অবশেষে মহা ধুমধামের সাথে নুসরাত ও ফরহাদের বিবাহ সম্পন্ন হলো। বাসর রাতে নুসরাত ফরহাদকে বলল, তাহলে আমাদের বিয়ে হয়েই গেল?
ফরহাদ বলল, হুম।
নুসরাত বলল, আমার তো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি তোমাকে পেয়েছি। একটু চিমঠি কাটবে?
ফরহাদ বলল, চিমঠি?
নুসরাত বলল, হ্যাঁ, এই হাতের উপর কাটো।
ফরহাদ চিমঠি কাটল। নুসরাত চিৎকার করে বলল, উহ, একটু আস্তে কাটবে না?
ফরহাদ বলল, ব্যথা পেয়েছ?
নুসরাত বলল, নাহ। আজ কোন ব্যথাই ব্যথা নয়। কোন কষ্টই কষ্ট নয়। আজ থেকে শুধু সুখ আর সুখ। কী দেখছ ওভাবে?
ফরহাদ বলল, ভাবছি।
নুসরাত বলল, কী ভাবছ?
ফরহাদ বলল, এত বিশাল আকাশ ছেড়ে চাঁদ কেন এই অভাগার ঘরেই এলো!
নুসরাত বলল, বাব্বাহ! রোমান্টিক হয়ে গেছে আমার রাগী স্বামী!
ফরহাদ বলল, রোমান্স তো তুমিই আমাকে শিখিয়েছ। আমি তো ভালবাসার ক খ-ও জানতাম না।
নুসরাত বলল, একটাই অভিযোগ আমার জীবনের তরে, তোমাকে কেন পেলাম এতোদিন পরে! আরো আগে যদি তোমায় পেতাম কত ভালো হতো!
ফরহাদ বলল, কেন?
নুসরাত বলল, জীবনের কত বসন্ত তোমাকে ছাড়াই কেটে গেল!
ফরহাদ হেসে দিল। নুসরাতও হাসল।
*****
নুসরাত ও ফরহাদ সেন্ট মারটিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমুদ্র আর আকাশের সীমাহীন সৌন্দর্য তারা মুগ্ধ চোখে উপভোগ করছে। হটাৎ তারা দেখল বালি আর ইট দিয়ে কাঁদার মাঝে একজন বৃদ্ধ লোক কী যেন তৈরী করছে। লোকটির উসকোখুসকো চুল, ছেঁড়া জামা, অগোছালো দাঁড়ি। গায়ে প্রচুর ময়লা। পাগলের মতো দেখতে।
নুসরাত বলল, উনি কী করছেন?
ফরহাদ বলল, কী জানি! চলো তো দেখি গিয়ে।
নুসরাত ও ফরহাদ এগিয়ে এলো। নুসরাত আরো একটু এগিয়ে আসতেই লোকটি চিৎকার করে বলল, থাম।আর এগোবি না। আর এগোনো নিষেধ।
নুসরাত বলল, কেন? আরও এগোলে কী হবে? কী এটা?
লোকটি পাগলের মতো হাসল। তারপর বলল, এটা? এটা জান্নাত।
নুসরাত ব্যঙ্গাত্বক ভাবে বলল, জান্নাত! পৃথিবীতে?
লোকটি বলল, কেন? তুইও তো তোর জান্নাত পৃথিবীতেই বানিয়ে নিয়েছিস!
নুসরাত বলল, হ্যাঁ, বানিয়ে নিয়েছি। এই যে দেখছ, আমার স্বামী। এই আমার সবকিছু, এই আমার জান্নাত। আমি আর কোন জান্নাতের পরোয়া করি না।
লোকটি ফরহাদের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর হাসতে হাসতে নুসরাতকে বলল, এটা তোর জান্নাত! না না না। আরে, এটা তো দরজা। এটা তোর পথ আটকে রেখেছে যাতে তুই গন্তব্যে পৌছতে না পারিস। তুই কত নির্বোধ, তুই কত বোকা!
নুসরাত বলল, চুপ করো। তোমাদের মতো ফকিরদের জন্যই এই দেশের বদনাম হচ্ছে। যেখানে খুশি সেখানেই বসে যাও ভিক্ষা করতে।
লোকটি হাসতে হাসতে বলল, ফকির! আরে নির্বোধ মেয়ে, সবাই ফকির। সবাই ভিখারী। ধনী হলেন একমাত্র ঐ উপরে যিনি বসে আসেন, তিনি। তিনি সবাইকে ভিখারী করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে সবাই তার কাছে ভিক্ষা চায়। আর বোকা মাটির পুতুল, পৃথিবীতে এসে নিজেই নিজেকে আমির ভাবতে শুরু করেছে, ধনী ভাবতে শুরু করেছে। এই দ্যাখ মাটি, চিনতে পারিস একে?
লোকটি কাঁদা মাটি তুলে তার সারা গায়ে মাখলেন। নুসরাত বলল, ছিঃ কী নোংরা!
লোকটি হাসতে হাসতে বলল, নোংরা! মাটি তোর কাছে নোংরা লাগে! তাহলে তুই নোংরা, পৃথিবীর সব মানুষ নোংরা! এই মাটি থেকে সবার সৃষ্টি, মাটিতেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। আর দেখিস, একদিন তোর মত সবার গর্ব, সবার দাম্ভিকতা এই মাটিতে এসে মিশে যাবে।
নুসরাত বলল, তোমার ঘেন্না করে না? তোমার কোন রুচি নেই?
লোকটি বলল, না, আমার ঘেন্না করে না। কারণ আমার প্রিয়তম তোর মত দুনিয়ার কোন পুতুল নয়। আমার প্রিয়তম সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে উত্তম।
লোকটি কাঁদতে লাগল। তারপর বলল, আমি জানি, আমার প্রিয়তম আমায় দেখছেন, আমার কষ্ট, আমার আনন্দ, আমার প্রেম, আমার বিরহ সব তিনি দেখছেন। আমি তাঁকে চাই, আমি শুধু তাঁকে চাই।
নুসরাত বলল, তোমার মত অদৃশ্য কারও ভরসায় আমি থাকি না। আমি আমার প্রেমকে দেখতে পাই, আমার সুখকে দেখতে পাই, আমার বেহেশতকে দেখতে পাই। আমার স্বামীই আমার বেহেশত। তুমি থাকো তোমার অদৃশ্য প্রিয়তমকে নিয়ে।
নুসরাত ফরহাদের হাত ধরে চলে গেছ। লোকটি কাঁদতে কাঁদতে সারা গায়ে কাঁদা মাটি মাখতে লাগল আর চিৎকার করে বলতে লাগল, আমায় তোমার কাছে নিয়ে যাও প্রিয়, আমায় তোমার কাছে নিয়ে যাও।
*****
গাড়িতে চড়ে ঢাকা ফিরছে নুসরাত ও ফরহাদ।
ফরহাদঃ তুমি লোকটার সাথে ওভাবে ঝগড়া না করলেও পারতে।
নুসরাতঃ তুমি দেখলে না, কী বাজে ব্যবহার করছিল আমাদের সাথে! কী সব উলটাপালটা কথা বলছিল তোমার সম্পর্কে! আমার সহ্য হচ্ছিল না।
ফরহাদঃ আরে, পাগলের কথায় এত গুরুত্ব দিলে চলে নাকি?
নুসরাতঃ এসব পাগলকে পাগলাগারদে নিয়ে কারেন্ট শক দেয়া উচিৎ। তাহলে যদি শিক্ষা হয়!
ফরহাদ হেসে দিল।
নুসরাতঃ হেসোনা, আমার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
******
নুসরাত ও ফরহাদ তাদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠল।
নুসরাতঃ শোবার ঘরটা আমি আমার পছন্দের রঙ দিয়ে সাজাবো।
ফরহাদঃ কিন্তু আমি অলরেডি আমার পছন্দের রঙ লাগিয়ে ফেলেছি।
নুসরাতঃ তাই? তাহলে ফার্নিচারগুলো আমার নিজের মতো করে সাজাবো। এটায় কিন্তু তোমার ফরমায়েশ চলবে না।
ফরহাদ হেসে বলল, ঠিক আছে।
নুসরাতঃ আমাদের দুজনের সংসার। কী মজা! শুধু তুমি আর আমি।
ফরহাদঃ কাজের লোক একটা রাখতে হবে। নইলে রান্না বান্না করবে কে?
নুসরাতঃ তুমি সে টেনশন করো না। আমি আজই মাকে বলবো বিনুকে এ বাসায় পাঠিয়ে দিতে। সেই কাজকর্ম সব করবে।
ফরহাদঃ থ্যাঙ্কস গড! বাঁচা গেল। তুমি তো এক কাপ চা-ও বানাতে পারো না।
নুসরাতঃ এতোটা অকাজেরও আমি না। এখনই চা বানিয়ে আনছি। তুমি বসো।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:৪৪