আমার কাছে ইদানিং মনে হয় বাংলাদেশে দুই শ্রেণীর লোক বসবাস করে। এক শ্রেণী অনেক অনেক ধনী আরেক শ্রেণী ভীষন গরীব। ধনীর দুলালদের জন্য এদেশে ইউরোপ আমেরিকার মত যেমন রয়েছে গাড়ী, বার , জিম, ফাইভস্টার হোটেল, ওয়েল ডেকোরেটেড হোম, সুন্দর পার্কের সুবিধা তেমন রয়েছে পড়াশোনার জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল,প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি।
গরীবের জন্য রয়ে গেছে প্রাইমারী স্কুল আর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলগুলোতে দেখা যায় প্রায় ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে আসে দামী গাড়ীতে চড়ে, পড়নে কেতাদুরস্ত পোষাক, চলনে সাহেবী ভাব।এদের বেশীরভাগই দেখা যায় বিজনেসম্যানের ছেলেমেয়ে বা এমপি/মন্ত্রীদের ছেলেমেয়ে বাদবাকি ডক্টর, ইন্জিনিয়ার বা অন্যান্য পেশাজীবীদের ছেলেমেয়ে, এককথায় সমাজের অনেক উঁচু স্তর থেকেই এরা আসে।
বাংলাদেশে যদিও মনে হয় মধ্যবিত্ত বলে কিছু আর নেই , তারপরও নিম্নবিত্তদের চেয়ে একটু ভাল পর্যায়ে যারা আছে তারাই ধরে নেই মধ্যবিত্ত। এদের অনেকের বাচ্চারা কিন্টারগার্ডেন বা কমদামী ইংলিশ মিডিয়াম কিছু স্কুল রয়েছে সেগুলোতে অধ্যয়ন করছে। তবে হাইস্কুল পর্যায়ে সরকারী স্কুলে চলে যাওয়া ছাড়া এদের কোন উপায় থাকেনা।
আপনাদের মনে হয়ত প্রশ্ন আসছে যে আমি আসলে কি নিয়ে লিখতে যাচ্ছি বা চাচ্ছি।
আমার এ লেখার মূল বিষয় হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা একটা শিশুর বা মানুষের জীবনে জীবনভর প্রভাব ফেলে থাকে
আমার ইচ্ছা নিজের মত করে কিছু কথা বলা। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং স্বনামধন্য প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া খুব কাছের কিছু মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং কয়েকমাস ঢাকার একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেয়ার করার। আমি জানি ব্লগে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন, অনেকেই হয়ত এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত, বা অনেকেই শিক্ষাবঞ্চিত আপনারা কেউই এটাকে অন্য কোনভাবে নেবেন না আশা করি। কাউকে হার্ট করার জন্য আমি এটা লিখছিনা।
যাইহোক, প্রথমেই আসে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কথা, এ নিয়ে কিছু কথা আমি এরই মধ্যে বলে ফেলেছি।
ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলগুলোতে দেখা যায় প্রায় ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে আসে দামী গাড়ীতে চড়ে, পড়নে কেতাদুরস্ত পোষাক, চলনে সাহেবী ভাব।এদের বেশীরভাগই দেখা যায় বিজনেসম্যানের ছেলেমেয়ে বা এমপি/মন্ত্রীদের ছেলেমেয়ে বাদবাকি ডক্টর, ইন্জিনিয়ার বা অন্যান্য পেশাজীবীদের ছেলেমেয়ে, এককথায় সমাজের অনেক উঁচু স্তর থেকেই এরা আসে।
এসব স্কুলের বেতন সাধারণত মাসে ৩৫০০ থেকে শুরু করে ৭০০০০হাজার টাকা পর্যন্ত আমি জানি। এমনকি এর চেয়ে বেশী টাকাও হয়ে থাকতে পারে। মাসিক বেতন ছাড়াও আছে ভর্তি ফি, বুক ফি, অমুক ফি তমুক ফি। ক্লাস পার্টির জন্য টাকা, ক্লাসমেট এবং টিচারদেরকে নানারকম গিফট না দিলে মান সম্মান ই থাকেনা।
যদি ভাবেন ভর্তি ফি ১০/২০ হাজার টাকা তাহলে ভূল করবেন। ঢাকার প্রথম সারির ২০/২৫ টা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রতিটা ক্লাসে ওঠার সময় যে পরিমান ফি দিতে হয়, তার পরিমান শুনলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়!
এখন কথা হচ্ছে এত টাকা খরচ করে যারা এসব স্কুলে পড়ছে তারা নিশ্চয়ই একেকটা ক্রিম তৈরী হচ্ছে বলেই সাধারনভাবে মনে আসার কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই?
আমি নিজের চোখে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যা দেখেছি তাতে কোনভাবেই মনে হয়না এরা ক্রিম। ক্রিম তো নয়ই বরং এরা মানুষ হিসেবেও যথাযথ গুনাগুন বহন করেনা অনেকে!
বাংলাদেশের একটা শ্রেণী(এলিট শ্রেণী) ডেসপারেট হওয়াটাকে স্মার্টনেস বলে বোধ করে ইদানিং বোধ হয়।এই ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়েছে বাচ্চাদের মাঝেও। যখন আমি শুনি ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়া ছেলে বাবার ফ্রিজ থেকে আনা ওয়াইন আনে স্কুলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার জন্য, যখন শুনি ছেলে দিনদিন ইয়াবা সেবন করে যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা খরচ করে, আর ছেলে কোথায় যাচ্ছে কি করছে বাবা মার খবরই নেই।
শুনলে কানে তালা লেগে যায় ক্লাস এইট নাইনের মেয়ে স্কুলে সেক্স করে প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে, আবার সেটার সমাধান ও করে ফেলছে তখন আমি কোনভাবেই মানতে পারিনা যে এরা আসলে সঠিকভাবে মানুষ হচ্ছে।
আমার এর আগে একটা লেখায় লিখেছিলাম ক্লাস টুয়ের একটা ছেলে কি করেছিল। ক্ল্পনা করা যায় যে ক্লাস টুয়ের একটা বাচ্চা সেক্স কি তা পর্যন্ত জানে?
একদিন স্কুলে গিয়ে শুনি ক্লাস টুয়ের কয়েকটা বাচ্চা ক্লাসের বাথরুমে খুব বাজে কথা লিখেছে। কি লিখেছে এমন ক্লাস টুয়ের বাচ্চা? আমি শুনে হতভম্ব লিখেছে আই ফাক উ। আই লাইক ফাকিং। আই ওয়ান্ট টু ফাক ..একজনের নাম। দুইটা ছেলে এমন লিখেছে। বাথরুম লক করা হয়।
এইগুলা গেলো একটা দিক, আরেকটা দিক এবং আসল দিক হচ্ছে পড়াশোনা। পড়াশোনার কি খবর?
কিছু ছেলেমেয়ে রিয়েলি ভেরী ব্রিলিয়ান্ট, আই মাস্ট সে।তারা ভালো করছে, করবে বা ভালো করে যাবে।
কিন্তু মেজরিটির কি অবস্হা?
মেজরিটি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার অবস্হা আসলে এত করুন যে মায়া হয় ভাবতে এতগুলো টাকা এভাবে তাদের বাবা মা তাদের পেছনে খরচ করছে অথচ এই দেশে অনেক অনেক গরীব ছাত্র আছে যারা পড়তে চায় কিন্তু পড়তে পারেনা টাকার অভাবে, পারেনা দুমুঠো ভাতের অভাবে।
আমি মাঝে মাঝে এত খারাপ পরিস্হিতিতে পড়েছি যে মনে মনে শপথ করে ফেলেছি যাইহোক না কেনো আমি আর চাইনা কখনোই যেনো আমাকে বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করার প্রয়োজন হোক।
আমার সাথে এখানে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক অমত করে বসতে পারেন।
আমি তারপরো মনে মনে হেসে বলবো সত্যিকারের পরিস্হিতি তো আমি জানি এটাও জানি কি যন্ত্রনা আপনারা ভোগ করে চাকরি করছেন।
বেশীরভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিয়ম হলো যাই হোক না কেনো,কোন বাচ্চাকেই আপনি জাস্ট এটা করোনা, বা বলোনা এ বাদে কিছু বলতে পারবেন না। ব্যাপারখানা এমন, সে যদি এমনও বলে বসে থাকে আই *** ইউ তারপরও না। আপনি কমপ্লেইন দিবেন অফিসে, একসময় অথরিটিই উলটা আপনাকে দোষ দিবে।
আপনি ক্লাসরুম কনট্রোল করতে জানেন না। দোষ আপনার!
শিক্ষক রা এখানে কি যন্ত্রনা সহ্য করে বোলে বোঝানো মুশকিল।
ক্লাসরুমে ঢুকবেন ছেলেরা হইহইরইরই আর মেয়েরা সমানে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। আপনি চিৎকার করতে করতে আর পড়ার কথা, নেক্সট এক্সাম অমুক দিন নোট দিতে দিতে কাহিল হয়ে বের হবেন। ১ টি সেকেন্ড শান্তি কি জিনিস পাওয়া অসম্ভব। অথরিটি আপনাকেই চার্জ করবে কতটুকু পড়া হলো, কতটুকু হলোনা, কেনো হলোনা, বাচ্চারা কেনো এক্সামে ভালো করলোনা!
আমি একবার ক্লাসে এক ছেলেকে চুয়ইগাম খেতে দেখে ফেলে দিতে বলেছিলাম। সে চুয়ইগাম চুষতে চুষতে বলে ম্যাম আপনি কি করবেন চুয়িংগাম টা নিয়ে? আপনি চুষবেন!
এরা মনে করে কিছু কথা ইংরেজীতে বলতে পারলেই আর কিছু লাগেনা। এটাইতো স্মার্টনেস!
খাতা দেখা নিয়ে আছে বিশাল ঝামেলা। প্রতিটা খাতা দেখতে প্রচুর সময় লাগে হোক সে ক্লাস টেস্টের বা ফাইনালের। বাচ্চারা বা বাচ্চাদের গার্জিয়ানরা ফাইনালের খাতা দেখতে আসে। যেখানে ভূল থাকবে সেখানে আপনাকে এমন কায়দা করে মার্ক করতে হবে যেনো শুধরানোর বা নতুন কিছু লেখার সুযোগ না থাকে, কারন কিছু গার্জিয়ান সুযোগ বুঝে বাচ্চার ভূল ঠিক করে ফেলে, এবং আপনি এতগুলো বাচ্চা বা গার্জিয়ানের মাঝে কে বসে থেকে এমন একটা কাজ করছে খেয়ালই করতে পারবেননা। এবং এই কিছু গার্জিয়ান এত নিচু মানসিকতার যে তারা এটাকে উল্টো কমপ্লেইন বানায়। আমার বাচ্চা ত ঠিক লিখেছে। আপনি কেনো কেটেছেন বা মার্ক কেটেছেন!
এই অংশ পড়েও অনেকে রাগারাগি করবেন আমি জানি । আমি খুব ভালো জানি।কিন্তু যা সত্য আমি তাই বলেছি, এবং ঢালাও ভাবে সবার কথা বলিনি।কিছু গার্জিয়ানের বিহেভ সত্যি এত খারাপ যে আমি আর ইচ্ছা রাখিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করার ।আমি টাকার কাঙাল নই। শিক্ষকতা সত্যি খুব ভালো লাগতো যদি একবার শিক্ষকদের মানুষ বলে অনেকেই ভাবতেন।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, স্বনামধন্য এসব স্কুলের ৯৯.৯৯ ভাগ ছাত্র কোনভাবেই বাংলাদেশে থাকতে চায়না, তাদের স্বপ্নযাত্রাটা বিদেশে। ইউরোপ, আমেরিকায়। তাঁদের চিন্তাভাবনায় ইউরোপ, আমেরিকা এমনভাবে মিশে আছে যেনো তারা এ মুহূর্তেও বাংলাদেশে নেই আছে সে স্বপ্নরাজ্যে!
হায়রে বাংলাদেশ! যে দেশের সবচেয়ে বেশী সম্পদ যারা ব্যবহার করছে তারাই এদেশে কখনো থাকতে চায় না।
যাইহোক আমি শুরু করেছিলাম অল্প কথায় বলবো ভেবে, কিন্তু এখন ভাবছি এটার একেকটা পয়েন্ট নিয়ে সিরিজ করবো।
এটা এ সিরিজের প্রথম পর্ব।