আগেরদিন বিকেলে একসাথে বসে চা খাওয়া খুব কাছের বন্ধুটি যখন পরেরদিন না ফেরার দেশে চলে যায়,
সেই শোক সামলানোর জন্য ঠিক কি রকম মানসিক প্রস্তুতি দরকার?
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করি, 'হৃদয়' নামের এই অদৃশ্য বস্তুটি মানুষকে না দিলে কি খুব বেশিই বেমানান হতো? চলা যেতো না একদম?
আমি জানি সৃষ্টিকর্তা সকল প্রশ্ন, অসুন্দর, সকল অশোভন,অসুবিধে,সমস্যার উর্ধ্বে।
হৃদয় না থাকলে কি হতো? কোন শোক-কষ্ট-ব্যথা মানুষকে স্পর্শ করতো না।এটা একটা সুবিধে বটে।
তবে মানুষের অকৃত্রিম ইচ্ছে- 'মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে।'
সুন্দর,মনোহরা এই পৃথিবী ছেড়ে আসলে কেউই মরতে চায় না।চরম শোক,কষ্ট,ব্যথা-যন্ত্রনা সইতে না পেরে যে মানুষটি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়,
আত্মহত্যার একটু আগে সেও তার চারপাশের দুনিয়াকে একপলক দেখে নেয়।গোলাপের গায়ে কাঁটা আছে বলেই হয়তো গোলাপ এত সুন্দর!
আর পৃথিবীতে আনন্দ,সুখ, শোক,দু:খ-কষ্ট এবং তা অনুভবের জন্য একটি হৃদয় আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটাও এতো আকর্ষণীয়।
বন্ধু জাহিদের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে অনেকক্ষন পাথরের মতো হয়ে ছিলাম।
মনে হচ্ছিল পৃথিবীর গতিপথ পাল্টে গেছে, থেমে গেছে ঘূর্ণন।ভেঙ্গে গেছে মহাকর্ষীয় সব শক্তি।
সবকিছু স্থবির। যেকোন সময় প্রলয় আসন্ন।
এমন সময় আমার সাহস যোগাতে এগিয়ে এলো আমার স্ত্রী, ফাতিমা।
সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পাঠ করলো- 'কুল্লু নাফসিন যা'ঈকাতিল মঊত।'
আসলেই তো। পৃথিবীর কিছু মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ একজন আছেন,
কিছু মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তা বলে আদৌ কেউ নেই।আবার, কিছু মানুষ এ দু'য়ের দোলাচলে বাস করে।
বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী আর সংশয়বাদীরা 'সৃষ্টিকর্তা' নিয়ে যতোই বিরোধ করুক, তারা সকলে এই একটি বিষয়ে একমত যে, তাদের সবাইকেই একদিন মরতে হবে।মৃত্যু গ্রাস করবে প্রত্যেকটি জীবনকে।মৃত্যুর হাত থেকে কারোর রেহাই নেই।
জাহিদ আমার বাল্যকালের বন্ধু।একসাথে স্কুল,কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি।মাঝখানে আমি বাইরে চলে যাই।
দেশে এসে জানতে পারি সে বিয়ে করেছে। তাদের একটি দু' বছরের মেয়েও আছে। মাঈশা নাম।
জাহিদের ইনকাম আহামরি কিছু ছিলো না। গ্রাজ্যুয়েশান কমপ্লিট ছিল,কিন্তু চাকরির বাজারে আজকাল 'স্পীড মানি'র এতই কদর যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজ্যুয়েটরাও কোথাও ঠাঁই পান না।
জাহিদের ছোট্ট একটা ব্যবসা ছিলো। কিছু ষ্টুডেণ্ট পড়াতো আর বই লিখতো।এইটুকুই।
এইটুকু দিয়েই দিব্যি চলছিলো তিনজনের সংসার।
একদিন জাহিদকে প্রচুর বিমর্ষ অবস্থায় পেলাম।আমার সদাহাস্য বন্ধুটির এমন চেহারা আমাকেও বিমর্ষ করে তুললো।
আমি জানতে চাইলাম, - 'কি ব্যাপার? তোকে এতটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেনো?'
সে বলতে চাইলো না।উঠে যেতে চাইলো।আমার জোরজবরদস্তিতে শেষ পর্যন্ত বললো তার মেয়েটার ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে।আমাকে বলতে বলতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললো,- 'মাঈশাকে ঘিরেই আমাদের পৃথিবী।ওর কিছু হলে আমাদের দু'জনের কেউই বাঁচবোনা।'
আমার কাজ তাকে অভয় দেওয়া,শান্ত্বনা দেওয়া।সন্তানের কিছু হলে বাবা-মা'রা যে এতটা ভেঙ্গে পড়ে, জানতাম না।
খুব ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি।তাই, আমাকে নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তেমন অনুভব করার সুযোগ হয়নি। আর, আমার আর ফাতিমার বিয়ের দীর্ঘ সাত বছর অতিক্রম হলেও, আমাদের কোলে কোন সন্তান আসেনি।তাই জাহিদের কষ্টটি আমাকে অতোটা ধাক্কা না দিলেও, তার চোখের জল আমাকে অনেকটাই কাতর করে তুললো।
আমি তাকে বললাম,- 'দেখ, এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবেনা।রোগ যেমন আছে, তার চিকিৎসাও আছে।ইনশা আল্লাহ, মাঈশার কিছুই হবেনা।'
জাহিদের সাথে এই আলাপগুলো করেছিলাম কয়েক মাস আগে।
এরপর একদিন হঠাৎ দেখা। দু'জনেই অসম্ভব ব্যস্ত ছিলাম।জাহিদের মুখে সর্বদা লেগে থাকা সেই অকৃত্রিম হাসি আর নেই।আমাকে দেখে হাসার ভান করেও পারলোনা।আমি তো তাকে চিনি।কৃত্রিমতায় যে তাকে মানায় না।একদম না।
মাঈশার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি। দু' জনে দু কাপ চা খেলাম। হালকা আলাপ, এরপর যে যার পথে।
আজকে ঠিক এই সময়টায় এসে তার মৃত্যু সংবাদ শুনতে হবে ভাবিনি। এমনও হয়? এতটাই ঠুনকো মানুষের জীবন? যেন কচু পাতার উপর একটি শিশির বিন্দু।একটা দমকা হাওয়া, এরপর ঠুস করে নিচে পড়ে যাওয়া।আহহ জীবন!!
হার্ট ষ্ট্রোকে মৃত্যু। ভয়ানক মৃত্যু।
গতকালের শুধুই জাহিদ আজ হয়ে গেল একটি লাশ।নড়ানড়া বিহীন।
গতকালের জাহিদকে আজ সম্বোধন করতে হলে কতোকিছুই সাথে লাগাতে হবে।মৃত জাহিদ, মরহুম জাহিদ, Late Jahid...
হায় বাস্তবতা!! শোকের অনলে ঘি ঢেলে দেবার কতো চোখ ধাঁধানো বন্দোবস্তই না তোমার!
স্কুল জীবনে জাহিদের কাঁধে কতো চড়েছি।শারীরিক দৈর্ঘ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলো জাহিদ।তার কাঁধকে মই বানিয়ে কতোশতো বার স্কুলের গাছের ডাব,আম,পেয়ারা চুরি করেছি, তার ইয়ত্তা নেই।আজ সেই জাহিদ আমার কাঁধে, লাশ হয়ে।
এরচেয়ে নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক কোন দৃশ্য পৃথিবীতে আছে? আমি জানিনা।
জাহিদের মৃত্যুর সাথে সাথে মাঈশার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলো।
জাহিদ যাদের সাথে শেয়ারে ব্যবসা করতো, তারা পূর্ণাঙ্গ শেয়ারের লভ্যাংশ দিচ্ছেনা। জাহিদের মৃত্যুর পরেরদিন থেকেই নামে-বেনামে বেরিয়ে এসেছে অনেক পাওনাদার, যাদের অনেককে জাহিদের স্ত্রী কখনো দেখেই নি।
কোন এক সাহিত্যিক বলেছিলেন, - 'জীবিতকে নিয়ে ব্যবসা চলে, মৃতকে নিয়ে নয়।'
সেই সাহিত্যিক আজও বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। থাকলে তাকে এনে খুব দেখাতে ইচ্ছে হচ্ছে,- 'দেখুন, মৃত লাশকে নিয়েও এখানে কতো রমরমা ব্যবসা হয়।'
তিনমাসের মাথায় বাড়িওয়ালা জাহিদের স্ত্রী-কন্যাকে আর বাসা ভাড়া দিতে রাজি না।
ব্যবসার অংশীদারেরা ব্যবসার বিরাট 'ক্ষতি' দেখিয়ে জাহিদের নাম চুক্তিপত্র থেকে বাদ দিলো।
ঢাকা শহর।যেখানে খাবার পানিটাও মাগনা পাওয়া যায় না, সেখানে বুঝি এই অবস্থায় ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা হবে?
অবস্থা এমন, ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে পথে বসা ছাড়া ভাবির উপায়ন্তর নেই।আমাদের অবস্থাটাও আহামরি কিছু না।মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। কোনরকম নিজেদের ভরণপোষণ সামলে বাড়তি কারো দায়িত্ব কাঁধে নেবো, সে সাধ্যি কই?
তবুও টুকটাক যতটুকু পারছিলাম, বন্ধুর পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা অব্যাহত ছিলো।
বন্ধুর স্ত্রী-সন্তানকে এভাবে নিগৃহীত,অবহেলিত হতে দেখে আমার মনের ভেতর রক্তক্ষরণ হতো।
কিন্তু কিছুই করার ছিলোনা তখন।
একটা সমিতিতে আমার কিছু জমানো টাকা ছিলো।ঠিক করলাম, টাকাগুলো তুলে মাঈশার চিকিৎসা করাবো।
একরাতে আমি এই ব্যাপারে ফাতিমার সাথে আলাপ করলাম। তাকে বললাম ভাবিদের দূর্দশার কথা।যেহেতু আমাদের কোন সন্তান ছিলোনা,মাঈশার প্রতি আমাদের দু'জনেরই দূর্বলতা ছিলো।আমি মনে করেছিলাম, ফাতিমা আমার প্রস্তাবে উৎসাহের সাথেই রাজি হবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ফাতিমা বললো,- 'না, এটার দরকার নেই।'
আমি মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি কল্পনাও করিনি ফাতিমা আমার এই প্রস্তাবে আমার মুখের উপর 'না' বলে দেবে।
এই ফাতিমাকে আমি সাত বছর ধরে চিনি।
এই সেই ফাতিমা, যে জাহিদের মৃত্যু সংবাদে শোকার্ত,শোকে মূহ্যমান আমার পাশে সাহস আর শান্ত্বনার ফুয়ারা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।আর আজ সে?
ফাতিমার এমন আচরনে হৃদয়ের গভীরেই ধাক্কার মতো খেলাম।আমার এতদিনের বিশ্বাস,আস্থা,ভালোবাসা যেন মূহুর্তেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেতে চাইলো।এ আমার সঙ্গিনী, ফাতিমা? মিলাতে পারলাম না।
আমি উঠে যেতে চাইলাম।ফাতিমা আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলো।
বললো,- 'আপনি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন?'
আমি উত্তর দিলাম না।স্বার্থপরতার এই যুগে ফাতিমাকেও পাল্টে যেতে হলো? কেন?
সে আবার বললো,- 'আমার কথাটা একবার শুনুন।'
আমি বললাম,- 'বলো'।
-- ভাবিদের আমরা আজ নাহয় টাকা দিয়ে সাহায্য করলাম।কিন্তু আগামিকাল? আগামি পরশু কে করবে?
আমি মনোযোগি শ্রোতার মতো বললাম,-'ঠিক বুঝতে পারছিনা।'
ফাতিমা বললো,- 'ভাবিদের আমরা হয়তো আজ দয়া করবো, কিন্তু এই মূহুর্তে তাদের দরকার আশ্রয়।একটি ঠিকানা।মাথা গোঁজার একটি স্থায়ী আবাস।মাঈশার মাথার উপর একটি ছায়া।তাই নয় কি?
এত গুরুম্ভীর কথার সারমর্ম উদ্ধারে আমি সেবারও ব্যর্থ হলাম। তাকে বললাম,- 'পরিষ্কার করে বলো,দয়া করে।'
এবার ফাতিমা আমার হাত ধরে ফেললো।কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,- 'আমি চাই আপনি ভাবিকে বিয়ে করুন।'
আমি দীর্ঘক্ষন চেয়ে রইলাম ফাতিমার দিকে।সে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। টপটপ করে তার চোখের জল নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,- 'তুমি ঠিক আছো?'
ফাতিমা কিছু বলতে পারলো না। আমার হাত তখনও ধরে আছে।আমি বাম হাতে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম,- 'এটা হয়না, ফাতিমা।'
সে বললো,- 'কেনো হবেনা? আজ আল্লাহ না করুক, জাহিদ ভাইয়ের জায়গায় আপনি আর ভাবির জায়গায় আমি হলে?'
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।ফাতিমার যুক্তির বীপরিতে ছোঁড়ার মত যুক্তি আমার হাতে নেই।
তবু বললাম, - ' যতটুকু হোক, টাকা দিয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।'
সে বললো,- 'এটা দয়া।আমি চাই তারা দয়া নয়, অধিকার নিয়ে বাঁচুক।'
-- 'কিন্তু ভাবি?'
ফাতিমা বললো,- 'সে দায়িত্ব আমার।'
আমি মূহুর্তের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। সেই সত্বাকে ধন্যবাদ জানালাম যার হাতে আমার প্রাণ,ফাতিমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য।
আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো।
বিয়ের দিন রাতে ফাতিমা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলো।
জাগতিক নিয়ম- পুরুষ মানুষ নাকি কঠিন হৃদয়ের।তারা নাকি খুব সহজে কাঁদেনা।
সেদিন জগতের এই চিরাচরিত নিয়ম ভেঙ্গে ফাতিমাকে আলিঙ্গন করে আমিও অনেক কেঁদেছি......