Painting ## Annisa Farhin
১ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
২ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
৩ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
(৩য় পর্বের পরের অংশ)
আজ ভোরের দিকে কমলাপুর ষ্টেশনে পৌঁছল সুমিরা। চট্টগ্রাম থেকে রাতের ট্রেনে চেপেছিল। একটা উদ্বেগের মধ্যে জার্নি শেষ হল সুমির। আমানকে বলল, বাবা আসবে বলেছিল, দেখছি না কেন, তুমি একটু দেখ তো। আমান এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরাতে লাগল। এমন সময় সেতু চিৎকার করে উঠল, ঐ তো নানুভাই!
ইয়াহিয়া প্রতিদিন ভোরে জগিং করতে বের হন। আজ তিনি জগিং করতে করতে কমলাপুর ষ্টেশনে চলে এসেছেন। সেতু হঠাৎ নানুভাইকে পেয়ে কোলে উঠে বসে থাকল। সুমি ও আমান ইয়াহিয়াকে কদমবুচি করল।
ইয়াহিয়া বলল, পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
সুমি ক্যানভাসের ছোট ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে বলল, না বাবা, তেমন সমস্যা হয়নি। তবে সারাটা পথ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। পেপারে পড়েছি পিকেটাররা নাকি রেললাইন খুলে ফেলে। সেতু ও আমান ঘুমিয়েছিল। আমরা স্লিপিং টিকেট নিয়েছিলাম। কিন্তু জার্নিতে আমার ঘুম আসে না।
ইয়াহিয়া আমানের দিকে তাকালেন। আমান তোমাদের লাগ্যাজ কই ?
আমান কুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ তো বাবা কুলির কাছে।
তাহলে চল, আর দেরি নয় বাসায় ফেরা যাক।
তারপর ইয়াহিয়া সেতুকে কোলের উপর ঝাকি দিয়ে বললেন, চল নানুভাই, এতক্ষনে তোমার নানুমণি হয়ত তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
সজলের পাশের রুমটা সাফসতুর করে রেখেছিলেন বিলকিস। এই রুমে সুমিদের থাকার ব্যাবস্থা হল। বিয়ের আগে সুমি এই রুমে থাকত। বিলকিসের মনে হল অনেক দিন পর যেন ঘরটা প্রাণ ফিরে পেল।
ঘরে পৌঁছেই আমান বলল, তার গোসল করা দরকার। সে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। সেতু বারান্দায় বসে নানুভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছে। সুমি বিছানায় শুয়ে পড়ল।
নাস্তা করে ঘুমা। বিলকিস মেয়েকে বললেন।
সুমি হাই তুলে। না মা, উঠে নাস্তা করব। তুমি আমান আর সেতুকে নাস্তা দিয়ে দাও। ওরা বাপ বেটা ট্রেনে ঘুমিয়েছিল। আমি জার্নিতে ঘুমাতে পারি না। মনে একটা ভয় এসে যায়। মনে হয় আমি ঘুমিয়ে গেলে বুঝি ট্রেনটা এক্সিডেন্ট করবে। এখন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভাইয়া কোথায় ? ভাইয়াকে দেখছি না যে ?
বিলকিস দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলেটার ঠিকমত নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, শান্তিমত একটু ঘরে ঘুমাতেও পারে না। আবার ধরপাকড় শুরু হয়েছে। ওদের পার্টির কয়েকজন নেতাকর্মী এরেস্ট হয়েছে। গতরাতে পুলিশ এসেছিল বাসায় সজলকে খোঁজার জন্য। কী জানি কোথায় কোথায় রাত কাটায়।
সুমি চুলফিতা খুলে ফেলে চুল ছড়িয়ে দিল বালিশের উপর। ভাইয়া যে কেন রাজনীতি-ফাজনীতি করে আমি কিছু বুঝি না মা। এইটা একটা লাইফ হল ? তোমরা ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছ না ? মণিকা আপুকে সারাজীবন এভাবে ঝুলিয়ে রাখবে। যে একজন নারীর মনের কষ্ট বুঝতে পারে না, সে জনগণের কষ্ট কীভাবে বুঝবে ? মনে হয় তোমারা ভাইয়াকে কিছু বল না ?
বলিনা মানে ! আমি তো কয়েকদিন আগেও তাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, আমরা চৌধুরী সাহেবের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাব কিনা।
ভাইয়া কী বলল ?
সবসময় সে ঐ একটি কথাই বলে, দেখি মা একটু ভাবতে সময় দাও। তার ভাবাভাবির আর শেষ হয় না।
সুমি বামহাত ভাঁজ করে মাথার নিচে রাখল। মাথা সামান্য কাত করে মায়ের দিকে তাকাল। মণিকা আপার খবর কী মা ?
মণিকা মাঝে মাঝে আসে। শুনতে পাই ও ঘরে খুব অশান্তিতে আছে। ওর মা ওর জন্য ছেলে পছন্দ করে, আর ও প্রত্যেকটা না করে দেয়। এ নিয়ে মা মেয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। অনেক সময় কথাবার্তা বন্ধ থাকে। ওর মা তো সজলকে মোটেও সহ্য করতে পারে না। কিন্তু চৌধুরী সাহেব সজলকে বেশ পছন্দ করেন।
আমান বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। বিলকিস বললেন, আমান নাস্তা খাবে এসো।
আমান তোয়ালে চুলের পানি মুছতে মুছতে বলল, আসছি মা।
সেতুটা কোনদিকে গেল আমি দেখি বলে বিলকিস উঠে চলে গেলেন।
বাবার সঙ্গে গল্প করছে মনে হয়। সুমি চোখ বন্ধ করল।
এখন ঘুমাবে নাকি ? আমান বলল ।
সুমি চোখ খুলল না। আমার মাথা ধরেছ। মনে হচ্ছে এখনও মাথার ভেতর ট্রেন চলতেছে। আমাকে জাগিও না।
আমান মাথা ঝাকি দিল। ওকে। কিন্তু আমি যে চুলব্রাশ খুঁজে পাচ্ছি না।
সুমি চোখ না খুলে বলল, বড় ব্যাগটার সাইড পকেটে দেখ।
আমান ঝুঁকে সাইড পকেটের জিপার খুলে দেখল। নাহ, এখানে নেই।
সুমি পাশ ফিরল। ব্যাগের ভেতরে চেক কর।
আমান ব্যাগের ভেতরে তার চেহারাটা নিয়ে গেল। কই, পাচ্ছিনা তো ?
তাহলে ছোট ব্যাগটায় দেখ। সুমির কন্ঠে উষ্মা।
আমান ছোট ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে চেয়ারে বসল। তারপর ভেতরের সব জিনিস একবার উলট-পালট করল। এখানেও নেই। মনে হয় তুমি চুলব্রাশ নিতে ভুলে গেছ।
সুমি স্পিরিংয়ের মত লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। বড় ব্যাগটার সাইড পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুলব্রাশ বের করে আনল। তারপর গজ গজ করতে করতে আবার শুয়ে পড়ল।
একটা ব্রাশ খুঁজে নিতে পারনা, কখনও মোজা খুঁজে পাওনা, কখনও কলম খুঁজে পাওনা। বাংলাদেশের পুরুষদের এই অধপতন দেখে মনে হয় খালেদা-হাসিনাকে রাজপথে নামতে হইছে। যাও, নাস্তা করতে যাও, বাবা ওয়েট করছে। সুমি আবার চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথার যন্ত্রনাটাও কমছে না। তার সজলের কথা মনে পড়লা। না জানি ভাইয়াটা এখন কোথায় আছে।
সজল তখন রাজপথের মিছিলে। মেহনতি জনতা পার্টির মিছিল ঢাকা কলেজের দিক থেকে নিউমার্কেটের দিকে আসছিল। মিছিলের ফ্রন্টলাইনে সজল, মহসিন ভাই, এনায়েত, মনির আরও অনেকে আছেন। মিছিল ধানমণ্ডি পৌঁছতেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ল মিছিল লক্ষ্য করে। মিছিল থেকে কেউ কেউ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করল পুলিশের উপর। পুলিশও পাল্টা জবাব দিতে লাগল। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পুরো এলাকায় উড়তে লাগল টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়া।
হঠাৎ একটা ইটের টুকরা এসে পড়ল সজলের কপালে। সজল কিছু বুঝে উঠতে পারল না। হাতের তালু দিয়ে কপাল চেপে ধরে সে ধানমণ্ডির একটা গলি দিয়ে দৌড়াতে লাগল। টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় তার চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে আর পানি ঝরছিল ঝর্ণার মত। সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা; মনে হচ্ছে সে যেন কুয়াশার ভেতর দৌড়াচ্ছে। কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে তার চেহারা, বুকের দিকের শার্ট চপচপ করছে। এমন সময় শুনতে পেল পেছনে বুটের আওয়াজ। পুলিশ তাড়া করছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কিছুদূর দৌড়াতেই সে দেখল, সামনের দিক দিয়ে একদল পুলিশ এগিয়ে আসছে।
এখন কী করবে সজল। কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তার সামনে ভেসে উঠতে লাগল পুলিশি নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব চিত্রগুলো। সে দেখতে পেল পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে গেছে। দুই হাত উপরের দিকে বেঁধে শুন্যে ঝুলিয়ে রাখল তিনদিন। সজল চিন্তা করল কিছুতেই পুলিশের হাতে ধরা দেয়া যাবে না। হঠাৎ একটা বাড়ির খোলা গেট নজরে এল তার। সে বিলম্ব না করে গেট দিয়ে প্রবেশ করে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। বাড়িটা আর কারো নয়, মণিকাদের।
মণিকার মা-বাবা দুইদিন আগে নেপাল গিয়েছে বেড়াতে। নেপাল থেকে যাবে আজমির। মণিকাকে জোর করেছিল কিন্তু মণিকা যায় নি। সে বলেছিল, আমার বেড়াতে ভাল লাগে না। তোমরা যাও।
এত বড় বাড়িতে চাকর-বাকর ছাড়া মণিকা একা। সময় যেন তার কাটতে চায় না। সে বেলকুনিতে পায়চারি করে, আবার কখন ও দুই হাতে রেলিংয়ে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখনই আকাশের দিকে তাকায় দেখতে পায় মেঘগুলো যেন এক অদৃশ্য বলয়ে আটকে আছে।
মণিকাদের কাজের লোকজন সার্ভেন্ট কোয়াটারে থাকে। তাদের ঘরের পিছে আলাদা করে বানানো ছোট ঘরটি সার্ভেন্ট কোয়াটার। তবে সেখানে অনায়াসে পাঁচ-ছয়জন লোক থাকতে পারে। সজল সার্ভেন্ট কোয়াটারের দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তার দুর্বল লাগছিল। মাথার ভেতর বোঁ বোঁ শব্দ হচ্ছে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। সজলকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ফেলল বাগানের মালি রহমত। সে তাড়াতড়ি সজলকে নিজের বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলল, সজল ভাই আপনে আঘাত পাইলেন কই ?
পুলিশ মিছিলে হামলা চালিয়েছে। সজল অস্ফূট স্বরে বলল । রহমত মণিকা আছে ঘরে ?
জে আছে।
তাকে একটু খবর দাও।
আইচ্ছা বলে রহমত দ্রুত চলে গেল।
মনিকা সজলকে এই অবস্থায় দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। সজলের কপালে ড্রেসিং করতে করতে বলল, গভীরভাবে কেটে গেছে। মনে হচ্ছে ডাক্তার ডাকতে হবে’। তার চোখ জলে পূর্ণ হয়ে উপচে বেরিয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
সজলের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দুর্বল হয়ে আসছে শরীর। সে ক্ষিণ কন্ঠে বলল, ইশতিয়াককে ফোন কর।
ধানমণ্ডিতেই ইশতিয়াকের ক্লিনিক। মণিকাদের বাড়ি থেকে দূরে নয়। ইশতিয়াক সজলের কলেজ জীবনের বন্ধু। ইন্টার পাশ করে ইশতিয়াক ভর্তি হল মেডিকেলে আর সজল ঢাকা ভার্সিটিতে। ইশতিয়াক নিজেই এখন ক্লিনিকের মালিক। মণিকার ফোন পেয়ে ছুটে এলো ইশতিয়াক। সজলের ক্ষত পরীক্ষা করে দেখল তেমন মারাত্মক নয়। তবে স্টিচিং লাগবে। তার কালো ব্যাগে ডাক্তারি সরঞ্জাম খোঁজতে খোঁজতে মণিকার উদ্দেশ্যে বলল, ড্রেসিংটা খুলে ফেল।
মণিকা ধীরে ধীরে ড্রেসিং খুলে ফেলল। ইশতিয়াক সজলকে চেতনানাশক ইংজেকশন দিয়ে ক্ষতস্থানে স্টিচ করে দিল চারটা। তারপর মণিকার দিকে ফিরে বলল, এবার ড্রেসিং করে দাও। ওষুধ লিখে দিচ্ছি। রেগুলার খাবে। সেরে উঠতে সাত আট দিন লাগবে। এখন সজল দুই ঘণ্টা ঘুমাবে। আমি আবার এসে দেখে যাব। তুমি চেহারাকে অমাবশ্যার চাঁদ বানিয়েছ কেন ? এ সিরিয়াস কিছু নয়।
মণিকা আঁচলে চোখের কোণ মুছে নিল। ইশতিয়াক ভাই কয়েকদিন ধরে আমার মন বলছিল, সজল কোন একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু তার বিপদ যে আমার বাড়ির পাশেই হবে ভাবি নাই।
ইশতিয়াক সজলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকাল। তুমি এই অবস্থায় তাকে কীভাবে উদ্ধার করলে ?
আমি উদ্ধার করি নাই। পুলিশের তাড়া খেয়ে সে ডুকে পড়েছিল আমাদের গেট দিয়ে। সার্ভেন্ট কোয়াটারের পিছে পড়ে থাকতে দেখে, বাগানের মালি রহমত আমাকে খবর দিল।
বাঃ চমৎকার ! শেষ পর্যন্ত তোমার কাছেই আশ্রয় খুঁজে নিল। মণিকা আমি ভবিষ্যৎ বাণী করছি অচিরেই তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে।
আমি বিয়ে নিয়ে আর ভাবিনা ইশতিয়াক ভাই। আমার টেনশান ঐ একটিই। সজল জীবনের মূল্যবান সময়গুলো হারিয়ে ফেলছে।
শুন মণিকা, রাজনীতিবিদদের জীবনটাই এরকম। এসব নিয়ে অযথা টেনশান করে লাভ নেই। তুমি তো জান বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় জেলে কাটিয়েছিলেন। আমি এখন আসি মণিকা। পরে আসব।
মণিকা মাথা নাড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস তাঁর বুক থেকে বেরিয়ে গেল। ইশতিয়াক যাওয়ার পর মণিকা রহমতকে ডাকল। রহমত শুন। রহমত এসে মণিকার সামনে দাঁড়াল। জে আপামণি বলেন।
আমি বাইরে যাচ্ছি। তুই সজলের খেয়াল রাখবি। বাইরের কাউকে গেট খুলে দিবি না। বুঝছিস ?
জে আপামণি।
(চলবে ...............)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৬