০১.
বিতর্ক মানে কি? এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পুরো বিষয়টি নিয়ে আবার চিন্তা করা উচিত। বিতর্ক মানে কি প্রতিযোগিতাতে বিজয়ী হবার পর অনেক মেডেল আর পুরষ্কার? বিতর্ক মানে কি ক্লাব, কম্পিউটার, স্যুভেনির আর পত্রিকাতে ছবি? বিতর্ক মানে কি দল বেঁধে বিদেশে প্রতিযোগিতা করতে যাওয়া এবং ফিরে এসে সেটি নিয়ে হামবড়া ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো? কষ্ট হয় যখন দেখি বিতর্ক হয়ে গেছে আনুষ্টানিকতা আর প্রতিযোগিতা সর্বস্ব একটি বিষয় যেখানে তার্কিক এর চাইতে বেশী গুরুত্ত্ব পায় অন্যরা। আমার মনে হয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার চাইতে বেশী হওয়া উচিত বিতর্ক কর্মশালা এবং প্রীতি বিতর্ক। বিতর্ক হচ্ছে বাকশিল্প। তার্কিক এর কথা এমন সুন্দর আর হৃদয়গ্রাহী হবে যে সেকথা শুনবে মানুষ গানের মতো মুগ্ধ বিস্ময়ে। এবার ভাবুন তো রুনা লায়লা আর সাবিনা ইয়াসমিন প্রতিবার মঞ্চে এসে শুধু গানের প্রতিযোগিতা করছেন। তখন কি আমরা আনন্দ বেশী পাবো? ঠেক তেমনি বিতর্কের চর্চা কমে গিয়ে প্রতিযোগিতা বেড়েে গেছে। ফলে অনেক মেডেল আর ক্রেষ্ট তৈরী হচ্ছে কিন্তু চোখে পড়ার মতো ভালো তার্কিক পাওয়া যাচ্ছে কম। কারন এরা সবাই ভালো ছাত্র। সবাই আরো নানা কাজে ব্যস্ত। ফলে কম্পিটিশনের আগে কয়েকদিন প্রস্তুতি নিয়ে এসে তারা জিতছে ঠিকই কিন্তু সেই চরম পারফেকশন বা সুক্ষ শেষ্ঠত্ত্ব অর্জন করছে না অনেকেই। বিতর্ক হবে চলমান ঘটনা নিয়ে। বিতর্ক হবে মানুষের প্রয়োজন নিয়ে। বিতর্ক হবে পলিসি নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে। এসব আলোচনায় আমরা সবাই উপকৃত হবো। বিতর্ক হবে অনেক জেনে। শুধু নিয়ম রক্ষা করে ২ টা পয়েন্ট তোলা আর ২ টার উত্তর দেয়া নয়, বিতর্ক হবে তথ্যসমৃদ্ধ, চিন্তার নিস্তরংগ সাগরে ঢেউ তুলে। তাই আমার আবেদন সবার কাছে, যদি প্রতিযোগিতা হয়, হোক, তবে তার চেয়ে বেশী হোক পুরষ্কারহীন প্রতিযোগিতা। প্রীতি বিতর্ক। ১ সপ্তাহ বিতর্ক হলে , ২ সপ্তাহ কর্মশালা আর প্রশিক্ষন হোক। আয়োজন হোক বন্ধুত্ত্বের। বিচারক আর বিচারের কাগজ নিয়ে নয়, বিতর্ক হোক আনন্দের।
০২.
এখন বিদেশে বিতর্ক এবং ইংরেজী বিতর্ক নিয়ে একটা অদ্বুত বিষয় চালু হয়েছে। দেশে কিছু তার্কিক গজিয়েছেন যারা শুধু ইংরেজীতে বিতর্ক পারেন, বাংলা বিতর্ক করতে বললে তারা লাজুক হেসে বলেন, “সরি! আই অ্যাম নট গুড অ্যাট বাংলা ডিবেট। ইন ফ্যাক্ট আই অ্যাম মোর ইনটু ওয়ার্লডস ফরম্যাট।” ভালো। বেশ ভালো। তবে আপনি ফ্্রান্সে গেলে এমন কাউকে পাবেন না যিনি ফ্রেঞ্চ ভাষার চাইতে ইংরেজীতে বেশী পটু। আমেরিকাতে পাবেন না যিনি ফ্রেঞ্চ বিতর্ক পারেন কিন্তু নিজের ভাষায় যুক্তি দিতে পারেন না। বিতর্ক হচ্ছে একটা কাঠামোর মধ্যে যুক্তির অবতারনা। যে পারে সে বাংলাতেও পারে, ইংরেজীতেও পারে। কারো কারো ইংরেজী ভাষাজ্ঞান দুর্বল হতে পারে, কিন্তু যখন কোন বাংলাদেশী বাঙ্গালী বলে যে, সে বাংলাটা কম পারে তখন লজ্জা পাই। তার লজ্জা না থাকলেও, আমার লজ্জা আছে। এটা আরো বেড়েছে দেশে কিছু ইংরেজী স্কুলে বাংলা না শেখানোর ফলে। তারা রবীন্দ্রনাথকে টেগোর বলেন, মধুসুদন দত্ত কে বলেন মাধুসুদান ডাট্টা। ডাটা কেবল, ডাটা শাক আর দত্ত কবি একই উচ্চারনে উচ্চারিত হন। নিজের ভাষায় যে কথা বলতে পারে না, যুক্তি দিতে পারে না, তার জ্ঞান আমাদের দেশের মানুষের কি কাজ লাগবে? আন্তর্জাতিকতার এই যুগে তিনি হয়তো অনেক ভালো চাকরি পাবেন মাল্টিন্যাশনালে, অথবা বিদেশে চলে যাবেন, গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হয়ে। তবে একটা কথা ঠিক, সেই শুদ্ধ বাংলা বলা নিয়ামত ইলাহী কিংবা নাভেদ বিন সালেহরা কিন্তু ইংরেজীটাও ভালো পারেন। আর তাই তাদের দেখি কুইনিপিঅ্যাক, ইয়েল এর ফ্যাকাল্টি মেম্বার হতে। সব তার্কিককে একটা গল্প বলি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা বৃটিশ প্লেন নোয়াখালীতে মাটিতে পড়ে গেছে। যে এলাকাতে এটা পড়েছে সেখানে এক লোক ছিল যে সারাক্ষন দাবী করতো যে সে ইংরেজীতে মাস্টার্স। লোকে বোঝে কিন্ত তার প্রতিপত্তির ভয়ে কিছু বলতে পারে না। সে জানতো শুধু ইয়েস, নো, ভেরী গুড। প্লেনের বৃটিশ পাইলট ইংরেজীতে কি বলে, কেউ বুঝে না। তাই সব লোক মিলে সেই মাস্টার্স কে নিয়ে গেল পাইলটের কাছে।
পাইলট বললো “আই অ্যাম উন্ডেড”
লোকটা বলে “ইয়েস ইয়েস”
পাইলট বললো “ উইল ইউ হেল্প মি?”
লোকটা বলে “নো নো”
পাইলট বললো “ আই উইল ডাই হিয়ার?”
লোকটা বলে “ভেরী গুড, ভেরী গুড”
পাইলট আহত হলে কি হবে, বৃটিশ বলে কথা। মারলো জোরে এক চড় আর সাথে হুংকার। “আই উইল কিল ইউ”
সবাই দুর থেকে দেখে মাস্টার্সকে জিজ্ঞাসা করে, “ভাইজান, আপনাকে মারলো কেন?”
লোকটা বলে - আমার ইংরেজী শুনে সে রাগ করে আমাকে বললো, “তুই এতো ভালো ইংরেজী জানস, তুই নোয়াখালীত ফড়ি আছস কিল্লাই, তুই ইংল্যান্ড চলি যা।”
এরপর আর বেশী বলতে চাইনা। বেশী বললে লোকে আমাকে ইংরেজী বিদ্বেষী ভেবে বসবে।
০৩.
বিতর্ক নিয়ে উৎসাহ বেড়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিতর্ক প্রচারিত হবার ফলে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে গত ১৬ বছরে সেই জাতীয় বিতর্ক পরিনত হয়েছে একটি জনপ্রিয়তাহীন দায়সারা অনুষ্ঠানে। স্বজনপ্রীতি এবং নার্সিসিস্টিক প্রবণতাতে আক্রান্ত এই প্রতিযোগিতাতে সভাপতি সাহেব বসে থাকেন কলম হাতে নিজের চেহারা প্রদর্শনে। অনুষ্ঠানের প্রতিযোগীদের মাঝখানে দাড়িয়ে তিনি সেই ছবি পত্রিকাতে পাঠিয়ে দেন, আত্মপ্রচারের মোহে। কিন্তু তার্কিকদের নাম আর কেউ জানে না। কারা সেখানে তর্ক করেন, গত বছরের চ্যাম্পিয়ন কে? আমাদের সময় একজন কবীরুল ইসলাম, ইশতিয়াক মান্নান, নিয়ামত ইলাহী, বিরুপাক্ষ পাল, রুমানা আর রুবানা, বায়েজিদ আর আল মামুন নাম বলে শেষ করা যাবে না। কমপক্ষে ২৪ জন ছিলেন যাদের সারা দেশ চিনত। এখন সারা দেশ চেনে শুধু সভাপতি মহোদয়কে, কারন তার্কিক বদল হয়, তিনি বদলান না। প্রতিদিন তিনি আছেন। তিনি একাধিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। বিতর্ককে কর্পোরেট পণ্যে পরিনত করেছেন তিনি। ন্যাশনাল, মাল্টিন্যাশনাল, ফ্রম এটিএন টু সিএনএন তিনি বিরাজমান। তিনি ডেমোক্রেসির জন্য বিতর্ক করেন, কিন্তু তিনি নিজ সংগঠনে অটোক্রাটিক। সংস্কার নিয়ে অনেক কথা এখন। আপনারা কি জানেন সেই ১৯৯৪ সালে আমরা বিডিএফ এর সংবিধানে লিখে দিয়েছিলাম দুই টার্মের বেশী কেউ বিডিএফ এর প্রেসিডেন্ট বা জি এস থাকতে পারবেন না। আমরা লিখে দিয়েছিলাম প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারীর কোন আত্মীয়কে তিনি কমিটিতে রাখতে পারবেন না। আমরা বলে দিয়েছিলাম যে ক্লাব থেকে প্রেসিডেন্ট বা জি এস হবে , সে ক্লাব এর আর কেউ কমিটিতে থাকবে না। ১৯৯৪ তে যা আমরা বলেছিলাম, দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা সেইসব নিয়ে বলছেন ১৩ বছর পর। আমার মনে হয় এখন আমাদের উচিত ১৯৯৪ তে করা বিডি এফ এর সেই সংশোধিত সংবিধানটি তাদের নামে পোস্ট করে দেয়া । তাহলে তারা দেখতেন , যে বিষয় তারা বুঝেছেন স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরে। আমরা সেঠা বুঝেছিলাম বিডিএফ এর জন্মের আড়াই বছরের মাথায়। যদি সত্যিই বিতর্ককে ভালোবাসেন তবে, বিতর্কের সকল অঙ্গনে সংস্কার করুন। এখন শুধু রাজনীতি না, সংস্কার দরকার বিতর্ক আন্দোলনেরও। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা নেতৃত্ত্ব নয়, বিতর্কে চাই শিল্পের প্রতি নিবেদিত মানুষ। যাদের আটকে রাখা যায় না। যারা এক বাগানে ফুল ফুটিয়ে চলে যান অন্য বাগানে। চাই নিয়ামত ইলাহীর মতো কঠিন সংগঠক আর বিরুপাক্ষ পালের মতো নিবেদিত মানুষ। যারা বিতর্ক বেচে বড় হন নি বরং যাদের নাম দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বিতর্ক অ্গংন।
০৪.
আমার লেখা নিয়ে তর্ক হবে। কেউ বলবেন সব ঠিক, কেউ বলবেন কিছুটা ঠিক, কেউ বলবেন সবই বেঠিক। এটাই তর্ক। আমি সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি আমার কথা বলবো। আপনি আপনার। তারপর তর্ক হবে। তারপর সময় বলবে, মানুষ বলবে, কোনটা ঠিক। আমরা চেয়েছিলাম,দেশ চলবে এই নিয়মে। সংসদে তর্ক হবে। সেই তর্ক দেখে মানুষ শিখবে, রাজ পথের গুন্ডারা নয়, দেশ চালায় শিক্ষিত মানুষেরা। সন্ত্রাস নয়, লুটপাট নয়, দেশ চলে আইনের শাসনে। আমরা ভাবি এক, হয় আরেক। আমেরিকার নির্বাচনের এক বছর বাকি। অথচ সেখানে চলছে বিতর্ক এখন থেকেই। প্রথমে পার্টি পর্যায়ে। তারপর জাতীয় পর্যায়ে। নেতা নির্বাচনের জন্য পৃধিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি বিতর্ককে বেছে নিয়েছে টুলস হিসেবে। তার মানে কি? পৃথিবীতে যারা মোড়লি করবে, তাদের মোড়ল একজন সেরা বিতার্কিক। সেক্সি কোন চিত্রতারকা নন, টাকাওয়ালা কোন ধনকুবের নন, কোন স্পোর্টসম্যান নন। তিনি হলিউডের ২য় সারীর অভিনেতা রোনাল্ড রিগান অথবা বাদাম চাষী জিমি কার্টার অথবা আইনজীবি বিল ক্লিন্টন যেই হন না কেন, বিতর্ক তাকে জানতেই হবে। কারন মানুষ চেনা যায় এই কাজটির ভেতর দিয়ে। আর আমাদের দেশে বিতর্ক সংগঠনের নেতা থেকে জাতীয় নেতা, বিতর্ক না জানলেও তারা নেতা হতে পারেন। যদি আমরা চাই একদিন এদেশেও নেতাদের যুক্তিশীল মানুষ হতে হবে, তবে প্রথমে আমাদের যা করতে হবে, বিতর্ক সংগঠনগুলিতে বিতার্কিকদের নির্বাচিত করতে হবে নেতা হিসেবে। আপনি আচরি ধর্ম শিখাও পরেরে। তাই আগে নিজেদের আচরন ঠিক করতে হবে। বলা হয় তার্কিকরা নাকি ভালো সংগঠক হয় না। নেতৃত্ত্ব বিতার্কিক এর পারফর্মেন্সের ক্ষতি করে। এসব ঠিক কথা নয়। যোগ্য লোক এর হাতে বিতর্ক ভালো হবে। বিতর্কের পর ডিনার আর কনসার্টটা হয়তো একটু দুর্বল হতেও পারে, কিন্তু বিতর্ক হবে মানোত্তীর্ণ। আমরা সেটাই চাই। আর যদি এখন একটা তালিকা করেন , তবে দেখবেন বিতার্কিকরাই কিন্তু দেশের সবখানে ভালো ভালো জায়গায় নেত্তৃত্ত্ব দিতে চলেছেন। উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ছেন। আনুপাতিক হার এ হিসাব কষলে দেখবেন, বিতর্ক না জানা সেই ছেলেমেয়েদের চাইতে তারাই এগিয়ে আছেন। আসুন বিতর্ক বড় করে তুলি, এ প্রজন্ম বড় হোক জ্ঞান এর চর্চায়। ক্রেস্টের আকৃতি,টেলিভিশনে অন এয়ারের মেয়াদ আর অর্থের ছড়াছড়িতে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৫১