আপনি অনেক বড় সেলেব্রিটি।বর্তমান বাঙলাদেশের শিল্পাঙ্গন,সাহিত্যাঙ্গন আর রাজনীতিতে আপনি বহুল উচ্চারিত,প্রচারিত,প্রভাবিত আর ব্যবহৃত একটি নাম।বর্তমান বাঙলাদেশের বিশাল একটি অংশে রয়েছে আপনার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।সেই বিশাল অংশের আমি নিজেও একটি 'ক্ষুদ্র' অংশ,এবং এজন্যে আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি।আমি আপনার একজন একনিষ্ট ভক্ত।আপনার শুভাকাঙ্খী। আপনার সত্যিকার অর্থে শুভাকাঙ্খী বলেই হয়তো আপনার কিছু কাজ,কিছু কথা,কিছু লেখাকে আমি মেনে নিতে পারিনা।আপনাকে ভালোবাসি বলেই হয়তো আপনার 'একচেটিয়া' আর 'পক্ষপাতমূলক' কথাবার্তা,লেখা-যোখা আমাকে হতাশ করে।আমি সত্যিই মর্মাহত হই।
আপনি নিজেকে 'নিরপেক্ষ' বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।আপনি 'নিরপেক্ষতা'র রঙ গায়ে মেখে বেড়ালেও আমরা জানি আপনি নির্দিষ্ট একটি দলের,নির্দিষ্ট একটি আদর্শের 'নিজস্ব সম্পত্তি' তে পরিণত হয়ে গেছেন।সেই নির্দিষ্ট বলয় থেকে বেরিয়ে আপনি আর কিছুই বলতে পারছেন না।বলার সেই সুযোগটিও আর আপনার কাছে অবশিষ্ট নেই।সেই বলয়ের সাথে আপনি নিজেকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছেন যে, এখন সেই বলয়ের বাইরে এসে কিছু বললে আপনাকে না আবার 'তুই রাজাকার' উপাধি পেতে হয়।অবশ্য, সুশীলতা আর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আপনি যে মাঝেমধ্যে দু'একটি সত্য উচ্চারন করেন না, তাও নয়।
স্যার, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে।
মুক্তিযুদ্ধের পরের স্মৃতিগুলো কি আপনি এত তাড়াতাড়ি আর এত সহজে ভুলে গেলেন?
মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাঙলাদেশে আপনাদের পুরো পরিবারকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল কারা?
শহীদ পরিবার হিসেবে রাজধানীর বাবর রোডের যে বাড়িটিতে আপনারা থাকতেন,
যে বাড়িটিতে জড়িয়ে ছিল আপনার শহীদ পিতার অজস্র স্মৃতিচিহ্ন,রাতের অন্ধকারে সেই বাড়ি কারা কেড়ে নিয়ে আপনাদের পথে নামিয়েছিল?
গায়ের কাপড় আর কিছু থালাবাসন নিয়ে দুই বোন আর তিন ভাই সহ আপনার বিধবা মায়ের সেই করুণ পরিণতির কথা কি আপনাকে নিভৃতে পীড়া দেয়না? আপনার অবচেতন মন কি একবারের জন্যও আপনার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বলেনা,- 'ইকবাল,তোমার বিধবা মায়ের সেদিনের সেই অপমানের জ্বালা কি করে তুমি ভুলে গেলে?'
কারা ছিল সেদিনের সেই অমানবিক কর্মটির নেপথ্যে? তখন তো দেশে পাকিস্তানিরা ছিলনা? জামায়াতের হাতে ক্ষমতা ছিলনা একটি শহীদ পরিবারকে রাতের অন্ধকারে স্ব-পরিবারে উচ্ছেদ করার। ছিলনা কোন বামপন্থী শক্তিশালী নেতা।
তাহলে কারা ছিল? সে সময় ক্ষমতায় কে ছিল? কার ইঙ্গিতে হয়েছিল এই কাজ?
স্পষ্ট উত্তর,- সে সময় ক্ষমতায় ছিল স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান।আর তার নির্দেশেই তার গঠিত তৎকালীন কুখ্যাত সন্ত্রাসীগোষ্ঠী 'রক্ষীবাহিনী'ই আপনাদের পরিবারকে রাতের অন্ধকারে বাসা থেকে বের করে দিয়ে পথে নামিয়েছিল।ভুলে গেলেন আহমদ ছফার কথা? যে ব্যক্তি একটি শহীদ পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম অমানবিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদে গণভবনের সামনে কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দিতে চেয়েছিল।ভুলে গেলেন সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের কথা? যে ব্যক্তি অনেক কাঠখড় ডিঙিয়ে আপনাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবর রোডের সেই বাসা?
আজ সেই দলের জন্যে আপনার কান্না,আপনার মন খারাপ,আপনার আবেগ,আপনার ভালোবাসা-ভালো লাগা দেখে ইতিহাসও হয়তো লজ্জা পেয়ে স্মীত হাসে।
সেই দলটির এত অত্যাচার,এত অনাচার,এত কু-কীর্তি দেখেও আপনি চুপ করে থাকেন।কিচ্ছু বলেন না।কিচ্ছু লেখেন না। হয়তো বলার বা লেখার প্রয়োজনও মনে করেন না।
আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করছে, মুক্তিযুদ্ধের পর বাবর রোডের সেই বাসা থেকে রাতের অন্ধকারে কেন আপনাদের স্ব-পরিবারে বের করে দেওয়া হলো তার সদুত্তর কি আপনি পেয়েছেন?
পেয়ে থাকলে কি সেই কারন? আর, না পেয়ে থাকলে তা জানার চেষ্টা কি করেছিলেন? করে থাকলে কবে,কোথায়,কীভাবে করেছেন?
না করে থাকলে কেন করেন নি?
'
স্যার, নতুন বছরে আপনি আপনার কিছু স্বপ্ন এবং তার বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেছেন।
আপনার সেই স্বপ্নগুলোর একটি হলো,- 'বি.এন.পি কে রাজাকার জামায়াত-শিবির মুক্ত হওয়া।নাহলে আপনি বি.এন.পি কে বিরোধীদল দূরের কথা,এদেশের একটি রাজনৈতিক দল মানতেও নারাজ।
নি:সন্দেহে অতি উত্তম প্রস্তাব।বি.এন.পির প্রতি আপনার এরকম মহব্বতমূলক নসীহত দেখে আবেগে আপ্লুত না হয়ে পারিনা।
কিন্ত স্যার, বি.এন.পি কে যদি রাজাকার জামায়াত-শিবিরের সঙ্গ ছেড়ে গঙ্গা স্নান করে সহী-শুদ্ধ হতে হয়, তাহলে আপনাকেও যে 'মাতৃ-বংশের' সাথে সমস্ত রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে সহী আওয়ামিলীগার তথা মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের লোক প্রমান করতে হবে।
কেন? সেটা শুনুন আপনার বড় ভাই শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে।
তিনি লিখেছেন,- “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছেন তাদের মধ্যে আমার নানাও একজন,
যিনি মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে মারা গেছেন।
আমার এই নানার মতো, মামার মতো ভদ্রলোক, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এত পরিপূর্ণ ভদ্রলোক এই জীবনে দেখিনি।আমার নানা একটি আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছেন।একটি পূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন।কারণ বড় হওয়ার সময় এই অঞ্চলের হিন্দুদের দ্বারা প্রচণ্ড নির্যাতিত হয়েছেন।
কোনো মিষ্টির দোকানে গেলে তাদের
প্লেটে করে মিষ্টি দেয়া হতো না।তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাদের হাতে দেয়া হতো।
এটা শুধু মুসলমানদের সঙ্গেই না,নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গেও করতো।
এটা ছিল হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেম। এসব দেখে
দেখে সে সময়ের মুসলমানরা বড় হয়েছেন এবং তাদের মনে হয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন। অনেক যুদ্ধের পর তারা তা পেয়েছেন (পাকিস্তান রাষ্ট্র)।
যখন তারা দেখলেন চোখের সামনে দিয়ে সেই রাষ্ট্র ভেঙে যাচ্ছে, তখন তারা মনে করেছেন আবার হিন্দু রাজত্ব শুরু হয়ে যাবে।তখন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা শুরু করেন।
কিন্তু পাকিস্তান আর্মির অন্যায়গুলো ক্রমেই চোখে পড়তে থাকে। তারা দেখলেন পাকিস্তানি আর্মিরা তো কেবল হিন্দু মারছে না, সমানে মুসলমানদেরও খুন করছে।আমার নানা দেখলেন,তার অতি আদরের বড় মেয়ের পুলিশ অফিসার স্বামীকে (আমার বাবা) বেঁধে নিয়ে আর্মিরা গুলি করে মেরে ফেলল।
তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি হচ্ছে এসব? কোনদিকে যাবেন? তিনি কি পাকিস্তান আর্মির সঙ্গেই থাকবেন , নাকি কমন যে স্রোত আছে তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?এই নিয়ে কনফিউশন তৈরি হলো তার মধ্যে। তিনি এই কনফিউশন দূর করতে পারলেন না। এক্ষেত্রে তার যেমন দোষ ছিল, আমাদেরও ছিল। কারণ আমরা তাদের বোঝাতে পারিনি। কনফিউশন দূর করাতে পারিনি।
তিনি মারা গেলেন মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে।
এখন আমরা তাকে ক্ষমা করব কি করব না
সেই প্রশ্ন।শেখ মুজিব সাহেব তাদের
ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি ক্ষমার পক্ষপাতি।'
- (ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন, পৃ- ৩১-৩২)।
'
আপনার বড় ভাইয়ের সাক্ষ্য অনুযায়ী আপনার নানা একজন রাজাকার।তাই রাজাকারের রক্ত শরীরে বহন করা আপনার মতো কোন বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতার গল্প শুনতে চাইনা।
হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলবেন আপনার নানা রাজাকার হলেও, আপনার পিতা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ওকে ফাইন।বি.এন.পির প্রতিষ্ঠাতাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক।রণাঙ্গনের বীর সেনানী।আর বি.এন.পি হলো এমন একটি দল,যে দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
তাই, বি.এন.পি কার সঙ্গ নেবে, কার সাথে জোট করবে,কার সাথে প্রেম-পিরীতি করবে সেটা বাতলিয়ে দেওয়ার বা সেটা নিয়ে কথা বলার আপনি কে?
You are exactly nobody & no class....
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৬