১৩ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
সজল বিছানায় বসে ঝুঁকে আছে মেঝের দিকে। জুতার ফিতা লাগাচ্ছে। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে মনিরকে দেখতে। গতকাল বিক্ষোভ মিছিলে সে পুলিশের হামলায় আহত হয়। মনির অনেক করিৎকর্মা ছেলে। পার্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ। মনিরের কথা ভাবতে ভাবতে সজলের মনে একটা দুশ্চিন্তা ভর করে। সরকারের পেটোয়া বাহিনী দিন দিন যেরকম মারমুখী হয়ে ওঠছে, রাজপথে নামাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণ জেগে ওঠেছে, সবাই স্বৈরাচারের পতন চায়। সুতরাং লড়াই শেষ পর্যন্ত চলিয়ে যেতে হবে।
মণিকা আঙুলে আঁচল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, এত সকাল সকাল কোথায় বের হচ্ছ ?
সজল মুখ না তোলে জবাব দিল, হাসপাতালে যাব মনিরকে দেখতে।
দুপুরে তাড়াতাড়ি ফিরবে।
কোন প্রোগ্রাম বানিয়েছ ?
মণিকা মাথা ঝাঁকাল। আশুলিয়া যাব।
সজল এবার মুখ তুলে তাকাল মণিকার দিকে। আশুলিয়ায় দেখার কী আছে ? বেড়ানোর মত ওটা একটা জায়গা হল ?
বাদল ভাইয়ের খামারটা দেখব।
আসলে আমিও অনেকদিন ধরে ভাবছি বাদলের ওখানে যাবার কথা।
তুমি শুধু ভাবতেই থাক। তোমার একশান স্লো।
সজল হাসল। বেরিয়ে যাবার আগে মণিকার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল। মণিকা বলল, সাবধানে যেও।
সজল বেরিয়ে গেলে মণিকা খামার ব্যাবস্থাপনা বইটি নিয়ে বসল। সে ঘরে একা। বিলকিস ও ইয়াহিয়া গিয়েছেন শপিংযে। কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের অনেক কেনাকাটা দরকার। এই একটা ট্রাভেল ব্যাগ, ক্যামরা, শীতের কাপড়, হাল্কা টাইপের চপ্পল, আরো যা যা প্রয়োজন মনে করে। মণিকা অবশ্য বিলকিসকে বলেছে, মা ক্যামরা কেনার দরকার নাই। ক্যামরা আমার আছে। একটা দূরবীণ হলে ভাল হয়। দূরবীণ দিয়ে সূর্যাস্ত দেখার মজাই আলাদা।
সজল কক্সবাজার যেতে রাজি হয়েছে। একটা ভাল লাগা অনুভূতি মণিকাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ভার্সিটি জীবনে সজলকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘোরেছে। সেই অনুভূতি ছিল একরকম। বিয়ের পর এই প্রথম সজলকে নিয়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে এই অনুভূতি অন্যরকম। কিন্তু সজলের সাথে তো তার বিয়ে হয় নি। সে আর সজল ছাড়া বিষয়টা অন্যকেউ জানে না। কিন্তু তারা সংসার করছে, দিব্যি সুখে আছে। বিয়ে জিনিসটা আসলে কী ? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের সম্মতি ছাড়া তো আর কিছু নয়। বাকী বিষয়গুলো সামাজিকতা, আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কি। এসব বাহ্যিক বিষয় তার কাছে কোন গুরুত্ব পায় না। তার কাছে ভালোবাসাই জীবনের পাথেয়। ভালোবাসাই যদি না থাকল, আইনের জোরে কি কোন সংসার টিকিয়ে রাখা যাবে ? হয়ত যাবে, হয়ত যাবে না। গেলেও সেই সংসার অশান্তির দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। মণিকা বিয়ে নিয়ে ভাবতে চায় না। এখন সে বেশ আছে। ভালোবাসাই তার কাছে অপার মহিমা।
সে কক্সবাজার আগেও গিয়েছে। কিন্তু সেবার ছিল মা-বাবার সাথে বেড়ানো। এবার থাকছে সজল। তার প্রাণের মানুষ। আনন্দে তার হৃদয় শীতের ঘাসের মত ভিজে আসে। সে মনে মনে কক্সবাজারে বেড়ানোর দিনগুলো সাজিয়ে নেয়। কোথায় কোথায় বেড়াবে তার একটা আগাম পরিকল্পনা থাকা ভাল। সুযোগ হলে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসার চিন্তাও মাথায় রাখল। হঠাৎ টেলিফোনের রিং বেজে ওঠাতে মণিকা দৌড়ে গিয়ে রিসিভ করল। সজল ফোন করেছে। মণিকাকে জানাল দুপুরে চীনা রেস্তোরাঁয় খাবে, মণিকা যেন চলে আসে। মণিকা জানতে চাইল, কোন রেস্তোরাঁয় ?
সাংরিলা,
ওকে। মণিকা দ্রুত ঘরের কাজ শেষ করে নিল। বিলকিসকে জানাল আশুলিয়া যাওয়ার কথা।
দুপুরের খাবার শেষ করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে সজল ও মণিকা এদিক সেদিক ঘোরে আরও কিছু সময় কাটাল। যখন তারা আশুলিয়া এসে পৌঁছল, তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। চারদিকে নেমে এসেছে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার। আশুলিয়ায় আসার কথা বাদলকে আগেই ফোন করে জানিয়েছিল সজল। তাই আগে থেকেই বাদল খামারে চলে এসেছে। সজল আর মণিকাকে পেয়ে উচ্ছ্বসে ফেটে পড়ল বাদল। সজলকে জড়িয়ে ধরে বলল, বহুদিন পর মিয়া-বিবি একসাথে দেখলাম। তোদের কথা শুনেছি। তোরা নাকি..
ইশতিয়াক বলেছে ? সজল বাদলকে কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রশ্ন করল।
আরে কথা থাকে নাকি! যাক ভালই হল। তো মণিকা তোমাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে খুব সুখে আছ।
মণিকা হাসল। বাদল ভাই বেশি কিছু আশা করা ভুল। আমার চাহিদা কম। সুতরাং আমি happy the women . বাদল ভাই আপনার খামারটা দেখতে চাই।
বাদল ফান করল। তোমরা কি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এসেছ ?
না বাদল ভাই, আমরা আপনার সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।
বুঝতে পেরেছি। আমার কম্পেটিটর হতে চাও। তাহলে তো তোমাকে সব হাতেকলমে দেখাতে হবে। কারণ কম্পেটিটর সমান সমান না হলে জমবে না। কী বল ?
ঠিক বলেছেন।
সজল বলল, জানিস বাদল, মণি বলল তাজমহল দেখবে। আমি বললাম তাজমহলে দেখার কি আছে, চল বাদলের খামার দেখে আসি।
বাদল বলল, বেশ করেছিস। মণিকা নিরবে হাসল।
একঘণ্টারও অধিক সময় ধরে তারা বাদলের খামারটি পরিদর্শন করল। বাদল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। মণিকার হাতে একটা বই দিয়ে বলল, এতে পশু চিকিৎসার সবকিছু পাবে।
ধন্যবাদ বাদল ভাই। আপনার এখানে সময়টা খুব ভাল কাটল।
সজল বলল, আমরা এখন আসি বাদল।
আসি মানে ! বাসায় যাবি না ? তনিমা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আবার উত্তরা ? সজল ভ্রূ কুচকাল ।
উত্তরা কী গাজীপুর নাকি ? আরে বুদ্ধু, ঢাকা যেতে তোকে উত্তরার উপর দিয়েই তো যেতে হবে।
সজল বোকার মত হেসে বলে, তাই তো।
তনিমা আগে থেকেই দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল। মণিকাকে জড়িয়ে ধরল সে। বলল, শেষ পর্যন্ত লাইলি মজনুর দেখা পেল।
এখন কী আর লাইলি মজনু আছি নাকি। মণিকা বলল।
তনিমা সজলের দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাব্বাহ, এতদিন পর নেতাজির আমাদের কথা মনে পড়ল। আমি তো মনে করেছি ভুলেই গিয়েছেন। ভার্সিটিতে পড়া কালে তনিমারা সজলকে নেতাজি বলেই ডাকত। তার চেহারাও ছিল অনেকটা সুভাষ বসুর মত। সজল তখন তুখোড় ছাত্রনেতা। দেখতে সুদর্শন ও তার বিনয়ের কারণে মেয়েদের মাঝে খুব পপুলার ছিল। সজল হেঁটে গেলে অনেক মেয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলত, এই দেখ দেখ রাজার কুমার যাচ্ছে। How sweet . তাদের মাঝে মণিকা থাকলে তাকে ক্ষেপানোর জন্য মেয়েরা আরও একটু ওভার এক্টিং করত। অনেকে ফ্লাইয়িং কিস ছুড়ে দিত সজলের দিকে। মণিকা তখন কোমরে ওড়না প্যাচিয়ে মেয়েদের সাথে ঝগড়া করত। মণিকার পাগলামি দেখে সবাই খুব মজা পেত।
সজল মাথা নাড়ল। না তনিমা ভুলিনি। তবে সময়গুলো কীভাবে নদীর স্রোতের মত হারিয়ে যায় বুঝতে পারিনা।
আজকে আর ছাড়ছি না নেতাজিকে। আপনারা দুই বন্ধু গল্প করেন, আমি মণিকাকে নিয়ে ভেতরে গেলাম।
ইশতিয়াককে ফোন করে দিয়েছি, বাদল বলল। ও আসার পথে জামানকে উঠিয়ে নেবে গুলশান থেকে। ইশতিয়াক অলরেডি রওয়ানা দিয়েছে। পৌঁছাতে হয়ত আধা ঘণ্টা মত লাগতে পারে। বোতল একটা খুলবি নাকি ?
সজল চোখ কপালে তুলল। শুধু শুধু বসে থাকব নাকি ? হয়ে যাক এক রাউন্ড।
গুড। এক মিনিট, আমি আসছি। বাদল বসার ঘর থেকে ভেতরের দিকে চলে গেল। ফিরে এল একটা বোতল বগলদাবা করে। চেয়ারে নয়, কার্পেটে বসি।
কাজের ছেলেটা ট্রেতে করে গেলাস, পিরিচে চনাচুর, কাজুবাদাম,আইস কিউব ও সালাদ দিয়ে গেল। বাদল সজলের হাতে বোতল দিয়ে বলল, তুই খুল।
চলবে-----------
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৮