somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাতুড়ে গদ্য (বারেকের টিভি)

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাজারের ঠিক শেষ মাথায় বারেকের চা’র দোকানটা। মৃত্যুর দিন গুনতে থাকা বুড়ো বাবলা গাছটা দাঁড়িয়ে এতদিন ধরে কিছু মানব শিশুর বিভিন্ন উচ্চতার অত্যাচার সহ্য করে আসছিল। তার চিরল পাতার ছায়ার নাগালের ভিতরেই বারেক দোকানটা শেষ পর্যন্ত বসিয়েই ফেলল। মফস্বলের এই মৃতপ্রায় বাজারে দোকান বসানোর মত নির্বুদ্ধিতা নিয়ে বাজারের লোকেরাও বারেককে কম খোঁচায়নি, সে নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। সাধারন চা’র দোকানগুলো যেমন হয় বারেকের দোকান তা থেকে উন্নত কিছুই না। বরং খরচ কমানোর জন্য কেরসিন স্টোভের বদলে মাটির চুলা বসিয়েছে, যেটা ধরাতে তাকে প্রতি ভোরেই নাকাল হতে হয়। তবে একটা বিশেষত্ব আছে তার দোকানে। সেটা আর কিছুই না, একটা ১৪ ইঞ্চি সাদা-কালো টিভি। যার এন্টেনাটাকে একটু কায়দা করে, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ডিশের তারের সাথে প্যাঁচ খাইয়ে দেয়া হয়েছে।

অলস দুপুরের বাবলার চিরল ছায়ায় হেলান দিয়ে অনেকেই বসে থাকে। এককাপ চায়ের সাথে একটা টোস্ট বা একটা বন নিয়ে মুলতঃ টিভির অনুষ্ঠানই সবাই খেতে পছন্দ করে। হয়ত কখনো কোন নায়কের রিকশা চালাতে চালাতে শিল্পপতির মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাদের হাতে থাকা শুকনো বিস্কুটকে ক্রীমের নরম আবরণে ঢেকে রাখে। নয়ত কোন গানের দৃশ্য দেখে পাশে বসা জনের পিঠে থাবা দিয়ে “মাগীর দুধ দুইটা দেখছোস? শালার অক্করে গাছপাকা আমের লাহান” বলে উত্তেজনা প্রশমণের ব্যর্থ চেষ্টায় জোরে জোরে চায়ের কাপে চুমুক দেয় কেউ। এই চুমুকের সময়ই অনেকে খেয়াল করে তাদের কাপে আর তলানি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফের জমিয়ে বসে লুঙ্গির খুট থেকে কেউ কেউ বিড়ি বের করে, কেউ বের করে খুচরো টাকা।

মাঝ সকালে আসেন কিছু বয়স্ক মানুষ। তাদের কারো মুখে তৃপ্তির আলো ঝলমল করে, কারো মুখে ভরসা হারানো আঁধারের ছোঁয়া। তাঁরা বসেন, এক বা দুই কাপ চা খান। টিভিতে দেখায় মিছিল, নাটক, রাস্তায় জ্বলতে থাকা আগুন কিংবা দেখায় রাজধানীর কোনো বড় দালানে ঢুকতে বেরোতে থাকা মানুষ। বয়স্ক চা প্রেমীরা তাকিয়ে থাকেন চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে টিভিতে দেখাতে থাকা বিবিধ সাদাকালো আগুনের সাথে বাস্তবের রঙ্গিন আগুনকে মিলিয়ে দেখেন। কখনো কাশির দমকে বাঁকা হতে হতে বারেককে আরেকটা আদা চা’র অর্ডার দেন কেউ। কেউ বা বাবলার শরীরে, মধ্যমায় লেগে থাকা চুনের শেষাংশ মুছতে মুছতে রক্তের মত পানের পিক ছুড়ে দেন রাস্তার ধুলোর দিকে।

নানা বয়েসী শিশুরা প্রায় সারাটা দিনই আশেপাশে খেলা ধুলা করে। আর বড়দের উচ্চারিত নানান শিক্ষা জমা রাখতে থাকে মগজের বিভিন্ন কুঠুরীতে। মাঝে মাঝেই সেগুলোর সফল প্রয়োগ চলে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অধিকারীর উপরে। কখোনো সখোনো দোকানে আসার উপলক্ষ্য পেলে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকে সাদাকালো শিশু বা বয়স্ক লোকেদের দিকে। কচি মনে হয়তো সাদাকালো আর রঙ্গীন বাস্তবের পার্থক্য করতে পারে না। তাদের বিস্ময় হয়ত এতটুকুই যে, এত সুন্দর করে সেজে থাকা মানুষ গুলোর মুখ বা জামা-কাপড়ে আমাদের মত রঙের ছোঁয়া নেই কেন?.

সন্ধ্যায়, দোকানীরা তাদের পসরা বন্ধ করে ঘরে ফেরার আগে, পারস্পরিক বিকি-কিনির তুলনা মূলক আলোচনার জন্য আসে। আসলে প্রতক্ষ্য আলোচনার থেকে বেশি প্রাধান্য পায় চা’র সাথে সাথে টা’র বিল দেবার সময়কার পরোক্ষ লাভ-ক্ষতির বিবরণ। এখানেও স্পষ্টতঃ দু’টো শ্রেণী দেখা যায়। যাদের সামর্থ কম তারা বেশী সময় নষ্ট না করে কোনোমতে এককাপ চা খেয়ে চলে যায়। যাবার আগে অবশ্য টিভির সাদাকালো ছবির সাথে নিজেদের সাদাকালো জীবনের মিল দেখে একটু হাসির রঙ মনের ভিতর নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটা বেশ আয়েশ করে অনেক সময় নিয়ে চা খায়। সাথে টিভির সাদাকালো রঙ এর দিকে খানিকটা উপহাস নিয়েই তাকিয়ে থাকে।

রাত অনেকখানি গভীর হলে ঝলমলে গাঢ় রঙ এর জামা-কাপড় পরা কিছু মেয়ে দোকানের আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করে। তাদের কেউ কেউ এসে বসে দোকানে। তবে তারা শুধু চা’ই খায়। শুন্য দৃষ্টিতে তারা সাদাকালো টিভির মানুষ গুলোর সাথে সাথে নিজেদের কৃত্রিম রঙ্গীন সাজ আর তাদের ক্রেতাদের ভেতরের কালো চাহিদাটাকে মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।

বারেক নিজে কখনো আগ্রহ নিয়ে তার সাদাকালো টিভির দিকে তাকায় না। সে বরং তার খদ্দেরদের মনের ভিতরের নানা রঙের খেলা যেভাবে মুখের পর্দায় ফুটে ওঠে তা নিয়েই মগ্ন থাকতে ভালবাসে। দোকানের ঝাঁপ নামাতে নামাতে বারেক ডাক দেয় “আয় আয়... তু তু তু”। কোথা থেকে জানি একটা কুকুর ছুটে আসে, বাসি বনরুটি গুলো সামনে নিয়ে কৃতজ্ঞতার রঙ ছড়িয়ে দেয় রাতের অন্ধকারে। দোকানের ভিতরে শুয়ে বারেক অনুভব করতে থাকে সাদাকালো জীবনে রঙের খেলা গুলো।
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×