ইউরোপীয়দের কাছে সভ্যতা হলো জ্ঞানের সমষ্টি। আর চীনাদের কাছে সভ্যতা হলো "সাংকেতিক চিহ্নের আলোকরশ্মি" (লাইট অফ সিম্বল)। চীনারা মনে করে, এসব সাংকেতিক চিহ্ন তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষ দান করে গেছেন। তাদের পূর্বপুরুষ ছিল মহান। তারা ইউরোপীয়দের "শ্বেত বানর" নামে অভিহিত করে। চীনাদের বিশ্বাস, আকাশ যেমন নক্ষত্রমালার জন্য, জমিন তেমন চীনা লোকদের জন্য। নক্ষত্রমালা যেমন অগণিত, চীনারাও অগণিত। নক্ষত্রমালা যেমন আকাশে সেরাদের সেরা, তারাও পৃথিবীর বুকে সেরাদের সেরা।
ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের চোখে বিশ্বদর্শন হলো এই যে, পৃথিবী একটি বৃহৎ দাবাবোর্ড। যেখানে কিছু সাদা গুটি ও কিছু কালো গুটি রয়েছে। সাদা গুটি কালো গুটিকে পরাজিত ও উৎখাত করবে এবং কালো গুটির রাজ্য দখল করে নেবে।
কিন্তু চীনারা দাবা খেলে না। তাদের চোখে বিশ্বদর্শন হলো কলব্রিজ তাস খেলার ন্যায়। তাস খেলতে সর্বনিম্ন চারজন খেলোয়ার প্রয়োজন। এর মধ্যে তিনজন হলো মূল খেলোয়ার, আর অবশিষ্টজন হলো নির্বোধ। নির্বোধের সব কার্ড উন্মুক্তই থাকে বলা যায়। কেননা, সে কখন কী চাল দেবে তা পূর্বেই অনুমান করা যায়। তাই সে সবসময় থাকে পয়েন্টলেস। সে শুধু খেলার প্রয়োজনে খেলে, আর কিছু নয়।
বাকি তিনজন খেলোয়ারের একজন হলো সহযোগী। সহযোগী অপর প্লেয়ারকে সাহায্য করে যায়, আর আশায় থাকে যদি কোন প্লেয়ারকে পয়েন্ট দ্বারা চেজ করা যায়!
বাকি দুই প্লেয়ার হচ্ছে বুদ্ধিমান ও আসল প্রতিপক্ষ। খেলাটা এগিয়ে যায় মূলত তাদের দ্বারাই। তারাই হলো খেলার প্রাণ।
যুক্তরাস্ট্র খেলা আহবান করে। রাশিয়া ও ইউরোপ হলো নির্বোধ। কারণ, তারা কখন কী চাল দেবে তা আমেরিকার মুখস্ত। তাহলে আমেরিকার শক্ত ও মূল প্রতিপক্ষ কে? চীন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বে সহযোগী খেলোয়ার ছিল। কিন্তু এখন তারা বিলুপ্ত। সুতরাং, এখন রাশিয়াকে নির্ধারণ করতে হবে, তারা কী নির্বোধ হয়ে খেলবে, নাকি সহযোগী হিসেবে।
কীভাবে খেলা হয়? খেলা হয় হাতে হাতে, কার্ড বদলের মাধ্যমে খেলা চলতে থাকে। রাশিয়া যদি চীনের সাথে সহযোগে খেলে, তবে সেটাই তাদের মঙ্গলজনক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তার উন্নয়নের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। তারা এখন ক্লান্ত, তারা শ্লথগতি হয়ে গেছে, এবার তাদের পতনের দিন। অন্যদিকে, চীন দ্রুততম উন্নয়নশীল রাস্ট্র। তাদের গ্রোথ রেট বেড়েই চলেছে।সুতরাং, এই খেলায় বিজয়ী হবে কে? চীন। আর তাই রাশিয়া যদি এখনো যুক্তরাস্ট্রের পোষা নির্বোধ হয়ে খেলে, তবে তারা হবে লুজার। কেননা, নিয়তি এখন চীনের দিকে।
সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণ মানে হলো ভবিষ্যতের উপর নিয়ন্ত্রণ--- এটাই হচ্ছে মূল পরিকল্পনা। চীনাদের জীবন পুরোটাই কৌশল বা পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আর তাদের সবচেয়ে বড় ও মহান কৌশল হলো "স্ট্রেটেজিম" বা মিলিটারি কৌশল। তাদের কাছে রয়েছে অশেষ কৌশলের সম্ভার। অসীম কৌশলের অধিকারী তারা। কেননা, তাদের পুরো জীবনব্যবস্থা কৌশলের ভিত্তিতে চলে। আর তাদের কাছে সেই বিজয়ই গৌরবময় ও শিল্পময় বিজয় যে বিজয় অস্ত্রহীন, অশান্তিহীন, শারিরিক ও দ্রব্যাদির ক্ষয়ক্ষতিহীন ভাবে অর্জিত হয়। অর্থাৎ কৌশলই যেখানে একমাত্র হাতিয়ার।
চীনের হায়ারোগ্লিফ হলো সাংকেতিক চিহ্ন যা অঙ্ক ও সংগীতের থেকে একটু কম মানের।
পশ্চিমাদের কাছে চীনাদের চিন্তা ভাবনা সবকিছুকেই কৌশল বলে মনে হয়। কেননা, যেখানে অন্য দেশসমূহ অক্ষর বা বর্ণ দ্বারা ভাব প্রকাশ করে, সেখানে চীনারা ব্যবহার করে সাংকেতিক চিহ্ন যেমন একটি আচ্ছাদিত গাছ!
চীনারা যে শত্রুর উপর বিজয় অর্জন করে, সে শত্রুকে আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হয়, মাথা নুইয়ে থাকতে হয়, হাঁটুগেড়ে বসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।
আনুগত্য ব্যতীত চীনাদের সাথে আপনি বন্ধুত্ব করতে পারবেন না। চীনাদের কাছে বন্ধুত্ব হলো একটি রক্তবন্ধন (ব্লাড ইউনিওন)। এই রক্তবন্ধনের একটাই নীতি আর সেটা হলো আন্তরিকতা। যদি কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের সময় আন্তরিকতা না থাকে, তবে রক্তবন্ধন স্থাপিত হবে না। আর যদি আন্তরিকতা থাকে, তবে চীনের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। সে তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে, সমস্ত ধরণের বিসর্জন দিয়ে হলেও আপনাকে জেল থেকে মুক্ত করবে যেটা পশ্চিমা বন্ধুরা কখনই করবে না।
চাইনিজ মুদ্রা ইয়ান ভিত্তিহীন নয়। এটি একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
ডলার হচ্ছে ভিত্তিহীন মুদ্রা। এমনকি রাশিয়ার রুবলও। রাশিয়া যদি যুক্তরাস্ট্রের নির্বোধ প্লেয়ার হওয়া থেকে বেরিয়ে আসে ও স্বর্ণকে ভিত্তি করে রুবলকে শক্তিশালী করে তবেই তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি। এখন রাশিয়াকে বসে না থেকে খেলতে হবে।
চীন ও যুক্তরাস্ট্র হচ্ছে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা মুখোমুখি লড়ে যাচ্ছে। তারা শত্রু নয়, কিন্তু প্রতিযোগী। পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যারিয়ারকে টপকে যেতে তাদের প্রবল প্রতিযোগিতা। চীন নম্রভাবে খেলছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এগ্রেসিভ খেলা খেলছে।
তাহলে রাশিয়া কে? রাশিয়া হলো প্রতিবেশী, নেতা নয়।
অর্থনৈতিক মুদ্রাব্যবস্থায় কাগুজে মুদ্রার কোন ভিত্তি নেই। এটি শূণ্য মানে শূণ্য, একেবারে শূণ্য। কিন্তু স্বর্ণকে মুদ্রার ভিত্তি বানানোর মানে হলো এমন একটি ভিত্তির উপর মুদ্রাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা কখনও শূণ্য হবে না। কারণ, সোনা গ্রামে মাপা যায়, আউন্সে মাপা যায়, ক্যারেটে মাপা যায়। অর্থাৎ এর মান কখনই শূণ্য হবার নয়।
চীন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ উত্তোলনকারী দেশ। তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতি বছর ২৮০ টন সোনা উত্তোলন করে। আর চীনারা উত্তোলন করে ২৯০ টন।
পাশাপাশি চীনারা রৌপ্যেও বিশ্বে সেরা। তাদের জমিতে অন্য যেকোন সম্পদের থেকে রৌপ্যের পরিমাণ অধিক।
কাগুজে অর্থনীতি এখন প্রায় ধবংসের দোরগোড়ায় এবং অর্থনীতি পুনরায় ফিরে যাচ্ছে গ্রাম, আউন্সে। আর চীন হচ্ছে সবচেয়ে বেশী সোনা ও সবচেয়ে বেশী রূপার দেশ। সুতরাং, তাদের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা খুব কম। আর ধ্বস নামলেও তারা সেটা সহজেই ঠিক করে নিতে সক্ষম।
চীনারা অক্ষর চেনেনা, তারা ব্যবহার করে সাংকেতিক চিহ্ন। তাদের চিন্তা ভাবনাও তাই গঠিত হয় সাংকেতিক চিহ্নের দ্বারা। সাংকেতিক চিহ্নের একক হচ্ছে সঙ্গীত, তার উপরের স্তর হচ্ছে গণিত আর তার উপরের স্তর হচ্ছে হায়ারোগ্লিফিক। সংকেতের বিপরীত হলো শয়তান। শয়তান বিভক্ত করে আর সংকেত যুক্ত করে।
ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা যেখানে অক্ষরের উপর নির্ভরশীল, সেখানে চীনারা সাংকেতিক চিহ্নের উপর নির্ভরশীল। তাদের চল্লিশ হাজারের চেয়েও বেশি হায়ারোগ্লিফ রয়েছে যা সংকেত, কোড ও বিভিন্ন ছবি দ্বারা নির্মিত। তারা একটি গাছ ও তার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে ফেলে।
পশ্চিমারা যুক্তি ও গবেষণার উপর নির্ভর করে আর চীনারা কৌশলের উপর। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাদের হার মেনে নিতে হবে চীনাদের কৌশলের কাছে। কারণ, এটা গড়েই উঠেছে ভিন্ন ভিত্তি থেকে।
চীনাদের কাছে মানব সচেতনতা তিন ভাঁজ। আকাশেরও তিন ভাঁজ। আকাশ গোল আর ভূমি ভাঁজ ও খাঁজযুক্ত। তাদের কাছে আকাশের প্রতীক গোল আর ভূমির প্রতীক বর্গক্ষেত্র।
ইউরোপ ও আমেরিকানরা পৃথিবীকে দাবাবোর্ড ভেবে খেলে আর চীনারা তাস ভেবে। আর এই দাবা ও তাসের লড়াইয়ে তাসই জয়ী হবে।
[লিখেছেনঃ আন্দ্রে দেভইয়াতভ, রুশ গোয়েন্দা।]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩