“রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ ।একটা গ্ল্যাডিয়েটরের তবু কিছুটা আশা থাকতো, একটা সিংহের সঙ্গে ঝুটোপুটি করতে করতে সে জিতেও যেতে পারে ।কিন্তু এখানে? সেই ঝুটোপুটি করার সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই। হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কটকট করে কতগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে, মুহুর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে। এইরকম অবস্থার মধ্যে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশি সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি?”
“তুইতো এখানে পড়বিনা ।আই আই টিতে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে, তোকে না হয় কয়েকমাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেব”।
“আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত ।কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে ।আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা। তুমি কি তাই চাও আম্মা?”
জননী জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন,“না,তা চাই নে।ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম।দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে।যা,তুই যুদ্ধেই যা।"
আপনারা এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন আমি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আর শহীদ রুমি বীর বিক্রমের কতপকথন লিখলাম উপরে। শহীদ জননী এরপর “দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে” অনেকবার আফসোস করেছেন।
আজ শাফি ইমাম রুমির বীর বিক্রমের ৬৩ তম জন্মদিন। ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জননী জাহানারা ইমাম এবং শরীফ ইমামের ঘর আলোকিত করে আসেন তিনি। আম্মার দুই সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়।
তার শেষ জন্মদিনের কথা আম্মা তার বই “একাত্তুরের দিনগুলি” তে লিখেছেন,
“সকালেই গেলাম রুমী আর জামীকে বাড়ি নিয়ে আসতে। আজ রুমীর জন্মদিন, অন্তত দুপুরে কিছু রান্না করে খাইয়ে দিই। গিয়ে দেখি কিটি ওখানে বেড়াতে গেছে। গুলশানে বেশির ভাগ বাড়িতে বিদেশীদের বাস- সেখানে চলাফেরার একটু সুবিধে, আর্মির উৎপাত একটু কম।
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, কাচা বাজার সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন, কিছুই পাওয়া যাবে না- আজও কি ডাল, আলু দিয়ে খাওয়া হবে? হঠাত চোখ পড়লো এয়ারপোর্ট রোডের ষাঁড় ষাঁড় বন্ধ দোকানের মাঝে ছোট্ট গোশতের একটা খোলা দোকানে মাত্র একটি খাসীর রান ঝুলছে। তক্ষুণি গাড়ি থামিয়ে রানটা কিনে নিলাম। বললাম, “ রুমী, তোর কপালে পেয়ে গেলাম”।
বাড়ি পৌছে দেখি চিংকু আর কায়সার বসে আছে। বললাম, “ ভালোই হল তোমরা এসেছ আজ রুমীর জন্মদিন। তোমরা দুপুরে ওর সাথে খেয়ে যাও”।
তারপর তিনটে চুলা ধরিয়ে কাসেম, বাকের দুজনকে খাটিয়ে নিজেও দ্রুত খেটে তৈরি হল পোলাও, কোর্মা আর চানার হালুয়া। গুলশান থেকে আসার সময় রেবা তার বাগানের কিছু টম্যাটো তুলে দিয়েছিল। সেটা দিয়ে সালাদ বানানো হল।
খাওয়ার পর ঢেকুর তুলে জামি বললো, “ভাইয়ার জন্মদিনের খাওয়াটা ভালোই হল। এমন দুর্দিনে এর বেশি আর কি চাই?’
খাওয়া দাওয়ার পর রুমী জামীকে আবার গুলশানে রেখে এলাম”।
শুভ জন্মদিন রুমী ভাই। নিশ্চয়ই বেহেশতে বসে আমাদের জন্য করুণা করতেছ। আমেরিকার উচ্চশিক্ষা আর আয়েশি জীবনের মায়া ত্যাগ করে যে দেশের আশায় জীবন দিলে, তোমার সেই সোনার বাংলা আমরা এখনো গড়তে পারিনি। তোমার ঘাতক এখনো বাংলার বাতাস দুষিত করে। তোমার রক্তে কেনা বাংলায় ওরা আম্মাকে বলে "জাহান্নামের ইমাম"। বিশ্বাস করো রুমই ভাই আমার গলা টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ওদের। পারিনা। আইনের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তুমি তো বিশৃঙ্খল বাংলা চাওনি। আশা করবো তোমার বাংলা তোমার হত্যার বিচার করবে, আর খুনিদের লাশ তোমার রক্তের বিনিময়ে কেনা মাটিতে রাখা হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৪৬