেশান ঠিকই আছে। সংকটের মধ্যেই সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। বাদল বলল।
তুইও কী রাজনীতি করার কথা ভাবছিস নাকি ? তনিমা মণিকার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল।
মণিকা হাসল। নেতার বউ যখন হয়েছি, একটু একটু বাতাস তো লাগবেই।
পাঁচ নম্বর রাউন্ডে ইশতিয়াক ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। জোরে জোরে মাথা দোলাতে দোলাতে চোখ বন্ধ করে বলল, জানিস সজল মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিই। এখনও বুঝতে পারলাম না আমি কী রোগ সারাই, না মানুষের রোগ কামনা করি। প্রতিদিন অসুস্থ মানুষ দেখতে দেখতে নিজেকেই অসুস্থ মনে হয়। কখনও কখনও মনে হয় আমি বুঝি চাই মানুষ আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ুক। তোর কী মনে হয় চেম্বারে রোগী আসলে ডাক্তার খুশি হয় ?
সজল মাথা ঝাঁকাল। বিলকুল না। মনে হচ্ছে তোর মধ্যে কমপ্লেক্স কাজ করছে। তুই এক কাজ করতে পারিস, সপ্তাহে একদিন ফ্রী সানডে ক্লিনিক সার্ভিস। এতে তোর কমপ্লেক্স কেটে যাবে।
মানুষের রোগ-ব্যাধি হওয়ার পিছনে ডাক্তারদের কোন হাত নেই ইশতিয়াক ভাই। আল্লাহ্ বলেছেন, রোগ-ব্যাধি তিনিই দিয়ে থাকেন। মণিকা বলল।
ইশতিয়াক ধীরে ধীরে চোখ খুলে। তুমি সিওর আল্লাহ্ এরকম বলেছেন ?
কোরআনে আছে।
তাহলে মানুষের রোগ-ব্যাধি হোক ডাক্তাররা তা চায় না। তুমি এরকম বলছ ?
যে জিনিস আল্লাহ্ স্বেচ্ছায় দিয়ে থাকেন, তা কী চাওয়ার দরকার আছে ?
হা হা করে হেসে উঠে ইশতিয়াক। আমি কত বোকা ছিলাম ! মনটা এখন হাল্কা হয়ে গেল। দে সজল আর একটা পেগ দে।
ডাক্তারদের বেশি খেতে নেই। এখন বিশ্রামে থাক।
সবখানে নেতাগিরি !
ধর হাফ দিলাম। বাট টেক ইট স্লোলি।
সারারাত জাম্পেস আড্ডা দিল সবাই। ফজরের আজানের সাথে সাথে সজল আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করল। বলল, পিকেটাররা রাস্তায় নামার আগেই আমাদের বাড়ি পৌছাতে হবে।
---চলবে---------